প্যাম্পু আর পুকপুকি
প্যাম্পু আর পুকপুকি
" প্যাম্পু, দুস্টুমি করবে না। এদিক সেদিক যাবে না।" মা হালকা করে একটু ধমকে দিলেন প্যাম্পুকে। প্যাম্পু বাধ্য ছেলের মত ঘাড় নাড়লো আসলে কিন্তু সে ভারী দুস্টু আর ছটফটে। একজায়গায় স্থির হয়ে থাকতে ভারী কষ্ট হয় তার। প্যাম্পু মায়ের কাছে গিয়ে একবার মায়ের গায়ে নিজের শুঁড়টা ঘষে দিল। মা বলল,"হয়েছে হয়েছে। দুস্টুমি করে এসে আদর খাওয়ার মতলব।" প্যাম্পু ফিক করে একটু হেসে ফেলল।
" আমরা একটু ওদিকে যাচ্ছি। তুমি এখানেই থাকবে কিন্তু।" মা প্যাম্পুকে সাবধান করে দিলেন। ওদিকে বোধহয় ভালো ভালো গাছপালা আছে। সবাই তাই খেতে যাচ্ছে। প্যাম্পুর এখন পেট ভর্তি। মা তাকে কচি কচি কলাগাছ খাইয়ে দিয়েছে। প্যাম্পুদের দলে প্যাম্পু ছাড়া আর কোনও বাচ্চা নেই। অবশ্য সে একাই একশ। প্যাম্পুরা চাঁদবিল নামে একটা গ্রামের পাশের জঙ্গলে এসেছে। এখানটায় জঙ্গলটা একটু হাল্কা। সবাই চলে যেতেই প্যাম্পুর মনে দুস্টুমি করার ইচ্ছেটা বুড়বুড়ি দিয়ে উঠলো। কি করা যায় ভাবতে লাগলো সে। এদিক ওদিক তাকাতে তাকাতে হঠাৎ একটা লাল রঙের বিশাল বড় বল দেখতে পেল আকাশ পারে। ওই বলটা তো আনতেই যেতে পারে সে। মা অবশ্য তাকে কোথাও যেতে বারণ করেছে কিন্তু মায়ের বারণ ছেলেরা কবেই বা শুনেছে অতএব প্যাম্পু চলল বল আনতে। জঙ্গল থেকে বেরিয়ে সে আলু চাষের ক্ষেতে নেমে পড়ল। বলটার দিকে এগিয়ে চলেছে সে কিন্তু মুশকিল হল বলটা এখনও তার নাগালের মধ্যে আসছে না। প্যাম্পুও দমবার পাত্র নয় । বলটা ধরেই ছাড়বে সে। লাল বলটা খুব পছন্দ হয়েছে তার। বলটার দিকে তাকিয়ে মাঠ পেরিয়ে চলেছে প্যাম্পু। হঠাৎ তার মনে হল পায়ের নীচের মাটিটা বোধহয় সরে গেল।
আগামী পরশুদিন পুকপুকির ছোটকার বিয়ে। বাড়িতে প্রচুর লোকজন আসছে। সবাই ব্যস্ত। পুকপুকিকে কেউ সময় দিচ্ছে না। মাও কাল থেকে শুধু সময়ে সময়ে তাকে খাওয়াচ্ছে, স্নান করাচ্ছে, ঘুম পাড়াচ্ছে। তাকে আদর করার সময়ই নেই মায়ের। পুকপুকিদের বাড়িটা চাঁদবিল গ্রামের শেষ প্রান্তে। বর্ধিষ্ণু পরিবার তাদের। প্রচুর জমি জায়গা আছে। মাঝখানে উঠোন আর তিনদিকে মস্ত মস্ত বারান্দা ঘেরা বড়সড় দোতলা মাটির কোঠাবাড়ি তাদের। পুকপুকিকে বারান্দায় মাদুর বিছিয়ে বসিয়ে দিয়েছে তার মা। পুকপুকির বাবা রোজ অফিস থেকে ফিরে পুকপুকিকে কত্ত আদর করেন। ওই পঞ্চায়েত অফিস নামে একটা অফিসে কাজ করেন তার বাবা। আজ ফিরে এসেই পাড়ার কাকুদের সাথে বাইরে চলে গেলেন। হাতির পাল এসেছে তারা যাতে কোনও ঝামেলা না করতে পারে সেসব নিয়ে আলোচনায় মত্ত । পুকপুকির দিকে তাকানোর সময়ই নেই। দাদু,ঠাম্মি, মেজকা, কাম্মা সবাই দৌড়াদৌড়ি করছে খালি। পুকপুকিকে কেউ কোলে নিচ্ছে না, আদর করছে