বৃদ্ধাশ্রম
বৃদ্ধাশ্রম
বিছানা থেকে উঠতে গিয়েও আবার বসে পড়লেন সুরভী। বাতের ব্যাথাটা বড্ড জ্বালাচ্ছে আজকাল। মনমেজাজ খারাপ হয়ে যায়।
কোনোরকমে লোহার খাটের রেলিংটা ধরে টলমল পায়ে উঠে দাঁড়ালেন। দরজা দিয়ে ঘরের বাইরে বেরিয়ে অবশ্য উঠোনজোড়া রোদ দেখে মনটা ভালো হয়ে গেল। সামনেই বাগানের মধ্যে একদল কচি মুখের বৃদ্ধ-বৃদ্ধাদের হই-হুল্লোড় করে মাটি কোপানো, গাছের গোড়ায় জল-সার দেওয়া দেখে পায়ের যন্ত্রণা ভুলে সিঁড়ি বেয়ে নিচে নামতে শুরু করলেন।
ওনার দিকে নজর পড়তেই রানু প্রায় ছুটে সামনে এসে বলল, "সুরভীদি, তুমি আবার বাগানে নামছো! অমলা জানলে খুব রাগ করবে। এক্ষুনি ঘরে গিয়ে আবার শুয়ে থাকো।" সুরভী মুখ গোমড়া করে আর্দ্ধেক সিঁড়ি নেমেই দাঁড়িয়ে রইলেন। সেই দেখে অভয় বাবু ওদিক থেকে গলা তুলে বললেন, "অমলার কড়া হুকুম, আপনাকে দেখলেই যেন থানায় খবর দিই।" বলে নিজের রসিকতায় নিজেই হাসতে লাগলেন। প্রথমে বিরক্তি বোধ করলেও তাঁরজন্য এদের উৎকন্ঠা দেখে মনে মনে একটু স্বস্তি বোধ করলেন সুরভী। সংসার থেকে বিতাড়িত হয়েও যে শেষ বয়সে রাস্তা-ঘাটে মরে পড়ে থাকতে হবেনা এটাই শান্তি। বাকি সিঁড়িকটা ধিরে ধিরে নেমে স্বগতোক্তি করলেন, "যাই গিয়ে অমলার সাথে কথা বলে আসি, এই মেয়েটা আমায় দেখছি শয্যাশায়ী করেই ছাড়বে।" বলে প্রধান দরজার বামদিকে অফিস ঘরের দিকে চললেন।
অমলা এই 'শেষের কবিতা' বৃদ্ধাশ্রমের ম্যানেজার। বয়স চল্লিশোর্ধ হলেও এই আশ্রমের আবাসিকদের কাছে ছোটো মেয়ের মতোই আদরের। যেভাবে বুক দিয়ে সবাইকে আগলে রাখে তার তুলনা হয়না। মেয়েটা বড্ড অভাগী, স্বামী অন্য মহিলার সাথে সংসার ফেঁদেছে বলে এই বৃদ্ধাশ্রমে চাকরি নিয়েছে। রাতদিন এক করে সকল আবাসিকদের স্বাচ্ছন্দ্যের দিকে নজর রাখে। যেখানে এই বৃদ্ধাশ্রমের কোনো আবাসিকের খরচ করার সাধ্য নেই; এই আদর-যত্ন তাদের কাছে পরম প্রাপ্তি। একটা স্বেচ্ছাসেবী সংস্হা এই বৃদ্ধাশ্রম পরিচালনা করে। আবাসিকদের যার যা সাধ্য দেয় আর সাথে নিজেরাই বাগানে ফল-সব্জী ফলিয়ে বা বেতের ঝুড়ি বানিয়ে কিছু আয় করে আশ্রমের খরচ চালানোর জন্য। সত্যি বলতে এরা বাড়ির থেকে আনন্দেই থাকে এখানে। সুরভী সন্ধ্যেবেলা সকলকে রবি ঠাকুরের গান শেখায়। এক আনন্দঘন পরিবেশ আছে এখানে, আর আছে অপার শান্তি।
