Dola Bhattacharyya

Children Stories Comedy

4  

Dola Bhattacharyya

Children Stories Comedy

ন জেঠুর প্ল্যানচেটের গল্প

ন জেঠুর প্ল্যানচেটের গল্প

6 mins
229


আগেই বলেছি, আমার বাবা আর জেঠু খুব ভালো গল্প বলতে পারতেন। আমার বাবার বলা 'ছোড়দাদুর ম্যাজিক দেখানোর গল্প' আগেই বলেছি। এবার বলব জেঠুর বলা গল্প। 

সেটা ছিল শ্রাবণের এক বৃষ্টি ভেজা রাত। সারাদিন ধরে টিপটিপ করে বৃষ্টি পড়েই যাচ্ছে। সন্ধ্যা নাগাদ ন জেঠু এলেন ছাতা মাথায় দিয়ে। ন জেঠু হচ্ছে, বাবার সেজ ভাইয়ের পরের ভাই। হ্যাঁ। ইনিই আমাদের গল্পজেঠু। অত সুন্দর গল্প বলতেন বলে আমি তাঁর নাম দিয়েছিলাম গল্পজেঠু। 

ন জেঠুকে পেয়ে সেদিন গল্প শোনার ইচ্ছে প্রবল হয়ে উঠল আমাদের । পরদিন রবিবার। স্কুল ছুটি। পড়ার চাপ বেশি নেই। আমরা দুটি ভাইবোন ধরে বসলাম, জেঠু, তোমার সেই প্ল্যানচেটের গল্প বলো। ন জেঠুর প্ল্যানচেট করার গল্প আগেও শুনেছি আমরা। বড়রা ওনার আড়ালে বলত প্ল্যানচেট না প্লেন চিট। স্বকপোলকল্পিত গল্পগুলো পরিবেশন করার গুণে প্রাণ পেয়ে উঠত। আমাদেরও তাই শুনে শুনে আর আশ মিটত না। মায়ের দেওয়া চা জলখাবার খেতে খেতে গল্প শুরু করলেন ন জেঠু। গল্পটা আমি ন জেঠুর জবানিতেই বলছি :—

     

      তোমরা জানো, প্রথম জীবনে আমি মিলিটারিতে সার্ভিস করেছি। অফিসের কাজে আমায় বিভিন্ন জায়গায় যেতে হয়েছে। তখন আমার পোষ্টিং ছিল পাটনায়। সারাবছর কাজে ব্যস্ত। তাই ছুটিতে বাড়ি এলে, বন্ধুদের সাথে চুটিয়ে আড্ডা মারতাম। আর সেই আড্ডার আসর বসত বিনোদবিহারী মানে ছোড়দাদুর বাড়িতে, মানে যেখানে এখন তোরা বাস করছিস। ঠিক এইঘরেই ছোড়দাদুর ম্যাজিকের আসর বসত। আবার এই ঘরেই আমাদের প্ল্যানচেটের আসরও বসত।

সেবার কদিনের ছুটি নিয়ে বাড়ি এসেছি। এসে শুনলাম, সুদেব নামে আমাদের এক ঘনিষ্ঠ বন্ধু মারা গেছে। আমাদের আড্ডার আসরে ঠিক হল, সুদেবের আত্মাকে প্ল্যানচেটের মাধ্যমে নামিয়ে আনব। 

