জীবন সুধা
জীবন সুধা


‘আমি আগন্তুক/ আমি বার্তা দিলাম/ কঠিন অঙ্ক এক কষতে দিলাম’ – এই গানটাই মাথায় এলো লিখতে বসে। জীবন যে কখন কি অঙ্ক কষতে দেয়, তার উত্তর খুঁজে পাওয়া/ যাওয়া অনেকটা ওই এই গানেরই আর একটা লাইনের মতো – ‘এ প্লাস বি প্লাস সি হোল স্কোয়ার ইকুয়াল টু?/ কলেজ স্কোয়ার?’
আমি অনেক ভেবেছি। সদুত্তর পাইনি। তাই এই গল্পের উপস্থাপনা। এবার গল্পের জাল কোনদিকে কিভাবে ছড়ায় সেটাই দেখার!
হ্যালো, জীবনদায়ী নার্সিংহোম থেকে বলছি। জীবন দে বলছেন।
হ্যাঁ, বলছি।
আপনার টেস্ট পজিটিভ এসেছে। আপনাকে চোদ্দ দিন হোম আইসোলেশনে থাকতে হবে। স্বাস্থ্য দপ্তরকে আমরা জানিয়েছি। ওনারা আপনার সাথে যোগাযোগ করে নেবে।
ফোনটা ছেড়ে খাবার টেবিল থেকে উঠে চুপচাপ ঘরে চলে গেলেন। ছোট মেয়ে জামাই মুখ চাওয়া চাওয়ি করেও পরস্পর কিছু বুঝতে পারিনি দেখে ছোট মেয়েই বাবাকে জিজ্ঞাসা করল – কার ফোন ছিল বাপি? খেয়ে নিয়ে যদি কিছু দেখার থাকে দেখনা।
চুয়াত্তর বছরের বৃদ্ধ জীবনবাবু নিজেকে সামলে নিয়ে বললেন – না, আর খাবো না। জীবনদায়ী থেকে ফোন করে জানালো রেজাল্ট পজিটিভ। এখন চোদ্দ দিন এঘরেই থাকবো। তোমরা শুধু খাবারটা দিয়ে দেবে আর কাল থেকে ঝুমা কে কাজে আসতে মানা করে দাও।
মাথাটা বন বন করে ঘুরছে ছোট জামাই সায়কের। কী কুক্ষনে বৌয়ের জেদের বসে সাত মাসের মেয়েটাকে নিয়ে অন্নপ্রাশনের পরের দিন এসেছিলাম। তার পরেই লকডাউন শুরু হল আর আটকে গেল। ছোঁয়াচে রোগ। এভাবে এক ছাদের তলায় থাকা যায়। মেয়েটাকে নিয়েই চিন্তা।
একটু ঝাঁঝিয়েই বউ কে বলল – পই পই করে মানা করেছিলাম এই পরিস্থিতিতে হাসপাতালে না যেতে। নাও এবার ঠেলা সামলাও!
নিচু স্বরে কর্কশভাবে অনু বলেছিল – কিছুদিন ধরেই বাবার বুকে ব্যাথা করছিল। ডাক্তারকে ফোনে বললে তিনি জানান, পূর্বেই স্টেন্ট বসানো থাকায় না দেখে কোন ওষুধ দেবেন না। অগত্যা ডাক্তার দেখাতে গিয়েছিলেন। ডাক্তার অ্যাঞ্জিয়গ্রাম করতে বললেও, এখন কোভিড টেস্ট নাকরে কেউ কোন টেস্ট করছে না। মানুষটা লকডাউনের প্রথম দিন থেকে কোথাও বেরোয়নি। অ্যাসিম্পটমেটিক, টেস্ট না হলে কেউ জানতো! তার থেকেও বড় কথা বাড়িতে আটকে রেখে রাত বিরেতে যদি বুকের ব্যাথাটাই বেড়ে কিছু হত, কী করতাম! সারা জীবন আক্ষেপ থাকতো। আশা করি সেগুলো ভেবেচিন্তে বলছ!
অনু আমি সব ভেবেছি। এই অবস্থায় আমাদের কিছু হলে মেয়েটার কি হবে ভেবে দেখেছ!
