ফ্ল্যাটের বাসিন্দা
ফ্ল্যাটের বাসিন্দা
লকডাউনের জন্য ওয়ার্ক ফ্রম হোম চলছে শুভর। গত বছরই তল্পিতল্পা গুটিয়ে ব্যাঙ্গালোর থেকে সোজা কলকাতায় এসে নিজের বাড়িতে বসেই কাজ করছে এখন ও। দিব্যি, খোশমেজাজে দিনকাল ভালোই কাটছিল। কিন্তু অফিসের ল্যাপটপের হার্ডওয়্যার ইস্যু দেখা যেতে একটু সমস্যা হল বৈকি। অগত্যা একবার ব্যাঙ্গালোর যেতেই হবে। নিজের সাধের ব্যাঙ্গালোরের ফ্ল্যাটটা ঠিকঠাক আছে কিনা দেখেও আসা যাবে। বড্ড আপন ওই ফ্ল্যাটটা। এছাড়া ব্যাংকের টুকটাক কাজও না হয় মিটিয়ে নেওয়া যাবে। সর্বপরি নিজের কর্মক্ষেত্রের শহর তথা সেকেন্ড হোমে একবার ঢুঁ মেরে আসা যাবে।
যাই হোক, কোভিড-বিধি মেনে ফ্লাইটে চেপে ব্যাঙ্গালোরের উদ্দেশে রওনা হল শুভ। একটা চাপা আনন্দ কাজ করছে শুভর মনে। নীল আকাশও সাদা মেঘকে বুকে জড়িয়ে সেই আনন্দ ভাগ করে নিতে আজ দোসর হয়েছে শুভর। সময়মতো ব্যাঙ্গালোর পৌছালো শুভ। ফাঁকা রাস্তায় হু হু করে যখন গাড়ি ভাড়া নিয়ে ফ্ল্যাটের দিকে চলছে শুভ তখন শহরটায় কাটানো স্মৃতিরা যেন হুড়মুড়িয়ে হানা দিচ্ছে শুভর মনে।
ওই তো সেই ক্যাফেটা। অফিস থেকে ফেরার পথে বন্ধুরা মিলে আড্ডা মারত। ডান দিকের শপিং মলটাও বন্ধ। উইকএন্ডে মুভি দেখা থেকে শখের কেনাকাটি, সব-ই তো এই শপিংমলটায়। ফ্ল্যাটটাকে আস্তে আস্তে খুব সুন্দর করে সাজিয়ে তুলছিল শুভ। রংবেরঙের নানান ডিজাইনের শো পিসের সাথে নবাবী আমলের পুরোনো ঝাড়বাতি, এই সব কিছু দিয়ে নিজের ফ্ল্যাটটাকে সম্পূর্ণ আলাদাভাবে সাজিয়ে তুলছিল ও। কত পেন্টিং, ফটোগ্রাফ, ডিজাইনার ওয়াল ক্লক দেওয়ালের শোভা বাড়িয়েছিল। বারান্দায় রাত্রিবেলা আরাম করে বসার জন্য একটা ইজি চেয়ারও কিনেছিল শুভ। জিনিষপত্রগুলোর উপর মায়া পড়ে গেছিল। তাই তো গত বছর যখন ফিরল তখন বেশ কিছুদিন মন খারাপ ছিল শুভর। নিজের হাতে সাজানো গোছানো ফ্ল্যাটটাকে খুব মিস করত ও।
ঘরের দেওয়ালের রংটা হালকা হয়ে যায়নি তো? আচ্ছা! ডাইনিংয়ের ঘড়িটা পেন্ডুলাম দুলিয়ে দুলিয়ে এখনো চলছে নাকি বন্ধ হয়ে গেছে? ধুলো তো পড়েছে নিশ্চই। তিন-চার দিন সময় নিয়ে এসেছে, যতটা পারবে ফ্ল্যাটটার ঝুল ধুলো ঝেড়ে পরিষ্কার করে রাখবে। আবার কবে আসবে ঠিক নেই। নিজের ফ্ল্যাটটাকে দেখবে সেই আনন্দ আর সেই ফ্ল্যাটটা কেমন অবস্থায় আছে তার আশঙ্কা, এসবের দোটানার মাঝে পড়ে শুভর আর তর সইছে না।
