Soumo Sil

Children Stories Inspirational action

2.2  

Soumo Sil

Children Stories Inspirational action

অগ্নিকন্যা

অগ্নিকন্যা

7 mins
519


"দুর্বলতা"! কথাটা শুনতে অনেকটা সাধারণ বলে মনে হয় কিন্তু বাস্তব জীবনের প্রতিটা মুহূর্তে এই "দুর্বলতা" শব্দটা গ্রাস করে প্রত্যেকটা মানুষকে। ছোট থেকেই চিত্রিতা দুর্বল মনোভাব নিয়ে বড়ো হয়েছে, এতে অবশ্য তার কোনো দোষ নেই, দোষটা হচ্ছে বর্তমান সমাজের। সমাজের প্রতিটা মানুষ মেয়েদের দুর্বল বলতে থাকে এর কারণে মেয়েরা নিজে দের দুর্বল ভাবতে শুরু করে, ঠিক তেমনই চিত্রিতার বাবা মাও তাকে ছোট বেলা থেকে মেয়েরা "দুর্বল" এই শব্দটার সাথে পরিচিত করে মানুষ করেছে। আজকে বড়ো হয়ে চিত্রিতা দেখে তার চারপাশে তারই সমবয়সী ছেলে মেয়েরা ছুটে খেলে বেড়াচ্ছে আবার তো কেউ কেউ ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার হয়ে বিদেশে চলে যাচ্ছে। এখন চিত্রিতার বয়স ২৪বছর, সে ছোট থেকে বাড়ির কাজ করেই নিত্যদিনের একঘেয়ে জীবন কাটিয়েছে অবশ্য চিত্রিতার বাবার ইচ্ছার বিরুদ্ধে তার মা একপ্রকার জোর করেই তাকে স্কুলে পাঠিয়েছিল আর এটাই ছিল চিত্রিতার জীবনের একঘেয়েমি থেকে একটু মুক্তি। সে স্কুলে উচ্চমাধ্যমিক পর্যন্ত পড়ে ছোট খাটো কাজে লেগে গেছে, এখন চিত্রিতার বাড়ি থেকে তার ইচ্ছার বিরুদ্ধে তার বাবা বিয়ে দেওয়ার জন্য সম্বন্ধ দেখছে । ঠিক এই সময় খবর এলো চিত্রিতাকে দুপুর থেকে বাড়িতে পাওয়া যাচ্ছে না। এত রাতে সবার মনে পড়েছে চিত্রিতা ঘরে নেই, সারা বাড়িতে তার বাবা মা-র মেয়েকে খোঁজার জন্য হুলুস্থূল পড়ে গেল আবার পাড়া থেকে কয়েকজন মুরুব্বি এলো তাদের মেয়েকে খুঁজতে কিন্তু সারারাত খোঁজার পরেও চিত্রিতাকে খুঁজে পাওয়া গেল না। অবশেষে খুঁজে না পেয়ে ভোরের আলো ফোটার মুখে সবাই ক্লান্ত হয়ে চলে গেল আর কেউ কেউ রুটিয়ে দিয়ে গেল কোনো ছেলের সাথে প্রেম ছিল চিত্রিতা তার হাত ধরেই পালিয়েছে। এমন অবস্থায় চিত্রিতার মা মেয়েকে না খুঁজে পেয়ে কাঁদছে আর তার বাবারও প্রায় একই অবস্থা আপসোস করছে কেন মেয়েকে লেখাপড়া না শিখিয়ে বিয়ে দেবার জন্য এত তাড়াহুড়ো করছিলো। এদিকে কেউই জানে না চিত্রিতা কোথায় গেছে অন্যদিকে চিত্রিতা হেটে চলেছে শুনশান এক পথ ধরে, মাঝে মাঝে হাপিয়ে গেলে থেমে কোনো গাছের তলায় বিশ্রাম নিচ্ছে আর ছোট জলাশয় দেখতে পেলে প্রাণ ভরে জল খাচ্ছে। সে নিজেও জানে তার বাড়িতে তার মা বাবা কত টা চিন্তা করছে তাকে দেখতে না পেয়ে কিন্তু তার কাছে আর কোনো উপায় ছিলো না তার এই বিয়ে টা আটকাবার একমাত্র সে পালিয়েই