অনু ঘর থেকে বেড়িয়ে যায়। সারা ঘর, আসবাব, বাসন সাবান জল দিয়ে মুছতে মুছতে জীবন বাবু কে বলে – বাপি ভয়ের কিছু নেই। তুমি একবার তোমার অফিসের মেডিক্যাল অফিসার কে জানাও। দেখ উনি কী বলেন। তোমার তো শরীরে কোন অসুবিধা নেই। তাহলে !
জীবন বাবু তাই করেন।
ডাক্তার শীলের সাথে কথা হল। খুবই ভাল ছেলে। শুনেই বললেন – না না মিস্টার দে একদম চিন্তা করবেন না। আপনার বাড়ির কাছাকাছি কোথাও একটা ব্যবস্থা করে কল ব্যাক করছি।
অনু শুনে আশ্বস্ত হল। বলল – খুব ভালো বাপি। সত্যি রাত বিরেতে কিছু অসুবিধা হলে কোথায় কী হবে তার চেয়ে কোম্পানি যখন মেডিক্যাল ফেসিলিটি দিচ্ছে, নিয়ে নাও।
ডাক্তার শীল ব্যবস্থা করে জীবনবাবুকে জানালেন – ইমিডিয়েটলি ভর্তি হয়ে যান। বেড বুক করা আছে। বিল টু কোম্পানি হবে। শুধু এমপ্লয়ী নাম্বার আর আধার কার্ডের জেরক্সটা নিয়ে যাবেন। লাগবে।
জীবন বাবু, মেয়ে জামাই সবাই নিশ্চিন্ত! এবার ব্যাগ গুছিয়ে জীবন বাবু মেয়ে কে বললেন – তাহলে আমায় ছাড়তে তুমি চল। ওখানে যদি কিছু লাগে।
অনু সোজাসুজি বরের থমথমে মুখের দিকে চেয়ে বললেন - না বাপি, তোমাদের জামাই মেয়েকে নিয়ে একা থাকতেও পারবে না আর আমায় মেয়ের সব কাজ করতে হয় তো ইনফেকশনের ভয় থাকবে।
বাবা সম্মতি জানিয়ে মাথা নেড়ে বললেন বড়মেয়ে মনু কে একবার কল করে বলতে যে ফেরার পথে হাস্পাতালে চলে যেতে, উনি একাই একটা ট্যাক্সি করে চলে যাবেন। তারপর ভর্তি হয়ে গেলে চলে আসবে। এমনিতে বড়মেয়ে প্রতি সপ্তাহে বাবা কে দেখতে আসে। রোজ রাতে ফোন করে খবর নেয়।
কিছুক্ষন পরে বড়মেয়ে ফোনে জানায় আজ তার পক্ষে সম্ভব নয়। অফিসে মিটিং আছে। আগে বলে রাখলেও ম্যানেজ করা যেত, কিন্তু, এখন সম্ভব নয়।
অগত্যা জীবনবাবু একাই যাবেন মনস্থির করলে, অনুর দিকে তাকিয়ে অনিচ্ছাস্বত্বেও সায়ক যেতে রাজি হয়।
ঝামেলা কিছুই পোহাতে হয়নি। ভর্তি করে বাড়ি এসে সাবান মেখে স্নান সারলেও ভয়টা সারা গায়ে লেগে থাকে সায়কের।
ঝড়ের বেগে পাড়ার লোক ইতিমধ্যে জেনে গেছে। থানা পুলিশ, কাউন্সিলর সবাই ফোন করেছেন। তবে হসপিটালে ভর্তি জেনে সবাই স্বস্তি পেয়েছে।
আত্মীয় পরিজনের মুহুর্মুহু ফোনে অতিষ্ঠ লাগে অনুর। দিদির ফোন তো সহ্যই হয় না! তবু সে শান্ত ভাবে পরিস্থিতি সামাল দেয়। দুবেলা হসপিটালে ফোন করে বাবার খোঁজ নেয়।
সতেরো দিনের মাথায় হসপিটাল থেকে জানালো জীবনবাবুকে ছেড়ে দেওয়া হবে। টেস্টের রেজাল্ট নেগেটিভ এসেছে। মাথার ভেতরটা হাল্কা লাগছে অনুদের। একটাদিন প্রবল মানসিক চাপে দুরু দুরু বুকে কাটিয়েছে। হাসপাতাল থেকে যে কদিন ফোন এসেছে ফোন ধরতেই ভয় হয়েছে, নাজানি কিনা কি খবর আসতে চলেছে এই ভেবে।
এক বুক নিঃশ্বাস নিয়ে সায়ক আজ নিজেই শবশুরমশাইকে আনতে প্রস্তুত। আত্মীয়স্বজন সকলে ছোটজামাইয়ের প্রশংসায় পঞ্চমুখ । কাল সম্পত্তির ভাগ হলে তারা যদি কিছু বেশি পায় তাতে কারোর খারাপ লাগবে না। একটি বেসরকারি ভ্রমণ সংস্থায় চাকরি করার কুবাদে সায়কের চাকরিটা গেছে! ফলে এমতাবস্থায় অবিশ্বাস করলেও ‘মানুষ মানুষের জন্যে’ গেয়ে যা জোটে তাই লাভ!
