STORYMIRROR

Partha Pratim Guha Neogy

Inspirational

4  

Partha Pratim Guha Neogy

Inspirational

নাগরিকত্ব

নাগরিকত্ব

12 mins
369

মানুষের জন্ম স্বাধীন, বাঁচার অধিকার স্বাধীন ও মানুষ সারা জীবনই স্বাধীন। কিন্তু বর্তমানের দুনিয়ায় আমরা মানুষেরা নিজেদের মনের কুমনোবৃত্তির কারণে আমরা নিজেরাই আমাদের সেই অধিকার থেকে বঞ্চিত করতে চলেছি। আমরা স্বাধীন মানবজীবনকে বিভক্ত করতে চলেছি বিভিন্ন আইনের দ্বারা - যেমন NRC ও CAA। নিজের জন্মভূমিতে থাকার অধিকারও আজ প্রশ্নের মুখে। প্রান্তিক মানুষেরা তাই অস্তিত্ব রক্ষার ভয়ে ভীত, তারা জানেন না কিভাবে নিজের অধিকারকে প্রমান করবেন। সাধারণ জীবন আজ চতুর্দিকের চাপে দিশাহীন। এরকম যুগসন্ধি কালে সন্ধ্যাবেলা রুটির দোকানে উবু হয়ে বসে চটপট করে রুটি বেলছে লক্ষ্মী । তারই সাথে তাল মিলিয়ে ঝপাঝপ করে গনগনে আঁচে রুটি সেঁকেও নিচ্ছে। আগুনের তাপে নাকে মুখে ঘামের ফোঁটা জমে কালো মুখটা বেশ চকচক করছে এই হিমের রাতেও। দোকানের মুখটাতে বেশ ভিড় জমেছে। তাদের মধ‍্যে কেউ একজন চেঁচিয়ে বলে ওঠে, "কিগো লক্ষ্মীমাসি আমারটা হল, তখন থেকে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে মশার কামড় খাচ্ছি।" "এই যে দিচ্ছি বাবা একটু সবুর কর। তাড়াহুড়ো করলে কাল এসে বলবি মাসি তোমার রুটি কাঁচা ছিল। ভালো করে রুটি সেঁকেও দাওনি।" কথাটা বলেই আবার খুন্তি দিয়ে চাটুতে রুটি উল্টাতে থাকে লক্ষ্মী। 


দোকানের বাইরে একদল ছেলেবুড়ো খরিদ্দার ভিড় করে দাঁড়িয়ে কী সব এন.আর.সি , সি.এ.এ নিয়ে আলোচনা করছে। লক্ষ্মী এসব বোঝেও না বোঝবার চেষ্টাও করে না। 


রুটির দাম দিতে গিয়ে একটাকার ছোট কয়েন দিল ছেলেটা। সেটা নিয়ে লক্ষ্মী মুচকি হেসে বলল,”তুই দিচ্ছিস দে। আমি নিলাম কিন্তু তোদের ফেরত দিতে গেলেই, না বলিস না বাবা। আজকাল ভিখারিও ছোটকয়েন নিতে চায় না।“ কথাগুলো বলেই আবার রুটি বেলতে লাগল লক্ষ্মী। চাকিতে বেলুন দিয়ে আটার লেচি বেলে রুটিতো নয় যেন পূর্ণিমার চাঁদ তুলছে লক্ষ্মী। 


ঠিক এইভাবেই সন্ধে ছ'টা থেকে রাত এগারোটা পর্যন্ত রোজ রুটির দোকান চালায় লক্ষ্মী। সকালের দিকটা চা,বিস্কুট,পাউরুটি, ঘুগনি আর বিকাল থেকে শুধু রুটি। তবে চা করে বিকেলেও এক ফ্লাস্ক রেখে দেয়। একা হাতে আর কতদিক সামলাবে। 


৩৬৫দিনই তার জীবনের আহ্নিক গতি রুটির ঘূর্ণনের মতো ঘোরে।

                                              

