Debdutta Banerjee

Others

3  

Debdutta Banerjee

Others

সম্ভবামি যুগে যুগে

সম্ভবামি যুগে যুগে

5 mins
9.5K


ফুলে ফুলে লাল হয়ে আছে কৃষ্ণচূড়া গাছটা। মৃদু হাওয়ায় একটা দুটো ফুল খসে পড়ছে। পায়ে পায়ে গাছটার নিচে এসে দাঁড়াই আমি। এই প্রথম দাদুর গ্ৰামের বাড়ি ঘুরতে এসেছি। আসলে আমার জন্ম লন্ডনে। দীর্ঘ পনেরো বছর পর বাপি আর মাম আমায় নিয়ে ইন্ডিয়া এসেছে। খুব ছোট বেলায় একবার এসে নাকি খুব অসুস্থ হয়ে পড়েছিলাম। তাই মাম আমায় নিয়ে আর আসতে চাইতো না। কিন্তু দাদু খুব অসুস্থ বলে আমরা এসেছি। 

আনমনে একটা টাটকা ফুল হাতে তুলে নিয়েছিলাম। এই ফুলটা লন্ডনে দেখিনি। নামটা কে যেন কানে কানে বলে গেলো, বিদেশে থাকলেও বেঙ্গলী সোসাইটিতে আর ক্লাবে যাতায়াতের জন্য বাংলাটা অনেকটাই জানি।ফুলের রেণু গুলো কি সুন্দর। ওদিকে একটা টেনিস বলের মতো সাদা ফুলের গাছ। কয়েকটা হলদে সাদা বলের মতো ফুল পড়ে রয়েছে। মন বলল ওটা কদম ফুল। নামটা ....

আচ্ছা ঐ গাছের ডালে একটা দোলনা ছিল না!! এগিয়ে গেলাম, কিন্তু নেই। ওধারে ভাঙ্গা ঠাকুর দালান। একসময় দুর্গা পূজা হতো। কেন জানি আমার মনে হয় সব চেনা। আমি আগেও এসেছি এখানে। এসে থেকেই একা একা ঘুরে বেড়াচ্ছি বাড়ির আনাচে কানাচে। ভগ্নপ্রায় এই সুবিশাল বাড়িতে দাদু থাকেন কয়েকজন কাজের লোক নিয়ে। বাড়িটায় ফাটল ধরেছে, এখানে ওখানে বট অশ্বত্থর চারা গজিয়েছে। একতলায় বিশাল বৈঠকখানায় বড় বড় তৈলচিত্র। মনে হয় এদের চিনি। সার সার বন্ধ ঘর আমায় হাতছানি দেয়। দোতলায় দক্ষিণের বড় ঘরে দাদু থাকেন। পাশেই বসার ঘর। উত্তরের বড় ঘরে আমাদের থাকার ব্যবস্থা। পাশেই লাইব্রেরী। আবার তিনটে তালা বন্ধ ঘর। ওধারে ছোট-কাকুর ঘর। উনি অস্ট্রেলিয়ায় থাকেন। গতবছর নাকি এসেছিলেন। আমাদের সাথে স্কাইপ আর ফেসবুকেই দেখা হয়। 

-"মিঠি, একা একা কোথায় ঘুরছ ? সন্ধ্যা হবে। ঘরে এসো। " মাম দোতলার বারান্দা থেকে আমায় দেখতে পেয়ে ডাক দিয়েছিল। পাখিরা সব ঘরে ফিরছে। তাদের কলকাকলি মুখরিত বাগান পার করে আমি এলাম পুকুর ঘাটে। কচুরিপানায় ভরে রয়েছে পুরোটা, একসময় অনেক মাছ হতো। ওধারে ফুলের বাগানে আগাছার জঙ্গল। কিন্তু আমার মন বলছে ওখানে একসময় ফুল ফুটত।

