STORYMIRROR

Partha Pratim Guha Neogy

Inspirational

4  

Partha Pratim Guha Neogy

Inspirational

মুন্ডা বিদ্রোহ

মুন্ডা বিদ্রোহ

5 mins
519

ব্রিটিশ রাজের ঔপনিবেশিক শাসন শুধুমাত্র আদিবাসীদের আর্থিক ভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করেনি তাদের স্বাধিকার এবং প্রথাগত জীবনযাত্রাকে বিধ্বস্ত করেছিল । এই ধারার ব্যবহার আদিবাসীদের ক্ষুব্ধ করে তুলেছিল এবং তার চূড়ান্ত পরিনতি ছিলো মুন্ডা বিদ্রোহ বা মুন্ডা অভ্যুত্থান ।

নৃঃতাত্বিক দিক দিয়ে মুন্ডারা ছিলো অস্ট্রিক জনগোষ্ঠীর মানুষ । মুন্ডা বিদ্রোহ হয়েছিলো মূলত ছোটনাগপুর অঞ্চলে,মূল কেন্দ্র ছিলো রাঁচি এবং সিংভূম অঞল । মাথায় রাখতে হবে ১৮২০ খ্রিস্টাব্দে কোম্পানি সরাসরি ছোটনাগপুরের শাসনভার গ্রহন করে এবং ভূমি বন্দোবস্ত চালু করে । উচ্চহারে রাজস্ব,বহিরাগত বা দিকুদের অত্যাচার।মহাজনী শোষনের বিরুদ্ধে কোল,হো,ওঁরাও এবং মুন্ডারা প্রতিরোধ গড়ে তুলেছিল। ১৮৩২ নাগাদ ছোটনাগপুর অঞ্চলে কল বিদ্রোহের সূত্রপাত হয়েছিলো এবং উনবিংশ শতকে এই বিদ্রোহের সম্প্রসারিত রূপ ছিলো মুন্ডা বিদ্রোহ। ‘উলগুলান’-এর (অর্থ ‘প্রবল বিক্ষোভ’) লক্ষ্য ছিল মুন্ডা রাজ ও স্বাধীনতা প্রতিষ্ঠা করা।

কোল সমাজের নেতৃস্থানীয় ব্যক্তি বা সর্দারদের বলা হতো মুন্ডা বা গ্রাম প্রধান ।এরা আদতে কোল সম্প্রদায়ের অংশ ।প্রথাগত নিয়ম অনুযায়ী কোলরা সকলে মিলে বনজঙ্গল কেটে ও পরিষ্কার করে চাষবাস উপযোগী করে তোলে । তাদের মালিক রাজাও নয়, জমিদার নয় । মালিকানা ছিলো যৌথ ।এটি খুন্তকান্টি ব্যবস্থা নামে পরিচিত ছিল । বনের ফলমূল,কাঠ,বেত প্রভৃতির উপর অধিকার ছিল কোলদেরই।


বিদ্রোহের প্রেক্ষাপট:


চিরাচরিত আর্থ-সামাজিক ব্যবস্থার ভাঙন –


ঔপনিবেশিক শাসনে মুন্ডাদের খুন্তকান্তি ব্যবস্থার অবসান ঘটে । ১৭৯৩ খ্রিস্টাব্দে চিরস্থায়ী ব্যবস্থার প্রবর্তন হলে আদিবাসী জমিদারেরা তাদের জমিদারিগুলি হস্তগত করে শিখ, মুসলিম এবং পাঞ্জাবী বহিরাগত জমিদারেরা ।

অন্যদিকে ফসলের পরিবর্তে নগদে রাজস্ব দেওয়া বাধ্যতামূলক হওয়ায় ছোটনাগপুর অঞ্চলে বহিরাগত মহাজনদের প্রভাব বাড়তে থাকে । সামগ্রিকভাবে জমিদার ও মহাজন্দের প্রভাব বাড়তে থাকে । সামগ্রিকভাবে জমিদার ও মহাজনী শোষনের বিরুদ্ধে মুন্ডা নেতারা প্রচারাভিযান শুরু করে।


