Dola Bhattacharyya

Children Stories Classics Inspirational

4  

Dola Bhattacharyya

Children Stories Classics Inspirational

ফেয়ারওয়েল

ফেয়ারওয়েল

5 mins
264



আজকের দিনটা অন্যান্য দিনের থেকে অনেকটাই আলাদা। আজ আর স্কুলে যেতে হবে না। শুধু আজ কেন, আর কোনোদিনই স্কুলে যাবেন না অমলতাস বন্দ্যোপাধ্যায় , ছাত্র ছাত্রীদের প্রিয় গাছস্যার। আগামী কাল ওনার ফেয়ারওয়েল। স্কুল থেকে একটা অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়েছে। ছাত্রছাত্রীরাও থাকবে অনুষ্ঠানে। শিক্ষকদের ফেয়ারওয়েলের অনুষ্ঠানে সাধারণত ছাত্রছাত্রীদের রাখা হয় না। এই স্কুলে এটাই রীতি। তবে অমলতাস, হেডমাস্টারমশাই এবং স্কুলের পরিচালন কমিটির অনুমতি নিয়ে ছাত্রছাত্রীদের ইনভাইট করেছেন। ওদের প্রিয় গাছস্যারের বিদায়ী অনুষ্ঠানে ওরা থাকবে না, এও কি সম্ভব। 

অমলতাস চিরকুমার, ছাত্রছাত্রীদের আপন সন্তানের মতোই স্নেহ করেন। ওরাও দিয়েছে উজার করা ভালোবাসা ওদের প্রিয় গাছস্যারের জন্যে। গাছস্যার, নামটাও ওদেরই দেওয়া। 


হাওড়া জেলার এক প্রত্যন্ত গ্রামে বাড়ি অমলতাসের। জমি জায়গা ও আছে অনেক। বিরাট বড় বাগানে আম, জাম, জামরুল, লিচু, পেঁপে গাছের ভীড়। ফাঁকা জায়গা গুলোতে একসময়ে কিছু ফুলের গাছ বসিয়েছিলেন অমলতাস। অনেকদিন তো যাওয়া হয়নি গ্রামের বাড়িতে। গাছগুলোর কি অবস্থা হয়েছে কে জানে! অমলতাসের ছোটবেলা কেটেছে গাছপালার সান্নিধ্যে। তখন থেকেই গড়ে উঠেছিল গাছপালার প্রতি তীব্র ভালোবাসা। চাকরির জন্যে গ্রাম ছেড়ে আসতে হয়েছিল একটা সময়ে। তবু গাছের প্রতি ভালোবাসা ছিল অটুট।


 শহরে এসে প্রথমে একটা মেসবাড়িতে উঠেছিলেন অমলতাস। সেখানে ছিল দমবন্ধ করা পরিবেশ। বরং স্কুলটা ছিল অনেক খোলামেলা। এখানে এসে একটু স্বস্তি পেতেন। দিনের শেষে মেসে ফিরে আর ভালো লাগত না। বন্ধুদের সাথে হৈচৈ, আড্ডা, সিনেমা দেখা এসবে অভ্যস্ত ছিলেন না অমলতাস। বেশ কয়েকবছর পর একটা ছোট্ট ফ্ল্যাট কিনে ফেললেন। ফ্ল্যাটটা বেশ খোলামেলা। চারপাশে বেশ কিছু গাছপালাও রয়েছে । সামনেই রয়েছে বাচ্চাদের খেলার একটা মাঠ। জায়গাটা পছন্দ হয়েছিল বেশ। এতগুলো বছর তো এখানেই কেটে গেল। পরীক্ষার খাতা দেখতে দেখতে যখন চোখ দুটো ক্লান্তিতে বুজে আসতে চাইত, বেডরুমের লাগোয়া ছোট্ট ব্যালকনিতে এসে দাঁড়াতেন। একরাশ এলোমেলো বাতাসের ঝাপটা এসে লাগত মুখেচোখে । খুব ভালো লাগতো তখন। এখান থেকে চলে যাবার আগে ফ্ল্যটটা বিক্রি করে দিয়ে যাবেন ভেবেছিলেন। পরে সিদ্ধান্ত বদলেছেন অমলতাস। এতদিন থাকার ফলে বেশ মায়া পড়ে গিয়েছে এই ফ্ল্যাটের ওপর। নাঃ। আজ আর ঘুম আসবে বলে মনে হচ্ছে না। নানা কথা ভাবতে ভাবতে ভোর হয়ে এল প্রায়। বিছানা থেকে উঠে পড়লেন অমলতাস। মনটা বড় বিষণ্ণ লাগছে।দেখতে দেখতে স্কুলে যাবার সময় হয়ে এল। ফ্ল্যাটের দরজার চাবি দিয়ে বেরিয়ে পড়লেন অমলতাস। 