মফস্বল শহরে এখন বাড়ির বৌরা সব বিবি হয়েছে। কেউ প্রয়োজনে কেউ অপ্রয়োজনে। যাদের টোনা-টুনির সংসার অর্থাৎ স্বামী-স্ত্রী দু'জনে চাকরি করে তাদের তো লক্ষ্মীর দোকানে মাস কাবারি রুটির হিসাব করাই থাকে। কিন্তু যে সব স্ত্রীরা সারাদিন বাড়িতে থাকে তারাও সন্ধের পর থেকে টিভি সিরিয়ালের সৌজন্যে রান্নাঘর মুখো হতে চায় না। অফিস ফেরত বাড়ির কর্তাটিকে মুঠোফোনে আদেশ করা হয় এই বলে, " কিগো বাড়ি আসার পথে লক্ষ্মীর দোকান থেকে দশটা রুটি নিয়ে এসো। আমার গা'টা কেমন ম‍্যাজম‍্যাজ করছে। আটা মাখতে পারবো না। ট্রেনে বসে বসে ফোন ঘাঁটতে ঘাঁটতে রুটি আনতে ভুলে যাও যদি তবে কিন্তু ভাত গিলতে হবে।" স্বামী বেচারা আর কী করে, যুগধর্ম মানতে বাধ‍্য তারা। কারণ রুটি না নিয়ে গেলে বাড়ি ঢুকে এককাপ চা তো দূর, চাঁদবদনীদের হাসিমুখগুলো কপূর্রী ঠাকুর হয়ে, উবে যায়। গিন্নীরা তখন সিরিয়ালের 'রাসমনি'র মতো এমন দাপট দেখায় যে সংসারে 'স্বামী কেন আসামী' সিনেমাও হিট হয়ে যায়।


আবার কোনো কোনো স্বামীর রাতে রুটি না হলে সকালে কোষ্ঠ সাফ হয় না। তাতে বায়ুর নিন্মগতি প্রাপ্ত হয়। যাতে ভদ্রসমাজ নাকে রুমাল চাপা দেয়।


এও এক পরিবর্তন। সময়ের সাথে সাথে আরো কত পরিবর্তনের সাক্ষী থাকে লক্ষ্মী। মনে মনে হাসে আর বলে, তা বাপু বেশ, তোমরা বিবিয়ানি করো তাই আমরা খেটেখুটে পেট চালাতে পারি।

                                         

রুটির দোকান বন্ধ করে কমলা বাড়ি ঢোকার আগে তেমাথার মোড়ে বুড়ো অশ্বত্থ গাছের নিচে ষষ্ঠীর থান বলে কপালে হাত ঠেকায় ভক্তিমনে। অশ্বত্থ গাছটার ডানদিকে বড় পুকুরটা মজে গিয়ে এঁদো ডোবায় পরিণত হয়েছে। তাই লক্ষ্মীর মনে ভারি দুঃখ হয়। সে ভাবে সময়ের সাথে সাথে ভরন্ত সংসারও এই ভাবেই মজাপুকুরে বদলে যায়। এইসব সাতপাঁচ ভাবতে ভাবতে বাড়িতে ঢুকেই বিছানায় শোয়া অসুস্থ স্বামীর সেবায় নিজেকে নিয়োজিত করে। 


আজকাল লক্ষ্মীর স্বামী একসময়ের তেজিয়াল অসিত দাস এখনও কথায় কথায় লক্ষ্মীকে ঝাঁঝিয়ে উঠে গালমন্দ করে। লক্ষ্মীর তাতে মান অভিমান তো দূর, কোনো বিরক্তিবোধও নেই। সেই ছোট থেকে জ্ঞান হওয়া ইস্তক শুনে এসেছে মায়ের মুখে। মেয়েদের স্বামী ছাড়া গতি নেই। পতি পরম গুরু। 


আজ অনেকদিন বাদ মায়ের কথা মনে পড়ল লক্ষ্মীর। উত্তরবঙ্গের রায়গঞ্জে সুভাষ কলোনিতে তার বাপের বাড়ি। মার মুখে শুনেছিল,তার বাপ-মা ওপার বাংলার মানুষ। রায়টের সময় প্রাণের ভয়ে চলে এসেছে এদেশে। যদিও তার জন্ম রায়গঞ্জেই হয়েছে। অগ্রহায়ণ মাসে নবান্নের সময় জন্মেছিল বলে,পাড়ার লোকে মাকে বলেছিল, "তোমাগো ঘরে লক্ষ্মী আইসে।" 


