Ankita Chatterjee

Children Stories Inspirational Others

4  

Ankita Chatterjee

Children Stories Inspirational Others

বোধন

বোধন

7 mins
298



১.


" জানো বাবাই আজ না ম্যাম আমাদের সবাইকে।জিজ্ঞেস করছিলেন যে পূজার জন্য কার ক'টা জামাকাপড় হয়েছে? আমার সব ফ্রেন্ডরা বলেছে বাবাই কিন্তু আমি বলতে পারিনি। এবার পূজায় আমার নতুন জামা হবে না বাবাই?" প্রশ্নটি করে থামলো আট বছর বয়সের মেয়ে মিলি, ভালো নাম সৌমিলি কিন্তু তার বাবা ও মা তাকে 'মিলি' নামে সম্বোধন করেন। 


নিজের মেয়ের এমন প্রশ্নে চোখ ছলছল করে উঠলো সতীনাথের। কী বলবে সে তার মেয়েকে যে তার বাবাই এবার পূজাতে তাকে নতুন জামা দিতে পারবে না? কী করে বলবে এইটুকু মেয়েটাকে যে তার বাবাইয়ের চাকরিটাই তো নেই, নতুন জামা কেনার টাকাটাও তো নেই। সতীনাথ নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করে তার মেয়ের মাথায় হাত বুলিয়ে বললো," আমার মিলিরও তো নতুন জামা হবে, সেই জামা পড়ে আমার মিলি বোধন দেখবে, পূজা দেখবে।"


মিলির চোখ আনন্দে উজ্জ্বল হয়ে উঠলো, আনন্দিত হয়ে মিলি বললো," আমিও নতুন জামা পড়ে বোধন দেখবো বাবাই?"


সতীনাথ মলিন হেসে বললো," হ্যাঁ মা, মায়ের পূজাতে তার সব সন্তানরা খুব খুশি থাকে। তোকেও খুশি থাকতে হবে তো, সবসময় হাসি মুখে থাকবি।"


মিলি হাসি মুখে সেখান থেকে বাড়ির উঠোনে চলে গেলো, সে তো এখন অনেক খুশি। অন্য সবার মতো সেও তো নতুন জামা পড়বে, খুশি না হলে হয় না কী?


'দূর্গাপূজা' বাঙালির তথা সমগ্র ভারতবাসীর অন্যতম প্রধান উৎসব, মায়ের পূজাতে অর্থাৎ দূর্গাপূজাতে সবাই নতুন পোশাক কেনেন, এই কয়েকদিন তো কেউ দুঃখে থাকে না সবাই নিজের সামর্থ্য অনুযায়ী খুশি থাকেন। একজন সাধারণ মানুষও হাসি খুশিতে পূজা কাটান আবার একজন ধনী মানুষও হাসি খুশিতেই থাকেন এই পূজার দিনগুলো। বোধন আসবে মায়ের আর মাত্র দুদিন পর, এই কোভিড পরিস্থিতিতেও সব নিয়ম মেনে পূজার আয়োজন হচ্ছে সব জায়গায়, বোধন আসবে বলে সবাই কতো আনন্দিত, সারা বছর তো মানুষ অপেক্ষা করে থাকে দূর্গাপূজার জন্য তাহলে এই দিনগুলোতে তো সবাই হাসিমুখেই থাকবেন। সবাই নিজের নিজের সামর্থ্য অনুযায়ী পূজাতে নতুন জামাও কিনেছেন আবার অনেকেই সতীনাথের মতো কিনতে পারেননি। 


২.