অরণ্য অধিকার হরণ-


ঔপনিবেশিক অরণ্য আইন প্রয়োগ করে অরণ্য এবং অরণ্যজাত দ্রব্যের ওপর আদিবাসীদের চিরাচরিত অধিকার হরণ করা হয়। আদিবাসী মুন্ডারা অরণ্য থেকে বাঁশ,কাঠ, পাতা, মধু,ফলমূল সংগ্রহ করত । এমনকি অরণ্যে পশুশিকার করতো এবং পতিত জমিতে পশু চরাতো । এই অধিকার হরণ শুধুমাত্র তাদের আর্থিকভাবে ক্ষতিগ্রস্থ করেনি তাদের এতদিনের অধিকার এবং স্বতন্ত্রতাকে ছিনিয়ে নিয়েছিল । ১৮৮২ খ্রিস্টাব্দে জমি জরিপ করে পতিত জমিগুলিকে কোম্পানি দখলে নিলে মুন্ডারা ছিন্নমূল হয়ে যায়।


বেগার শ্রম –


মুন্ডাদের বলপূর্বক জমিদার ও জোতদারদের বেগার শ্রম দিতে বাধ্য করতো।এমনকি কোম্পানি তার বানিজ্যিক ফসল চাষ এবং অন্যান্য কাজে মুন্ডাদের সামান্য মজুরির বিনিময়ে বলপূর্বক কাজে নিয়োগ করতো ।তাদের জোর করে আসামের চা বাগানে পাঠানো হতো ।


খ্রিস্টান মিশনারিদের কার্যকলাপ –


১৮৪৫ খ্রিস্টাব্দে লুথেরান,অ্যাংলিকান,ক্যাথলিক মিশনারিরা মুন্ডা সমাজে খ্রিস্টান ধর্ম প্রচার করতে গেলে তীব্র প্রতিক্রিয়া সৃস্টি হয়েছিল ।


বিরসা মুন্ডার আবির্ভাব ও নেতৃত্ব-


বিরসা মুন্ডা শুধুমাত্র মুন্ডা বিদ্রোহের নায়ক নন, তিনি সমগ্র আদিবাসী সমাজের কাছে এক কিংবদন্তী নেতা ।ধরতী আবা বা ধরত্রীর পুত্র বিরসা মুন্ডাদের কাছে হয়ে উঠেছিলেন ‘সিংবোঙা’ বা ‘সূর্যদেব্তা’এবং বিরসা ভগবান । তার ডাকেই সংগঠিত হয়েছিল ‘মুন্ডা উল্‌গুলান’ বা তুমুল আলোড়ন ।

বিরসা মুন্ডার জীবনের প্রথম পর্ব –

বিরসা জন্মগ্রহন করেছিলেন ১৮৭০ খ্রিস্টাব্দে রাঁচি জেলার অন্তর্গত বোহান্ডা জঙ্গলের নিকট চালকাদ গ্রামে । বাবা সুগান মুন্ডা, মা কারমীর চতুর্থ সন্তান ছিলেন বিরসা মুন্ডা । বিরসার ছোটবেলা কেটেছিল বনে বাদাড়ে ঘুরে বেড়িয়ে,পশুপালন করে আর বাঁশি বাজিয়ে। লোকমুখে ছোটবেলা থেকে কোল ও মুন্ডা সর্দারদের বীরত্বের কাহিনী ও অতীতের সুখের, গৌরবের দিনগুলোর কথা শুনে ছোট্ট বিরসা চঞ্চল হয়ে উঠত।


