ভালোবাসায় ভরা একদিন

স্বাতী সফটওয়্যার কোম্পানিতে চাকরি নিয়ে বছর দুয়েক হলো অন্যত্র ফ্ল্যাট ভাড়া নিয়ে আছে।রবির সঙ্গে ওর প্রেমটা চলছে আজ বছর ছ'য়েক।অনেক বার দুজনের মধ্যে মিস আন্ডারস্ট্যান্ডিং হয়েছে,তবে

সম্পর্ক ভেঙে যায়নি।আসলে,ওরা যে,কেউ কাউকে ছেড়ে বেশি দিন থাকতে পারেনা।দুজনেই দুজনের

অভ্যেসে পরিনত হয়েছে বলা চলে।তবু,ওরা কেউ কাউকে হৃদয় দিয়ে ছাড়া শরীর দিয়ে ছুঁয়ে দেখেনি।

ওরা মানতো,শারীরিক মিলনে নিঃস্বার্থ প্রেমের নিয়মভঙ্গ করা হয়,তাতে করে ভালোবাসা ভাঙতে পারে।

না,ওদের প্রেমটা স্কুল বা কলেজের প্রেম না।একই পাড়ায় দুজনের বাড়ি,ছোটো থেকে চেনা জানা,তাই

মেলামেশা করতে করতে কখন যে প্রেমটা হয়ে গেছে তা বুঝে ওঠার সময় পায়নি।কারন দুজনেই দুজনকে খুব সহজে গ্রহণ করে নিয়েছিলো।রবি বাবার বই এর ব্যবসা সামলায়।স্বাতী চাকরিটা পাওয়ার পর থেকে ওদের ফোনে এবং মনে যোগাযোগ থাকলেও চাক্ষুষ সাক্ষাৎ প্রায় হয়ই না।এমনিতে যদিও স্বাতী বহুবার রবিকে ওর ওখানে ঘুরে আসতে বলেছে কিন্তু,রবি যায়নি।রবি বলেছে-'রোজই তো কথা হচ্ছে।তাছাড়া তুই ফিরলে দেখা তো হয় আমাদের।' স্বাতী বলেছে-'একবার এলেই কী হবে?' রবি কথা দিয়েও যেতে পারেনি।

এবার প্রায় মাস তিনেক স্বাতী বাড়ি ফেরেনি ইচ্ছে করেই।যাতে রবি তার সঙ্গে দেখা করতে আসে।

সাথীর জন্য তার বড্ড মন কেমন করছিলো তাই বাধ্য হয়েই সে স্বাতীর সঙ্গে আজ দেখা করতে এসেছে।স্বাতী তাকে স্টেশনে আনতে গেছে।

ট্রেন এসে থামলো।রবিকে দূর থেকে চিনতে পেরে স্বাতী তার দিকে এগিয়ে গিয়ে বলল-'কখন বেরিয়ে

ছিলি?' রবি বলল-'দুপুরে খাওয়া দাওয়া সেরে।' স্বাতী জিজ্ঞেস করলো -'বাড়িতে কী বলে এসেছিস?'

রবি উত্তর দিলো-'কিছু নতুন বই আনার আছে বলে এসেছি।' স্বাতী বলল-'আজ কিন্তু যেতে দেবোনা তোকে।' রবি বলল-'তা আবার হয় নাকি?থাকবো

কোথায়?' স্বাতী বলল-'আমার ফ্ল্যাটে।' রবি বলল,

-'তা আবার হয় নাকি?আমরা আর ছোটা বাচ্ছাটি নেই।' স্বাতী বলল-'অত চাপ নিসনা তো।এক না এক

দিন তো স্বামী স্ত্রী হয়েই যাবো।' রবি বলল-'সে যখন

হবো তখন হবো।' স্বাতী জেদ ধরলো রবিকে আজ ওর ফ্ল্যাটে থাকতেই হবে।অগত্যা,রবি বুঝলো যে

উপায় নেই,বাড়িতে আর একটা মিথ্যে বলতে হবে।

স্বাতী প্রস্তাব রাখলো-'চল,পাশেই একটা বড় লেক আছে।ওখানে গিয়ে বসা যাবে।কতদিন জমিয়ে গল্প