এখন পুরোনো কথাটা মনে পড়তেই লক্ষ্মী মনে মনে একটু হেসে নিল। তারপর ভাবলো হেমন্ত ঋতুতে জন্ম বলে তার জীবনটাও হেমন্তর মতো হারিয়ে গেছে।  


শরত ও শীতের চাপে পড়ে অস্তিত্বহীন হয়ে আছে হেমন্ত। 


দুইদিদির পরে আবার মেয়ে জন্মেছিল বলে ছোটথেকেই অনাদর, অবহেলায় বড় হয়েছে। তারউপর গায়ের রং ছিল কালো। তাই তার মা মাঝে মাঝেই বলত কপাল চাপড়ে," আমার প‍্যাটেই ক‍্যান যে হইলি পুড়াকপালী! তোর নগে আমার জীবনটাও ভাজাপুড়া হইয়া গেল গ‍্যা।" এসব চিন্তা ভাবনায় লক্ষ্মীর রাতের ঘুমটা ঠিক মতো হল না। 


পরের দিন বিকালে বাড়ি থেকে দোকান আসবার সময় লক্ষ্মী দেখে পাড়ার মেয়েরা খেলছে, "এলাটিং বেলাটিং সইলো, কিসের খবর হইল।" কমলা মনে মনে হাসে আর ভাবে সময় এগিয়ে গেছে কত। সবার হাতে এখন বড় বড় ফোন তবুও এক টুকরো পুরোনো স্মৃতির মতো তাদের এলাকায় রয়ে গেছে হারিয়ে যাওয়া ছোটবেলা। 

লক্ষ্মীর মনে পড়ে যায় এই খেলার কথা। আর তার সাথে খেলার মাহাত্ম্যের কথা। 


একটু বড় হতেই বেড়াল পার করবার মতো লক্ষ্মীর বিয়েটা হয়ে যায় অসিত দাসের সঙ্গে। অসিত দাস তখন লিলুয়ার কোনো এক লেদ কারখানায় কাজ করতো। হাট্টাকাট্টা যুবক পুরুষ। গায়ের রং কালো হলেও লক্ষ্মীর মুখে লালিত‍্য ছিল। বড় বড় চোখে ছিল মায়াকাজল। একমাথা কোমর ছাপানো চুল। অসিত দাসের মা এই দেখেই লক্ষ্মীকে ছেলের বৌ করে এনেছিল। রগচটা ডাকাবুকো অসিত দাস প্রথম জীবনে লক্ষ্মীকে ভালোবাসা, আদর, আবদার সবই দিয়েছিল লক্ষ্মী বাধ‍্য মেয়ে বলে। আর ছিল শাশুড়ির ভালোবাসা। 


নিয়তিদেবী লক্ষ্মীর ভাগ‍্যটা খুব যত্ন করে গড়েছে। 


বিয়ের বেশ কিছু বছর পরে একটি ছেলে বিমল ও মেয়ে পিয়াকে নিয়ে লক্ষ্মীর যখন ভরাট পাঁচজনের সংসার। ঠিক তখনই অসিত দাস বিছানায় পড়লেন। ম‍্যাসিভ হার্ট অ্যাটাক। ডানদিকের হাত-পা পক্ষাঘাতে অচল । লক্ষ্মী তখন আতান্তরে। কী করবে ভেবেই কুল কিনারা করতে পারে না। শাশুড়ি তখন সাহস দিয়ে বললেন, " শক্ত হ মা। তোকেই হাল ধরতে হবে। মেয়েরা সারা জীবন ত‍্যাগ স্বীকার করে। তোকে ভগবান পরীক্ষায় ফেলেছে। তোর উপর আমার অগাধ বিশ্বাস। তুই সেই পরীক্ষায় উত্তীর্ন হবি।" 