বাঁচতে পারতো। সে হেটে চলেছে মাইলের পর মাইল ধরে তার গন্তব্য জানা নেই। সে বাড়ি থেকে বেরিয়ে এসেছিলো তার এতদিনে কাজ করা কিছু টাকা নিয়ে, এই টাকাতে সে নিজেও জানে তেমন কিছুই করা যাবে না তাও সে নিজের উপর বিশ্বাস রেখে সুদূর দিগন্তে হেটে চলেছে। একসময় চলতে চলতে সন্ধে নামার মুখে চিত্রিতা দূরে একটি ছোট দোকান দেখে পায় এবং সে দ্রুত গতিতে এগিয়ে যায় দোকানটার দিকে সে দেখতে পায় দোকানে কিছু মধ্যবয়স্ক লোক বসে আছে, সে দোকানের কাছে যেতেই তাকে সবাই কেমন সন্ধেহের দৃষ্টিতে দেখছে। চিত্রিতা তাদের দৃষ্টিকে এড়িয়ে দোকানের ভিতরে প্রবেশ করে এবং দোকানদারকে একটু জল দেওয়ার জন্য অনুরোধ করে, তারপর চিত্রিতা জলটা নিয়ে পুরো জলটা চোখে মুখে দেয় ভালো করে এর ফলে ক্লান্তির কিছুটা উপশম হয়, সে দোকান থেকে দুটো বিস্কুট আর এক কাপ চা নিয়ে দোকানের ভিতরে এক কোনে গিয়ে বসে। চিত্রিতা এই একটা দিনে একা বাহিরে থেকে অনেক কিছুই উপলব্ধি করেছে বাহিরে টাকে চেনার বাহিরেটাকে জানার তার আগ্রহ বেড়েছে। এতিমধ্যে সন্ধে হয়ে গেছে চিত্রিতা চায়ের বিল মিটিয়ে তাড়াতাড়ি দোকান থেকে বেরিয়ে আসে আর আবারও হাঁটতে থাকে সামনের পথ ধরে আর দোকানে বসা লোক গুলো তার যাওয়ার পথের দিকে একই ভাবে তাকিয়ে থাকে। চিত্রিতা নিজেও জানে না সে কোথায় যাচ্ছে কিন্তু সে হেটে চলেছে, কিছুটা পথ অতিক্রম করার পর এক জায়গায় এসে পৌঁছায় আর দেখতে পায় একটা ছোট মাঠে কিসের একটা অনুষ্ঠান হচ্ছে, চিত্রিতা এগিয়ে দেখতে যায় কী হচ্ছে, সে দেখতে পায় মাঠের একপাশে মঞ্চ আর সেই মঞ্চের উপরে লাল নীল আলো জ্বলছে আর সুন্দর গান বাজছে আর সেই গানের সুরের সাথে তাল মিলিয়ে নাচ করছে কিছু ছোট মেয়ে। তার নজরে আসে তারই বয়েসি ২টি মেয়ে মঞ্চের একপাশে দাঁড়িয়ে কিছু একটা করছে, চিত্রিতা এগিয়ে যায় তাদেরকে লক্ষ করে এবং কাছে গিয়ে জিজ্ঞেস করে এটা কিসের অনুষ্ঠান হচ্ছে জবাবে তারা বলে এটা তাদের গ্রামের একটা অনাথ আশ্রমের বর্ষপূর্তির অনুষ্ঠান। চিত্রিতা কথাটা শুনে কিছুক্ষন চুপ থাকে তারপর মেয়েদুটির দিকে দৃষ্টি দিয়ে বলে "আমিও তোমাদের সাথে কাজ করতে চাই"। চিত্রিতার কথা শুনে তার সব থেকে কাছে দাঁড়িয়ে থাকা মেয়েটি বলে "তুমি কাজ করতেই পারো কিন্তু আমাদের এখানে একটা নিয়ম আছে, আমাদের অনাথ আশ্রমে শুধু অনাথ মেয়েরাই থাকে শুধু এমন না এমনও অনেক মেয়ে থাকে যাদের বাবা মা তাদের উপর অত্যাচার করে, সমাজ যাদেরকে নিচু চোখে দেখে এইরম মেয়েরাও থাকে আর আমাদের কাজ হয় তাদের খুশি রাখা। মেয়েটি থেমে আবারও বলতে শুরু করে "আমাদের গ্রামে একটা ছোট