Debdutta Banerjee

Others Comedy

3  

Debdutta Banerjee

Others Comedy

শারদ_উপহার

শারদ_উপহার

5 mins
16.5K


রেললাইনের ধারে জলার গায়ে দিগন্ত বিস্তৃত কাশফুলের বন। তার মাঝখানে খেলে বেড়াচ্ছি আমি। একটা ট্রেন কু ঝিকঝিক শব্দ তুলে চলে যেতেই বাতাসে ভেসে এলো ঢাকের আওয়াজ। আমি ছুটে যাই সে আওয়াজ লক্ষ‍্য করে। ধানক্ষেতের পর বাঁশ ঝাড় আর বড় পুকুর পাড় হলেই আমাদের তিন মহলা বাড়ি। সামনেই দূর্গা মন্ডপ। চতুর্থীতেই ঠাকুর বানানো শেষ গদাইকাকার। ঢাকিরাও এসে গেছে। কাল থেকেই পুরো দমে উৎসব শুরু। শিউলি গাছের নীচে সাদা কমলার আলপনা, আমার দুই বোন ফুল কুড়াতে ব‍্যস্ত। স্থলপদ্ম গাছটা ফুলের ভারে ঝুঁকে পড়েছে। বড়দা পদ্ম তুলছে সাজি ভরে। ছোট ডোবাটায় প্রচুর জলপদ্ম ফুটেছে। হাঁস গুলো চরে বেড়াচ্ছে। ঢাকের আওয়াজটা ভারি মিষ্টি।

হঠাৎ ঘুমটা ভেঙ্গে গেল। ভাললাগার রেশ শরীরে মনে নিয়ে উঠে বসলাম। ঋত,আমার একমাত্র মেয়ের ঘর থেকে ঢাকের আওয়াজ আসছে। বোধহয় ইউটিউবে পুজো দেখছে।

আজ কুড়ি বছর আমি দেশের বাইরে। আশাকে বিয়ে করার পুরস্কার হিসাবে আমায় গৃহত‍্যাগ করতে হয়েছিল। এই কুড়ি বছর বাড়ীর কারোর সাথে আমার যোগাযোগ ছিল না। আমি সিডনীতে আশাকে নিয়ে ঘর বেঁধেছিলাম। কিন্তু নিয়তির পরিহাসে অথবা গুরুজনদের অভিশাপে সে ঘর দীর্ঘস্থায়ী হয় নি। সাত বছরের ঋতকে আমার কোলে দিয়ে আশা চিরবিদায় নিয়েছিল সব আশার আলো নিভিয়ে দিয়ে। ও চেয়েছিল আমি যাতে দেশে ফিরি। কিন্তু আমার আর ফেরা হয় নি।

আমার বাড়ি ছিল বর্ধমানের এক গ্ৰামে। বাড়িতে বড় করে দুর্গা পূজা হতো। এখনো মাঝে মাঝে মনে পড়ে সে সব কথা। খুব মন খারাপ হয় শরৎ আসলে।

উঠে বারান্দায় এসে দাঁড়ালাম। ঋত দু কাপ ব্ল‍্যাককফি নিয়ে পাশে এসে দাঁড়ালো। বলল

-"আমি সব ব‍্যবস্থা করেছি, সামনের সপ্তাহেই আমরা যাচ্ছি।"

-"আমি গিয়ে কি করবো মা? তুই পড়তে যাবি যা।" ও শান্তিনিকেতনে পড়তে চেয়েছিল। আমি আর আশা দুজনেই ওখানে পড়েছিলাম। ও একা একাই নেটে সব ব‍্যবস্থা করেছে। বিশ্বভারতীতে পড়তে চলেছে কিছুদিনের ভেতর। হয়তো শিকড়ের টান একেই বলে।

-"এই দেশে একা থেকে কি করবে তুমি?" ঋতের সরল প্রশ্ন।

ওকে কি করে বোঝাই ও দেশে গিয়েই বা কি করবো। আমার নিজের লোকেরা আমায় চায়না। কোনো টান নেই।

