নবাবের শহরে একদিন
নবাবের শহরে একদিন


আজ সকাল থেকেই সোনাইয়ের মনটা উড়ুউড়ু, হবে নাইবা কেন, আজ অনেকদিন পর পছন্দের কার্টুনগুলো যে দেখতে পাবে৷ এতদিন পরীক্ষার জন্য মায়ের কড়া নিষেধ ছিল সোনাই যেন একদম টিভির রিমোটের দিকে ভুল করেও হাত না দেয়৷ সোনাইও মায়ের কথা অক্ষরে অক্ষরে পালন করেছে৷ এতদিন বুকে একপ্রকার পাথর চাপা দিয়ে রেখেছিল৷ শত ইচ্ছে হলেও টিভির ঘরে একবারের জন্যও আসেনি৷ কালকেই পরীক্ষা শেষ হয়েছে তাই আজ আর আনন্দ ধরছে না৷ আরও একটা আনন্দের বিষয় অবশ্য আছে। সেটা হল অনেক দিন পরে ওরা পুরো পরিবার মিলে মুরশিদাবাদ ঘুরতে যাবে। ইতিহাস বরাবরই সোনাইয়ের পছন্দের বিষয়। তাই সেদিন যখন ছোট কাকা মুরশিদাবাদ যাওয়ার কথা বলল সবথেকে বেশী খুশি সোনাই হয়ে ছিল।
আজ শুক্রবার (২৮/১২/১৯), ওর খালি মনে হচ্ছে কবে যে রবিবারটা আসবে। দেখতে দেখতে শনিবার এসে গেল, ওদের রবিবার ভোর ৬:৫০-এর হাজারদুয়ারি এক্সপ্রেসের টিকিট কাটা আছে। সেই জন্য ওরা বাড়ি থেকে তাড়াতাড়ি বেড়িয়ে পড়ল। যথাসময়ে ওরা কলকাতা স্টেশনে চলে এল। সবাই ট্রেনে উঠে পড়েছে। সোনাই তো খুশিতে পাগল হয়ে যাচ্ছে। জানলার ধারে বসে বাইরের অপরূপ দৃশ্য দেখতে দেখতে ওর মনে হচ্ছে ও যেন কোনো দেখছে। ঠিক বেলা ১১টার সময় ওরা মুরশিদাবাদ পৌঁছে গেল। ওখানে ওদের আগে থেকেই হোটেল বুক করা ছিল।সবাই মিলে দুটো টোটো ভাড়া করে নিয়ে হৈহৈ করতে করতে হোটেলের উদ্যেশে রওনা দিল। হোটেলে পৌছে যে যার ঘরে গিয়ে একটু জিরিয়ে নিয়ে ঘুরতে বেরোবার জন্য টোটোতে উঠে পড়ল। প্রথমেই ওরা গেল কাটরা মসজিদে, ওখানে গিয়ে ওরা একটা গাইড ভাড়া করে ভিতরে ঢুকল। গাইড ওদের সাথে পুরো জায়গাটা ঘুরতে ঘুরতে এই জায়গার ইতিহাস বলে লেছে- কাটরা মসজিদ হল খুব প্রাচীন ও ইসলামিক নিদর্শন। এটি ১৭২৩ খ্রিস্টাব্দে নবাব মুরশিদকুলি খা তৈরি করেন। মসজিদের উপরের মুক্ত অঙ্গণ চারিদিক দিয়ে দোতলা কক্ষ বেষ্টিত। এটির ঐতিহ্য শুধুমাত্র ইসলামিক শিক্ষার কেন্দ্র হিসাবে নয়, এটি বিখ্যাত মুরশিদকুলি খার সমাধির জন্য যিনি প্রবেশপথে সিড়ির নীচে শায়িত আছেন। মসজিদের চারকোণে মিনারের মতো চারটি বৃহদায়তন আলম্ব আছে। সোনাই তো খুব মনোযোগ সহকারে গাইডের সব কথা শুনছে। অনেক ঘোরার পর সবাই সামনেই একটা হোটেলে দুপুরের খাওয়ার খাবার জন্য ঢুকল।
খুব একটা আহামরি না হলেও মোটের উপর বেশ ভালোই। তখন সবাই খিদের টানে সবজি ভাতও চোখ বুজিয়ে খেয়ে নিচ্ছে। সোনাই তো অবাক ওর ছোট ভাই শুভমকে দেখে। যে ছেলে মাছ ছাড়া ভাত খায়না সে আজ চুপচাপ খেয়ে নিচ্ছে। সবার খাওয়া হয়ে গেলে ওরা আবার টোটোতে গিয়ে বসেছে। ওদের পরবর্তী গন্তব্য কাঠগোলা বাগানবাড়ি। এক বিশাল জায়গা জুড়ে এই বাগানবাড়ি। এখানে এসে প্রথমে ওরা দেখল একটা গোপন সুড়ঙ্গ পথ,যার মাধ্যমে আগেকার দিনে নৌকাপথে যাতায়াত করা হতো। এই পথটির অপর প্রান্ত গঙ্গায় গিয়ে মিশেছে। এখানে একটা