 আজ শেষবারের মতো স্কুলের দরজায় এসে দাঁড়ালেন অমলতাস।ওরা অপেক্ষা করছিল গাছস্যারের জন্যে। উনি আসতেই চারপাশ থেকে ঘিরে ধরল সবাই। বড় মাঠটার একপাশে প্যান্ডেল করা হয়েছে অনুষ্ঠানের জন্য। সেখানে নিয়ে এসে বসানো হলো অমলতাস কে। নির্দিষ্ট সময়ে শুরু হল অনুষ্ঠান। শিক্ষক সহকর্মীরা আজ সবাই অমলতাস কে নিয়েই তাদের বক্তব্য রাখছেন। শুনছেন অমলতাস। মুখে মৃদু হাসি। চোখদুটো তাদের দৃষ্টি ছড়িয়ে দিয়েছে অনুষ্ঠান মন্ডপ ছাড়িয়ে রক্ত করবীর শাখায়, আমলকি গাছের ফলভরা শরীরে। ওই তো কদমগাছটা ।অনেকদিন আগে ওকে এনেছিলাম এখানে। গত বর্ষায় কত ফুল ফুটিয়েছে ও । 


অনুষ্ঠান প্রায় শেষের দিকে। এবার মঞ্চে এসে দাঁড়াল এক ছাত্রী। টুয়েলভে পড়ে মেয়েটি। পড়াশোনায় খুব ভালো। হেডমাষ্টার মশাইএর অনুমতি নিয়ে বলতে শুরু করল সে , আমি সুতপা নন্দী। আমাদের পিতৃতূল্য গাছস্যার শ্রী অমলতাস বন্দ্যোপাধ্যায়ের বিদায়ী অনুষ্ঠান আজ। সেই উপলক্ষে আমি একটা গল্প লিখেছি। গল্পের নাম, 'আমাদের গাছস্যার'—:


   অমল স্যার যেদিন প্রথম এই স্কুলে জয়েন করলেন, হেডমাষ্টার মশাই বলেছিলেন, "মাষ্টার মশাই, আমার এখানে যারা রয়েছে, এক একটা ক্ষুদে শয়তান সব। আপনার ওই ভালো মানুষ টাইপের চেহারা দেখে মাথায় না উঠে বসে বিচ্ছু গুলো" । মৃদু হেসে বলেছিলেন অমল স্যার , "অত চিন্তা করবেন না মাষ্টারমশাই। আমি আমার সেরাটাই দিতে চেষ্টা করবো ওদের। আজ একটা উপহার এনেছি ওদের জন্য। যদি অনুমতি করেন।"

" কি এনেছেন "? 

" একটা গাছ। রক্ত করবীর চারা "। ঝোলা থেকে চারাটা বের করে টেবিলের ওপর রাখলেন অমল স্যার । এই গাছটা আমি ওদের দিয়েই রোপন করাতে চাই, যদি আপনি পারমিশন দেন"। 

"নিশ্চয়ই। দিলাম পারমিশন। আজ স্কুলের প্রাঙ্গণে বৃক্ষ রোপন অনুষ্ঠান হবে। আমরা সবাই থাকব সেখানে।" 

শুরুটা এইভাবেই হয়েছিল। স্যারের ধুতি পাঞ্জাবী পরা সৌম্য দর্শন চেহারা খুব সহজেই ছাত্রদের মন জয় করে নিয়েছিল। বাংলার টিচার অমল স্যার খুব সহজেই ওদের প্রিয় গাছস্যার হয়ে উঠেছিলেন। গাছ ভালোবাসেন মানুষটা । ছাত্র ছাত্রীদের মনেও সেই ভালোবাসার বীজ অঙ্কুরিত হয়েছিল। 