আশা ছিল আমার ছোটবেলার বান্ধবী,সাঁওতাল পরিবারের মেয়ে হয়েও ও পড়াশোনা করে বড় হওয়ার স্বপ্ন দেখতো। একসাথে কলেজে পড়েছিলাম। ও বাংলা সাহিত‍্য নিয়ে পড়তো। অসাধারণ কবিতা লিখত। এরপর ওর বিয়ে হয়ে গিয়েছিল। বেশ কিছুদিন যোগাযোগ ছিল না।

সেবার দুর্গা পূজায় খুব মজা হয়েছিল। দশমীর বিসর্জন হচ্ছিল। হঠাৎ মাঝ নদীতে একটা মেয়েকে ভাসতে দেখে তুলে নেয় মাঝিরা। তখনো প্রাণ আছে শরীরে। পাড়ে এনে গোধুলীর কনে দেখা আলোয় আমি চমকে উঠি, এ যে আশা। সারা শরীরে অত‍্যাচারের চিহ্ন!

পনেরো দিন পর ও যখন সুস্থ হল ওর কোনো যাওয়ার জায়গা নেই। স্বামী ওকে শিক্ষিত হওয়ার অপরাধে ছেড়ে দিয়েছে, ঘর বেঁধেছে অন‍্য মেয়ের সাথে। তুমুল অত‍্যাচার করে মৃতপ্রায় আশাকে ভাসিয়ে দিয়েছিল ভাসানের দিন। ওর বাবা মা আগেই গত হয়েছে।সাঁওতাল পরিবারের বৌ হয়ে বই পড়া আর কবিতা লেখা ছিল ওর অপরাধ। আমাদের ব্রাক্ষ্মণ বাড়িতে ওর স্থান হবেনা জানতাম। কিছুদিনের জন‍্য ওকে শান্তিনিকেতনে এক বন্ধুর বাড়ি রেখে এসেছিলাম। আমার বাড়ির উদারমনস্ক লোকেদের এক ভিন্ন রূপ ফুটে উঠেছিল তখনি। এরপর ওকে কলকাতায় নিয়ে যাই। আমি তখন কলকাতায় এক কলেজে পড়াতাম। কিছুদিনের মধ‍্যেই আমি বিদেশে চলে যাবো। আমার বাড়িতেই ওকে রেখেছিলাম। ছোট বোনটা তখন আমার কাছে থেকেই পড়তো। চেষ্টা করছিলাম কোনো স্কুলে ওকে ঢোকানোর। এর মধ‍্যেই একদিন বাবা এসে হাজির। গ্ৰামে নাকি রটে গেছিল আমি আশাকে বিয়ে করেছি। বাবার চোখে ছিল তীব্র ঘৃণা।আমার আর বোনের কথা কেউ বিশ্বাস করেনি সেদিন। লজ্জায় আশা আরেকবার আত্মঘাতী হতে গেছিল। বোনকে জোর করে বাবা বাড়ি নিয়ে গেছিল।

দিনটা ছিল ভুত চতুর্দশীর শেষে দীপাবলীর রাত। অনেক রাত অবধি ছাদে বসে ভেবেছিলাম। নিজের লোকেরাই যখন আমায় বিশ্বাস করেনি আমি আর নিজের সাথে লড়াই করিনি। কিছুদিনের মধ‍্যেই আশাকে স্ত্রীয়ের মর্যাদা দিয়ে ওকে নিয়ে দেশ ছেড়েছিলাম। সব ভুলিয়ে দিয়েছিল আমাদের মেয়ে ঋত। আজ সেই ঋত চাইছে দেশে ফিরতে।

গেষ্ট হাউসের জানালা দিয়ে ভেসে আসছিল মিষ্টি চেনা সুবাস। এ আমার অতি প্রিয় গন্ধ। বাচ্চা মেয়ের মত শিউলি তলায় ছোটাছুটি করছে ঋত, যেমন করতো আশা। আজ ষষ্ঠি। ওকে নিয়ে সন্ধ‍্যায় টুকটাক কেনাকাটি করলাম। পিৎজা, বার্গারে অভ‍্যস্ত মেয়ে মাছ-ভাত খেলো তৃপ্তি করে। পরের দিন গাড়ী নিয়ে আমরা আশপাশ ঘুরতে বেরিয়েছিলাম। আকাশে বাতাসে পূজার গন্ধ, ছোট বড় কত পূজা চারদিকে। একশোআট শিব মন্দির দেখে গাড়ি এগিয়ে চলেছে পিচ রাস্তায়। দু ধারে সবুজ ধানখেত, মাঝে মাঝে কাশবন।

