প্রত্যাবর্তন

শৈল শহর সিকিম, ঠান্ডাটা বিকেলের দিকে একটু জাকিয়েই পড়েছে। কলকাতার আবহাওয়ায় থাকা আমাদের মত বাঙালির কাছে যথেষ্টই। কিন্তু এসব সত্ত্বেও পাহাড়ের বিকেলটার একটা আলাদা সৌন্দর্য আছে, যা সহজে কেউ হাতছাড়া করতে চান না। পড়ন্ত রোদের পাহাড় - অনেকটা তার টানে কখন যে ঘর ছেড়ে বাইরে এসে দাঁড়িয়েছি সন্মোহিতের মত, বুঝতে পারিনি। পুরো মনটা সূর্য অস্তের মধ্যে ডুবে ছিল। হঠাৎ পিছন থেকে নারী কন্ঠের আওয়াজে সম্বিত ফিরলো।

ঠান্ডা লেগে যাবে তো , গায়ে কিছু জড়াওনি কেন?" একটু চমকে গেলাম। পেছনে তাকিয়ে দেখি বারান্দায় মঞ্জুলা দাঁড়িয়ে।

- "তুমি উঠে পড়েছ? কখন এলে? বসবে এখানে?" 

আমি সবুজ মখমলের মত লনে ছড়িয়ে রাখা একটা বেতের চেয়ারের দিকে আঙুল তুলে বললাম।- "হ্যাঁ। বসবো। তার আগে একটু চা দিতে বলি? খাবে?"

আমি ঘাড় হেলাতেই ধীর পায়ে ভেতরে চলে গেল মঞ্জুলা। একটা জংলা ছাপ কুর্তি উপরে গরম কাশ্মীরি শাল পড়ে। মুহূর্তের জন্য আমার মনে হলো ওর পায়ে এক জোড়া নূপুর যেন বড্ড মানাতো এখন। এই ধীর স্থির চলাফেরায় একটা আলাদা ছন্দ এনে দিত। ভাবনা আমার স্বভাব। ভাবতে ভাবতেই দূরের পাহাড়ে সূর্যাস্তের মুহূর্তের বিষণ্ন ছায়া দেখতে পাচ্ছিলাম আমি। একটু অন্যমনস্ক হয়ে পড়েছিলাম। কাঁধে একটা হাতের স্পর্শে ঘুরে দেখে বুঝলাম মোটা জ্যাকেটটা এনে দিয়েছে মঞ্জুলা । নিজে একটা গরম চাদর পায়ের উপরে জড়িয়ে একটু গুটিসুটি মেরে বসলো চেয়ারে।আমি জিজ্ঞেস করলাম ওকে- "বিকেলের ওষুধটা খেয়েছো?"- "হ্যাঁ। আজকে মনে ছিল।" একটা খুব মিষ্টি হাসি আমাকে উপহার দিয়ে বললো ও। তারপর ব্যস্ত হয়ে পড়লো টি-পট থেকে চা ঢালতে। 

সিকিমের একটা পাহাড়ের ওপরের বাগান ঘেরা বাংলোয় আছি আমরা, গত আড়াই মাস ধরে। জায়গাটার নামটা এত অদ্ভুত, মনে থাকেনা কিছুতেই। একটা গাড়ি নেওয়া আছে এখানে। মাঝে মধ্যে বাজারে বেরিয়ে যাই সপ্তাহের কোনো এক দিন। একটু আধটু দরকারি চাল তেল নুন আনতে, বাকি সবজিপাতি বাগানেই হয়। সেই দিয়েই চালিয়ে নেওয়া হয়। একটা চৌকিদার আছে, সে-ই মালির কাজ করে। আর তার বউ রান্নাবান্নার দিকটা সামলায়। মঞ্জুলা খুব একটা ঘেঁষেনা ওদিকে। যা দেয়, তাই চুপচাপ খেয়ে উঠে পড়ে। আর আমার অখন্ড অবসর। মাঝে মধ্যে একটু আধটু বোতল খুলে বসি। একা একাই পান করি, মঞ্জুলা হাসে শুধু পাশে বসে। আমি অপেক্ষা করি ওর উচ্ছল হয়ে ওঠার, কিন্তু ও আবার চুপ হয়ে যায়। দূরের দিকে তাকিয়ে থাকে। আর কি যেন ভাবে শুধু বসে।ওর এই নিশ্চুপ চেহারা দেখতে দেখতে আমিও হারিয়ে যাই ফেলে আসা দিনগুলোর স্মৃতির মনের অ্যালবামে :

- "কিরে রাজদা , চল চল খেলতে যাবো, চল না।" 

- "আরে ধুর, জানিস তো আমার ভালো লাগেনা, কেন ঝামেলা করছিস?"

