Akash Karmakar

Children Stories Drama Tragedy

3  

Akash Karmakar

Children Stories Drama Tragedy

জননী

জননী

5 mins
331


ছোট্ট মেয়ে পরী, কতই বা আর বয়স, এই তো গেল বছর সাতে পড়েছে। জন্মের বছর দুয়েকের মধ্যেই বাপকে হারিয়েছে। মা মেয়ের সংসার একটা ছোট্ট ভাড়াবাড়িতে। সে বাড়ির অবস্থাও বেশ করুন; পলেস্তারা খসে পড়ে মাঝেমধ্যেই রাতের বেলায়, বৃষ্টি হলে তো ঘরের জল মুছতেই সময় চলে যায়। এবার পয়সা না থাকলে ভালো বাড়িই বা জুটবে কোথা থেকে আর। মায়ের রোজগারেই কোনোক্রমে দিন কেটে যায় দুজনের। মায়ের রোজগার বলতে তেমন কিছুই না, ঐ কয়েকটা বাড়িতে মা রান্না করে যা পায় তাই দিয়ে বাড়ির ভাড়া মিটিয়ে মা মেয়ের চলে যায়। মেয়েকে সঙ্গে নিয়েই মা সকাল হলেই বেরিয়ে পড়ে কাজে, কারণ একা বাচ্চাকে কার কাছেই বা আর রেখে যাবে! পরী এমনিতে খুবই বাধ্য মেয়ে। মায়ের কাছেই তার অল্পস্বল্প পড়াশোনা চলে। যে সব বাড়িতে মা রান্না করতে যায় তাদের বাড়ির বাচ্চাগুলোর সাথে পরীও খেলে বেড়ায়, বেশ এভাবেই সময়টা পেরিয়ে চলে। এরকমই একটা বাড়িতে পরীরই মতন বয়সী আরেকটি বাচ্চা থাকে যে খুব ভালো নাচ করে। পরীও মাঝেমধ্যে তার সাথে তাল মেলানোর চেষ্টা করে, বাচ্চাদের মধ্যে সেরকম ভেদাভেদ বাড়ির কর্তা গিন্নী কখনোই করেন না। কিন্তু যা হয় আর কি গরীব নিম্নবিত্ত বাড়িতে– যেখানে পেট চালানোটাই একটা যুদ্ধের সমান সেখানে নাচ তো অলীক কল্পনা মাত্র! মেয়ের নাচ করার এত শখ দেখে মা অনেক কষ্টে একজোড়া নুপূর কিনে দেয়; ঘুঙুর কেনার সামর্থ্য তো ছিল না। ঐ নুপূর জোড়া পায়ে পরে পরী নিজের মত্তেই নেচে বেড়ায় আনন্দে; সন্তানের হাসিমুখের চেয়ে বেশী আর কিছুই নেই তৃপ্তিদায়ক একজন মায়ের কাছে। 


     লড়াই চলছিল জীবনযাত্রার, একটু একটু করে মেয়েকে নিয়ে মা সাজিয়ে তুলছিল ছোট্ট পৃথিবী যেখানে হয়তো দারিদ্র্যের যন্ত্রণা ছিল কিন্তু দিনের শেষে সন্তানকে বুকে জড়িয়ে ধরে দিন কাটানোর তৃপ্তি ছিল। পরী যে বড়ো ন্যাওটা ছিল তার মায়ের। হঠাৎই মায়ের বুকে আক্রমণ করল এক বিষাক্ত ভাইরাস; ছোট্ট প‍রী কিছু বুঝে ওঠার আগেই তার সাথে মায়ের পার্থিব সম্পর্ক ছিন্ন হল। ঘনিয়ে এল আঁধার ছোট্ট পরীর জীবনে; বাবা আগেই ছেড়ে গেছল আর এবার পালা মায়ের। ভাড়াটেও বুঝে গেল এই ছোট্ট মেয়ের পক্ষে ভাড়া দেওয়া সম্ভব নয়, অগত্যা গৃহহীন হতে হল পরীকে। আস্তানার খোঁজে পেটের টানে কান্নাকে সম্বল করে রাস্তায় রাস্তায় ঘুরে বেড়ানোর লড়াই শুরু হল ছোট্ট পরীর। কিন্তু যার নাম পরী তার তো এত সহজে হারিয়ে যাওয়ার কথা নয় এই পৃথিবীর রঙ্গমঞ্চ হতে! সে নাচ করতে চেয়েছিল, ভেবেছিল একদিন তার নাচের ছন্দে মোহিত হবে সমগ্র জগৎ।