অসুস্থ স্বামী ও দুই বাচ্চাকে শাশুড়ির জিম্মায় ফেলে রেখে আয়ার কাজ নিয়েছিল লক্ষ্মী। কিন্তু বিধিবাম। দিনের বেলায় কাজ তবুও মেনে নিয়েছিল অসিত দাস । কিন্তু নাইট ডিউটি শুরু হতেই বিছানায় শুয়ে শুয়ে তরপানি শুরু হল, "কার সাথে সারারাত ফস্টিনষ্টি করে এলি নষ্ট মেয়ে মানুষ।" প্রথম প্রথম লক্ষ্মী কেঁদে ভাসাতো। শাশুড়ি এসে আড়াল করতো লক্ষ্মীকে। কিন্তু দিনের পর দিন ছেলেমেয়ের সামনে এই অপমান মেনে নিতে পারলো না। আবার প্রতিবাদ করতেও পারলো না। 


তাই আয়ার কাজে ইতি দিয়ে এই পালপাড়া অঞ্চলেই দুবাড়ি রান্নার কাজ নিল। তাতেও যখন সংসারের অভাব মেটাতে পারে নি তখন সাহস করে এই রুটির দোকান দেওয়া লক্ষ্মীর। 

                                                

আজ বৃহস্পতিবার। আজকের দিনটাই লক্ষ্মী একটু বেলা করে দোকান খোলে। বৃহস্পতিবার সকালটা লক্ষ্মীর জীবনে একটু আনন্দ ডেকে আনে। ভোরবেলা ঘুম থেকে উঠেই অসুস্থ স্বামীকে 

পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন করে নিজে স্নান করল লক্ষ্মী। তারপর একটা ফিকে রংয়ের ছাপা শাড়ি পরে, চুল আঁচড়ে বিনুনি বাঁধলো। কপালে ছোট করে সিন্দুরের টিপ পড়ল। মাথার সিঁথিতে সিন্দুরের রেখা টেনে হাতের নোয়ায় সিন্দুর ঠেকালো। 

ঘরের মধ‍্যে পরিপাটি করে গোছানো সিংহাসনে মা লক্ষ্মীর পটে ঘট পেতে বৃহস্পতিবারের লক্ষ্মীপুজো করল। না পাঁচালি পড়ার মতো বিদ‍্যে বা সময় লক্ষ্মীর নেই। কিন্তু ভক্তিশ্রদ্ধা আছে। এককাপ চা স্বামীকে খাইয়ে দিয়ে নিজেও চা খেয়ে লক্ষ্মী লোনের কাজে গেল।


'বন্ধন' ক্ষুদ্রঋণ গোষ্ঠীর লোন। গ্রুপের নাম 'উৎসাহ'। তাদের পাড়াতেই রীনাদের বাড়িতে প্রত‍্যেক সপ্তাহে লোন মিটিং বসে। হপ্তা প্রতি লোনের কিস্তি শোধ করতে হয়। আগে গ্রুপটা ছোট ছিল। এখন আড়ে-বহরে বেড়েছে। আসলে 'বন্ধন' যবে থেকে নিজেও ব‍্যাঙ্ক হয়ে গেছে তবে থেকে এই গোষ্ঠীও আকারে আয়তনে বেড়েছে। তাতে লক্ষ্মীর ভালোই লাগে। তাকে সবাই মাসি মাসি বলে ডাকে। লোনের স‍্যার আসার আগে সকলের মুখে তাদের সংসারের সুখদুখের গল্প শুনে নিজের কষ্টটা জলো লাগে লক্ষ্মীর কাছে। মাঝে মাঝে লঘু হাসিঠাট্টাও হয়। তবে আজ রীনা গ্রুপের সব মহিলাদের বুঝিয়ে বলছে সেই আগে শোনা,এন. আর, সির কথা।

চুপচাপ স্বভাবের লক্ষ্মী রীনাকে জিজ্ঞেস করল,

" হ‍্যাঁরে মা রীনা এটা কী রে? এই এন. আর.সি।"