- "তোর ভালো না লাগলেই বা কি, বয়েই গেছে আমার। আমি বলছি বলে যাবি, ব্যস।"

- "দাঁড়া কাকিমা কে বলে দিচ্ছি, মজা বুঝবি।"

- "ইশঃ আমিও বলবো তুই স্কুলে লুকিয়ে বই পড়ছিলি ক্লাসে বসে।"

- "কি বদমাস মেয়ে রে তুই। মিথ্যে বলবি?" 

- "তাহলে চল খেলতে।" 

- "উফ, শান্তিতে একটু গল্পের বইটাও শেষ করতে দেবেনা।- "কিগো, ঘরে চলো।"

মঞ্জুলার গলা শুনে চোখ তুলে তাকালাম, বর্তমানে ফিরেও এলাম । ওর বড় বড় চোখের পাতাগুলো আর নিষ্পাপ মুখটা দেখে ইচ্ছে করছিল জড়িয়ে ধরি। পরক্ষনেই নিজেকে সামলালাম। কারোর অসহায়তার সুযোগ নেব, এটা ভাবলাম কি করে? হোক না সে আমার সবচেয়ে কাছের মানুষ।একটু ফ্যাসফেসে গলায় বললাম, - "আজকে একটু খাই? ঠান্ডা লাগছে তো। বোতলটা আনতে বলবে ভেতর থেকে? আর সাথে কিছু?" 

একটু চুপ করে আমার দিকে তাকিয়ে ধীর পায়ে আবার সেই ছন্দ মিলিয়ে ভেতরে চলে গেল মঞ্জুলা । আবারও আমি তাকিয়ে রইলাম ওর যাওয়ার পথের দিকে। ভাবতে চেষ্টা করছিলাম, ওর কি সত্যি কোন অবস্থার উন্নতি হয়েছে এখানে এসে? দমচাপা ভাবটা কি কম মনে হচ্ছে একটু? ওর কি জীবনে আবার একটু হলেও বাঁচার ইচ্ছা জাগছে?

নাহ্, আপনারা যা ভাবছেন তা নয় একদমই। আমি মোটেই বদ্ধ মাতাল নই, বা নিজের স্ত্রীকে নিয়ে মধুচন্দ্রিমা যাপনের জন্য এই নির্জন পাহাড়ে বাংলো ভাড়া করে দিন কাটাচ্ছি না। আমি একজন প্রথিতযশা মনোরোগ বিশেষজ্ঞ। আর মঞ্জুলা আমার একজন রোগিনী মাত্র। না, শুধু মাত্র এই কথাটা বোধহয় খাটে না এই ক্ষেত্রে। মাঝে মাঝেই আমাদের ফেলে আসা রঙিন কৈশোরে চলে যাই আমি আজও, মঞ্জুলাকে সামনে দেখলে। 

তখনকার বিহার, বর্তমান ঝাড়খণ্ডের রাঁচি শহরে আমাদের দুই পরিবার থাকতো পাশাপাশি। আর আমাদের দুজনের বন্ধুত্বের সেই শুরু এবং হয়তো বা শেষও। কোন অজ্ঞাত কারনে সেই ছোট থেকেই মঞ্জুলা ধারণা করিয়ে দিয়েছিল ও একান্তই আমার, শুধুই আমার । আর সেটা আমার মনের ভেতরে বদ্ধমূল হয়ে বসেছিল চিরকাল। কিন্তু শহর বদলের সাথে সাথে আমাদের যোগাযোগেও ইতি ঘটে গেছিল তখনকার মত।

