Aditi Ghosh Dastidar

Inspirational

3  

Aditi Ghosh Dastidar

Inspirational

আজ যদি জীবনের শেষ দিন হয়

আজ যদি জীবনের শেষ দিন হয়

5 mins
39


শিক্ষকতায় থাকার জন্য বয়োসন্ধির ছেলেমেয়েদের সঙ্গে আমার দীর্ঘদিনের ঘনিষ্ঠতা। তাদের মনের ভেতরের নানা রকম দুঃখ, বিষাদ, আনন্দের মুহূর্তের খবর তারা অনেক সময় আমাকে দিয়েছে। তাতে বুঝেছি এই বয়েসে সাময়িক উত্তেজনার বয়েসে ওরা আচমকা অনেক কিছুই ভেবে বসে। আমরা বড়রা তার নাগাল পাই না। তাই আত্মহত্যার প্রবণতা দেখা যায় তাদের মধ্যে।

এখন পৃথিবী জুড়ে এই ছেলেমেয়েদের এই অবসাদ, মানসিক অস্থিরতা নিয়ে মনোবিদরা উদ্বিগ্ন। তৈরী হয়েছে পাশে থাকার, পরামর্শ দেবার নানা প্রতিষ্ঠান। তবে আমাদেরও দায়ভার কম নয়, এই ছেলেমেয়েরা তো আমাদেরই ঘরের।

আমরা মা বাবারা অনেক সময় বাচ্চাদের ঘিরে স্বপ্ন দেখি, আবার ইচ্ছে হলেই বদলে ফেলি নিজেদের। আর দাবি করি ছেলেমেযেরাও তার তালে তাল মিলিয়ে চলবে।তাদের মনে যে কি ঝড় ওঠে, ভালোবাসার ফল্গুস্রোত শুকিয়ে মরে যায় তার খবর আমরা তখন নেবার দরকার মনে করি না। নিজেদের আবর্তে ঘুরে মরি নিজেরা।

মধ্যবিত্ত মানসিকতা, স্বপ্ন, ছেলেমেয়েদের টানাপোড়েন এই বিষয়গুলোই ছিল আমার গল্প রচনার পিছনে।জানি না কতটা পেরেছি, কিন্তু চেষ্টা করেছি একটা ছেলের মনের টানাপোড়েনকে ফুটিয়ে তোলার।


হঠাৎ মাথায় কি করে প্রশ্নটা এলো নিজেই ঋজু বুঝতে পারলো না। অবশ্য ঋজুর কাছে এ ঘটনাটা নতুন নয়। মাঝেমাঝেই তার মাথায় উদ্ভট উদ্ভট চিন্তা ঘুরে বেড়ায়। কিন্তু আজ হঠাৎ কে যেন মনের মধ্যে থেকে বলে উঠলো, "ঋজু , আজ যদি তোমার জীবনের শেষ দিন হয়!"


রাতে বিছানায় শুয়ে ঘুম আসছিলো না। নানান এলোমেলো চিন্তার ফাঁক দিয়ে কখন যেন কথাটা মাথার মধ্যে ঢুকে পড়লো, আর ঘুম দিলো চটকে। 

আসলে ঋজু একটু ভাবুকগোছের। ওর বন্ধুরা বলে ও নাকি বাজারে গিয়ে টেনশন কেনে।

তবে সত্যি বলতে কি এমনিতে অত ভাববার সময় নেই ঋজুর জীবনে। কিন্তু গত কয়েকমাসে যা ঘটছে পৃথিবীর বুকে, তাতে ঋজুর মনে হয় হিমালয়ের চুড়োও বোধহয় ভাবনার তাপে গলে যেত।

কোত্থেকে এক বিচ্ছিরি ভাইরাস এলো। ঝামেলা পাকালো সব মানুষের জীবনে। তার মধ্যে ঋজুর স্কুলজীবনের শেষ বোর্ডের পরীক্ষার মাত্র দুটো পরীক্ষা বাকি রয়ে গেলো। কম্পিটিটিভ পরীক্ষাগুলোও পিছিয়ে গেলো। সব হবে নাকি দেড়-দু’মাস পরে।

মনখারাপ হলেও ঋজু নিজেকে বুঝিয়েছিল, সময় যখন পাওয়াই গেলো আরো ধারালো করা যাক নিজেকে। করছিলোও তাই।

কিন্তু আজ সন্ধ্যেবেলা মা যা বললো তাতেই তো ঋজুর মনে এই প্রশ্নের ঝড় উঠলো!