পরদিন রাত নটা নাগাদ বসল আমাদের প্ল্যানচেটের আসর। একটা গোল টেবিল ঘিরে ছটা চেয়ার, আমরা ছ জন বন্ধু পরস্পরের হাত ধরাধরি করে বসলাম। টেবিলের ওপর রাখা হল একটা উল্টানো কাপ, একটা কাগজ আর পেন্সিল। কাপটা যদি ঘুরতে শুরু করে, তাহলে বোঝা যাবে, যাকে ডাকছি সে এসেছে। আমাদের বন্ধু শ্যামকে মিডিয়াম হিসেবে বেছে নেওয়া হল। মিডিয়ামের হাতের কাছে কাগজ আর পেনসিল রাখা হয়েছে। টেবিলের মাঝখানে একটা মোমবাতি জ্বলছে।বাকি ঘর অন্ধকার। দেওয়ালে ছটা বিশালাকৃতির ছায়া যেন কোনো গোপন পরামর্শে ব্যস্ত। একটা গাছমছমে পরিবেশ সৃষ্টি হয়েছে। সেদিকে নজর না দিয়ে একমনে আমরা ডাকছি সুদেবকে। মিনিট পনেরো এভাবেই কাটল। হঠাৎ বাতির শিখাটা কাঁপতে কাঁপতে একেবারেই নিভে গেল। দেওয়ালের ছায়াগুলো সহসা ডুব দিল ঘোর অন্ধকারে। অদ্ভুত ব্যাপার! অন্ধকারের মধ্যেও আমরা একে অপরকে স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছি। একটা অপার্থিব আলোর দ্যুতি যেন ছেয়ে রয়েছে ঘরের ভেতর ।সেই অপার্থিব আলোয় দেখতে পেলাম, টেবিলের ওপরে কাপটা কাঁপছে থির থির করে ।প্রশ্ন করা হল, কেউ কি এসেছো? 

মিডিয়ামের দিকে চোখ গেল। ওর মাথা ঝুলে পড়েছে বুকের ওপর। পেন্সিল ধরা হাতটা চলতে শুরু করেছে। কাগজের ওপর উত্তর লেখা হল —হ্যাঁ ।

আবার প্রশ্ন করা হল —কে তুমি? 

উত্তর — সু - সু-দেব। 

প্রশ্ন —কেমন আছো সুদেব? 

উত্তর — কষ্ট - বড় কষ্ট। 

প্রশ্ন — তোমার কি এখানকার কথা মনে পড়ে সুদেব? 

আর কোনো লেখা নেই। মিলিয়ে গেল সেই অপার্থিব আলো। ঘরের আলো জ্বলতে দেখা গেল, অচৈতন্য শ্যাম টেবিলে মাথা রেখে পড়ে রয়েছে। 

তার পরের দিন আবার সুদেব কে ডাকলাম। সুদেব এল, খুব অল্প সময়ের জন্য। যেটা জানতে চাইছিলাম ওর কাছ থেকে, সেটা আর জানা হল না। এরপর আবার ফিরে গেলাম আমার কর্মস্থলে। 


পরের বার ছুটিতে এসে আবার পড়লাম প্ল্যানচেট নিয়ে। আমাদের যেন নেশায় পেয়ে বসেছিল। সেদিন ছিল অমাবস্যার রাত।গাঢ় অন্ধকার চারিদিকে। ঘরের ভেতর আমরা সেই ছজন, একে অপরের হাত ধরে বসে আছি। বাইরে ঝিঁঝির ডাক অবিরাম। একটাই মাত্র মোমবাতি বাতি জ্বলছে টেবিলের মাঝখানে । গা ছমছমে পরিবেশ। সুদেবকেই আমরা ডাকছি আবার। 

প্রায় ঘণ্টা খানেক কেটে গেল এভাবেই। ধৈর্য্যের শেষ সীমায় তখন আমরা। হঠাৎই দমকা হাওয়া লেগে নিভে গেল বাতিটা। দেখতে পেলাম কাপটা আস্তে আস্তে ঘুরছে। মিডিয়ামের দিকে নজর পড়ল, হাতে পেনসিল, মাথাটা ঝুলে পড়েছে। প্রশ্ন করলাম — কে? কে এসেছো? সুদেব? 

উত্তর — না। 

প্রশ্ন —তাহলে কে তুমি? 

উত্তর —বলব না। 

প্রশ্ন — কেন এসেছো? 

উত্তর —বা রে। সুদেব যে নতুন জন্ম নিয়েছে। 

প্রশ্ন — কিন্তু তোমায় তো ডাকিনি আমরা। তুমি কেন এলে! 

উত্তর — জানিনা যাও। সন্দেশ খাবো। ইচ্ছে করছে। খুউব। 

প্রশ্ন — কেন খাওয়াবো তোমাকে! 