রীনা কলকাতার কলেজে পড়া মেয়ে ভালো শ্রোতা পেয়ে অনেক কথা বোঝালো লক্ষ্মীকে। যার মোদ্দা কথাটুকু ধরলে এটাই দাঁড়ায়, ভোটারকার্ড আধারকার্ড থাকলেই তুমি এ দেশের নাগরিকত্বের দাবীদার নও। এমনকি এখানে জন্মালেও এ দেশের নাগরিক হবে না। তোমার বাবা মাকেও এদেশে জন্মাতে হবে। কথাটা শুনে কেউ একজন বলল," ওসব গুজব। আসলে প্রতিবেশী দেশের সংখ্যালঘুদের নাগরিকত্ব দেবার নিয়ম এন.আর.সি।"

রীনার সাথে তার জোর তর্ক বেঁধে গেল।

  

কোনটা ঠিক কোনটা ভুল তা লক্ষ্মী জানেনা। কিন্তু মনটা কু ডাকল তার। কথাটা শোনার পর থেকেই নিরীহ লক্ষ্মীর মনে একরাশ চিন্তা ঢুকে গেল। তবুও নিজেকে কাজের মধ‍্যে সংসারের দায়িত্বে ডুবিয়ে দিল।


লোনের কিস্তির টাকা দিয়ে বাড়ি ফিরতে ফিরতে মনে মনে রীনার মায়ের প্রতি কৃতজ্ঞতায় লক্ষ্মীর চোখদুটো জলে ভরে উঠল। যদি ঠিক সময় মতো রীনার মা 'বন্ধন' এর লোনের কথা না বলতো, তবে লক্ষ্মীর রুটির দোকান আর হতো না। প্রত‍্যেক বছরে লোন নিয়ে নিয়ে লক্ষ্মী দোকানের ব‍্যবসা বাড়িয়েছে। পৌরসভার সরকারি বাড়ি প্রকল্পের ডিপোজিট মানি জমা দিয়ে বাড়ি বানিয়েছে। বিমল বড় হতে তাকে টোটো কিনে দিয়েছে। পিয়ার বিয়ে দিয়েছে। এমনকি শাশুড়ি মারা যাবার পর তার শ্রাদ্ধশান্তির কাজটাও একটু ঘটা করে লোনের টাকাতেই করেছে। শাশুড়ির উপর একটু টান বেশি লক্ষ্মীর। জগতে ওই একটা মানুষই তাকে বুঝতো। 


বন্ধনের লোন ও রুটির দোকান লক্ষ্মীর জীবনে অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ হয়ে আছে।

                            প্রত‍্যেক শনিবার পালপাড়া অঞ্চলে ভিখারিরা ভিক্ষা করতে আসে। ওদের এলাকা অনুযায়ী দিন ঠিক করা থাকে। লক্ষ্মী আজকের দিনে একজনের অপেক্ষায় থাকে। না সে ঠিক ভিখারি নয়। সে বাউল। গুরু দাস বাউল। গায়ে গেরুয়া শাড়ি। সঙ্গে গেরুয়া সুতির চাদর চাপা থাকে। নাক থেকে কপাল পর্যন্ত রসকলি। বগলে খোমর চেপে আঙুলে করে তার টান দিয়ে গলা ছেড়ে গান ধরে বুগবুগির আওয়াজের সাথে,


" তুমি ভেবেছো কী মনে, এই ত্রিভুবনে

  তুমি যাহা করে গেলে কেউ জানেনা


  বারে বারে আর আসা হবে না।


  এমনও মানব জনম আর পাবে না

   বারে বারে আর আসা হবে না।"


গানটা শেষ করেই লক্ষ্মীকে একগাল হেসে বলে ওঠে," পেন্নাম গো দিদি পেন্নাম। নিতাইয়ের কিরিপায় সব ভালো তো। তা দেখো কেনে, বাসি রুটি যদি এক আধখান থাকে তোমার দোকানে... তো গরম চায়ের সাথ একটুন দাও কেনে। ভারী জার পড়েছে ইবারে। খিদেটো লেগেছে দিদি।তোমার দোকান থেকি বেরিয়ে নদীর ধারে একটুন বসে জিরোবো গায়ে রোদ মেখে। বাকি সাথিরাও ওদিক পানে এসে জড়ো হবে।"