না। তার এই দুবছর বয়সে এত অবজ্ঞা, অবহেলা আজ পর্যন্ত পেতে হয়নি পুকপুকিকে। অভিমানে ঠোঁট ফুলে যাচ্ছে তার। তবে কি কান্নাকাটি করা, বায়না করা তার স্বভাব নয়। ভারী ভালো মেয়ে সে তাই নিজের মনেই খেলনাগুলো নিয়ে খেলছিল। হঠাৎ তার নজর পড়ল নতুন গান করা পুতুলটার দিকে। পিসিমনি এনে দিয়েছে তাকে। পুকপুকির মনে হল পুতুলটা তার বন্ধু ডাবলুকে দেখানো হয়নি তো। কারুর তো সময় হবে না তাকে ডাবলুদের বাড়িতে নিয়ে যাওয়ার। তাহলে সে একলাই পুতুলটা নিয়ে ডাবলুদের বাড়ি চলে গেলে কেমন হয়। সে তো বেশ বড় হয়েই গেছে মনে হয়। পুতুলটাকে নিয়ে বারান্দা থেকে নেমে পড়ল পুকপুকি। এগিয়ে চলল সদর দরজার দিকে। বাড়ির বাইরে বেরিয়ে পড়ল সে। সবাই এখন বাড়ির ভেতরে ব্যস্ত। কেউ খেয়াল করল না তাকে। ডাবলুদের বাড়ি সে একলা কখনও যায়নি। মনে হয় ওইদিকে ডাবলুদের বাড়ি। ছোট্ট ছোট্ট পায়ে এগিয়ে চলল পুকপুকি।
" বড়দা, পুকপুকিকে কোথাও খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না।" পিসিমনি ছুটতে ছুটতে বাইরে এসে পুকপুকির বাবাকে বললেন।
" কি বলছিস তুই!" চিৎকার করে উঠলেন পুকপুকির বাবা।
সারাবাড়িতে হুলুস্থুলুস পড়ে গেছে। পুকপুকির মা অজ্ঞান হয়ে গেছেন। সবাই নিজেদের দোষারোপ করছে ব্যস্ত হয়ে পড়ার জন্য। সারা গ্রামের লোক লেগে পড়ল পুকপুকিকে খুঁজতে।
বল আনতে এসে প্যাম্পু ভারী বিপদে পড়ল। মানুষগুলো যে মাঠের মধ্যে এত্ত বড় গর্ত করে রেখেছে সে বুঝতেই পারেনি। এখান থেকে উঠতেও পারছে না সে। মায়ের জন্য ভারী মন কেমন করছে তার। মা তাকে অনেকবার মানা করে গিয়েছিল কোনও দিকে যেতে। মা নিশ্চয়ই এখন তাকে খুঁজছে। এদিকে পুকপুকিও ঠিক বুঝে উঠতে পারছে না ব্যাপারটা কি হল। সে যাচ্ছিল ডাবলুদের বাড়ি হঠাৎ করে ঝুপ করে একটা কিসের ওপর পড়ে গেল। এটা যে ডাবলুদের বাড়ি নয় সেটা নিশ্চিত। জিনিসটা একটু নড়ে উঠল। এবার পুকপুকি ভয় পেয়ে চিৎকার করে কাঁদতে আরম্ভ করে দিল। আরে! এই মানুষের ছানাটা আবার কোথেকে এসে গায়ে পড়ে কান্নাকাটি জুড়ে দিল। এর হাতে আবার কি একটা ছিল। সেটা প্যাঁ প্যাঁ করে বাজছে। প্যাম্পু কিচ্ছু বুঝতে পারছে না কি হচ্ছে ব্যাপারখানা।
চাঁদবিলের জঙ্গল ধারে পুরো গ্রাম ভেঙে পড়েছে। পাত্রদের বাড়ির পুকপুকি শ্যালো মেশিনের জন্য খোঁড়া গর্তে পড়ে গেছে। শুধু তাই নয় ওই গর্তেই আবার আগে থেকেই একটা বাচ্চা হাতি পড়েছিল। এমন ঘটনা তো সচরাচর ঘটে না তাই বনবিভাগের সাথে সাথে শহর থেকে তড়িঘড়ি দমকলও এসে গেছে। সাংবাদিকরাও হাজির। প্যাম্পু আর পুকপুকির জন্য চাঁদবিল আজ সরগরম। জঙ্গলের প্রান্তে হাতির দলটাও দাঁড়িয়ে আছে। প্যাম্পু আর পুকপুকি এমনভাবে পড়েছে যে দুজনকে প্রায় একসাথেই উদ্ধার করতে হবে। বিকেল থেকে সন্ধ্যে গড়িয়ে রাত নামছে। মাঠে আলোর ব্যবস্থা করা হয়েছে। অবশেষে ফরেস্ট কাকু আর দমকল কাকুরা সম্মিলিত চেষ্টা করে প্রথমে পুকপুকি আর তারপর প্যাম্পুকে গর্ত থেকে তুললেন। উল্লাসে ফেটে পড়ল সবাই।