সতীনাথ একটা বেভারেজ কোম্পানিতে কাজ করতো, গত বছর লক ডাউনে যখন অনেকের চাকরি চলে যেতো তখনও তার চাকরি ছিলো কিন্তু বলে না 'ভাগ্যের লিখন না যায় খন্ডন', ওর বেলায়ও সেটাই হলো। গতবার চাকরি না গেলেও এই তো কয়েকমাস আগে চাকরিটা চলে গেলো। কোম্পানির না কী এখন ক্ষতি হচ্ছে বেশি তাই সবাইকে রাখা যাবেনা, এই কথা বলেই সতীনাথ ও আরো কয়েকজনকে চাকরি থেকে বরখাস্ত করা হয়। শুধু তা ই না, দুই মাসের বেতন পর্যন্ত দেওয়া হয়নি তাদের। টাকা না থাকলে তো নিজের আত্মীয়ও পর হয়ে যায়, তাই তো গত কয়েকমাস থেকে সতীনাথ ও তার পরিবারের সাথে কেউ যোগাযোগ রাখেননি, এমনকি তার নিজের দাদা না ও তার শ্যালক পর্যন্ত না। যেখানে এতো কাছের মানুষরা সম্পর্ক না রাখতে পারে সেখানে তো অন্যদের থেকে আশা করাটাও বৃথা। সতীনাথের যা সঞ্চয় ছিলো তার পুরোটাই এই কয়েকমাসে বেঁচে থাকতে প্রয়োজন হয়েছে, যার জন্য সঞ্চয়ও আর নেই তেমন। এই পরিস্থিতিতে কোথাও কাজও পাচ্ছে না, যা কাজ পাবে সেটাই করবে কিন্তু পাচ্ছে তো না। সতীনাথ বসে বসে এসবই ভাবছিলো তখনই তার স্ত্রী রূপা এসে বললো," তুমি এতো ভাবো না। এক বছর পূজাতে নতুন জামা না হলে কিছু হবে না। মিলির তো আরো জামা আছে সেগুলোই পড়বে ও এবার। তুমি এতো চিন্তা করো না।"


সতীনাথ ছলছল চোখে নিজের স্ত্রীকে বললো," আমি কতো হতভাগ্য বাবা বলো যে নিজের একমাত্র সন্তানকে পূজাতে জামা দিতে পারে না। একজন হতভাগ্য স্বামী যে নিজের স্ত্রীকে পূজাতে একটা শাড়ি পর্যন্ত দিতে পারে না। মিলি সরকারি স্কুলে পড়ছে বলেই টাকা লাগছে না, যদি স্কুলে টাকা লাগতো তাহলে মনে হয় আমি ওকে স্কুলেও পড়াতে পারতাম না।" 


রূপা বললো," তুমি এমন কেনো বলছো? আজ এগারোটা বছরে তুমি কোনো বছর তো আমাকে পূজাতে শাড়ি দাওনি এমন তো হয়নি। এবার হয়েছে তাতে তোমার তো দোষ নেই, পরের বছর আবার সবাই নতুন পোশাক পাবো। মিলিকে নিয়ে তুমি চিন্তা করো না, আমি ওকে ঠিক বুঝিয়ে দেবো।"


সতীনাথ বললো," তুমি আমি জামাকাপড় না পেলেও আফসোস এতোটা হবে না রূপা কিন্তু মিলি ও তো একটা বাচ্চা মেয়ে, এখনও তো সেভাবে বোঝার বয়স হয়নি বলো? মানুষ নিজের চার পাঁচটা সন্তানকে পূজাতে পোশাক দিতে পারছে আর আমি আমার এক মাত্র সন্তানকে পূজাতে জামা দিতে পারবো না? আমি আমার মেয়ের চোখে জল দেখতে পারবো না রূপা।"


সতীনাথের কথা শুনে রূপার বুকটা হাহাকার করে উঠলো, সত্যিই তো একজন মা হয়ে এটা কী করে সহ্য করবে? ও সব সহ্য করতে পারবে কিন্তু পূজার দিনে তার সন্তান একটা নতুন জামা পড়তে পারবে না এটা কতোটা কষ্টের সেটা একজন মা হয়ে ও নিজেই বুঝতে পারছে। সেই সাথে বুঝতে পারছে নিজের স্বামীর কষ্টটা, কোনোদিন নিজের স্বামীকে এভাবে ভেঙে পড়তে দেখেনি ও নিজের জীবনে, কতো কিছু কষ্ট সহ্য করেছে তারা কিন্তু সতীনাথ সবসময় সাহস রেখেছে আর আজ সেই মানুষটাই ভেঙে পড়েছে। একজন বাবা যে সারাজীবন শুধুমাত্র স্ত্রী, সন্তানের জন্য নিজের পরিবারের জন্য উপার্জন করে যান, কষ্ট করে যান কিন্তু পূজার সময়েই যদি নিজের সন্তানের মুখে হাসির পরিবর্তে চোখে জল দেখেন তাহলে তাদের অবস্থা ঠিক কেমন হবে সেটা সতীনাথকে দেখে বোঝা যাচ্ছে আর সেটা সবাই বুঝতেও পারবেন না, শুধুমাত্র সতীনাথের মতো মানুষ ও তাদের স্ত্রীরা বুঝতে পারবেন। 