লক্ষ্মী গুরু বাউলকে যত্ন করে দোকানের বেঞ্চে বসিয়ে চা রুটি খাওয়ালো। শেষে যাবার আগে পাঁচটা টাকা গুরু বাউলকে হাতে দিল। গুরু বাউল যতক্ষণ ছিল ততক্ষণ লক্ষ্মীর মুখে এক তৃপ্তির হাসি ঝুলে ছিল। কত নতুন নতুন জায়গার খবর দেয় গুরু বাউল। কত নতুন মানুষ। কত রকম তাদের স্বভাব। এগুলো শুনে লক্ষ্মীর মন আকাশ কুসুম ভাবে। যদি সে পাখি হত তবে উড়ে যেত সেইসব জায়গায়। তার জীবনটা কুয়োর ব‍্যাঙ হয়েই কেটে গেল। তবুও মুখ ফুটে কারো বিরুদ্ধে কখন অভিযোগ নেই লক্ষ্মীর।


বড়রাস্তার ধারে রোজের হিসাবে ভাড়ার গুমটি দোকান লক্ষ্মীর। আজ আবার সরকারি দপ্ত‍র থেকে রোড মাপজোক হচ্ছে। রাস্তা না কি চওড়া হবে। গুমটি সব ভাঙা হতে পারে।


এইসব দেখে লক্ষ্মীর মন খারাপ আরো বেড়ে যায়। গুরুর গান শুনে যে আনন্দটুকু হয়েছিল সেটাও মিলিয়ে যায় একনিমেষে।

                           বিমল টোটো চালাতে চালাতে এই পালপাড়ারই এক উঠতি প্রোমোটারের মেয়েকে প্রেমে করে বিয়ে করেছে। আসলে বিমল হল মাকালফল। দেখতে সুন্দর। কিন্তু ব‍্যক্তিত্ব থেকে বিদ‍্যাবুদ্ধি কোনটাই তার নেই। তাই বাপের এক মেয়ে রূপা , বাপের আদরের দুলালী বিমলকে ঘরজামাই করে রেখেছে।

মাঝে মাঝে লক্ষ্মীর রুটির দোকানে এসে উদাত্ত কন্ঠে রবীন্দ্র সংঙ্গীত গাওয়ার মতো করে "মা..." বলে ডাকে। আর টাকা চায়। আর কমলাও মমতামাখা চোখে বিমলকে দেখে গলে জল হয়ে কিছু টাকা হাতে দেয়। 


হঠাৎ করে এতদিন রোগভোগের পর অসিত দাস মারা গেল এক ম‍্যাড়মেড়ে বুধবারে ঘুঘু ডাকা দুপুরে। লক্ষ্মী তখন সদ‍্য দোকান থেকে এসেছে। আগামীকাল বৃহস্পতিবার লোনের কিস্তির টাকা গুছিয়ে রাখছিল ঠিক সেই মুহূর্তে, অসিত দাস হেঁচকি তুলে তার জীবনাবসান ঘটালো। 


পিয়া শ্বশুরবাড়ি থেকে জামাইকে সঙ্গে করে এল। 

বিমল এল রূপাকে নিয়ে। পিয়াই একটু বাবার জন‍্য হাউমাউ করে কাঁদলো। লক্ষ্মী সব দেখছে। কিন্তু চোখে জল তার আসছে না। তবে কি শোকে পাথর হয়ে গেল লক্ষ্মী?