মঞ্জুলাকে খুঁজে পেলাম হঠাৎ মাসছয়েক আগে। কয়েকটা বেসরকারি উন্মাদআশ্রমে আমি নিজের তাগিদেই শ্রমদান করি। কিছুটা কম সময়ের জন্য হলেও। একটি নতুন রোগিণীর আবির্ভাব সেখানে রোজকার ঘটনা, তবে অদ্ভুত লেগেছিলো তখন, যখন সেই রোগিনীদের মধ্যে একজন হঠাৎ আমার ছেলেবেলার নাম ধরে ডেকে ওঠে আমায়। মারাত্মক রকমের চমকে উঠেছিলাম সেদিন। নোংরা, উস্কোখুস্ক চুল, অর্ধনগ্ন একজন উন্মাদ রোগিনী আমাকে ডাকছে দেখে আশ্রমের ভেতরেও কর্মীরা অবাক হয়েছিল সেদিন। বারবার আসার চেষ্টা করেছিল আমার কাছে। কিন্তু ওর ঘোলাটে দৃষ্টি আমাকে আটকে দিচ্ছিল বারবার।

আমি অফিসে ফিরে এসে ফাইল দেখে সেই রোগিণীর নাম বের করেই খেলাম দ্বিতীয় চমক। জানা গেল, বাড়ির লোকেরাই ধরে বেঁধে দিয়ে গেছে এখানে ভর্তি করে। সপ্তাহ খানেক হলো। কোনো যোগাযোগের দূরভাষ না থাকায় ঠিকানাটি পকেটে করে নিয়ে বেরোলাম সত্যসন্ধানের আশায়। ততক্ষণে আমার নির্দেশে ওকে ধরে বেঁধে পরিষ্কার করে জামাকাপড় পরিয়ে আনা হয়েছে। বিড়বিড় করতে থাকা মুখ আর ঘোলাটে চোখের ভেতরে থেকেও মঞ্জুলাকে খুঁজে পেতে আমার কোন অসুবিধাই হলোনা এবার। আর আমার দিকে তাকিয়ে হাঁসা, হাসিটা সেই ছোটবেলার মতই লাগলো।

ওর ফাইল ঘেঁটে বেশি কিছু পেলাম না চিকিৎসা সংক্রান্ত, কিন্তু ওর অবস্থা দেখে আমার ডাক্তারি জ্ঞান বলছিল, কমপক্ষে অন্তত বছরখানেক বিনা চিকিৎসায় ছিল। অতীতের ইতিহাস না জানা গেলে শুধু ওষুধে মনোরোগ সারে না সবসময়। ভালোবাসা ও সহমর্মী কাছের মানুষের খুব প্রয়োজন হয়। আমি পরের দিন ঠিকানায় গিয়ে তাজ্জব হয়ে গেছিলাম। বাড়ি বন্ধ ছিল, আর একজন প্রতিবেশী উপযাচক হয়ে আমাকে জানিয়েছিল যে, বাড়ির পাগল বউকে নিয়ে নাকি ওনারা কাশী গেছেন কিছুদিন আগে। যেই বউয়ের পরপর দুবার সদ্যজাত কন্যাসন্তান জীবিত থাকে না, আর তার পরে বদ্ধ উন্মাদ হয়ে যায়, সেই বউকে কি আর শ্বশুরবাড়ি রাখতে পারে?

বাড়ি তালাবন্ধ হওয়ায় আমি কারোর সাথে যোগাযোগ আর করতে পারিনি ঠিকই, কিন্তু কোন কারণে মঞ্জুলা যে শ্বশুরবাড়িতে চক্ষুশূল, আর তাঁদেরই কোন করা ব্যবহার যে ধীরে ধীরে মঞ্জুলাকে এই পথে ঠেলে দিয়েছে, সেটা বেশ বুঝতে পারছিলাম তখনই। ওর মা বাবার খবরও ও কিছু জানে না, না সেসব ও জানতে বুঝতে পারে। যোগাযোগ করারও কোন উপায় বা পথ খোলা ছিল না আমার সামনে।

তখনই সিদ্ধান্তটা নিয়ে নি। পুলিশের কাছে একটা FIR করি। আমার নিজের কাজের জগতের সূত্রে চেনা এবং জানাশোনা আরো কিছু ভালো এবং বড় মনোরোগ বিশেষজ্ঞদের সাথে কমিটি করে যতটা সম্ভব সমস্যার সমাধান করার চেষ্টা করি। সবার শেষে, শুধু মঞ্জুলার জন্যই আমার দীর্ঘ দিনের পরিশ্রমের তিল তিল করে তৈরি করা পসার, রোগীদের সারি, আর অসংখ্য আমার দিকে চেয়ে থাকা মানুষদের ছেড়ে আমি এই নির্বান্ধব অবস্থায় এক অসহ্য সুন্দর পাহাড়ে এসে থাকছি গত কয়েকমাস ধরে। মঞ্জুলার স্বামী হয়ে। অন্ততঃ মঞ্জুলা তেমনই জানে।