জলায় পদ্ম ,শাপলা ,শালুকের ভিড়। আকাশে নীল সাদার আলপনা দেখতে দেখতে হঠাৎ মনে হল এ কোথায় চলেছি!! এ পথ যে আমার ভীষণ চেনা!!ঋত কানে হেডফোন গুঁজে ওর মা'এর গান শুনছে। আশা বড় ভালো গান গাইতো। সব তোলা ছিল আমার কম্পিউটারে।

এসব নিয়েই বড় হয়েছে ঋত।

দূর থেকে দেখা যাচ্ছে তিন মহলা বিশাল বাড়ি, যদিও জীর্ণ তবুও আভিজাত‍্যের ছাপ রয়েছে এখনো। সামনের দুর্গা মন্ডপ থেকে ভেসে আসছে ঢাকের আওয়াজ। শিউলি গাছটা আজও ফুলে ফুলে ছেয়ে আছে। টুপটাপ ফুল পড়ছে ঝরে। নিচে সেই ফুলের বিছানায় দুটো মেয়ে ফুল কুড়াচ্ছে। ড্রাইভার বলল এই অঞ্চলের বহু পুরানো এই মুখুজ‍্যে বাড়ির পূজা। ঋত নেমে পড়েছে। পায়ে পায়ে শিউলি গাছের নিচে গিয়ে দাঁড়িয়েছে। একটা দুটো করে শিউলি ফুল ঝরে পড়ছে ওর গায়ে। এ যেন সাদর আমন্ত্রন।

গাড়ি দেখে মন্ডপ ছেড়ে বেরিয়ে এসেছে সাদা ধুতি পাঞ্জাবী পরা দু জন। বয়সের চিহ্ন গুলো দূরে সরিয়ে চিনতে পারি ছোটকা আর বড়দাকে। আমি নেমে পড়েছি ততক্ষণে। ঐ তো লালপেড়ে শাড়ী ,কপালে বড় সিঁদুরের টিপ.....

তার মানে বাবা আছেন !! মনে এক অদ্ভুত আত্মতৃপ্তি নিয়ে দু পা এগোতেই ছোটকা জড়িয়ে ধরলো আমায়। বাড়ির ভেতর থেকে অনেকেই বেরিয়ে এসেছে। দুটো মেয়ে বাবাকে ধরে ধরে নিয়ে আসছে। বয়সের ভারে বৃদ্ধ হয়েছে বাবা।সবার মুখে আনন্দের ছোঁয়া, কিন্তু কৈ!! কারো চোখে অবাক হওয়ার ছায়া তো নেই !! বাবা বলছে

-"কৈ, আমার মা দুগ্গা কৈ ? এগিয়ে আয় মা। আমার কাছে আয়।"

লাল সাদা চুড়িদার পরা ঋত এগিয়ে গেলো বাবার কাছে। আমার দিকে তাকিয়ে দুষ্টুমী মাখানো মুখে ছুঁড়ে দিলো এক মিষ্টি হাসি।

এবার বুঝলাম ওর এই শান্তিনিকেতনে পড়তে আসার ফাঁকে ও ফেসবুক আর নেটের সাহায‍্যে পৌঁছে গেছিল ওর নিজের ভিটেতে। আলাপ পরিচয় চলেছিল। পুরোটাই ওর প্ল্যান। এক পূজার শেষে আমি হয়েছিলাম গৃহহারা। আজ ঋত আমায় দিল আমার জীবনের শ্রেষ্ঠ শারদ উপহার।

নিজের লোকেদের মাঝে হারিয়ে যেতে যেতে বহু দিন পর ফিরে পেলাম সেই হারিয়ে যাওয়া স্মৃতিগুলো। ঋত তখন উৎসবের মধ‍্যমনি হয়ে সবার আদর খেতে ব‍্যস্ত। ঢাকিরা মনের আনন্দে ঢাক বাজাচ্ছে। নীল আকাশে সাদা মেঘের ফাঁকে মনে হল আশা হাসছে।

-সমাপ্ত-


Rate this content
Log in