মমতা
মমতা
সীমা টিফিন খেয়ে চেয়ারে বসতে গিয়েই দেখল কাল সকালে যে বয়স্কা ভদ্রমহিলা ভর্তি হয়েছিলেন, তার সেলাইনের বোতলটা শেষ হয়ে গেছে কিন্তু বড় নার্স দিদিরা খেয়ালই করেনি। সীমার গায়ে এখনো নতুন গন্ধ তাই বড় নার্স দিদিরা ওর কথায় খুব একটা কর্ণপাত করে না। বেশি কিছু বলতে গেলে উল্টে সিমাকেই কথা শুনতে হয়। সবে মাত্র এক মাস হয়েছে ও জয়েন করেছে। সত্যি সরকারি হাসপাতালে এত রোগীর চাপ যে দিদিরা সবাইকে ঠিকমতো খেয়াল করতে পারে না। সীমা তৎক্ষণাৎ গিয়েই স্যালাইন টা লাগিয়ে দিল আর ওষুধ কিছু দিতে হবে কিনা সেটাও দেখে নিল। আজ ওর অন্য ওয়ার্ডে ডিউটি । রজনী এলেই ও পাশের ওয়ার্ডে চলে যাবে কিন্তু আজ রজনীর আসতে একটু বেশি দেরি হচ্ছে। রজনী ওর সাথেই জয়েন করেছে আবার ওরা এক সাথেই ট্রেনিং নিয়েছে। অবশেষে রজনী এল। সীমা ওই বয়স্কা ভদ্রমহিলার কথা ওকে বলতে ও উত্তর দিলো
"দেখ সীমা এত রোগীর মাঝে কাউকে আলাদা করে দেখাশোনা করা ঠিক নয় , তুই পাশের ওয়ার্ডে যা, যদি কিছু প্রবলেম হয় তবে আমি দেখে নেব"
কথাটা সত্যি। এতো রোগীর মাঝে কাউকে আলাদা ভাবে দেখাশোনা করাটাও সম্ভব নয়। আসলে আগের দিন যখন এই ভদ্রমহিলা ভর্তি হতে এসেছিলেন , তখন ওনার সাথে একজন দশ বারো বছরের মেয়ে ছিল । আর কেউ আসেনি । সীমা বেশ কিছুক্ষণ পর বাচ্চা মেয়েটিকে ডেকে জিজ্ঞেস করেছিল
"বাড়িতে বড় কেউ নেই ? তুমি একা এনেছো ? ইনি তোমার কে হয়?
এক সাথে এতগুলো প্রশ্ন করে সীমা মেয়েটির মুখের দিকে চেয়ে রইল উত্তরের আশায়। মেয়েটি তার শুকিয়ে যাওয়া ঠোঁট নেড়ে বলল
"আমার ঠাকুমা । আমার বাবা মা একটা অ্যাক্সিডেন্টে মারা গেছে, এখন আমি ঠাকুরমার কাছেই থাকি। দিদি তুমি আমার ঠাকুমা কে একটু ভালো করে দেখা শোনা কোরো, ইনি ছাড়া আমার আর কেউ নেই"
মেয়েটির চোখ ছল ছল করে উঠলো। সীমার হৃদয়টা যেন কেউ মোচড় দিলো। মেয়েটির মুখের দিকে তাকিয়ে এক মমতায় ভরে গেল ওর মন। মনে হচ্ছিল এই মেয়েটিকে ও নিজের কাছে রেখে মানুষ করে কিন্তু ওর যা পারিবারিক অবস্থা তাতে এটা যে কখনোই সম্ভব নয় ও তা ভালো করেই জানে। তবু বলল
"তোমার নাম কি ? আর তোমার ঠাকুমা ঠিক ভালো হয়ে উঠবে । আমি রইলাম তোমার ঠাকুমাকে খুব ভালো করেই দেখাশুনা করব"
মেয়েটির করুন মুখে যেন একটু হাসি ফুটল
"দিদি আমার নাম জুঁই, তুমি খুব ভালো , আর একটা কথা জিজ্ঞেস করবো?"