যখন সম্পূর্ন উন্মাদ মঞ্জুলাকে আমি আশ্রম থেকে আমার ফ্ল্যাটে নিয়ে আসি, তখনই ও হঠাৎ নিজের থেকে অনেকটাই বদলে যেতে থাকে। খুব হাই প্রোফাইল সমাজের উচ্চবিত্ত বাসস্থানে থাকা সত্ত্বেও পড়শীদের চোখ এড়াতেই এভাবে তড়িঘড়ি পাহাড়ের প্ল্যান করে চলে আসা আমার। ওর যে একটু ভালোবাসা আর অনেকটা মানসিক সাহায্যের প্রয়োজন সেটা বুঝে আমি কলকাতায় থাকার সময়েই অনেকটা সময় ওকে দেবার চেষ্টা করতাম, নিজের ব্যস্ততা কমিয়ে এনে এনে। আর এখন, আমার সমস্ত সময় ওরই জন্য। যার ফল আমি দিন দিন দেখতে পাচ্ছি চোখের সামনে, গত আড়াই মাস ধরে। 

সুস্থ হয়ে উঠছে আমার মঞ্জুলা । কিন্তু সমস্যা একটাই। পুরোনো কথা কিছুতেই মনে করতে পারছে না। যেন এটাই ওর সংসার, আমিই ওর আসল স্বামী, আমরা অনন্তকাল মধুচন্দ্রিমায় এখানেই থাকছি। এটা একটা সাংঘাতিক এফেক্ট আমার মনে ফেলছে। মঞ্জুলাকে ভীষণ ভাবে চাওয়া সত্ত্বেও আমি ওর পুরোপুরি সুস্থতার অপেক্ষা করে যাচ্ছি, আর নিজেকে খুব ধীরে ধীরে অবসাদের রাস্তায় ঠেলে দিচ্ছি। বুঝতে পেরেও কিছু করতে পারছি না, ওর অমোঘ আকর্ষণে।

রাতে খাবার পরে ঘরের ফায়ারপ্লেসের পাশে বসে একটা বই পড়তে পড়তে কখন যে ঘুমিয়ে পড়েছিলাম, মঞ্জুলার ধাক্কায় ঘুম ভাঙ্গলো আমার। উঠে গিয়ে বিছানায় শুতেই পাশে মঞ্জুলাকে অনুভব করলাম আমি, ধরে ধরে শুইয়ে দিচ্ছে পরম মমতায়। আর আমার এতদিনের সমস্ত প্রতিজ্ঞা খড়কুটোর মত উড়ে গিয়ে আমি দখল নিলাম ওর। মঞ্জুলার কোন প্রতিরোধ / অবরোধই সফল হলো না আর সে রাতে।

সকালে উঠে বিছানায় শুয়ে ছিলাম, হঠাৎ বিদ্যুৎচমকের মত মনে পড়ে গেল আগের রাতের ঘটনা। নিজের ভেতরের অবসাদ, না নেশার ঘোর - কি আমাকে এতটা নিচে নামাতে পারলো, সেটা ভেবে আমি মঞ্জুলার মানসিক অবস্থা নিয়ে চিন্তিত হয়ে উঠলাম আবার। ধড়ফড় করে উঠতে যেতেই চৌকিদারের বউ চা নিয়ে এলো আমার জন্য, বিছানায় চা খাবার অভ্যেস আমার একার জীবনে কোনোদিনই ছিলনা, এখানে এসে ধরিয়েছে মঞ্জুলা ।