রূপার বাবাই সব দায়িত্ব নিজের কাঁধে তুলে নিল। অন্ত‍্যেষ্টি কাজ দ্রুত শেষ হল। 


অসিত দাসের মৃত‍্যু সংবাদ ও শ্রাদ্ধের নেমন্তন্ন

দেবার জন‍্য পিয়া আত্মীয় স্বজনকে ফোন করল।

পিয়ার দুই মাসি। একজন রায়গঞ্জে থাকে। আর এক মাসি আসামের ধুবড়িতে থাকে। সবার শেষে আসামের মাসিকে ফোন করে পিয়া ফোনটা লক্ষ্মীকে ধরিয়ে দিল মায়ের মনটা হালকা করতে। কিন্তু মানুষ ভাবে এক হয় আর এক। 


আসামের মাসি ফোনে কমলার গলা পেয়েই আর্তনাদের মতো করে বলল, "ভৌনটি আমি কীবা নমরি বাঁচি আছো। তোর ভিনদৈয়ক ডিটেনশন ক‍্যাম্পত আটক করি থৈছে। কেনেকৈ জীয়াই থি থাকিম কোয়া? এন.আর.সিয়ে সকলো শেষ করি দিলে, শেষ হৈ গল আমার সংসার।" লক্ষ্মী আবার এন.আর.সির নামটা শুনে স্তম্ভিত হয়ে গেল। মেয়েকে ফোনটা দিতেই লাইন হট করে কেটে গেল।


তেরো দিনে ঘাটকাজ, তারপরের দিনে শ্রাদ্ধ ও শেষে আঁশপান্না বা মৎসমুখী হয়ে বাড়ি যখন ফাঁকা, তখন লক্ষ্মীর মনটা হু,হু করতে লাগল।


অনেকদিন বন্ধ থাকার পর দোকান খুলেছে লক্ষ্মী মনমরা হয়ে দোকানদারি সামলে রাতে বাড়ি ফিরে লক্ষ্মীর ভালো লাগে না ঘরে। অসিত দাসের গালমন্দ শোনা শেষের দিকে অভ‍্যেসে পরিণত হয়েছিল। ভালোমন্দ যেমনটি হোক। বিছানায় অসুস্থ হয়ে পরে থাকতো। তবুও কেউ তো লক্ষ্মীর জন‍্য অপেক্ষা করতো। বাড়ি ফেরার একটা তাগিদ তো ছিল লক্ষ্মীর জীবনে। আজকাল বড়ই একাকিত্ব নিঃসঙ্গতায় ভোগে লক্ষ্মী। শাশুড়িমার কথা মনে পড়ে খুব। সব থেকেও আজ লক্ষ্মীর জীবনে কিছুই নেই।

                             

আজ আবার বৃহস্পতিবার। লক্ষ্মী যথারীতি লোন মিটিঙে গেছে রীনাদের বাড়ি। বদলানোর মধ‍্যে বেশভূষা বদলেছে। অন‍্যদিনের মতোই সবাই লক্ষ্মীকে "মাসি মাসি" বলে এটা ওটা শোনাচ্ছে।

আজকে লোনে নতুন স‍্যর এসেছেন। কিস্তি জমা দেবার পর নতুন স‍্যর বললেন," লক্ষ্মী দাস কার নাম?"

লক্ষ্মী নিস্পৃহ ভঙ্গিতে বলল,"আমি স‍্যর।"

স‍্যর গাম্ভীর্য বজায় রেখে বললেন, " আপনার বয়স ষাট হয়ে গেছে। অতএব আপনার নামে আর লোন স‍্যাংশন হবে না। আর দুটো কিস্তি শোধ হয়ে গেলে আপনাকে আর গ্রুপে আসতে হবে না।"


লক্ষ্মী হতভম্ব হয়ে গেল। বিনা মেঘে বজ্রপাতের মতো অবস্থা লক্ষ্মীর। যদিও ইদানিং লোনের টাকার প্রয়োজন ফুরিয়েছে তবুও দীর্ঘদিনের অভ‍্যেস। এই 'উৎসাহ' গ্রুপের সাহচর্য। লক্ষ্মী এবার কী নিয়ে থাকবে এই ভাবতে ভাবতে কোনোরকমে বাড়ি পৌঁছালো। 


অসিত দাস যে বিছানায় শুয়ে থাকতো সেই বিছানায় শুয়ে গলা ছেড়ে কাঁদলো অনেকক্ষণ। 

কাঁদতে কাঁদতে কখন যেন ঘুমিয়ে পড়েছে। 

সেই ঘুমের মধ‍্যে স্বপ্নে শাশুড়ি এসে গায়ে মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে বলল, " অনেক করেছিস মা এই সংসারের জন‍্য এবার মুক্তি নে।" 