অবশেষে নিজের কমপ্লেক্সে পৌঁছালো শুভ। সেই গমগম ভাবটা নেই। অধিকাংশ বাসিন্দাই মনে হয় নিজের দেশের বাড়ি চলে গেছে লকডাউনের কারণে। চায়ের বন্ধ দোকান, স্ট্রিট ফুডের বন্ধ কাউন্টারগুলোকে দেখে মোটেই ভালো লাগছে না শুভর। অবশেষে যখন নিজের ফ্ল্যাটের সামনে এসে দাঁড়ালো ও, তখন যেন মনের ভেতরে এক অদ্ভুত প্রশান্তি কাজ করছে। দরজাটা চাবি দিয়ে খুললেই এক অদ্ভুত নস্টালজিয়ার গন্ধ ভেসে আসবে, জানে ও। মুখে স্মিত হাসি রেখে চোখ বন্ধ করে দু সেকেন্ড দাঁড়ালো ও। মনেই হচ্ছে না, এক বছরের বেশি সময় বাদে আবার ফ্ল্যাটের সামনে এসেছে ও। বরং মনে হচ্ছে প্রতিদিনের মতোই অফিস থেকে ফ্ল্যাটে ফিরেছে যেন। দরজার চাবিটা ঘুরিয়ে হাতলটা চাপ দিতেই ক্যাঁচ করে শব্দ করে দরজাটা খুলল। বাঁদিকের সুইচ বোর্ডের একদম বাঁদিকের সুইচটা অন করতে ঘরের আলোও জ্বলে উঠল।
কিন্তু একি হাল!! ঘরের একি অবস্থা! সারা ঘরের মেঝেতে পক্ষীবিষ্ঠা, পাখির পালক। শুধু মেঝে না! সোফা, বিছানাপত্র, টেবিল চেয়ার সবেতেই পক্ষী বিষ্ঠা। ডানা ঝাপটানোর আওয়াজ পেয়ে শুভ দেখল দিব্যি একটা পায়রা বাথরুমের খোলা স্কাইলাইটটা দিয়ে প্রবেশ করে ওর সাধের ঝাড়বাতিটার মধ্যে আশ্রয় নিল। ওখানে আরো কিছু পায়রা দিব্যি রয়েছে। হতাশ হয়ে ধপ করে সোফায় বসতে যাবে, কিন্তু নিজেকে সামলে নিল শুভ। সোফায় যে পক্ষীবিষ্ঠা, বসবে কি করে! রান্নাঘরের দিকে চোখ পড়তে শুভ বুঝল শুধু পায়রা নয়, ওদিকে চড়াই পাখির-ও অবাধ আনাগোনা। পাখিগুলো অবশ্য অনাহুত অতিথির আগমন পছন্দ করছে না। কিচিরমিচির আর বকমবকম শব্দে তার প্রতিবাদও জানাচ্ছে বটে।
সত্যি কিছুই বুঝতে পারছে না শুভ। কি করবে ও!! যেদিন ও নিজের বাড়ি ফেরার জন্য এসেছিল, সেদিন মেইন দরজা এবং সব ঘরের সব জানালা বন্ধ করে এলেও বেডরুম থেকে রান্না ঘর কোনো ঘরেরই দরজা বন্ধ করেনি। তাই স্কাইলাইট দিয়ে ঢুকে গোটা ফ্ল্যাট জুড়েই পাখিগুলো যে দৌরাত্ম্য চালিয়েছে তা বুঝতে আর বাকি নেই শুভর। কিভাবে কি করবে, কিছুই মাথায় আসছে না। একবার তো মনে হল, যা আছে থাক! আবার যখন পার্মানেন্টলি থাকবে তখন আবার ব্যবস্থা করবে না হয়! এখন তিন-চারটে দিন কোনো হোটেলে থেকে নেওয়া যেতে পারে। কিন্তু না! এইভাবে নিজের সাধের ফ্ল্যাটটাকে অপরিষ্কার রেখে যাবার আক্ষেপ আজীবন বয়ে বেড়াতে হবে।
প্রায় চার পাঁচ ঘণ্টা ধরে ঘর মুছে বেডরুমে আলো নিভিয়ে শুয়ে পড়ল শুভ। সারাদিন বড্ড ধকল গেছে, কিন্তু ঘুম আর আসে কই। পাখিগুলোর কি ব্যবস্থা হবে! আবারও তো ঘর অপরিস্কার হবে।
যেকোনো একটা সিদ্ধান্ত শুভকে নিতে হবে আগে। পাখিগুলোকে কোনো ভাবে রাখবে নাকি তাড়িয়ে দেবে! এখন ফ্ল্যাটে কেউ থাকে না। কিছু পাখি যদি মাথা গোজার ঠাঁই পাবার আশায় তার ঘরে আশ্রয় নেয় তবে ক্ষতি তো কিছু নেই। পরক্ষণেই শুভর মন সায় দিচ্ছে না। নিজের সাজানো ফ্ল্যাটটাকে তো ওরা আবারও অপরিষ্কার করবে। মনের অবস্থা বড্ড টালমাটাল, বড্ড দোটানায় পড়েছে শুভ।
