Anup Mukherjee

Inspirational

1  

Anup Mukherjee

Inspirational

আমি যে দেখেছি তারে

আমি যে দেখেছি তারে

3 mins
1.4K


আমার মেয়ে হাতছানি দিয়ে দমদম এয়ারপোর্ট সিকিউরিটির দরজার আড়ালে চলে গেলো। আমি দাঁড়িয়েই রয়ে গেলাম, হাতটা বেশ খানিকক্ষণ উঁচু ছিল,সে হয়তো দেখছে,হয়তো না। খানিক আরো অপেক্ষা, ফোন করে বলুক ওর সিকিউরিটি চেক, ইমিগ্রেশন হয়ে গেলে বাড়ি ফেরত যাবো। ওর তো জীবনের প্রথম প্লেন যাত্রা... হুঁ! জন্ম নেবার পর প্রথম। আমার স্মৃতি আমাকে ১৯ বছর আগে নিয়ে গেলো। ওর প্রথম আকাশে ওড়া,জন্ম নেবার আগের যাত্রা,যেদিন হয়তো আমি ওকে হারিয়েই ফেলতাম,যদি না ঈশ্বর আমার পাশে দাঁড়াতো।


আজ ১৯ বছর হয়ে গেলো, আমি নিউ ইয়র্ক থেকে কলকাতা এসেছিলাম। তার পর আর বেরোইনি। এয়ারপোর্টও দেখতে আসিনি, আজ প্রথম। সেই যাত্রা, নিউ ইয়র্ক থেকে কোলকাতা, মাঝে ফ্রাঙ্কফুর্ট এ ৯ ঘন্টা, আর সেই ৯ ঘন্টা আমি কোনো দিন ভুলবো না।


তিন বছর আগে ঘর বাড়ি ছেড়ে পাড়ি দিয়েছিলাম অজানার পথে নতুন ভালো ভবিষ্যৎ এর প্রতিশ্রুতির ওপর ভরসা করে। প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী তো কিছু পাইনি, কিন্তু জীবনটা নষ্ট হওয়ার আগে একটা আশ্রয় পাচ্ছিলাম। পেয়েছিলাম একটা পরিবার, আবার সময়ের আঘাতে সেটা হারাতেও হলো সেই অজানা দেশে। সেই অবস্থাতে দেশের মুখে পাড়ি দিয়েছিলাম, সাথে সন্তান, যে দুনিয়ার মুখে দেখবে আমার দেশে এসে।


মাথায় অনেক কিছু ঘুরছিলো, ঘোরটা কেটে গেলো বুঝতে পারলাম যে নামতে হবে, ফ্রাঙ্কফুর্ট এসে গেছে। ক্লান্ত শরীর নিয়ে নামলাম, কলকাতার প্লেন ৯ ঘন্টা পর। যে গেট থেকে যেতে হবে সেখানে গিয়ে কার্পেটে বসে গেলাম পা ছড়িয়ে। ৯ ঘন্টা অনেক। এদিক ওদিক কিছু কিছু যাত্রী শুয়ে বসে আছে, আমি থামে পিঠ ঠেকিয়ে নিজের কথা ভাবতে ভাবতে ঘুমিয়েই পড়লাম। যেদিন আমার স্বামীকে বলেছিলাম যে আমি মা আর ও বাবা হতে চলেছে, সেদিন নিজের খুশি ধরে রাখতে পারছিলো না। বললো, অফিস এ গিয়েই দু তিন দিনের ছুটি নিয়েই আসবে। কিন্তু কি জানতো সেদিন সে সারা জীবনের মতন ছুটি পেয়ে যাবে। অফিসে ডাকাতি হলো, তাতে ও প্রাণ হারালো। আমার সে দেশে কেউ নেই, পেটের সন্তানকে নিয়ে কোথাও যাবার জায়গা নাই, অগত্যা নিজের দেশের দিকে রওনা হতে হলো।