চা শেষ করতে করতে আমি অবশ্যকর্তব্য ভাবতে লাগলাম। কিভাবে মুখোমুখি হবো মঞ্জুলার ? এখানে সবাই আমাদের স্বামী-স্ত্রী বলেই জানে, সেই জন্য আমাদের আলাদা শয্যা। প্রথম দিকে একটু ঘড়িতে দেখলাম বেশ অনেকটাই বেলা হয়ে গেছে ইতিমধ্যে। বাথরুমে গিয়ে দেখলাম পরিষ্কার জামাকাপড় গুছিয়ে রাখা অন্যান্য দিনের মতোই। কিছু বুঝতে না পেরে হতবুদ্ধির মত স্নান সেরে বাইরে বেরোলাম। একটু অন্য ঘরগুলোতে উঁকি মেরে মঞ্জুলার কোন হদিস না পেয়ে গুটি গুটি পায়ে বাইরের লনের চেয়ারে গিয়ে বসলাম। প্রতিদিনের মতোই শিশির মোছা পরিষ্কার হয়ে থাকা চেয়ার আমার অপেক্ষায়। সাথে সেই বইটা, যেটা আগের রাতে পড়ছিলাম। প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই পেছনে একটা নূপুরের আওয়াজে চমকে তাকিয়ে দেখলাম মঞ্জুলা , হাতে ব্রেকফাস্টের ট্রে। মঞ্জুলার সহজ ব্যবহার আমাকে একটু অবাক করছিল তখন। হঠাৎ ও বলে উঠলো,

- "আমরা ফিরব কবে?" 

- "কোথায়?"

- "কেন কলকাতায়?"

- "তুমি যেদিন বলবে"

- "তাহলে চলো, কালকেই ফিরি। আর ভালো লাগছে না আমার এখানে।"

- "মঞ্জুলা ?"

একটু ভারী স্বরে ডাকলাম আমি।ও বললো, - "হ্যাঁ বলো, কি বলছো ?"- "কাল রাতের জন্য সরি। আমি আসলে, কি যে হয়ে গেল।"

- "কিন্তু যা হয়েছে সেটাকে কি তুমি বদলাতে পারবে?"- "না পারবো না জানি, কিন্তু তুমি, মানে আমি জানি খুব বাজে হয়ে গেছে, তুমি কি সেই জন্যই যেতে চাইছো? আমি সত্যি বলছি আমি দুঃখিত, তুমি যা শাস্তি দেবে আমাকে, আমি মাথা পেতে তা নেব, কিন্তু রাগ করে থেকোনা, প্লিজ।"- "সেই জন্যই ফিরতে চাইছি রাজদা । কিছু কথা আমারও আছে তোমাকে জানানোর। আমি ভয়ানক চমকে উঠলাম মঞ্জুলার কথা শুনে। ওর কি তাহলে সব মনে পড়ে গেছে? ওকে আমার এখানে নিয়ে আসা সার্থক তাহলে? পরমুহূর্তেই আমার ডাক্তারি সত্তা জেগে উঠলো আত্মপ্রসাদের সাথে।

- "কি জানাবে বলোতো?" 

- "যেটুকু তুমি জানোনা, সেই ঘটনাগুলো রয়েছে তোমাকে আমার জানানোর বাকী ।"

- "ঘটনা? আমি জেনে কি করবো বলো? তোমাকে সুস্থ করবার জন্য শুধু এখানে.. এখন তো আর আমার কিছু.."

- "তুমি কি জানো, আমরা তোমাদের থেকে আলাদা হয়ে যাবার পরেই বাবা মারা গেছিলেন দুর্ঘটনায়। মা কোনোরকমে একটা স্কুলের চাকরি জুটিয়ে আমাকে আর ভাইকে বড় করেছিলেন মামার বাড়িতে থেকে। আমি নিজেও টুকটাক টিউশনি করতাম জানো তো, কিন্তু মা-ও হঠাৎ চলে গেলেন হার্ট অ্যাট্যাকে, আর ভাই পুরো বখে গেল বদসঙ্গে পড়ে।

এদিকে মামার বাড়িতেও এত বাজে অবস্থা ছিল, ওরাও আর আমাদের একসাথে থাকা মেনে নিতে পারছিল না। তার মধ্যেই আমার বিয়ে হয়ে যায় প্রতাপের সাথে। ওর বাবার কাছে কিছু টাকা পেতেন আমার মামা, সেই টাকার বিনিময়ে বিয়েটা হয়। তবে খুব একটা খারাপ ছিলাম না জানো, যতদিন না আমার ছেলেটা ওরকম পঙ্গু হয়ে জন্মেছিল। তারপর এমন অত্যাচার শুরু করলো সবাই, আমিও কেমন ভুলে যেতে শুরু করলাম। 