রূপা নিজের স্বামীকে বললো," মা আছেন তো, তিনি যা করবেন ভালোর জন্য করবেন। মা চায়লে আমাদের মিলিও নতুন জামা পড়তে পারবে পূজাতে।"


সতীনাথ বললো," কাল বাদে পরশু বোধন রূপা, আমাদের মেয়েটা নতুন জামা পাবে না? অন্য বছর তো আমাদের দাদারা ওকে নতুন জামা দেয় কিন্তু এবার যেহেতু আমরা দিইনি তাই আমাদের মিলিকেউ দেননি। টাকা না থাকলে কেউ কারো না রূপা।"


রূপা হালকা হেসে বললো," সবাইকে চেনা গেলো গো। আজ আমরা দিইনি বলে তারাও আমাদের মেয়েটাকে একটা জামা দেয়নি। দরকার নেই কারো দয়ার, কষ্টে থাকি, ভালো থাকি নিজেরা থাকবো কারো করুণার দরকার নেই। তুমি চিন্তা করো না, মা ঠিক কিছু একটা করবেন।"


সতীনাথ কিছু না বলে সেখান থেকে ঠাকুরঘরে চলে গেলো। নেহাৎ ঘরটা নিজেদের নয়তো মাথার ওপর ছাদটাও থাকতো না। 


সতীনাথ সেখানে গিয়ে দুই হাত জোড় করে বললো," মা! মা গো কাল বাদে পরশু থেকে তোমার পূজা মা। সবাই যেমন তোমার সন্তান তেমন আমার মেয়েটাও তো আমার সন্তান মা। আমার মেয়েটা কী তোমার পূজাতে একটা নতুন জামাও পাবেনা মা? তোমার বোধনের দিন কী আমার মেয়েটা একটা নতুন জামা পাবেনা? মা তুমি তো তোমার পূজাতে কাউকে চোখের জলের সাথে রাখোনা, তাহলে আমার মেয়েটাকে কেনো রাখবে চোখের জলে? আমার মেয়েটাকে তোমার পূজার সময়ে হাসিমুখে থাকতে দাও মা। আমরা দুজন কষ্ট পাবোনা কিন্তু আমার মেয়েটা তো কষ্ট পাবে মা, ও তো একজন বাচ্চা মেয়ে। সবাই যেখানে পূজাতে নতুন জামা পড়বে সেখানে আমার মেয়েটা কী পুরোনো জামা পড়ে থাকবে? আমি তো কোনোদিন ওকে এভাবে রাখিনি মা, অন্তত একটা জামা ওর জন্য চাই মা।" বলতে বলতে কেঁদে উঠলো সতীনাথ, তার পেছন থেকেই রূপা নিজের স্বামীর কান্না দেখে নিজেও কাঁদতে থাকলো। এছাড়া তাদের আর কী ই বা করার আছে? 


৩.


আজ পঞ্চমী কিন্তু এখনও পর্যন্ত মিলির জন্য একটা জামাও আনা হয়নি। আনবেই বা কী করে? যেখানে ভালো করে খাবার সামগ্রী কেনার টাকা নেই সেখানে একটা জামা কেনা বিলাসিতা ছাড়া আর কিছুই না। মিলি সকাল থেকে বারকয়েক তার মা ও বাবাইকে জামার কথা জিজ্ঞেস করছিলো, কিন্তু ওকে কী বলবে সেটাও বুঝতে পারছিলো না তারা। দুপুরবেলা কোনোমতে ওকে আলুসেদ্ধ, ভাত খায়িয়ে ঘুম পাড়িয়েছে। রোজ রোজ এক খাবার খেতেও আর ভালো লাগছেনা মেয়েটার কিন্তু সবজিরও তো অনেক দাম, একদিন সবজি কিনে আনলে যে দুদিন ভাত খেতে পাবে না, সেজন্য এই খাবারই খেতে হয়। 