পাঁচ বছর পর —

চলে যাচ্ছেন অমল স্যার । শহরের নামকরা কলেজে অধ্যাপনার সুযোগ পেয়েছেন। সকলেরই যেমন স্বপ্ন থাকে, ওনারও ছিল তেমনই, কলেজে পড়ানোর স্বপ্ন ।সেই স্বপ্ন সফল হতে চলেছে। এই পাঁচ বছরে পাঁচটা গাছ উনি স্কুল কে উপহার দিয়েছেন। তারা এখন অজস্র ফুলের ভারে নুয়ে পড়ছে। স্কুলের ছোটো গেটের পাশের পাঁচিল বেয়ে মাধবীলতা উঠেছে গেটের মাথায়। থোকায় থোকায় ফুল ফুটিয়ে আলো করে রেখেছে। এইসব ছেড়ে চলে যাচ্ছেন অমল স্যার । আজ ওনার ফেয়ার ওয়েল। একটা ছোট্ট অনুষ্ঠানের আয়োজন করেছেন হেডমাষ্টার মশাই। নির্দিষ্ট সময়ে হল ভর্তি। শুরু হল অনুষ্ঠান। শেষও হলো। শেষবারের মতো ছাত্রদের উদ্দেশ্যে বক্তব্য রাখছেন অমল স্যার । মনটা ভারী হয়ে উঠেছে। হঠাৎ একটা কচি কন্ঠে ধ্বনিত হল, "গাছস্যার, যেতে দেব না তোমায়। তুমি না থাকলে আমরা গাছ পুঁতবো কার সঙ্গে!" সেই চিরন্তন বাণী "যেতে নাহি দিব"। মুহূর্তের মধ্যে শত কন্ঠে ধ্বনিত হল, থেকে যাও গাছস্যার।যেতে দেব না তোমায় আমরা। তবু যেতে দিতে হয়। যেতে দিতে হল। হেডমাষ্টার মশাইএর সহযোগিতায় স্কুল থেকে বেরিয়ে এলেন অমল স্যার । 

বাড়ি এসেও স্থির হতে পারছেন না অমল স্যার । মনের পটে ভেসে উঠছে ক্রন্দনরত ছোট্ট মানুষগুলোর মুখ। সাঁচ্চা ওদের ভালোবাসা। আর ওই ফুলে ভরা গাছগুলো! ওরা কি কম আপন। ছটফট করছেন অমল স্যার । রাত সাড়ে নটা নাগাদ হেডমাষ্টার মশাই কে ফোন করলেন অমল স্যার , "আমি কোথাও যাচ্ছি না স্যার। এত ভালোবাসা ফেলে কোথায় যাবো আমি!" হেডমাষ্টার মশাই টের পেলেন, কখন যেন ওনার চোখদুটোতে মেঘ ঘনিয়ে এসেছে ।ধরা গলায় শুধু বললেন, "ফিরে এসো অমলতাস। অপেক্ষায় থাকলাম।" 

পরদিন নির্দিষ্ট সময়ে স্কুলের ছোটো গেটের সামনে এসে দাঁড়ালেন অমল স্যার । মাধবীলতা হাসছে। আন্দোলিত শাখায় তার ফুলেল উচ্ছাস। ছুটে আসছে কচি কাঁচার দল। "ফিরে এসেছে আমাদের গাছস্যার"। কন্ঠে ওদের উচ্ছ্বাসের বন্যা। এদের ফেলে কোথায় যাবেন অমল স্যার ! 

গল্প শেষ। অমলতাস বাকরুদ্ধ। নিজেকে সংযত করে প্রশ্ন করেন সুতপাকে, "এ ঘটনা তো বহুদিন আগের। তুমি জানলে কি করে" ! 

সুতপা বলে. "এ ঘটনা সবাই জানে স্যার। সবার মুখে মুখে আজও ঘোরে এই কাহিনী। "

সত্যি, কলেজে পড়ানোর সুযোগ পেয়েও ছেড়ে দিয়েছিলেন অমলতাস। এই ছেলেমেয়েদের প্রাণ ভরা ভালোবাসা কে অবজ্ঞা করে চলে যেতে মন সরেনি সেদিন। 

আজও একটা গাছ এনেছেন অমলতাস। আমগাছ । ছাত্রছাত্রীদের হাতে তুলে দিলেন সেই গাছ। এই গাছ বড় হবে। ফল ধরবে। ওরা যখন প্রার্থনার লাইনে দাঁড়াবে, এই গাছ ছায়া দিয়ে প্রখর রোদের তেজ থেকে বাঁচাবে ওদের, বাবা যেভাবে ছাতা ধরে সন্তানের মাথায়, ঠিক সেইভাবে। আর তখনই ওদের মনে পড়ে যাবে ওদের প্রিয় গাছস্যারের কথা।


Rate this content
Log in