মিউজিয়াম আছে। সেখানে নবাবদের ব্যবহার করা সমস্ত জিনিস রাখা আছে। আর সবথেকে আকর্ষণীয় জিনিস হল কালো রঙের গোলাপের বাগান। আরও অনেক রকমের ফুল আছে যেমন ডালিয়া, জিনিয়া, চন্দ্র মল্লিকা, সূর্যমুখী। এখানে অনেক হনুমানও দেখতে পাওয়া যাচ্ছে। এখানে একটা পাখিরালয় আছে। ওখানে দেশ-বিদেশের নানা জাতের পাখি আছে। সবথেকে আকষর্ণীয় হল ম্যাকাও টিয়া আর এমু পাখি। এইসব দেখতে দেখতে ওদের ৪টে বেজে গেল। ওরা এবার যাবে কাশিমবাজার রাজবাড়ী দেখতে। সেখানে যাওয়ার পথে নশিপুর রাজবাড়ীটা বাইরে থেকে দেখে নেওয়া হলো। ওখানে ভেতরে যেতে দেয়না। কাশিমবাজার রাজবাড়ী গিয়ে ওখানে রূপোর রথ দেখতে পেল। আগেকার দিনে মাএ আশি টাকায় কেনা অসটিন গাড়িও দেখল সোনাই। ওখানে তখনকার দিনে রান্না করার বড়ো বড়ো হাড়ি কড়া খুন্তি হাতা সবকিছু দেখে সোনাই তো অবাক হয়ে গিয়েছিল। ওখান থেকে ফেরার পথে জগৎ শেঠের বাড়ি দেখতে গিয়ে জানতে পারল এইখানে এখন মেরামতের কাজ হচ্ছে। তাই ওরা সোজা চলে গেল ওদের পরবর্তী গন্তব্য হল মীরজাফরের বংশধরদের এগারোশো খানা সমাধিস্থল। এখানে অবশ্য প্রবেশ মূল্য দিয়েই ঢুকতে হয়। তবে খুবই সামান্য, মাএ ৫/- টাকা। টিকিট কেটে সবাই ঢুকল ভিতরে। বেশিরভাগ সমাধি ধবংস হয়ে গেছে। তার মধ্যে কয়েকটি একটু ভালো অবস্থায় আছে। তবে পুরো পরিবেশটা কেমন যেন গা ঝমঝম করা। সোনাই নিজের মনেই বলে ওঠে, ভাবা যায় এতগুলো সমাধি মাঝখানে দাড়িয়ে আছি। টোটোওয়ালা তাড়া দিল।সবাই আবার যে যার মতো ওঠে পড়ল। এরপর ওরা যাবে মুরশিদ কুলি খা-র মেয়ে আজিমউন্নিসা বেগমের জীবন্ত সমাধি দেখতে। এখানে একজন লোক সবাইকে এখানকার ইতিহাস বলছিল- আজিমউন্নিসার এক কঠিন অসুখ হয়েছিল তখন তাকে প্রতিদিন একজন যুবকের কলিজা খেতে হতো। এইভাবে ওনার অসুখ সেরে গেলেও উনি এই কলিজা খাওয়া ছাড়তে পারেন নি। উনি প্রায়ই একজন করে যুবকের কলিজা খেতে থাকেন। এই কথা জানতে পেরে ওনার স্বামী সুজাউদ্দৌলা ওনাকে জীবন্ত কবর দেন। পিতার ন্যায় উনিও সমাধির প্রবেশ সোপানের তলদেশে সমাহিত আছেন। এই করুণ ইতিহাস শোনার পর সোনাইয়ের মনটা একটু ভার হয়ে গেল। এরপর ওরা গেল মতিঝিল পার্কে। ওখানে টিকিট কেটে ঢুকতে হয়। জন প্রতি ২০/- টাকা। অন্ধকার হয়ে যাওয়ায় ওরা বেশী ভালো করে ভেতরটা ঘুরতে পারেনি। ওখানে সন্ধ্যেবেলা লাইট অ্যান্ড সাউন্ড শো হয়। সেটার জন্যও টিকিট কাটতে হয়।জন প্রতি ২০/- টাকা। এই শো না দেখলে ইতিহাসের এক করুণ বেদনাদায়ক অধ্যায় অজানা থেকে যেত। হয়তো এখানে আসাটাই সম্পূর্ণ হতো না। কীভাবে ষড়যন্ত্র করে জগৎ শেঠ, মীরজাফর, ঘসিটি বেগম ইংরেজদের সাথে পলাশির যুদ্ধে নবাব সিরাজউদ্দৌলাকে পরাস্ত করেছিল। বাংলার শেষ স্বাধীন নবাবের এই পরাজয়ের সাথে বাংলায় নেমে এসেছিল এক কালো মেঘের ছায়া। নবাবের সাধের বাংলা দুশো বছরের জন্য চলে গিয়েছিল ইংরেজদের অধীনে। তবে ওইসব বিশ্বাস ঘাতকদেরও শেষ পরিণতি কম কষ্টের ছিল না।