দোতলার মাঝের বন্ধ ঘরটা আমায় বড্ড টানছে কাল থেকে। মরচে ধরা তালা বলছে এ ঘর খোলা হয় না বহুদিন। মাধব কাকা বলেছিল এ ঘর আমার পিসির। মাম আর বাপি এক আত্মীয়র বাড়ি গেছিল পাশেই। দাদু ঘুমচ্ছেন। আমি একটা তার ঢুকিয়ে খুলে ফেলেছি ঐ ঘরের দরজা। বহুদিন কেউ ঢোকেনা। সারা ঘরে মাকড়সার ঝুল আর পুরু ধুলো, জানালার খড়খড়ির ফাঁক দিয়ে যেটুকু আলো আসছে তাতে এক নীলচে আলো-আঁধারী মায়া জাল তৈরি হয়েছে। পর্দা সরাতেই কাঁচের জানালা গলে বহুদিন পর রোদ্দুর এসে ঢুকল। বিছানায় বিবর্ণ গোলাপি চাদর। এক পাশে বইয়ের টেবিল। আঁকার সরঞ্জাম। ওধারে আলমারি। ছোট্ট আয়না আর ড্রেসিং টেবিল। একটা সুন্দর চন্দন কাঠের বাক্স। একটা পরিচিত গন্ধ ঘরটা জুড়ে।

-"দিদিভাই, তুমি এঘরে কি করে ঢুকলে? বড় কর্তা জানলে আমার চাকরী যাবে। " হারান কাকা আমায় বার করে ঘর বন্ধ করে দেয়। 

 

পরদিন দুপুরে মাথাটা দপদপ করছিল খুব। মাম রান্নাঘরে। বাপি আর দাদু নিচের ঘরে , গলার আওয়াজ পাচ্ছি। ডাক্তার কাকু এসেছেন দাদুকে দেখতে। চন্দন কাঠের বাক্সের চাবিটা পেয়েছিলাম টেবিলের ড্রয়ারে। ওতে একটা বিবর্ণ শুকনো গোলাপ ছিল। 

লাইব্রেরী ঘরে ঘুরতে ঘুরতে একটা মোটা বই চোখে পড়ল। আরব্য রজনী। বাংলাটা মা পড়তে শিখিয়েছিল। বইটা খুব চেনা, আনমনে বইটা খুলতেই এক জোড়া নূপুর আমার সামনে পড়ল। নূপুরজোড়া পায়ে পরে ছম্ ছম্ আওয়াজ তুলে সিঁড়ি বেয়ে নিচে নেমে গেলাম। বাপি আর দাদু আমার পায়ের শব্দে অবাক হয়ে তাকিয়ে রয়েছে। দু জনেই একসাথে বলে, -"এই নূপুর তুমি কোথায় পেলে?" 

আমরা সবাই বৈঠকখানায় বসে আছি।সন্ধ্যার শাঁখের আওয়াজ ভেসে আসছে আশেপাশের বাড়ি থেকে। 

 দাদু অনেকক্ষণ চুপচাপ, হঠাৎ নিস্তব্ধতা ভেঙ্গে বলে ওঠে, -"সমু আর রমুর পর আমার একটা মেয়ে ছিল স্নেহা। সমু যখন একুশ আর রমু আঠারো স্নেহা সদ্য পনেরোয় পা দিয়েছে। সারা বাড়ি ও একাই মাতিয়ে রাখতো। পড়াশোনা, নাচে, গানে ও ছিল অনন্যা। কিন্তু কি যে হল!! একদিন আচমকা আমার স্নেহা হারিয়ে গেলো। অনেক থানা পুলিশ হয়েছিল। রমু ,সমু কম খোঁজ করেনি, কিন্তু আর ওকে খুঁজেই পাইনি। ওদের মা সেই দুঃখে আর বেশিদিন বাঁচেনি।  

আজ মিঠিকে দেখে বারবার স্নেহার কথা মনে পড়ছে। অনেক মিল ওদের দু জনের। এই বয়েসেই আমার মেয়েটা ......" দাদুর গলা বুজে আসে কান্নায়। মাম্ আমায় জড়িয়ে ধরে করুণ চোখে বাপির দিকে তাকায়।

 বাপি একবার আমার দিকে তাকিয়ে বলে, -"পিসি ভাইঝির মিল তো থাকবেই। জিনগত মিল এগুলো। মিঠি ও এই বংশের মেয়ে। "