করা হয়নি।' রবির সম্মতি থাকায় দুজনে মিলে লেকের ধারে গিয়ে নিরিবিলি জায়গা খুঁজে বসলো।

সত্যি বলতে কী দূর থেকে যতটা জায়গাটাকে নির্জন মনে হচ্ছিলো,সেখানে বসে বুঝতে পারলো,তাদের মত আরো কত জোড়ায় জোড়ায় মিলে সেখানে

গোপনে প্রেম জমিয়েছে।তবে,শুধু যে গল্প করছে তা ই নয়।কেউ কেউ আবার ওড়না ঢেকে ঠোঁটে ঠোঁটে

কামড়ও দিচ্ছে।বিগত ছ বছর ধরে স্বাতী এবং রবি একে অপরকে ভালোবাসলেও তাদের এখন পর্যন্ত

একটা চুমু খাওয়ার সাহস হয়নি।সেই জন্য তারা যেন একটু আন ইজি ফিল করছিলো।রবি বলল

-'তোকে এখানেই আসতে হয়।' স্বাতী বলল-'ওরা যা

করছে করুক।আমাদের কী।আচ্ছা,আমার জন্য কিছু আনিসনি?' রবি বলল-'এনেছি কিন্তু এখানে দেবো না।আজ আছি যখন পরে দিয়ে দেবো।' স্বাতী

বলল-'দেখি তোর হাতটা।' রবি তার হাতটা বাড়িয়ে দিলো।স্বাতী তার হাতে একটা ব্রেসলেট পড়িয়ে দিতে

রবি বলল-'এটার আবার কী দরকার ছিলো?' স্বাতী বলল-'আছে,আছে।অনেকদিন হলো গড়িয়েছি এটা তোকে দেব দেব করে আর দেওয়া হয়নি।পছন্দ

হয়েছে তো?' রবি বলল-'লাজবাব হয়েছে।' তারপর

তারা দুজনে মন খুলে গল্প জুড়ে দিলো।

সন্ধ্যের ঠিক মুখে আকাশে তখন মেঘ জমেছে।রবি বলল-'এবার এখান থেকে উঠে পড়া যাক।দুজনে

লেক থেকে বেরিয়ে বাইরে এলো।স্বাতী একটা দই

ফুচকার স্টল দেখতে পেয়ে বলল-'চল,ফুচকা খাবি?'

রবি ফুচকা জিনিসটা পছন্দ করেনা।তবু,স্বাতী খাবে

বলছে বলে-' হুম চল।তবে আমি কিন্তু পাঁচটা..' স্বাতী

বলল-'আমি পঞ্চাশ।'রবি পাঁচটা ফুচকা খেয়ে স্বাতীর দিকে হাঁ করে তাকিয়ে দেখছে।চোখ দিয়ে জল বেরিয়ে যাচ্ছে,গাল ফুলে যাচ্ছে-তাও পঞ্চাশটা তো পঞ্চাশটাই খেলো।শেষে তার অবস্থা পুরো কাহিল।

রুমাল দিয়ে তার হাত মুখটা রবিই মুছিয়ে দিলো।

স্বাতী ফ্ল্যাটে ফেরার বাকি রাস্তাটা রবির কাঁধের ওপর ভর করে ফিরলো।

ফ্ল্যাটে ঢুকে,কিছুক্ষন টেবিল ফ্যানের নীচে বসতে স্বাতীর অবস্থা স্বাভাবিক হলো।বাইরে বৃষ্টি নামার

তোড়জোড় চলছে।স্বাতী পাম্প চালিয়ে জল ভরতে উঠতে রবি বলল-'তুই শান্ত হয়ে বোস।আমায় বল কীসে কীসে জল ভরতে হবে।' স্বাতী রাজি ছিলোনা,