হঠাৎ করে পর্দা নেমে যাওয়ায় কিছুক্ষণের জন্য সোনাই হতভম্ব হয়ে গিয়েছিল। আসলে এই শো টা দেখতে দেখতে ওর মনে হচ্ছিল সবকিছুই যেন ওর চোখের সামনে সত্যিকারে হচ্ছে। ও নিজে যেন ওই সময় পৌঁছে গেছে। আজকের মতো ওদের ঘোরা শেষ। এবার হোটেলে ফেরার পালা। হোটেলের সামনের দোকান থেকে রাতের খাবার তরকা রুটি কিনে নিয়ে সবাই যে যার ঘরে চলে এল। পরেরদিন সকালবেলা ঘুম থেকে উঠে এখানকার আবহাওয়াটা উপভোগ করতে করতে সোনাইয়ের মনে হচ্ছিল আর কয়েক ঘন্টা মাএ বাকি। তারপর ওদের ফিরে যেতে তবে আসার সময়ে যতটা খালি এসেছিল ফেরার সময় ততটাই স্মৃতি নিয়ে যাচ্ছে। আজকে ওরা মুরশিদাবাদের সবচেয়ে আকর্ষণীয় স্থান হাজারদুয়ারি প্রাসাদ দেখতে যাবে। আজ পর্যন্ত যেটার ব্যাপারে ও শুধু শুনেই এসেছে আজকে নিজের চোখে দেখবে ভাবলেই ওর গা শিউরে উঠছে। সকালে গরম গরম লুচি আর আলুর তরকারি দিয়ে টিফিন সেরে ওরা হাজারদুয়ারির টিকিট কাউন্টারে চলে এল। জন প্রতি ২৫/- টাকা। টিকিট কেটে ওরা ভিতরে প্রবেশ করল। এখানে একটি ম্যাজিক আয়না আছে যাতে যে আয়নার সামনে দাঁড়াবে তাকে ছাড়া সে তার আশেপাশের সবাইকে দেখতে পায়। এখানে বিভিন্ন নবাব, ইংরেজদের তৈলচিত্র, আলোকচিত্র, অঙ্কিতচিত্র, রৌপ্যনির্মিত সিংহাসন, হাতির দাঁতের নির্মিত পালকি, শ্বেত পাথরের ভাস্কর্য, বিভিন্ন ধরনের অস্ত্র, পোশাক-পরিচ্ছদ, নবাবদের ফরমান, ইংরেজদের সাথে বিভিন্ন চুক্তিপএ প্রভৃতির নিদর্শন দেখত পাওয়া যায়। এর ভিতরে প্রবেশ করার আগে ওরা গাইডের কাছ থেকে হাজারদুয়ারি সম্পর্কে বেশ কিছু তথ্য জেনেছে। গাইডদের ভেতরে প্রবেশ নিষেধ হওয়ায় ওরা বাইরে দাড়িয়ে শুনে নিয়েছে। যেমন- এই ত্রিতল বিশিষ্ট মনোরম প্রাসাদটি নবাব নাজিম হুমায়ুন জা-১৮২৯-৩৭ খ্রিস্টাব্দে নির্মাণ করেন। ইহার সুসজ্জিত গোলাকার বৃহৎ কক্ষটি 'দরবার কক্ষ' হিসাবে ব্যবহার করা হতো এবং প্রশস্ত কক্ষগুলি সংক্রান্তকাজে ব্যবহৃত হতো। তাছাড়াও ইহার বহু কক্ষ উচ্চ পদস্থ ইংরেজ পদাধিকারীর আবাস গৃহ হিসাবে ব্যবহৃত হতো। প্রায় আড়াই ঘন্টা ধরে পুরো প্রাসাদটা দেখে ওরা সবাই খুব ক্লান্ত হয়ে পড়েছে। সামনেই অনেক হোটেল আছে। একটাতে গিয়ে ওরা দুপুরের খাবার খেল। কিছুক্ষণ বিশ্রাম নিয়ে ওরা টোটোতে করে রওনা দিল স্টেশনের উদ্দেশ্যে। ওদের ট্রেন বিকেল ৫টায় হাজারদুয়ারী এক্সপ্রেস। ইতিহাসের শহরকে বিদায় জানিয়ে অনেক স্মৃতি মনে নিয়ে ওরা ট্রেনে উঠে পড়ল। দেখতে দেখতে কীভাবে যেন কেটে গেল এই দুদিন। সিরাজের সাথে যদি বিশ্বাসঘাতকতা না হতো তাহলে হয়তো বাংলার ইতিহাস অন্য রকম হতো। এইসব ভাবতে ভাবতে সোনাই যে কখন ঘুমিয়ে পড়েছে বুঝতেই পারেনি। ঘুম ভাঙলো মায়ের ডাকে। ওরা এসে গেছে কলকাতা স্টেশনে। এবার ওদের বাড়িও পৌঁছে যাবে। মনের মধ্যে আবার একবার বাংলার শেষ স্বাধীন নবাব সিরাজউদ্দৌলার শহর মুরশিদাবাদ যাওয়ার ইচ্ছে নিয়ে সোনাই বাড়ি চলে এল।