Silpa Ghosh

Inspirational

2.8  

Silpa Ghosh

Inspirational

আটপৌরে মা

আটপৌরে মা

5 mins
4.5K


#আটপৌরে_মা

#মুক্তধারা_মুখার্জী

তালা খুলে ঘরে ঢুকে কোনোমতে স্কুলের জুতোটা খুলে স্কুলের জামাকাপড় পরেই খাটের ওপর প্রায় আছড়ে পড়লো দিয়া। কান্নায় ভেঙে পড়লো। স্কুলে পরীক্ষার সময় অন্তত সকলের মা কিংবা বাবা যায়। অথচ তাঁর মা বাবা দুজনের কেউই যায়না। আজ প্রথম নয়, কোনোদিনই যায়না। বাবার অফিস আর মা কেন জানিনা কোনোদিনই যায়না। তার পড়াশোনা হোমওয়ার্ক কিছুই দেখতে হয়না। চিরকালই পড়াশোনায় দিয়া মনোযোগী আর ভালো। তা বলে কি পরীক্ষার সময় একটু স্কুলেও যেতে নেই। এই তো আজ শেলী, রুম্পা, রিমা,অনুষ্কা সকলের মা বা বাবা এসেছে। স্কুল থেকে বেরিয়েই সব বকবক করতে করতে কি পেরেছে কি পারেনি বলতে বলতে বাড়ির রাস্তা ধরলো। আর সে একা বোকার মতো হাঁটতে হাঁটতে এলো। আজ মা থাকবেনা বলেই দিয়েছিল। মন্দিরে পুজো দিতে যাবে। আশ্চর্য্য! যেন কোন মাথাব্যথাই নেই । আর সব বন্ধুদের বাবা মা দিনরাত এক করে ফেলছে পরীক্ষা বলে। আর তার মা.....বারবার চোখ দুটো জলে ভরে যায় অভিমানে। ছোট্ট থেকেই দেখে আসছে মা যেন বড় নির্বিকার তাকে নিয়ে। শুধু খেয়াল রাখে খাচ্ছে কিনা,পড়ছে কিনা ব্যস। সারাদিন খালি এটা পরিষ্কার ওটা পরিষ্কার, নয়তো রান্নাঘরে রান্না করা আর ঠাকুরঘরে পুজো করা। সে স্কুলের গল্প করলেও ঠিক করে শোনেনা মা। সে কি এমন বড় হয়ে গেছে, সবে তো ক্লাস নাইন। দূর, কিচ্ছু ভালো লাগছেনা। চোখের জলে বালিশ ভিজতে ভিজতে কখন যেন ঘুমিয়ে পড়ে দিয়া।

অনেকক্ষন ধরে ডেকে ডেকে সাড়া না পেয়ে বাড়ির বারান্দার দিকে তালাটা খুলে তপতী দেবী ঘরে ঢোকেন। এই দিকের চাবিটা এইজন্যই সঙ্গে রাখেন। ঢুকে দেখেন দিয়া অঘোরে ঘুমোচ্ছে। থাক। একটু রেস্ট নিক। যা পড়াশোনার চাপ! বরং একটু কিছু পছন্দের জলখাবার বানিয়ে রাখি। ঘুম থেকে উঠে মনের মতো খাবার পেলে খুশি হবে মেয়েটা।এই ভেবে রান্নাঘরের দিকে পা বাড়ান। কে জানে কিরকম পরীক্ষা দিলো? ভালোই হবে নিশ্চয়ই। মনে মনে ভাবেন তপতী দেবী।

 ঘন্টাখানেক পর ঘুম থেকে উঠে দিয়া দেখে মা এসে গেছে। সে ঘুমিয়ে পড়লে ভগবান এসেও তাকে ডেকে তুলতে পারেনা তাই সবসময় বাড়ির বারান্দার দিকে একটা ডুপ্লিকেট চাবি সবাই সঙ্গে রাখে। তাড়াতাড়ি স্কুলের ড্রেস ছেড়ে ফ্রেশ হয়ে দেখলো মা তার পছন্দের চিঁড়ের পোলাও আর গাজরের হালুয়া বানিয়ে রেখেছে। খুব খুশি হলো দিয়া। মা ঠিক জানে সে কি খেতে ভালোবাসে, তার কখন কি চাই।তবু মা কেন এত সাধারণ এত ঘরোয়া, কারুর সাথে মিশতে পারেনা, কেন তার পড়াশোনা নিয়ে আগ্রহ দেখায়না কে জানে! এসব মনে পড়লেই মন খারাপ হয়ে যায় দিয়ার। 