রূপা ও সতীনাথ আজকে সামান্য খেয়েছে, ভালো লাগছে না তাদের খেতে কিন্তু মা লক্ষ্মীকে অপমান করতে নেই, সবার ভাগ্যে রোজ খাবারও জোটে না তাই একটু হলেও খেয়েছে তারা। রূপা সতীনাথকে বললো," তুমি কষ্ট পেয়ো না। এমন অনেক মানুষ আছে যারা দুবেলা দু মুঠো খাবারও পাননা, তাদের থেকে তো অনেক ভালো আছি আমরা। আমাদের মিলিও ভালো আছে, ওর মাথার ওপরে বাবার ছায়া আছে, মায়ের কোল আছে সেটাও সবার থাকে না।"


সতীনাথ বললো," আমি জানি আরো অনেকের আমাদের থেকে বেশি কষ্ট কিন্তু আমি তো আমার একমাত্র সন্তানকে কোনোদিন কষ্টে রাখিনি। তাহলে ওর কষ্ট আমি কী করে.." কথা সম্পূর্ণ করার আগেই সতীনাথের মোবাইলে দুটো মেসেজ আসার নোটিফিকেশন আসলো। সতীনাথ মোবাইলটা নিয়ে দেখলো একটা মেসেজ তার কোম্পানি থেকে এসেছে, যেখানে লক্ষ্মী পূজার পর আবার তাকে কাজে জয়েন করতে বলা হয়েছে। আর দ্বিতীয়টা, তার সেই দুই মাসের বেতন তার ব্যাংক একাউন্টে আসার মেসেজ। 


সতীনাথ দুটো মেসেজ দেখতে দেখতে হাউমাউ করে কেঁদে উঠলো। রূপা সতীনাথের এমন হঠাৎ কান্নাতে ভয় পেয়ে গেলো, ও কিছু জিজ্ঞেস করবে তার আগেই সতীনাথ কাঁদতে কাঁদতে বললো," মা গো তোমার এ কি মহিমা মা! তুমি থাকতে তোমার কোনো সন্তান কষ্টে কী করে থাকতে পারে? কে বলেছে তুমি নেই মা? আমার সন্তানকে, তোমার সন্তানকে তোমার পূজাতে হাসিমুখেই তুমি দেখতে চাও সর্বদা মা। আজ তোমার জন্যই আমার মেয়েটা নিজের হাসি ফিরে পাবে মা। তোমার বোধনে মিলিও নতুন জামা পড়বে। ধন্যবাদ মা,ধন্যবাদ। তোমার সন্তানের মাথায় হাত রেখো এভাবেই মা।" 


রূপা তার কথা বুঝতে না পেরে বললো," কী বলছো?"


সতীনাথ কাঁদতে কাঁদতে রূপাকে বললো," মিলিকে ঘুম থেকে ওঠাও, আমি দুই মাসের বেতন পেয়েছি সাথে কাজটাও ফিরে পেয়েছি। মিলিকে ওঠাও, মায়ের পূজার বাজার করতে যেতে হবে তো আর মিলির জন্য সবজি কিনতেও তো হবে। অনেক কাজ তো, মায়ের পূজা কাল বোধন। বোধনের দিন নতুন পোশাক পড়তে হবে তো।"


রূপা সব শুনে খুশিতে কাঁদতে কাঁদতে বললো," আমি বলেছিলাম তো তোমাকে মা আছেন, তিনি যা চান সেটাই হবে।" বলেই রূপা মিলিকে ঘুম থেকে ওঠাতে গেলো।


মিলি ঘুম ঘুম চোখে নিজের বাবাই ও মায়ের দিকে তাকিয়ে বললো," কী হয়েছে মা?"


সতীনাথ মেয়েকে বললো," বাজার যাবো তো, চল তৈরি হয়ে নে। বোধন তো কাল, পূজা হবে আর জামা আনতে যেতে হবে তো।"


মিলি খুশি হয়ে বললো," সত্যি?"


রূপা ও সতীনাথ একসাথে বললো," সত্যি। শারদ শুভেচ্ছা মিলি।"


মিলি খুশি হয়ে মা ও বাবাইকে জড়িয়ে ধরে বললো," শারদ শুভেচ্ছা মা, বাবাই।" 


 


Rate this content
Log in