     মানুষের মধ্যেই তো ঈশ্বর বাস করেন। রাস্তায় চলতে চলতে পরীর নজরে আসে রাস্তার ঐপাড়ে বটগাছের নীচে বসে থাকা মা দুর্গাকে, যে মা দুর্গার কিনা আটটা হাত! কিন্তু পরী তো জানে দুর্গা ঠাকুরের দশ হাত হয়, তবে এটা কোন ঠাকুর যার আট হাত? সে ভ্যাবলার মতন তাকিয়ে থাকে সেই বহুরূপীর দিকে। হঠাৎ সেই দুর্গা রূপী বহুরূপীটিও খেয়াল করে বাচ্চাটাকে, তাকে হাত নাড়িয়ে কাছে ডাকে। পরীও আর সাতপাঁচ না ভেবে এগিয়ে যায়। "তুই কে? এভাবে রাস্তায় ঘুরছিস কেন?" মা দুর্গা জিজ্ঞেস করছে দেখে পরীও তার মাকে হারানোর থেকে শুরু করে এখনো পর্যন্ত জীবনের সমগ্র ঘটনা বোঝানোর চেষ্টা করে নিজের মতন করে। চোখের জল মুছতে মুছতে বাচ্চা পরীকে বুকে জড়িয়ে ধরে বহুরূপী মা দুর্গা, সস্তার মেকাপের ভেতরে যে বেঁচে আছে এক কোমল মাতৃহৃদয়। "চল আজ থেকে তোর সব দায়িত্ব আমার; তোর আমার এই রঙবেরঙের জগতে আর কোনো অমাবস্যার আঁধার নামবে না" – এই বলে সে পরীকে কোলে তুলে নিয়ে চলল নিজের বাড়ির দিকে। তারও পুঁজি স্বল্প তবে তাগিদটা বড়ো, বেঁচে থাকার-বাঁচিয়ে রাখার। 


     এতদিন বহুরূপী সেজে শবনম যা পেত তাই দিয়ে একটা পেট কোনোরকমে চালিয়ে নিত কিন্তু এখন আর তা সম্ভব নয়। তাই সে একটা ফুটপাতের হোটেলে কাজে ঢুকল নয়তো মেয়েকে কিভাবে বড়ো করে তুলবে! শ্রীকৃষ্ণের সময় থেকেই যশোদারা এভাবেই বারবার এগিয়ে এসেছেন, জন্মদাত্রী মা নাকি পালনকর্ত্রী মা – কে বড় এই নিয়ে দ্বন্দ্ব করতে নেই; মায়েদের বিভিন্ন রূপকে শুধু বিভোর হয়ে অনুভব করতে হয়। কিভাবে নিজে অনাহারে থেকেও হাসতে হয় সন্তানের দিকে তাকিয়ে মায়েদের চেয়ে ভালো আর তা কেই বা জানে! সমস্ত রকম যন্ত্রণা-লাঞ্ছনাকে সহ্য করেও সন্তানকে আঁচলের তলে আগলে রাখার নামই তো মা। পরীও তার যশোদা মাকে নিয়ে আনন্দে দিন কাটাতে লাগাল। যখনই তার দেবীকা মায়ের কথা মনে পড়ে, কাঁদতে থাকে, সাথে সাথে তাকে কোলে তুলে নেয় বহুরূপী মা। মা যে সত্যিই বহুরূপী! 