দেখতে দেখতে দিয়া বড় হয়ে যায়। তার মা সাধারণ আটপৌরেই থেকে যায়। মেয়ের সাথে কোনোদিন কোনো বন্ধুত্ব গড়ে ওঠেনা উল্টে দূরত্ব বাড়ে প্রতিনিয়ত। দিয়ার অভিমানের তলায় চাপা পড়ে যায় মায়ের অপ্রকাশিত স্নেহ,মায়া,মমতা।

আজ দিয়াকে দেখতে এসেছে। পাড়ার একজন সম্বন্ধটা এনেছে। দিয়ার আরো পড়ার ইচ্ছে। কিন্তু দিয়ার বাবা চান ভালো পাত্র পেলে কালবিলম্ব না করে বিয়ে দিয়ে দায়মুক্ত হতে। দিয়া নিশ্চিত মাও নিশ্চয়ই তাই চায় । নয়তো সকাল থেকে তাদের জন্য লুচি তরকারি মিষ্টি ইত্যাদি বানাতে এত ব্যস্ত হতোনা মা। আর ঘর দোর সাজানো পর্দা চেঞ্জ করা....উফফ!যেন আজি বিয়ে। এদিকে ছেলের পড়াশোনা কি, কি চাকরী করে আর মানুষটাই বা কেমন কিছুই জানা নেই। 

"রান্নাবান্না একটু আধটু জানো তো? যদিও কাজের লোক আছে।কিছুই করতে হবেনা। তবু,ওই আর কি! হাজার হোক, বাড়ির বউ তো!"

বয়স্কা মহিলা মানে ছেলের বাবার মাইমা বললেন।

"হ্যাঁ, দিয়া সব পারে। বাকিটুকু বিয়ের আগেই ওর মা শিখিয়ে দেবে। আপনি চিন্তা করবেন না"।

বাবা বিগলিত হয়ে বললেন।

দিয়া অবাক হয়ে দেখছে তার অত্যন্ত উন্নতমস্তক কঠিন বাবা কেমন হাসতে হাসতে মিথ্যে বলছেন বিনম্রতার সঙ্গে। 

"আমাদের এরকম ঘরোয়া শান্ত মেয়েই দরকার। চাকরী করলে ঠিক সন্তান মানুষ হয়না জানেন তো?"

"ঠিক বলেছেন। আমিও তাই মানি। এইজন্যই তো আমার মিসেসকেও কোনোদিন চাকরি করতে দিনি। বিয়ের পর ঘরে থাকবে রান্নাবান্না করবে বাচ্ছা মানুষ করবে তাদের লেখাপড়া শেখাবে আর কি চাই বলুন? দেখছেন না দিয়া মা আমার কিরকম সহবত শিখেছে"।

"তা ঠিক। এখনকার দিনে নয়তো সব যা উড়নচন্ডী মেয়ে। ভয়ই লাগে। কতজনের সঙ্গে সব সম্পর্ক থাকে জানতে পারা সম্ভব নয়"।

"ঠিক। একদম ঠিক বলেছেন। ঐ জন্যই তো পড়া শেষ হতে না হতে বিয়ের চেষ্টা করছি। যত বেশি ডিগ্রী বাড়বে পাত্র পাওয়া মুশকিল আজকালকার দিনে জানেন? আর আমি মনে করি মেয়ের ডিগ্রী ছেলেদের থেকে একটু কম হওয়াই ভালো"।

দিয়া বিস্মিত তার বাবার মানসিকতায়। এসব সে কি শুনছে? এখনও কোন কল্পযুগে বিচরণ করছে তার বাবা। 

দুই পক্ষের সম্মতিতে দিয়ার মতামতের অস্তিত্বকে অস্বীকার করে তারা বিয়েতে রাজি হয়ে গেলেন। 

"আমার এই বিয়েতে মত নেই"।

চমকে তাকায় দিয়া আর ঘরের বাকি সবাই। ঘরের মধ্যে উপস্থিত অত্যন্ত সাধারণ এক মহিলার চোখেমুখে দৃঢ়তার ছাপ স্পষ্ট।

"তোমার কি মাথা খারাপ হয়ে গেল? কি বলছো তুমি জানো?"