স্কুল আছে সেখানে অনাথ আশ্রমের বাচ্চারা পরতে যায় এবং আমাদের কাজ হয় সেইসব ছোট ছোট মেয়েদের শিক্ষিত করে বর্তমান সমাজের কাছে মেয়েরা যে দুর্বল নয় সেটাই দেখানো।" এই বলে মেয়েটি চুপ হয়ে যায়, এতক্ষন চিত্রিতা চুপ করে কথা গুলো শুনছিলো তার চোখের পাতা একটু ভিজে এসেছিলো তার জীবনে দুঃখের কথা গুলো মনে করে পরক্ষনেই নিজেকে সামলে নিয়ে চিত্রিতা জিগ্যেস করে "তোমাদের নিয়মটা তো বললে না? " তখন অপর মেয়েটি জবাব দেয় "আমাদের এখানে নিয়মটা খুব ছোট তুমি পালন করতে পারলে থাকবে, এখানে যারাই বাচ্ছাদের দেখাশোনা করে বাচ্ছাদের শক্তিশালী করে তোলে তারা প্রত্যেকেই এখানে থাকে এবং তাদেরকে একটাই লক্ষ স্থির করতে হয় আগে নিজে এমন হবো যাতে সমস্ত কিছু ভয়কে উপেক্ষা করে করতে পারি এবং সব দিক থেকে এগিয়ে থাকি " এই বলে মেয়েটি চিত্রিতার দিকে তাকায় তখন চিত্রিতা একটু ভেবে জবাব দেয় "আমি রাজি আমাকে পারবো"। ঠিক এর পরের দিন থেকেই শুরু হয় চিত্রিতার জীবনের এক নতুন অধ্যায়, সে অনাথ আশ্রমে থাকার জন্য একটি ঘর পায় এবং এর সাথে সে সেখানে থেকে ছোট ছোট বাচ্ছা মেয়েদের নানান কৌশল শিখিয়ে সমাজে কিভাবে সব দুর্বলতা কাটিয়ে সব কিছুকে জয় করা যায় এইসব শেখাতে থাকে তার নিজেরও ভালো লাগতো যখন সে বাচ্ছা দের সাথে থাকতো আর এইসব সেখাতো। দেখতে দেখতে ১২ টা বছর কেটে যায়, এখন চিত্রিতার বয়স ৩৬ বছর, সে এই ১২টা বছরে অনেক কিছু শিখেছে এর মধ্যে সে ৬বার পাহাড়ে ঘুরে এসেছে ১১ বার সমুদ্র ভ্রমণ করেছে বাচ্ছাদের সাথে নিয়ে সব মিলিয়ে এখন তার জীবন অনেকটাই অন্য রকম। চিত্রিতার এখন একটাই উদ্দেশ্য আশ্রমের বাচ্ছা মেয়েদের অগ্নিকন্যা তৈরী করা যাতে তারা সমাজের নারী বিরোধী কাজের বিরোধিতা করতে পারে এবং নতুন একটি নারীবিদ্বেষমুক্ত সমাজ গঠন করতে পারে। এর মধ্যে এত বছর পেরিয়ে গেছে আশ্রম থেকে পুরোনো কিছু মেয়ে যারা আশ্রমে পড়তো তারা কেউ বাহিরে গেছে মাউন্ট এভারেস্ট জয় করতে আবার কেউ বিদেশে গেছে ডাক্তারি পড়তে। চিত্রিতার মাঝে মাঝেই তার ছেড়ে চলে আশা বাড়ি তার বাবা মার কথা মনে পড়তো এখন তারা কেমন আছে কী করছে। বেশ কয়েকদিন ধরেই চিত্রিতার মন কেমন করছে তার বাবা মাকে দেখবে বলে, একদিন খুব ভোরে চিত্রিতা তার সাথে আশ্রমের পুরোনো ৪জন মেয়েকে নিয়ে বেরিয়ে যায় বাড়ির উদ্দেশ্যে, চিত্রিতা জানেও না তার বাড়িতে তার বাবা মা তাকে এতদিন পর মেনে নেবে কিনা কারণ সেতো কাউকে কিছু না বলে অভিমান করে চলে গেছিলো। এই সব ভাবতে ভাবতেই সে তার পুরোনো গ্রামে চলে আসে, এই ১২ বছর তার চেহারায় কিছুটা পরিবর্তন আসলে মুখোশ্রীটা