খ্রিস্টান ধর্মের প্রভাব- 


একদিকে দারিদ্র ও অন্যদিকে মিশনারি প্রভাবে সুগান মুন্ডা তার ১২ বছরের পুত্র বিরসাকে স্থানীয় জার্মান মিশনারি স্কুলে ভর্তি করে দেন। পরে এক ক্যাথলিক গীর্জার স্কুলে ভর্তি হন বিরসা । বিরসার মনে একদিকে আদিবাসী সংস্কৃতি অন্যদিকে মিশনারি ধর্ম ও শিক্ষার পারস্পারিক বিরোধিতার টানাপোড়েন চলছিলো । এই সময় তিনি বৈষ্ণব গুরু আনন্দ পাঁড়ের দ্বারা প্রভাবিত হয়েছিলেন ।


বিরসার নিজেস্ব ধর্ম ও বিধান-


অবশেষে সমস্ত দ্বিধা দ্বন্দের অবসান ঘটিয়ে বিরসা আদিবাসী ঐতিহ্য এবং বিশ্বাসের ওপর ভর করে নিজেকে ‘ সিংবোঙার’ অবতার হিসেবে তুলে ধরেছিলেন।

বিরসার অসাধারন ব্যক্তিত্ব সাহস,নতুন ধর্মীয় ভাবাবেগ এবং সম্মোহনী ক্ষমতা মুন্ডা সমাজকে আলোড়িত করেছিলো। তিনি মুন্ডা সমাজের সংস্কারের জন্য কিছু নির্দেশিকা চালু করেছিলেন, যেমন বলা হয়েছিলো-

১। মুন্ডাদের মদ্যপান পরিত্যাগ করতে হবে ।

২। সুন্দর এবং নির্মল গ্রাম ও চরিত্র গঠন করতে হবে ।

৩। সর্বপ্রকার কুসংস্কার ত্যাগ করতে হবে ।

৪। ব্রাহ্মণদের মতো গলায় ‘জানে’ বাঁ পবিত্র সূত্র ধারণ করতে হবে।

বিরসা আসলে একই সঙ্গে মিশনারি এবং পুরোহিত শ্রেণির প্রভাব খর্ব করতে চেয়েছিলেন। তার অনুচরেরা তার বাণী গ্রামে গ্রামে প্রচার করতেন। একই সাথে বেগার খাটা নিষিদ্ধ ঘোষনা করা হয়।


মহাপ্রলয়-


বিরসা ঘোষনা করেন পৃথিবীতে ‘মহাপ্রলয়’ আসন্ন। ঐ প্রলয়ে ব্রিটিশ রাজ ধ্বংস হয়ে যাবে । বিরসা এক জমায়েতে প্রচার করেন ব্রিটিশ সরকারের উচ্ছেদের মধ্যে দিয়ে মুন্ডারাজ প্রতিষ্ঠা করাই তাদের একমাত্র উদ্দেশ্য। ব্রিটিশ সৈন্যরা তাকে ধরে রাখতে পারবে না। শত্রুপক্ষের বুলেট তার মন্ত্রগুণে জল হয়ে যাবে।

আন্দোলনের দ্বিতীয় পর্ব – বিরসার অনুপস্থিতিতে রদিকুরা আদিবাসীদের ওপর অত্যাচারের মাত্রা বাড়িয়ে দিয়েছিলো । সর্বোপরি ১৮৯৭-৯৮ খ্রিস্টাব্দে ভয়ঙ্কর দুঃভিক্ষে মুন্ডাদের জীবন বিপর্যস্ত হয়ে গিয়েছিল ।

দ্বিতীয় পর্বে বিরসা মুন্ডাদের বিদ্রোহ ছিলো অনেক বেশী রাজনৈতিক । K.K. Singh যথার্থই বলেছিলেন “ The movement was agrarian in its root, violent in its means and political in its end”