উত্তর — গুপ্তধনের সন্ধান দেব তোমাদের। 

প্রশ্ন —কোথায় গুপ্তধন? 

উত্তর —আগে সন্দেশ আনো। অনেক টা আনবে কিন্তু। 

একজন তাড়াতাড়ি গিয়ে অনেকটা সন্দেশ নিয়ে এল। এবার বললাম, সন্দেশ এসেছে। গুপ্তধন কোথায়? 

উত্তর — আমার সাথে তোমরা চলো, গুপ্তধনের হদিশ দিচ্ছি। আর সন্দেশটা মিডিয়ামের হাতে দাও। 

দিলাম। কিন্তু জায়গাটা কোথায়? 

উত্তর - মাদ্রালে। আমার কাকার বাড়ির বাগানে ।উত্তর দিকে পাঁচিলের ধার ঘেঁষে একটা পেয়ারা গাছ আছে। তার তলায় দাঁড়িয়ে বিশ ইঞ্চি পিছিয়ে যেতে হবে। যেখানে ডান পা পড়বে ঠিক সেখানেই খুঁড়তে হবে। পেন্সিল টর্চের আলোয় লেখাগুলো পড়ছিলাম আমরা। 

অতঃপর রাতের বেলায় একটা কোদাল ঘাড়ে নিয়ে শুরু হল আমাদের মাদ্রাল অভিযান। সন্দেশ খেতে খেতে মিডিয়াম শ্যাম চলেছে আমাদের আগে আগে। গুপ্তধনের লোভে আমরা কেউই খেয়াল করলাম না, শ্যাম একদম স্বাভাবিক ভাবে হাঁটছে। গন্তব্যস্থলের কাছাকাছি আসতে শ্যাম হঠাৎ চেঁচিয়ে উঠল, পালাও। পালাও। কাকা টের পেয়ে গেছে। বন্দুক নিয়ে ছুটে আসছে এদিকেই। পড়ি কি মরি করে মারলাম দৌড়। ছুটতে ছুটতে একেবারে এপারে এসে নিশ্চিন্ত। হঠাৎ খেয়াল হল, শ্যামকে তো দেখছি না। কোথায় গেল সে। সেই মারকুটে কাকার হাতে ধরা পড়ল না তো! 

সবাই এপারে চলে এসেছি। কিন্তু শ্যামকে কেউ দেখেনি। এক এক করে বেশ কিছু কথা মনে পড়ছে সকলের। এতক্ষণে সবাই বুঝে গেছি, ব্যাপারটা কি ঘটেছে। অনেক রাত হয়ে গেছে, তাই যে যার বাড়ি ফিরে গেলাম। পরদিন সকালে দলবেঁধে গেলাম শ্যাম দের বাড়ি। গিয়ে শুনি আজ সকালের ট্রেন ধরে কলকাতায় গেছে ও। সেখানে ওর দিদির বাড়ি। সাতদিন পরে ফিরবে। বুঝলাম। এ যাত্রায় গণপিটুনির হাত থেকে বেঁচে গেল ছেলেটা। 


আমাদের এই আড্ডাটা বেশ কিছুদিন ধরে চলেছিল। এরপর আমরা ঠিক করলাম, কোনো নামকরা লোকের আত্মাকে প্ল্যানচেট করে নিয়ে আসব। কিন্তু কাকে ডাকা যায়! ঠিক হল রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর কে ডাকব। 

জেঠু! রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর! এসেছিলেন? আমাদের চোখ কপালে। 

  হ্যাঁ। এখন চুপ করে শোনো। কথা বললে গল্পের মুড নষ্ট হয়ে যাবে। 

সেদিন আবার আমরা ছজন মিলে গোল টেবিল ঘিরে বসলাম। শ্যামের বদলে এবার অন্য একজনকে মিডিয়াম হিসেবে বেছে নিয়েছি। 

তখন আমরা একমনে রবিঠাকুরকেই স্মরণ করে চলেছি। বাতিটা এক সময়ে কাঁপতে কাঁপতে নিভে গেল। অপূর্ব মৃদু নীল আলোয় ঘরটা ভরে উঠেছে তখন। সেই আলোয় দেখলাম কাপটা আস্তে আস্তে ঘুরছে। প্রশ্ন করলাম— আপনি কি 

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর? 