তবু রবি পাম্প চালিয়ে বোতলে,বালতিতে আর রান্নার জন্য আলাদা জায়গায় জল তুললো।

স্বাতী তাকে জিজ্ঞেস করলো-'রাতে কী খাবি?' রবি 

বলল-'তুই কী খাবি বল?' স্বাতী বলল-'বিরিয়ানি

বানাবো বলে ফ্রিজে চিকেন এনে রেখেছি।তাহলে

বিরিয়ানিই বানাই?' রবি বলল-'তোর তো বিরিয়ানি

ভাল্লাগে না।' স্বাতী বলল-'তুই তো ভালোবাসিস,তাই

বিরিয়ানিই করবো।' রবি বলল-'না,আজ আমি

এসেছি।মানে আমি যেটা বলবো সেটাই হবে।' স্বাতী

বলল-'বল তবে।' রবি বলল-' ফ্রায়েড রাইস আর চিকেন কষা।তোর ফেবারিট।ওটাই হবে।এবং আমি নিজের হাতে বানিয়ে তোকে খাওয়াবো।' স্বাতীর রাজি না হয়ে

উপায় নেই।রান্নার তোড়জোড় শুরু হয়ে গেলো।

খেতে বসবার সময় ইলেক্ট্রিক নেই।বাইরে বৃষ্টিপাত।

বাতি জ্বালিয়ে খাওয়া দাওয়া সারলো দুজনে।তার

পর ফ্ল্যাটের পশ্চিম দিকের ছোট্ট ব্যালকনিতে ওরা

পর্দা সরিয়ে দাঁড়ালো।চারদিকে অন্ধকার।বাইরে

বৃষ্টির ঝমঝম শব্দ।রবি একটা সিগারেট জ্বালালো।

স্বাতী বলল-'কাউন্টার দে।'রবি বলল-'না না মোটেই না।এসব খেলে ফুসফুসের ক্ষতি হবে।' স্বাতী বলল

-'তোর জ্ঞান তুই তোর কাছে রাখ।মানে মানে দিবি কি না?' রবি তাকে দেবেনা,স্বাতী নাছোড়বান্দা।দুজনে

যেন ধস্তাধস্তি লেগে গেলো।স্বাতী,রবিকে জাপটে

ধরে ফেলে বলল-'দে এবার।' রবি বলল-'না,হবেনা।'

স্বাতী বলল-'তবে ফেলে দে।তুইও খাবি না।' রবি 

স্বাতীকে দেবেনা বলে সিগারেটটা বাইরে ছুঁড়ে ফেলে দিলো।

স্বাতী,রবিকে সেই জড়ানো অবস্থায় বলল-'আসিস

না কেন আমার কাছে?' রবি বলল-'এলেই যে এমন পাগলামি করবি বলে।' স্বাতী বলল-'আমার 

বুঝি তোকে ভালোবাসতে ইচ্ছে করেনা?'রবি তখন

নিজের হাতটা দিয়ে স্বাতীকে জড়িয়ে নিয়ে বলল

-'আচ্ছা।আমার বুঝি করেনা?' স্বাতী বলল-'মোটেও

না।নইলে তুই নিশ্চয়ই আসতিস।' রবি বলল-'ওরে

আমার পাগলি,তুই আমার বুকের মধ্যে সবসময়

আছিস তো।' স্বাতী বলল-'এমন করে স্পর্শ করে

জড়িয়ে তো রাখিস না।' রবি বলল-'আমাদের 

স্পর্শটা মনের।যা আর সবার মধ্যে নেই।' স্বাতী হেসে

আরও শক্ত করে সোমকে জড়ালো।রবি বাইরে 

হাত বাড়িয়ে বৃষ্টির কয়েক ফোঁটা সাথীর আদরমাখা

মুখটায় ছিটিয়ে দিলো।স্বাতী তার ভিজে যাওয়া গালটা রবির গালে ঘষে দিলো।রবি বলল-'এবার চল

তোর জন্যে কী এনেছি দেখাবো।'দুজনে ব্যালকনি থেকে ফিরে এলো।

রবি তার ব্যাগ থেকে স্বাতীর জন্য যে সালোয়ারটা এনেছিলো সেটা বের করে দিলো।স্বাতী গালভরা