ঘুমন্ত অবস্থাতে ২-৩ ঘন্টা কাটলো। খিদে পাচ্ছিলো, পাশে একটা খাবারের স্টলে গেলাম, মেনু কার্ড দেখে বুঝলাম আমার সাধ্যের ভেতর কিছুও নেই। নিজের জায়গায় ফিরে গেলাম। আরো খানিক সময় কাটলো। আমার পুতুল আমার ভেতর থেকে খাবার চাইছিলো, আমার ক্ষমতা ছিল না কেনার। আরেকবার উঠে ঘুরে এলাম, যদি কিছু পাই। না, কিছু সম্ভব না। বসে গেলাম, পুতুলের সাথে কথা বলার চেষ্টা করলাম, 'চুপ করে থাক, একটু পরেই পরের ফ্লাইটে উঠেই কিছু খেতে পাবো।' আরো ২ ঘন্টা কাটলো কিছু করে। আর বোধ হয় পারছিনা। মাথা ঝিমঝিম করছে, পেটে টান ধরছে। ভয় হচ্ছে! অজ্ঞান না হয়ে যাই। একটু জল খেয়ে এলাম, শুধু কিছু মুহূর্ত কাটলো। আরো চার ঘন্টা! হয়তো পারবো না অথচ কিছু করার নেই। 


দেয়ালে ঠেসান দিয়েই চোখ বন্ধ করে বসে আছি, নিজের সত্তা হারিয়ে ফেলছি ধীরে ধীরে, হঠাৎ মনে হলো কানে বাংলা আসছে, কেউ কাঁধে হাত দিয়েই জিজ্ঞেস করছে, ''তুমি বাঙালি, বাংলা জানো?'' কেউ আমাকে নাড়া দিচ্ছে। চোখ খুললাম, একটি মেয়ে, আমার থেকে হয়তো একটু বড়ো হবে, কি জবাব দিলাম আমি জানিনা। সে বললো,

"তোমাকে দেখছি অনেকক্ষন এখানে বসে আছো, তোমার শরীর খারাপ বুঝতে পারছি, খাবার স্টলে ঘুরতে দেখলাম, কি খাবে বল?"

 আমি জবাব দিলাম,

"কিছু না ভাই, আমার কাছে তো খাবার টাকা নেই, প্লেনে চড়েই খাবো।"

 সে নিজের খাবার জলের বোতলটা আমাকে ধরিয়ে বলল,

"এটা ধরো, আমি আসছি।"


আমি আবার চোখ বন্ধ করে নিজের আঁধারে তলিয়ে যাচ্ছি, ওর বোতল থেকে এক ঢোক জল খেলাম। মাথা কাজ করছে না। একটু পর সে প্যাকেটে খাবার নিয়ে এলো। বললো,

"আমরা স্টাফ, আমাদের একটা ক্যান্টিন আছে সেখানে কম দামে খাবার পাই নিয়ে এসেছি তুমি খাও।"

 আমি বললাম,

"আমার তো টাকা নেই।"

 সে একটি মিষ্টি হেসে খাবারটা প্যাকেট থেকে বার করে একটা পিস আমার মুখে তুলে দিলো। বললো,

"তুমি খাও, সেটাই আমার পাওনা।"

 আমার চোখে জল, তার মুখটাও হয়তো পরিষ্কার দেখতে পারছিলাম না। প্যাকেটটা নিয়েই খেতে শুরু করলাম। সে আমার পাশে বসলো, আমাকে খেতে দেখছিলো। খানিকটা খাবার পর যেন হুঁশ এলো! পশে তাকালাম তাকে কিছু বলবো, ধন্যবাদ কি ভাবে দেব, কি বলবো, কিছু তো!! দেখি কেউ নেই। এদিক ওদিক তাকালাম, না কোথাও সে নেই। হয়তো সে অজ্ঞাত থাকতে আমার সাথে কথা না বলে চলে গেছে। হয়তো সে কেউ না, হয়তো সে সেই ঈশ্বরের পাঠানো একজন। হয়তো তার স্পর্শে আমি সেই অদৃশ্য কে দেখলাম! 


আমি কি তারে দেখলাম যাকে দেখা যায়না ?


উত্তর পাইনি, পাবনা, কিন্তু আমার পুতুল যে আজ রওনা হলো তার জীবনের উচ্চ শিক্ষার জন্য, তার জীবনে সেই একদিন চিরকালের মতন কিছু দিয়ে গেলো।


সেই অদৃশ্য ঈশ্বর এসে সেদিন আমার আর আমার পুতুলের প্রাণ রক্ষা করে ছিল।  

(সমাপ্ত)


Rate this content
Log in

Similar bengali story from Inspirational