ওদের তাড়িয়ে দিলে কি হবে! ওরা গাছে বাসা খুঁজে নেবে ঠিক। ওদের তাড়িয়ে স্কাই-লাইটটা বন্ধ করলেই কেল্লা ফতে। সেই ভালো বরং। এসব উল্টোপাল্টা জিনিসে মায়া বাড়িয়ে লাভ নেই। প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হল শুভ। মিস্তিরি ডেকে স্কাই লাইটটা বন্ধ করতে হবে।
যেমনি ভাবা তেমনি কাজ। হাতে তো বেশি সময়ও নেই। তড়িঘড়ি মিস্তিরি ডেকে এনে স্কাইলাইট বন্ধ হল। ঘরে সেই উগ্র গন্ধটাও নেই। পরিষ্কার ঘরটাকে দেখে বেশ ভালো লাগছে শুভর। চিন্তায় গত দুদিন রাতে ঘুমও হয়নি শুভর। আজ একটু ভালো করে ঘুম লাগালো ও। কাল বাদ পরশু কলকাতায় ব্যাক করবে। কাল টুকটাক কিছু কাজ সেরে নেবে ক্ষণ। দুদিন তো পাখি তাড়ানো এপিসোডেই দিন চলে গেল।
পরদিন সকালে ঠকঠক শব্দে ঘুম ভাঙল শুভর। ধুর! এখন কে ঠকঠক করবে! শোনার ভুল হবে হয়তো। না, আওয়াজটা হচ্ছে তো। পাশ ফিরল শুভ। ওমা! কাঁচের জানলায় একটা চড়াই পাখি টোকা মেরে চলেছে নিজের মত করে। ও কি বলতে চাইছে! ও কি ওদের বাসস্থানে ঢোকার রাস্তা বন্ধ করে দেবার জন্য শুভর কাছে অভিযোগ জানাতে এসেছে? তাই হবে। খুব ছোটবেলায় শুভ গ্রামের বাড়িতে থাকত। উঠোনে বসে সকালে যখন মুড়ি খেত তখন এরকম চড়াই আসত। শুভ মুড়ি খেতে দিত চড়াইগুলোকে। বন্ধুদের মত যেন একসাথে বসে মুড়ি খেত ওরা। চড়াইগুলো কি সেই বন্ধুত্বের দাবি নিয়ে পুরোনো স্মৃতি মনে করাতে এসেছে? হবে হয়তো। জানলাটা খুলে দিল শুভ। কই! ঘরে ঢুকলো না তো! বরং ফুরুৎ করে উড়ে গেল। অভিমান করেছে মনে হয়। মনটা বড্ড খারাপ হয়ে গেল শুভর। পায়রাগুলোও কার্নিশে এসে বসছে। কই! জানলা খোলা পেয়েও ঘরে এসে ঢুকছে না তো!
মাথায় হঠাৎই একটা বুদ্ধি এল শুভর। সঙ্গে সঙ্গে কাজ শুরু। খোঁজখবর নিয়ে বেরিয়ে আর্টিফিসিয়াল ট্রি, হাউস নেস্ট কিনে এনে বারান্দায় সুন্দর করে সাজিয়ে রাখল শুভ। থাকুক না ওরা এই খোলা বারান্দাটায়। ক্ষতি কি! মাথার উপর ছাদটা তো পাবে। ওরা তো এইটুকুই চেয়েছিল হয়তো। তখন বিকেল হচ্ছে, বারান্দায় ঠিকঠাক করে জিনিষপত্রগুলোকে রেখে ঘরে ঢুকতে যাবে, শুভর কাঁধে একটা চড়াই পাখি এসে বসল। যেন কতদিনকার আত্মীয়তা ওদের। ঘাড় ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে এদিক ওদিক দেখছে। শুভ হেসে চড়াইটার দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করল
- কিরে? ধন্যবাদ জানাতে এসেছিস বুঝি?