প্যাম্পু অবাক হয়ে তাকিয়ে আছে। দলের অন্যরা তো পরের কথা মাও তার কাছে আসছে না। মানুষরা অনেক দূরে সরে দাঁড়িয়ে আছে তাও মা প্যাম্পুর কাছে আসছে না কেন! ওই ভালো মানুষরা তার সামনে একছড়া পাকা কলা রেখে গেছে। সে অনেকক্ষণ কিছু খায়নি কিন্তু তাও যেন তার খিদে পাচ্ছে না। সে শুঁড় তুলে মাকে ডাকলো। এ কী! তার দলের সবাই যেন জঙ্গলের ভেতরে চলে যাওয়ার উপক্রম করছে! হঠাৎ প্যাম্পুর মনে পড়ল, একবার মা তাকে বলেছিল যে হাতিদের গায়ে যদি মানুষের গন্ধ লেগে যায় তাহলে সেই হাতিকে দল আর ফেরত নেয় না। তাকে একলা থাকতে হয়। তাহলে কি প্যাম্পুকে...। না না এ হতে পারে না। মাকে ছেড়ে প্যাম্পু একলা থাকতে পারবে না।
" মা আ আ।" শুঁড় তুলে চিৎকার করে উঠে দৌড়তে আরম্ভ করলো প্যাম্পু। দলের অনেকেই জঙ্গলের ভেতরে চলে গেছে। প্যাম্পুর মা-বাবা আর কয়েকজন তখনও দাঁড়িয়ে আছে।
প্যাম্পুর বাবা প্যাম্পুর মাকে বলল যে সবাই বলছে প্যাম্পুকে আর দলে গ্রহণ করা হবে না। প্যাম্পুর মায়ের চোখ দিয়ে টপটপ করে জল পড়ছে। তার প্যাম্পু তো এখনও ছোট। একলা থাকবে কি করে? একটু দুস্টু কিন্তু ভারী সোনা বেটা তার প্যাম্পু। মাকে ছেড়ে কখনও থাকেনি সে। ও তো এখনও নিজে ভালো করে খাবার পর্যন্ত জোগাড় করতে পারে না। প্যাম্পুর মায়ের চোখে ভেসে উঠল একটু আগে দেখা কিছু দৃশ্যের কোলাজ। পুকপুকিকে তোলার পর ওখানে উপস্থিত সবাই একবার করে তাকে কোলে নিয়েছে, আদর করেছে। গোটা গ্রাম যেন তাদের ঘরের মেয়েকে ফেরত পেয়েছে আর তার মা-বাবা তো কোলে নিয়ে পাগলের মতো হামি খাচ্ছিল আর কাঁদছিল। ওই বাচ্চাটা তো প্যাম্পুর গায়ের ওপর পড়েছিল তাও তো হাতির গন্ধ লেগেছে বলে কেউ ওকে ফেলে পালিয়ে যাচ্ছে না। সবাই ওকে ঘরে ফিরিয়ে নিয়ে যাওয়ার জন্য উদগ্রীব তাহলে তার প্যাম্পুকে কেন একলা থাকতে হবে? মানুষরা যদি তাদের বাচ্চাকে ফিরিয়ে নিতে পারে তাহলে হাতিরা তার প্যাম্পুর বেলায় এমন করবে কেন? মনকে শক্ত করল প্যাম্পুর মা। সে তার প্যাম্পুকে কিছুতেই একলা ছেড়ে দেবে না। দরকার হয় সে নিজে দল ছেড়ে দেবে। প্যাম্পুর বাবাকে নিজের সিদ্ধান্তের কথা জানিয়ে এগিয়ে গেল প্যাম্পুর মা। প্যাম্পু মাকে ডাকতে ডাকতে ছুটে আসছে।
মা শুঁড় বুলিয়ে বুলিয়ে প্যাম্পুকে আদর করছে। প্যাম্পুও শুঁড় দিয়ে মাকে হামি দিচ্ছে। প্রথমে প্যাম্পুর বাবা আর পেছনে বাকিরাও তাদের আদরের প্যাম্পুর কাছে আসছে। আকাশের গোল পূর্ণিমার চাঁদটা থেকে তখন একরাশ জোছন হাসি ঝরে পড়ছে।