আমি চোখের ইশারায় কি বলায় ও বলল
"আমি ঠাকুরমাকে না নিয়ে বাড়ি ফিরব না , তোমাদের হাসপাতালের নিচে থাকবো যদি দরকার হয় আমাকে একটু ডেকে নিও"
আমি বড় নার্স দিদিদের বলে ওকে হাসপাতালের বারান্দায় থাকার ব্যবস্থা করে দিলাম। জুই এর জন্য এটুকু করতে পেরে আমার কেমন তৃপ্তি বোধ হল।
পাশের ওয়ার্ডে কাজ করলেও রাতে বার তিনেক এসে ভদ্রমহিলাকে দেখে গেলাম। অবস্থার খুব একটা উন্নতি চোখে পড়ল না । আসলে ওনার সেরিব্রাল হয়েছে। ভগবানের কাছে শুধু প্রার্থনা করতে লাগলাম যেন উনি বেঁচে ফিরে আসেন । নিজের জন্য না হোক জুঁয়ের জন্য ওনার বাঁচা খুব প্রয়োজন।
পরের দিন সকালে আমার ডিউটি শেষ করে জুঁই কে বললাম আমার সাথে বাড়ি গিয়ে কিছু খাওয়া দাওয়া করে আবার হাসপাতালে আসতে কিন্তু মেয়েটা শুনল না। ও ঠাকুমাকে এই অবস্থায় ছেড়ে কিছুতেই যেতে রাজি হল না । আমি আর কি করি, অগত্যা বাড়ি চলে গেলাম। রাতে যখন ডিউটিতে ঢুকবো হঠাৎ রজনীর সাথে দেখা হতে ও বলল
"একটু আগে ওই ভদ্রমহিলা মারা গেছেন , মেয়েটাকে অনেক খুজলাম কিন্তু মারা যাওয়ার কথা শোনার পর , আর কোথাও খুঁজে পেলাম না। নার্স দিদিরাও ওকে সবাই মিলে খুঁজেছে কিন্তু পায় নি।" জুঁই এর জন্য এত মমতা আমি কোথায় রেখেছিলাম জানিনা । আমি কাঁদতে কাঁদতে গোটা হসপিটাল ছুটে বেড়ালাম কিন্তু জুঁইকে কোথাও খুঁজে পেলাম না । ভদ্রমহিলার বডিটা বেওয়ারিশ লাশ হিসাবে পড়েই রইলো । যে কাজই করতে চ যাচ্ছি কিছুতেই মন দিতে পারছি না । শুধু জুঁয়ে র মুখটা আমার চোখের সামনে ভাসছে , আর দু চোখ জলে ভরে উঠছে।
পরের দিন ডিউটি শেষ করে বাসে উঠবো বলে রাস্তাটা পার হতে গিয়ে দেখলাম জুঁই একটা ফলের দোকানের পাশে চুপ করে দাঁড়িয়ে, এক দৃষ্টে ফল গুলোর দিকে তাকিয়ে। আমি ওর মুখ দেখেই বুঝেছিলাম ওর খুব খিদে পেয়েছে। আমি ছুটে গিয়ে ওকে জড়িয়ে ধরলাম কিন্তু ওর কোনো প্রতিক্রিয়া নেই । বললাম
"তুই কোথায় চলে গিয়ে ছিলিস? তোর আমার সাথে একবার দেখা করতে ইচ্ছা হয়নি?"
একটু চুপ করে থেকে জুঁই খুব ধরা গলায় বলে উঠলো
"তুমি মিথ্যে কথা কেন বলেছিলে তাই আমি তোমার সাথে দেখা করিনি , তুমি আমার ঠাকুমা কে বাঁচিয়ে দেবে বলেছিলে কিন্তু নার্স দিদিরা বলল আমার ঠাকুরমা মরে গেছে"
আমি হাপুস নয়নে কাঁদতে থাকলাম আর জুহি কে বুকে চেপে ধরে রাখলাম
"তুই একা নয় আমি তোর পাশে আছি,
তুই আজ থেকে আমার কাছেই থাকবি"
আমার অভাব হেরে গেল জিতে গেল আমার হৃদয়ের মমতা।