বিরসা তার আন্দোলন কেন্দ্র চালকাদ থেকে ডোমবাড়িতে নিয়ে আসেন । ১৮৯৯ খ্রিস্টাব্দে ২২ শে ডিসেম্বর বিরসা কোটডাঙায় একটি সভায় ঘোষনা করেন খ্রিস্টানদের উৎসব বড়োদিনের দিন আক্রমণের শানানো হবে ।এই দিন মুন্ডারা চক্রধরপুর,রাঁচি সহ বহুগ্রামে তীরধনুক,টাঙ্গি নিয়ে বিদ্রোহে ঝাঁপিয়ে পড়ে । জমিদার, মহাজনদের বাড়ি্, কাছারিবাড়ি আক্রমণ করে ।গির্জা,থানা ,আদালত আক্রমণ করে ।মিশনারিদের ঘরবাড়ি জ্বালিয়ে দেয় । ১৯০০ খ্রিস্টাব্দে ৯ ই জানুয়ারি সইল রাকার পাহাড়ে বিশাল সেনাবাহিনী পাঠান । মুন্ডারা বন্দুক,রাইফেলের প্রত্যুত্তরে তীর,বর্শা দিয়ে জবাব দিলেও পরাজিত হয় । গয়ামুন্ডা সহ অনেকেই নিহত হন ।

বিরসা পালিয়ে যেতে সক্ষম হলেও শেষে পর্যন্ত ধরা পড়ে যান তাকে বন্দী করে রাঁচি জেলে পাঠানো হয় । ২ রা জুন কলেরা রোগে আক্রান্ত হয়ে বিরসা মুন্ডা মারা যান । প্রায় ৫৮১ জন বিদ্রোহীকে গ্রেপ্তার করা হয়েছিলো । বলাবাহুল্য বিরসার মৃত্যুর পর মুন্ডা বিদ্রোহ থিতিয়ে পড়েছিলো ।

ফলাফল ও গুরুত্ব-

মুন্ডা বিদ্রোহ সফল না হলেও এর গুরুত্ব অস্বীকার করা যায় না ।

১। এই বিদ্রোহের দরুন ব্রিটিশ সরকার খুন্তকান্টি প্রথার স্বীকৃতি জানিয়ে ১৯০৮ খ্রিস্টাব্দে ‘ছোটনাগপুর প্রজাস্বত্ত্ব আইন’ পাশ করে মুন্ডাদের জমি হস্তান্তরের ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে ।

২। বেগার শ্রম বা বেট বেগারি প্রথার অবসান ঘটানো হয় ।

৩। K.K.Singh এর মতে বিদ্রোহের মধ্যে দিয়ে আদিবাসী সমাজ উচ্চবর্গীয়দের ক্ষমতা সম্পর্কে অবহিত হয় এবং অপেক্ষাকৃত হিংসাত্মক পদ্ধতি গ্রহণের প্রয়োজনীয়তা অনুভব করেন । অন্যদিকে প্রতিপত্তিশালী অংশও অতীতের নিপীড়নমূলক পদক্ষেপগুলি বর্জন করে । অর্থাৎ দুইপক্ষের মধ্যে একটি ভারসাম্য প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল ।

৪। মুন্ডা বিদ্রোহে অনুপ্রানিত হয়ে ছোটনাগপুরের ওঁরাও সম্প্রদায় জমির মালিকানা পাওয়ার জন্য ১৯১৪ খ্রিস্টাব্দে তানাভগৎ আন্দোলন শুরু করে ।

৫। বিরসা ব্যর্থ হলেও আদিবাসীদের মধ্যে তিনি দেবতা হিসেবে পরিগনিত হন । K.K.Singh যথার্থই বলেছেন “No hero in munda folklore has been commemorates in such term as Birsha”.

মহাশ্বেতা দেবীর জনপ্রিয় উপন্যাস 'অরন্যের অধিকার' শহীদ বিরসা মুন্ডার জীবন নির্ভর।



Rate this content
Log in

Similar bengali story from Inspirational