সেই ছোটবেলা থেকে ঋজু জানে ডাক্তার হবে।

কিভাবে জানি ওর মাথায় ঢুকেছিলো ডাক্তার হবার কথা। হয়তো মা-ই ঢুকিয়েছিল। কিন্তু সেই স্বপ্ন তার মনের মধ্যে এমনভাবে ঢুকে গেছিলো যে বরাবর ঋজু নিজেকে একজন ডাক্তার হিসেবে কল্পনা করেছে। ভেবেছে গ্রামে গিয়ে মানুষের সেবা করবে, দীনদুঃখীদের চিকিৎসার জন্যে তার হাতটি বাড়িয়ে দেবে। 

কিন্তু মা আজ সন্ধ্যেবেলা তাকে ডেকে বলল, "দেখো ঋজু, আমি ভেবে দেখলাম তোমার মেডিকেলের এন্ট্রান্স পরীক্ষাটা দেবার আর দরকার নেই।”

ঋজু তো আকাশ থেকে পড়লো! দিনের মধ্যে যে মা অন্তত পাঁচবার করে খোঁজ নেয় মেডিক্যাল-এর জন্যে ঠিকঠাক পড়ছে কিনা, সে আজ কি বলছে?

"কিছুদিন ধরেই ভাবছিলাম, কিন্তু বলিনি। এখন করোনার সময়ে পৃথিবীর যা অবস্থা, ডাক্তারদের জীবনের খুব ঝুঁকি। কত ডাক্তার চলে যাচ্ছেন অকালে। আমার একটা ছেলে। তাকে আমি সে ঝুঁকি নিতে দেব না!"

ঋজু হতবাক। বাবাও।

"কিন্তু সবাই যদি তাই ভাবে তাহলে তো দেশে ডাক্তারই থাকবে না!" বাবা বলে উঠেছিল।

"আমি অন্য কারুর কথা তো ভাববো না, আমার ছেলেকে নিয়ে আমি concerned ব্যস!"

"কিন্তু মা, ইঞ্জিনিয়ার হয়েও তো আমি মরে যেতে পারি, ধরো মাথায় বিম পড়ে, বা ইলেক্ট্রিকের শক খেয়ে।"

ঋজুর যুক্তি।

"বেশি পাকা পাকা কথা বোলো না ঋজু, কুষ্ঠীতে তোমার দীর্ঘায়ু আছে।''

"তাহলে তোমার চিন্তা কিসের,'' এবার বাবা।

"দেখো জেনেশুনে রিস্ক নেবার কোন মানে নেই, সব কিছু কি আর ফলে? এই যে ২০২০ সালটা এমন হবে কোনো জ্যোতিষী কি বলতে পেরেছিলেন আগে? আমি যা বলেছি তাই হবে,ঋজু ডাক্তার হবে না। এই আমার শেষ কথা।''

ঋজুর বুক থেকে গলা পর্যন্ত কান্নার দমক এলো। ও জানে মায়ের শেষ কথা মানে কি। আগে অনেক প্রমাণ পেয়েছে। তাই তর্ক করার কোনো মানেই হয় না।

এক ছুটে নিজের ঘরে চলে এসেছিলো। বাবা এসেছিলো অবশ্য পেছন পেছন। বুঝিয়েছিল যে পড়াশোনা ঠিকঠাক করে যেতে। পরীক্ষাও দিতে। তারপর না হয় ভাবা যাবে।

কিন্তু ঋজুর সব তালগোল পাকিয়ে যাচ্ছিলো। কি করে নিজের এতো দিনের প্ল্যান বদলাবে। কি করে বন্ধুদের কাছে মুখ দেখাবে।

খানিকক্ষণ বালিশে মুখ লুকিয়ে হু হু করে কাঁদলো ঋজু। মা অবশ্য সব সময় বলে ছেলেদের কাঁদতে নেই, কিন্তু মা তো এখন দেখতে আসছে না।