শবশুরমশাইকে নিয়ে ট্যাক্সিতে বাড়ি ফেরার সময় অনুর ফোন আসে। বাপির বাড়ি ফেরার আনন্দ তার গলায় থাকলেও, উৎকণ্ঠাও ছিল। অনু জানায় মনুর কোন অফিস কলিগেরও পজিটিভ হয়েছে। আর আজ দিদিরও জ্বর এসেছে, গলায় ব্যাথা!
জীবনবাবু শুনে জানলার বাইরের চলমান দৃশ্যের দিকে শূন্য দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকেন। সায়ক শবশুরমশাইয়ের উদ্দেশ্যে বলেন – বাবা চিন্তা করবেন না। দিদি ভাইয়ের এমনি জ্বরও হতে পারে। দেখাই যাক না। আগে থেকে ভয় পেয়ে কি লাভ!
জামাইয়ের কথা শুনে জীবনবাবু বলেন – ভয় স্বাভাবিক! ছেলে-মেয়ে নিয়ে সংসার। একী আমি, একা ঝাড়াহাতপা। তারপর এরোগে খরচও বিশাল। সরকারী হাসপাতালের ব্যাপার অবশ্য আলাদা। তোমাদের বয়সী কারোরই তো আর বিশাল ব্যাংক ব্যালেন্স হয়না সব খরচ খরচা চালিয়ে। আর আমারও বিশাল কিছু নেই। তবু তুমি যা করেছ, এসময় কেউ করবেনা। দেখছি তো চারদিকের যা অবস্থা! টাকা পয়সা থেকেও যা, না থেকেও তাই।
বাড়ি ফিরেও জীবনবাবু নিজেকে সেলফ আইসলেশনে রেখেছেন। বড় মেয়ের রাতে ফোন এসেছিল – বাড়িতে তাকে নিয়ে অশান্তি। একসাথে থাকতে সবাই ভয় পাচ্ছে। তাই কদিন বাবার কাছে এসে থাকতে চায়।
তিনি রাজি। সেই নিয়ে অনু বাবাকে অনুযোগের সুরে দিদির এড়িয়ে যাওয়া নিয়ে দুকথা বলেছে। বাবা উত্তর দেননি।
সায়ক অনুকে এ নিয়ে রাগ দেখালে সে বলেছে – এটা বাপির বাড়ি। বাপি যা চাইবে সেটাই শেষ কথা।
সায়ক আর কথা বাড়ায়নি।
দিদিভাই টেস্ট করিয়ে এবাড়িতে এসেছে। সবাই চুপচাপ আছে। মেপে কথা বলছে।
টেস্টের রিপোর্ট নেগেটিভ এসেছে।
জীবনবাবু এই আনন্দে বড় মেয়ের ফেভারিট মাটন আর ছোট মেয়ের পছন্দের ইলিশ আনতে বলেছেন। তিনি নিজে রান্না করে খাওয়াবেন। স্বভাবসিদ্ধ ফুরফুরে মেজাজে তিনি খাবার টেবিলে সবার সাথে খেতে খেতে গুনগুন করছেন- মানুষ মানুষের জন্যে,/ জীবন জীবনের জন্যে।/ একটু সহানুভূতি কি মানুষ পেতে পারে না?