এদিকে একদিন ছেলেটা সিঁড়ি থেকে পড়ে মারা গেল। আর ওরা বললো আমিই নাকি করেছি ওটা, তারপর থেকে আমিও কেমন হয়ে গেলাম। জেলে নিয়ে গেছিল, বাড়িতে এমনিও মারধর করতো, তারপর আমার আর কিছুই মনে নেই। শুধু হঠাৎ কোথায় যেন তোমাকে দেখলাম, শুধু ওইটুকুই জানি। কদিন ধরেই মনে পড়ছিল সব, ভাবছিলাম তোমাকে বলবো, কিন্তু তোমাকে আমি কখনো ভুলিনি জানো। খুব মনে হতো কোনোদিন তোমার সাথে দেখা হবেই আমার। কোনো এক দিন। 

তোমার এগুলো কিছুই জানা ছিলোনা বলো?"

আমি একেবারে হতচকিত হয়ে রইলাম। তারপর জিজ্ঞেস করলাম, - "তুমি কি নতুন করে তোমার ছেলের মারা যাওয়া নিয়ে পুলিশ কেস করতে চাও? বা শ্বশুরবাড়ির সাথে যোগাযোগ?"

এতক্ষণ কথা বলে একটু হাঁফিয়ে গেছিল মঞ্জুলা । আমার কথার উত্তর না দিয়ে আবার অন্যমনস্ক হয়ে তাকিয়ে থাকলো দূরে। তারপর বললো, - "কি করবো জানিনা, কিন্তু তুমি অন্তত গিয়ে নিজের জীবনটা আবার শুরু করো, আগের মত করে। আমি পরে ভাববো। আমার জন্য অনেকটা সময় তোমার এমনি চলে গেল রাজদা ।"

- "আমি তো জেনে বুঝেই নিয়ে এসেছি তোমাকে এখানে, সব ছেড়ে। যদি তুমি সুস্থ হয়ে যাও। অন্য কিছুই নয় বিশ্বাস করো। কাল রাতে যে কিভাবে, আমি সত্যি সরি মঞ্জুলা । কালই যাবার ব্যবস্থা করবো, তবে দুদিন সময় হয়তো লাগবে আমার।"

চুপচাপ খাবার শেষ করে ঘরে উঠে এলাম আমি। বুকটা হঠাৎ খুব ফাঁকা লাগছিল। একটা অনির্দিষ্টকালের অস্থায়ী বাসস্থান হঠাৎ শেষ হয়ে গেলে এমনই হয় বুঝি? নিজেকে বারবার সান্ত্বনা দিচ্ছিলাম, আমি তো ওকে সুস্থ করতেই এনেছিলাম এখানে। সেটা যখন ভালোভাবে হয়ে গেছে, এখন তো ফিরে যাওয়াই উচিত। কিন্তু কোথাও যেন একটা চিনচিনে কষ্ট ছড়িয়ে যাচ্ছিল বুকের ভেতর। ঘরের দরজা বন্ধ হবার আওয়াজে তাকিয়ে দেখলাম মঞ্জুলা ।

- "রাজদা ? তুমি এত ভীতু কেন? তুমি কি কিছু বোঝো না?"

আমি আবার হাঁ হয়ে গেলাম, কিছুই বুঝছি না যে।

- "তোমার ডাইরি পড়েছি আমি কালকেই। আমি বরাবরই জানতাম তুমি আমারই ছিলে, কিন্তু এতবছর ধরে? তারপর এতদিন একসাথে থাকলাম, একবারও আমাকে বলতে পারলেনা? কেন এত কিছু করছো আমার জন্য তুমি? কেন কেন? মঞ্জুলার চোখে জল দেখে আমিও কেমন যেন হয়ে গেলাম। সব ভুলে আবার জড়িয়ে ধরলাম ওকে, আর আমার ঠোঁট ছুলো ওর ঠোঁট। সেই যেমন আদিঅন্তকালের ভালোবাসার সেই একমেবাদ্বিতীয়ম প্রকাশ। মঞ্জুলার নিজেকে আমার কাছে সমর্পণ, এক পরম শান্তির প্রলেপ ছড়িয়ে দিল বুকে। এবার গোটা দুনিয়ার সাথে লড়াই করার শক্তি এখন আমার কাছে।