কান্নার পর মনটা হঠাৎ করে ফাঁকা হয়ে গেলো ঋজুর। আর অমনি টুক করে ভাবনাটা ঢুকে পড়লো।

'কি হবে ঋজু যদি কাল সকালে না থাকে।'

ভাবনাটা ঢুকেই মনে তালগোল পাকাতে লাগলো। ঋজু ভাবতে লাগলো কি কি ভাবে নিজেকে সরিয়ে ফেলা যায়! ভাৱতে ভাবতে কখনো নিজেই শিউরে উঠলো, কষ্ট এলো কেমন যেন গলার ভেতর থেকে দলা পাকিয়ে। তারপর আবার মায়ের ওপর রাগ হলো।

অনেকক্ষণ ধরে বালিশে মাথা রেখে ছটফট করতে করতে হঠাৎ ঋজুর মনে পড়লো মোড়ের বুড়ি ভিখারির কথা। যাকে ও রোজ ১০ টাকা দিতো। রতনদার দোকানে পাউরুটি ঘুগনি খেত বুড়িটা সেই টাকায়। লকডাউনের খবর জানতে পরেই নিজের জমানো টাকা থেকে তাড়াতাড়ি কিছু টাকা ঋজু রতনদাকে দিয়ে এসেছিলো, বুড়ির খাবারের ব্যবস্থা করার জন্যে। ঘরের অনেক শুকনো খাবারও দিয়ে এসেছিলো। সেই বুড়িমার কি হবে ঋজু না থাকলে?

মনে পড়লো বিন্তির কথা। কালীপুজোর সময় যখন দেশে ঠাকুমার বাড়ি যায় ওরা, পাশের বাড়ির ছোট্ট বিন্তি ওকে ভাইফোঁটা দেয়। এবছর কাকে দেবে? ঠাকুমা'ই বা কার জন্যে আচার বানাবে?

মনে পড়লো রাস্তার খোঁড়া কালো কুকুরটার কথা, যাকে রোজ ভোরে বারান্দা থেকে বিস্কুট ছুঁড়ে খাওয়ায় ঋজু। কে দেবে কাল সকালে ওকে খাবার?

আর মুনমুন? যাকে একটা কথা বলতে গিয়ে কতবার মেসেজ লিখেছে আর মুছেছে ঋজু। মুনমুন জানবেই না কোনোদিন ঋজু কতটা ভালোবেসেছিলো!

ঋজু কল্পনা করছিলো, খাটটা আছে, ও নেই তাতে। ওর এতো যত্নে সাজানো বই, পোস্টার, প্রিয় ল্যাপটপ সব সব পড়ে থাকবে কাল একলা তাই না?

ভাবতে ভাবতে ঋজুর মাথাটা গোলমাল হয়ে যেতে লাগলো। একটা অস্থিরতা তাকে পাগল করে তুললো যেন। ঘরের চারদিকটা আবার নতুন করে যেন দেখতে লাগলো ঋজু। তারপরই দেওয়ালে চোখে পড়লো গতবছর গোয়ায় বেড়াতে যাওয়া মা আর বাবার সাথে ওর ছবি। জল ছিটিয়ে দিচ্ছিলো ঋজু আর ওরা কেমন হাসছিলো। ঋজু না থাকলে মা বাবা কি আর ওমন করে হাসবে?

ভাবতে ভাবতেই আবার ঋজুর ভীষণ কান্না ঝাঁপিয়ে এলো দুই চোখে।

না আর ভাবনা নয়। ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার যাই হোক না কেন ঋজু ভবিষ্যতে, সে দেখা যাবে। কিন্তু কালকের সকালটা তাকে দেখতেই হবে।

ভাবতেই ঋজুর মনটা এক্কেবারে হালকা হয়ে গেলো পালকের মত!

চোখের পাতা আপনাআপনি ভারী হয়ে গিয়ে ঋজু তলিয়ে গেলো গভীর ঘুমে।


Rate this content
Log in

More bengali story from Aditi Ghosh Dastidar

Similar bengali story from Inspirational