ঘুম ভেঙে গেছে লক্ষ্মীর। দু'গালে জলের দাগ। এই কদিনেই আঁটোসাঁটো চেহারা ভেঙে আলুথালু হয়ে গেছে।  


লক্ষ্মী নিত‍্যদিনের অভ‍্যেস বশে দোকানে যায় । আজ পর্যন্ত দোকান বন্ধ যায়নি কোনদিন। খালি গুরুদশার কটা দিন বাদ দিয়ে।


লক্ষ্মী ভাবতে বসে, তার আর কিছু নেই। তার লোন নেই। দোকান ভাঙা পড়ে রাস্তা চওড়া হবে। তাই দোকানও নেই। ছেলে মেয়ে থেকেও নেই। স্বামী নেই। বন্ধু নেই। রিফিউজি বাবামায়ের মেয়ে বলে তার নাগরিকত্ব থাকবে কি না সে বিষয়ে সন্দেহ আছে!


তার অস্তিত্ব বিলুপ্ত হতে চলেছে। আর ভাবতে পারে না লক্ষ্মী। একবার হাহা করে হাসে এক হাউ হাউ করে কাঁদে। কাঁদতে কাঁদতে অজ্ঞান হয়ে পরে। এইভাবে দু'দিন কেটে যায় নিমেষে। কেউ এতটুকু খোঁজ করে না লক্ষ্মীর।


শেষ চৈত্রে অতিরিক্ত গরম পড়েছে। কালবৈশাখীর দেখা নেই। বসন্তর কোকিলের কুহুতান কাকের ডাকের মতো কর্কশ শোনাচ্ছে। এখন শনিবারের বারবেলা পড়ে গেছে। আকাশের নৈঋত কোণে কালো মেঘ জমেছে। খর বারে ঘোর অমাবস‍্যা। এ কিসের পূর্বাভাস!


লক্ষ্মী ঘর থেকে বেরোয়। চোখের চাওনি ঘোলা। তিনদিনের উপোসী শরীর শুকিয়ে পাকিয়ে গেছে। উন্মাদের মতো একমাথা রুখু কাঁচাপাকা চুল এলোকেশির মতো উড়িয়ে মলিণ হয়ে যাওয়া তিনদিনের বাসি কাপড় পরনে উদভ্রান্তের মতো পালপাড়া দিয়ে লক্ষ্মী ছুটে যায় নদীর দিকে। 

নদীর পাড়ে এসে মনে মনে বলে, মাগো চরণে ঠাঁই দাও। বলেই নদীর জলে ঝাঁপ মারতে উদ‍্যত হয়। 


ঠিক সেই মুহূর্তে গুরু দাস বাউল পেছন থেকে কাঁধে হাত দিয়ে দু'চোখে বিশ্বাস ও আস্থা জাগিয়ে বলে, " দিদিগো আত্মহত‍্যা মহাপাপ নরকে গমন।" 


গুরু দাস বাউল লক্ষ্মীকে বুঝিয়ে বলে," আমরা বাউল। সাধন ভজন করি আর আখড়াতে থাকি বট‍্যে। দেশ, সময় আমাদের আটকে রেখে রসটো পাবে নাখো। তুমি আমাদের সাথকে চলো।"


গুরু দাস বাউল কমলাকে নিয়ে চলে যাচ্ছে মুখে তার গান, 


" এমন মানব জনম আর কি হবে

  মন যা করো ত্বরায় করো এ ভবে

অনন্ত রূপ সৃষ্টি করলেন সাঁই

শুনি মানবের উত্তম কিছুই নাই

   দেব-দেবতাগণ করেন আরাধন

      জন্ম নিতে মানবে।

মন যা করো ত্বরায় করো এই ভবে..."


লক্ষ্মীর মনে হল এই ভালো হল, তার সব কিছুর বদলে সৃষ্টিকর্তা তাকে গোটা বিশ্ব নিখিল দান করলেন। এখন সে বিশ্ব নাগরিক।




Rate this content
Log in

Similar bengali story from Inspirational