একইরকম আছে গ্রামের কিছু মানুষ তাকে চিনতে পেরে তার দিকে তাকিয়ে থাকে কিছু ক্ষণ পড়েই চিত্রিতা পথ চিনে তার বাড়ির সামনে আসে। বাড়ির দরজা খোলই ছিল ভিতরে ঢুকে দেখে একজন বৃদ্ধ কাগজের ঠোঙা বানাচ্ছে আর একটা বয়স্ক মহিলা উনুনে আগুন দিচ্ছে, হটাৎই মহিলাটি পিছনে ফিরে চিত্রিতাকে দেখে এবং ক্ষীণ কণ্ঠে বলে ওঠে "চিত্রিতা তুই"! মহিলাটির মুখটা আনন্দে ভোরে ওঠে চিত্রিতাকে দেখে। চিত্রিতার বুঝতে ভুল হয়না এটা তার মা আর পাশে যে বসে ঠোঙা বানাচ্ছে সেটা তার বাবা। চিত্রিতার বাবা তার বৌয়ের মুখে চিত্রিতা নাম শুনে চমকে ওঠে আর দেখে সত্যি চিত্রিতা এসেছে তখন চিত্রিতার বাবা উঠে গিয়ে চিত্রিতাকে জড়িয়ে ধরে কাঁদতে থাকে এবং নিজের ভুলটা বলতে থাকে চিত্রিতাও তার বাবা মাকে ধরে অনেক কান্না করে অবশেষে চিত্রিতার সাথে আশা ৪টি মেয়ের সাথে তার বাবা মার পরিচয় করায় এবং অনাথ আশ্রমে এত বছর থাকা এবং কাজের কথা জানায়। চিত্রিতার সাথে থাকা ৪টি মেয়ের মধ্যে একজন ছিল এভারেস্ট জয় করা সেই মেয়েটি আর বাকি ৩জনের মধ্যে ২জন ছিল মহিলা জাতীয় দলের ফুটবল প্লেয়ার আর একজন মেয়ে ছিল যে তখনো মহাকাশ বিজ্ঞান নিয়ে পড়ছে তার ভবিষ্যতে চাঁদে যাবার ইচ্ছা আছে। ইতি মধ্যে চিত্রিতার বাড়ির বাহিরে ভিড় লেগে গেছে এভারেস্ট জয় করা মেয়েটিকে দেখবার জন্য আসলে এখন গ্রামেও খবরের কাগজ অনেকেই পড়ে তারা সেখান থেকেই এই মেয়েটির ছবি দেখেছিলো। সেইদিন চিত্রিতার বাড়িতে গ্রামের লোকজনের আসা যাওয়া লেগেই ছিল। কিছুদিন পর চিত্রিতা গ্রামের মাঠে একটি অনুষ্ঠান করে সেখানে মঞ্চে উঠে এভারেস্ট জই মেয়েটির সাথে সবাইকে পরিচয় করিয়ে দেয় এবং তার কথা সব্বাইকে বলে তার জীবন সংগ্রামের কথা বলে গ্রামের সকল মেয়েকে সাহস যোগায়। অনুষ্ঠানের শেষ মুহূর্তে চিত্রিতা তার গ্রামের লোককে এবং সমাজের কোনায় কোনায় থাকা নারীবিদ্বেষী মনোভাবাপন্ন মানুষগুলোকে উদ্দেশ্য করে একটা লাইন বলে - "ঘরে ঘরে জ্বলবে শিখা,দুর দিগন্ত কাঁপিয়ে আওয়াজ উঠবে নারীরা পণ্য না।"

"দিন বদলের সমাজে লেখা, নারীরা দুর্বল না নারীরাই শ্রেষ্ঠ বীর অগ্নিকন্যা।"


~ আমাদের সমাজে এখনো অনেক মানুষ আছে যারা মেয়েদের দুর্বল ভাবে, যারা মেয়েদের উপর প্রতি নিয়ত মানসিক এবং শারীরিক অত্যাচার করে যাচ্ছে। আসুন আমরা সবাই মিলে তাদের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তুলি। আমাদের মনে রাখা উচিত "মেয়েরা বোঝা নয় মেয়েরা পণ্য নয়" মেয়ে মানে "মা" মেয়ে মানে "মা দুর্গা", মেয়ে মানে "নারী শক্তি", মেয়ে মানে "অগ্নিকন্যা "!


Rate this content
Log in