 সন্দেহ আছে নাকি! অর্বাচীনের দল। 

আমরা — না না! ছি ছি! 

রবিঠাকুর —তলব করেছো কেন আজি 

তাড়াতাড়ি বলে ফেলো ওহে পাজি 

কোরো নাকো অযথা বাক্যব্যয় 

সহিতে পারিনা এই বৃথা সময়ের অপচয়। 

রবীন্দ্রনাথের এহেন উক্তিতে তখন আমরা ভীষণ ঘাবড়ে গেছি। কিন্তু ডেকে যখন এনেছি, তখন তো প্রশ্ন করতেই হবে। তাই আবার জিজ্ঞেস করলাম — আপনি এখনও কি কিছু লেখেন? 

রবিঠাকুর — হ্যাঁ ।এখনও লিখি ।ঢেঁকি তো স্বর্গে গেলেও ধান ভানে কিনা। 

আমরা —তাহলে আমাদের কিছু শোনান প্লিজ। 

রবিঠাকুর — ওহে ডেঁপো ছোকরার দল। শোনো — আমার কবিতা, গল্প এখন স্বর্গের দেব দেবীর শোনে, পড়ে। ওখানকার প্রেসে ছাপা হয়। তোমাদের শুনিয়ে খামোখা সময় নষ্ট করব কেন? 

রেগেমেগে চলে গেলেন রবিঠাকুর। আমরাও হাঁফ ছেড়ে বাঁচলাম ।এবারে ঠিক করলাম, আর ভারতের কারোকে নয়। এবার কোনো সাহেবের আত্মাকে প্ল্যানচেটে আনব। তখন সদ্য পঞ্চম জর্জ মারা গেছেন। ঠিক হল, তাহলে পঞ্চম জর্জকেই নামানো যাক। আবার বসলাম আমরা। উপযুক্ত পরিবেশ সৃষ্টি করা হল। টেবিলে বাতি জ্বলছে। একে অপরের হাত ধরে চোখ বন্ধ করে বসে আছি আমরা। আর একমনে পঞ্চম জর্জকে স্মরণ করছি। খুব বেশিক্ষণ কাটেনি তখনও। হঠাৎ একটা দমকা হাওয়া এসে নিভিয়ে দিল ল বাতিটা। আমরা নিথর, নিস্পন্দ। আচমকা বিদ্যুতের আলোয় ঝলসে উঠল ঘরের ভেতরটা ।টেবিলের ওপর কাপটাও বনবন করে ঘুরতে শুরু করেছে তখন। চেঁচিয়ে উঠলাম, কে, কে এসেছেন! 

আমি বিবেকানন্দ। এবার আর খাতা পেন্সিল নয়। বজ্র গর্জনের মতো গম্ভীর গলার স্বর, গমগম করে উঠল ঘরের ভেতর। আমরা নির্বাক। বিবেকানন্দ তখন বলে চলেছেন, ওহে অর্বাচীনের দল। কি শুরু করেছো তোমরা! তোমাদের জন্য পরলোকে আজ কি রকম বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি হয়েছে জানো! আর এই যে মিলিটারি ম্যান। তোমাকে বলছি। এইভাবে প্ল্যানচেট করে দেশোদ্ধার করবে তুমি! আমি বলছি, অবিলম্বে এই খেলা বন্ধ করো তোমরা। না হলে কিন্তু সর্বনাশ হবে। আর একবার বিদ্যুৎ ঝলসে উঠল ঘরের মধ্যে। বুঝলাম, বিবেকানন্দ চলে গেলেন। তাড়াতাড়ি করে আলো জ্বালানো হল। দেখলাম মিডিয়াম পরেশ সংজ্ঞাহীন হয়ে পড়েছে। নাকমুখ দিয়ে ব্লিডিং হচ্ছে। ব্যাস এই শেষ। আর কখনও প্ল্যানচেটে বসিনি আমরা।


Rate this content
Log in