ক্রুদ্ধ দিয়ার বাবা গর্জে ওঠেন।

"জানি। না বোঝার তো কিছু নেই। সারাজীবন তোমার দাসীবৃত্তি করেছি মানে এই নয় আমার বোধবুদ্ধিও ভোঁতা হয়ে গেছে। ভুলে যেওনা আমিও বিয়ের আগে এক কালে চাকরী করতাম। আমিও পড়াশোনায় যথেষ্ট ভালো ছিলাম। শুধু তুমি পায়ের তলায় দাবিয়ে রাখবে বলে আমার সবকিছু বিসর্জন দিয়ে আমাকে ঘরের কাজের লোক বানিয়ে এনেছিলে। কিন্তু ভাবলে কি করে একই জিনিস আমি আমার মেয়ের সাথে হতে দেব?"

দিয়া গলার কাছে কি যেন একটা দলা পাকিয়ে উঠছে।

তপতী দেবী বলে চলেছেন,

" মেয়েকে আমি নিজের মনের মতো করে মানুষ করেছি। মিথ্যে বলতে শেখাইনি। স্বাবলম্বী করার চেষ্টা করেছি। কোনোদিন এইজন্য আতুপুতু করে মানুষ করিনি যাতে শিরদাঁড়া ওর শক্ত হয়। হয়তো আজ বাবার সম্মানার্থে দিয়া চুপ করে রয়েছে। কিন্তু আমি থাকবোনা তা বলে।

 রান্নাঘরটা শুধুমাত্র মেয়েদের পরিচিতি নয়। আর বাচ্চা উৎপাদন করার যন্ত্র মেয়েরা নয়। একটা বাচ্চা যখন দুজনের সহযোগিতায় পৃথিবীতে আসে তখন তার সবরকম দায়িত্বও দুজনের। যেমন চাকরী করাটা একমাত্র পুরুষদের দায়িত্ব নয়। মেয়েরাও যথেষ্ট সুযোগ্যা তারাও একজন পুরুষের দায়িত্ব নিতে পারে। ছেলে চাকরি করলে তবেই মেয়ের বিয়ে সম্ভব উল্টোটা হলে নয়। কেন? শুধুমাত্র এই কারণে কত ভালোবাসা অঙ্কুরেই বিনষ্ট হয়ে যায়। একটা মেয়ে চাকরী করবে কি করবেনা সেটা সম্পূর্ণ তার ব্যক্তিগত মতামত। কিন্তু চাকরী করলে সন্তান মানুষ হয়না এরকম ভ্রান্ত ধারণা নিম্নরুচির মানুষের ক্ষেত্রেই সম্ভব। বাইরের কঠিন বাস্তবকে নিজে চিনলে তবেই একজন মা তার সন্তানকেও সেইভাবে শেখাতে পারবে।সন্তান মানুষ করার জন্য বাস্তবের সাথে পরিচিত হওয়া বিশেষ প্রয়োজন। নয়তো সারাজীবন রূপকথার জগতেই সন্তানকে ভাবতে শেখাবে তার মা। তারপর আপনাদের মতো নিম্ন মানসিকতার পরিবারে বিয়ে দিয়ে বাস্তবের খাদে ফেলে দেবে নিজের সন্তানকে।

ঠিক যেমন আমার স্বাধীনতা খর্ব করে আমাকে সংসারের জাঁতাকলে ফেলে দেওয়া হয়েছিল কিন্তু আমার মেয়ের ক্ষেত্রে সেটা হতে দেবোনা। আমি ওকে কোনো বাড়ির কাজের লোক করে নিয়ে যাওয়ার অনুমতি কাউকেই দেবোনা। আমার দিয়া কোনো বাড়ির শো কেসে সাজিয়ে রাখার প্রাণহীন জিনিস হয়ে থাকবেনা। তাই আপনারা আসতে পারেন,দরজা ঐদিকে"।

দিয়ার অভিমানের পাহাড় গলে চোখ দিয়ে অঝোরধারায় ঝরে পড়ছে। খুব ইচ্ছে করছে দৌড়ে গিয়ে জড়িয়ে ধরে তার অতি সাধারণ আটপৌরে মা কে।

(সমাপ্ত)


Rate this content
Log in

More bengali story from Silpa Ghosh

Similar bengali story from Inspirational