কিন্তু আমার মনে হয় আমি আরও অনেক কিছুই জানি। আর দু দিন পর আমাদের ফেরার পালা। মাম্ আমায় আগলে আগলে রাখছে। তবুও সেদিন দুপুরে খেলতে খেলতে ছাদে উঠে গেছিলাম। বিশাল ছাদের শেষ মাথায় দাঁড়ালে পাশেই রূপনারায়ণ নদী। বাঁধানো ঘাটে ছলাৎ ছলাৎ শব্দে জোয়ার আসছে। এই জলে আমার ভীষণ ভয়। সাঁতার শিখতে পারিনি এখনো। ছাদের শেষে লোহার ঘোরানো সিঁড়ি নেমে গেছে ঘাটের দিকে। 

আজ কেন জানি ঐ নদী আমায় ভীষণ টানছে। নদীর বাঁধানো ঘাট আমার ভীষণ চেনা। খুব ইচ্ছা করছে জলে পা ভেজাতে। মন্ত্রমুগ্ধের মতো সিঁড়ি বেয়ে নেমে চলেছি। পায়ে জলের ছোঁওয়া। বর্ষার ভরা নদী, জোয়ারের জলে ফুলে উঠেছে। আমি সুইমিং পুলের হাঁটু জলে নামতে বরাবর ভয় পেয়ে এসেছি। অথচ সিঁড়ি বেয়ে কোমর জলে নেমে এসেছি আজ। আস্তে আস্তে সব মনে পড়ছে। এখানেই সাঁতার শিখতে আসতাম মাঝে মাঝে, সবে ভাসতে শিখেছিলাম। সেদিন দুপুরে দুই দাদা তখনো কলেজে। একাই নেমে এসেছিলাম ঘাটে। তারপর বর্ষার চোরা স্রোতে ভাসিয়ে নিয়েছিল ছোট মেয়েটাকে। একে একে সব মনে পড়ছে। এই বাড়ি, এই বাগান, ঐ কদম গাছের দোলনা, পুকুর পারে মাছ ধরা....

-"মিঠি...." মামের ডাকে সম্বিৎ ফিরতেই টাল খেয়ে পড়ে যাচ্ছিলাম জলে, কোমর ছাপিয়ে বুক জলে দাঁড়িয়ে রয়েছি, কিন্তু আর জলকে ভয় পাচ্ছি না আমি। বাপি মামের চিৎকারে কাজের লোকেরাও বেরিয়ে এসেছিল। জল থেকে তুলে আমায় যখন ঘরে নেওয়া হল জ্বরে গা পুড়ে যাচ্ছে। সারাটা রাত একটা ঘোরের মধ্যে কাটল। কত কত পুরানো কথা মনে পড়ছে। একটা চাপা দুঃখ আবার একটা অন্য অনুভূতি....। 

ডাক্তার-কাকু পাশেই থাকেন। ছোট-কাকুর বন্ধু। সারারাত সেদিন আমাদের বাড়িতেই ছিলেন।আমি একদৃষ্টে তাকিয়েছিলাম। একসময় একসাথে কত খেলেছি, দোলনা চড়েছি, আমার জন্য পেয়ারা পাড়তে গিয়ে গাছ থেকে পড়ে ঐ চোখের উপরটা কেটেছিল। দাগটা এখনো আছে। আস্তে আস্তে উঠে বসলাম। কৈশোরের প্রথম ভালোবাসা কি ভোলা যায় !! 

-"এখন কেমন লাগছে ?" ওর প্রশ্নের উত্তরে হাল্কা হেসে বললাম -"কেমন আছো বুবু-দা?"

অবাক হয়ে ডাক্তার কাকু তাকিয়েছিল। দাদারা বুবাই ডাকলেও আমি একমাত্র ডাকতাম বুবু-দা। 

সম্পর্ক গুলো কেমন বদলে গেছে। নিজের বাড়ি ছেড়ে আবার ফিরে চলেছি অন্য দেশে। দাদুকে শুধু বলেছিলাম -"তোমায় মেয়ে ভরা নদীতে ভেসে গেছিল। খারাপ কিছু হয়নি। ওর জন্য একটা পূজা দিও। "

সাদা মেঘের সমুদ্রে প্লেনটা ভেসে চলেছে। এবার বাড়ি ফিরে সাঁতারটা শিখবো। জলের ভয়টা কেটে গেছে আমার। এবার ঠিক শিখতে পারবো।

#positiveindia


Rate this content
Log in