হাঁটু সামলে নুড়ি বেছানো পথ দিয়ে অফিস ঘরের বারান্দায় গিয়ে উঠলেন সুরভী। ভেতর থেকে একজন মহিলার স্বর শুনতে পেলেন। সেই মহিলা বেশ কান্নাভেজা গলায় বলছেন, "...সেই মেয়ে বুঝলেন ম্যাডাম, সেই পেটের মেয়েই এমন কাজ করল। জামাইয়ের কোনো দোষ দেখিনা বুঝলেন? সে সাতে পাঁচে থাকেনা কখনোই। আমার মেয়েরই সব দোষ। আমি কখনো ভাবতে পারিনি যে আমার নিজের মেয়ে আমাকে ঘরছাড়া করবে। সব লিখিয়ে নিয়ে, মা গো..." বলে কান্নায় ভেঙ্গে পড়লেন।
সুরভীর এই গলাটা এতোটাই চেনা লাগলো যে ও নিজের স্বভাব ভুলে জানলা দিয়ে উঁকি মেরে মহিলাকে দেখতে চেষ্টা করল। পেছন থেকে এক কাঁচা-পাকা চুলের মোটাসোটা বৃদ্ধাকে টেবিলে মাথা নুইয়ে বসে থাকতে দেখল। ততক্ষণে অমলার সুরভীকে নজরে পড়েছে। সে জোরে বলে উঠল, "সুরভী মাসিমা ওখানে দাঁড়িয়ে আছেন কেন? ভেতরে আসুন।"
অমলার গলা শুনে ওর সামনে বসা মহিলা মাথা উঁচু করে ঘাড় ঘুরিয়ে এদিকে দেখল। সেই মুখ দেখে সুরভীর মাথা ঘুরে গেল। কোনোরকমে দেওয়াল ধরে দাঁড়িয়ে কাঁপতে লাগল। অমলা ছুটে এসে সুরভীকে ধরে দেওয়ালের পাশের বেঞ্চিতে বসিয়ে দিল। নতুন আগন্তুক মহিলা ধির পায়ে উঠে এসে সুরভীর পায়ের কাছে বসে পা জড়িয়ে ধরে, "আমায় ক্ষমা করে দাও দিদি।" বলে কাঁদতে লাগল। অমলা কিছু বুঝতে না পেরে জিজ্ঞাসু চোখে দুজনের মুখের দিকে বারংবার তাকাতে লাগল।
সেই মহিলা অমলাকে উদ্দেশ্য করে বলল, "ম্যাডাম, আমি সুরভীদির একমাত্র বেয়ান। ওঁর ছেলের সাথেই আমার মেয়ের বিয়ে হয়েছে। আমার ষড়যন্ত্রের জন্যেই দিদি আজ ঘরছাড়া। ওপরওয়ালার নির্ভুল পরিকল্পনায় সেই মেয়ে আমাকেও নিঃস্ব করে দূর করে দিয়েছে।" বলে আবার ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদতে লাগল।
সুরভী নিজেকে সামলিয়ে নিয়ে ওঁর হাত ধরে বললেন, "সব ভুলে যাও দীপা। আজ থেকে তুমি আমার সর্বক্ষণের সঙ্গী হলে।"
অমলা একবার মৃদুস্বরে বলল, "আসলে জায়গা ফাঁকা আছে কিনা..." সুরভী হেসে অমলার দিকে তাকিয়ে বলল, "আমাদের সংস্হা তো উলের কাজ জানা একজন কাউকে রাখবে বলছিল। দেখোনা দীপাকে নেওয়া যায় কিনা। ওর মতো উলের কাজ খুব কম লোক জানে।"
দীপা কৃতজ্ঞতায় নুয়ে চোখের জল ফেলতে ফেলতে বিড়বিড় করে বলে উঠল, "নিজের পাপের ফল আজ নিজেই ভোগ করছি। এই মানুষকেই আমি ঠকিয়েছি। নরকেও আমার স্হান হবেনা।"
সুরভী শান্ত স্বরে বললেন, "এটা সংসারের ঝামেলা মুক্ত স্বর্গ। এখানে নরকের নামও নিওনা। এই বেশ ভালো আছি সমবয়স্ক বন্ধুদের সাথে। তুমিও দেখবে কেমন কাজের মধ্যে দিয়ে দিন কেটে যাবে।"