খুশি নিয়ে বলে উঠলো-'বুটিক্স এর কাজ করা সালোয়ার।' রবি বলল-'তুই বলছিলি না একদিন

ফোনে।' স্বাতী বলল-'তোর মনে ছিলো?'রবি বলল

-'বেগমসাসেবা বলেছে,আর সুলতানকে মনে রাখতে

হবেনা?' স্বাতী বলল-'দিল খুশ কর দিয়া জাহাপনা।

একবার পড়ি এটা?'রবি বলল-'জো মর্জি আপকা।'

স্বাতী সালোয়ারটা পড়ে এলো ভেতর থেকে।রবি প্রদীপের নিভু আলোতেই তার দিক থেকে চোখ সরাতে পারলোনা।-'রঙটা দারুন খেলছে'- বলল

রবি । স্বাতী হেসে বলল-'কার পছন্দ করা দেখতে

হবে তো।' হঠাৎ ইলেকট্রিক চলে এলো।স্বাতী তখন

সালোয়ারটা ছাড়তে শোবার ঘরে ঢুকলো।দরজা 

খোলা।সোমের হঠাৎ স্বাতীর খোলা পিঠে চোখ পড়ে যাওয়ায় লজ্জা পেলো।

স্বাতীর অমন সৌন্দর্য সে আগে কখনো দেখেনি।সম্মোহিত হয়ে যাওয়ার মত অবস্থা।

সে দৃষ্টি ফিরিয়ে নিলো এই ভেবে যে উত্তেজনার বশে

কখন ভুলটা হয়ে যায়।সামলানো যে বড়ই কঠিন।

একই বিছানায় পাশাপাশি দুজন শুলো।ছাতের নীচে

মিটমিট করে জোনাকির মত জ্বলা মিনিচারের মৃদু

রামধনু আলোয় দুজনে তাকিয়ে একে অপরকে ঠিক

একই প্রশ্নটাই করলো-'এখুনি ঘুমিয়ে পড়বি?' দুজনে

একে অপরের দিকে ফিরে আবেগ ভরা দৃষ্টি নিয়ে

এমন ভাবে দেখতে থাকলো,যেন জীবনে কেউ যেন

একে অপরকে দেখেনি। স্বাতী,রবির হাতটা ধরে

বলল-'কাছে আয়না।' রবি বলল-'এর চেয়ে বেশি

কাছে আসলে মিশে যাবো।' স্বাতী বলল-'একদিন কি

নিয়ম ভাঙা যায়না?' রবি বলল-'ভালোবাসাটা যদি

মিথ্যে হয়ে যায়।' স্বাতী বলল-'অনেকেই তো নিয়ম

ভাঙে।'রবি বলল-'নিয়ম ভাঙতে গিয়ে অনেক 

ভালোবাসা যে ভেঙে গেছে এক রাতে।' স্বাতী বলল

-'মিলন হওয়া কী ভুল?' রবি বলল-'হয়ত ভুল নেই।

তবে আমি চাই,এমনই একটা বিছানা একদিন ফুলে

সজ্জিত থাকবে।ভালোবাসা সেদিন কোনো বাধা

ছাড়াই নিজে থেকে চাইবে মিলতে।আমরা মিলবো।'

স্বাতী বলল-'সে অপেক্ষা আর কতদিনের?'রবি 

বলল-'নিয়ম মত ঠিক সময় এলেই আমাদের এত

দিন কার অপেক্ষা শেষ হয়ে যাবে।' স্বাতী বলল-

'সারাজীবন আমায় ভালোবাসবি তো?' রবি বলল

-'বিশ্বাস আছে তো আমার ওপর?' স্বাতী বলল

-'তুই যে কতটা বিশ্বাসী সেটা আজ আমায় আর 

একবার বুঝিয়ে দিলি।' কথাটা বলে স্বাতী রবির

কপালে খুব গভীরভাবে চুম্বন করে তার বুকের

বালিশে মাথা রাখলো।রবি বলল-'এই রাতটা

যেন বিরাট হয় ইশ্বর।' স্বাতী বলল-'হুম।আমি একটু

নিশ্চিন্তে ঘুমোতে চাই।'দীর্ঘক্ষন কথা বলতে বলতে

তাদের চার চোখের পাতায় প্রশান্তি নেমে আসলো।