   এভাবেই মা মেয়ের কথায় কথায় একদিন পরী মাকে তার নাচের ইচ্ছের কথা বলে ফেলে। সেও তো ভেবেছিল নাচ করবে! তার নাম হবে, সবাই চিনবে, তার মাকে নিয়ে শান্তিতে থাকবে। হোটেলে কাজ করতে গিয়ে একদিন শবনমের নজরে পড়ে একটা নাচের প্রতিযোগিতার পোস্টার, দেখামাত্রই সে ভেবে নেয় এখানে পরীকে পাঠালে কেমন হয়, মেয়েটার ইচ্ছেও আছে আর সে তো মন্দ নাচে না। নাচের তালেতালেই সে চেষ্টা করে নিজের ভেতরে জমে থাকা দুঃখ-যন্ত্রণা-আক্ষেপ-ক্ষোভকে ফুটিয়ে তুলতে। কিন্তু শুধু ভাবলেই তো আর হয় না। নাচের পোষাক, তার সাজ সরঞ্জাম এসবও তো লাগবে; এত টাকা পাবে কোথা থেকে? সম্বল তো পরীর ছিল শুধু একজোড়া নুপূর। হোটেলের মালিককে একবার বলার চেষ্টা করলেও তাচ্ছিল্য ছাড়া কিছুই জুটল না শবনমের ভাগ্যে। এদিক সেদিক ভাবতে ভাবতেই বহুরূপী মা একদিন ঠিক করে তার যে সমস্ত সাজগোজের জিনিসপত্র রয়েছে, শাড়ী-গয়না-কসমেটিকস সব বিক্রি করে যা পাবে তাই দিয়ে সে পরীকে নাচের প্রতিযোগিতায় পাঠাবে। সেও তো একজন শিল্পী; সবাই তো আর চাইলেই বহুরূপী সাজতে পারে না। 


   শুরু হল আরেক পরীর পথচলা। নতুন মায়ের সাহচর্যে পরী উঠতে চলেছে এক বড়ো মঞ্চে যেখানে হাজার হাজার লোকজন তার নৃত্যশৈলীর প্রথম ঝলক দেখার অপেক্ষায়। সকলের ভালোবাসা-তার দুই মায়ের আশীর্বাদে পরী প্রতিযোগিতায় প্রথম স্থান অধিকার ক‍রল। ধীরেধীরে সাফল্যের ধারায় সিক্ত হল তার এই রুক্ষ শুষ্ক লড়াইয়ের ময়দান। শখ- প্যাশন ক্রমশঃ হয়ে উঠল জীবিকা। সব দুর্গার দশ হাত লাগে না, দুই হাত দিয়েই প্রতিটি মা হয়ে ওঠে বাস্তবের দুর্গা। কিছু মানুষের সময়ের সাথে ভাগ্যের লড়াই চিরদিনের; পরীও সেই দলেরই একজন প্রতিনিধি। আজ যখন তার সময় এসেছে দুর্গা মাকে এক স্বাচ্ছন্দ্যময় জীবন উপহার দেওয়ার ঠিক তখনই দরজায় কড়া নাড়ল মারণরোগ কর্কট। ছয়মাসের এক দীর্ঘ লড়াইয়ের অবসান হল বহুরূপী মা দুর্গার বিসর্জনের মধ্যে দিয়ে। পরী-পরীর জীবনের ওঠানামা-তার আকাশছোঁয়া সাফল্য-যতদূর নজর যায় শুধু ধুধু মরুপ্রান্তর। 


    জন্মদাত্রী দেবকী মায়ের দেওয়া নুপূর জোড়া ছাড়া আর কোনো স্মৃতিই সে রাখতে পারেনি; আবার যখন ভাবল যশোদা মাকে নিয়ে সুখে কাটাবে বাকি জীবনটা তখন রুষ্ট হল অদৃষ্টের দেবী। কি আর করা যায়, 'জননী নৃত্য প্রশিক্ষণ কেন্দ্র'ই এখন পরীর সর্বক্ষণের বেঁচে থাকার উদ্দেশ্য হয়ে দাঁড়িয়েছে। নতুন সকাল, আজকের দিনটা খুব স্পেশাল পরীর কাছে, তাই আজ আর কোনো অনুষ্ঠান নয়। সকাল সকাল স্নান সেরে তার মায়ের নিজে হাতে লাগানো গাছের ফুল নিয়ে পৌঁছে যায় মায়ের কবরে আর সাথে ছিল নিজের হাতে বানানো একটা সুন্দর কার্ড যেটাতে লিখেছিল, 


চাঁদের আলোয় স্নিগ্ধ হল গর্ভধারিণী মায়ের স্বর্গ,

পথ দেখানো বহুরূপী মায়ের চরণে অর্পিত অর্ঘ্য।


মাতৃদিবসের শুভেচ্ছা নিও মা----

                            ইতি, 

                         আদরের পরী।


Rate this content
Log in