The Stamp Paper Scam, Real Story by Jayant Tinaikar, on Telgi's takedown & unveiling the scam of ₹30,000 Cr. READ NOW
The Stamp Paper Scam, Real Story by Jayant Tinaikar, on Telgi's takedown & unveiling the scam of ₹30,000 Cr. READ NOW

Sayantani Palmal

Abstract

5.0  

Sayantani Palmal

Abstract

বৃষ্টি থামার শেষে

বৃষ্টি থামার শেষে

14 mins
826


  

      বইয়ের খোলা পাতাটার দিকে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে হিমু। ছোটকা ওর জন্মদিনে উপহার দিয়েছিল বইটা। পড়ার বইয়ের বাইরেও বিভিন্ন ধরনের বই পড়তে সে খুব ভালোবাসে তাই ছোটকা যখনই বাড়ি আসে ওর জন্য ভালো ভালো বই আনে। তাই বলে কেউ যদি ভাবে হিমু সারাদিন বইয়ে মুখ গুঁজে থাকে তাহলে সে মস্ত ভুল করবে। হিমুর অনেক কাজ থাকে সারাদিন। দৈনন্দিন পড়াশোনা শেষ করতে তার খুব একটা বেশি সময় লাগে না। সবাই বলে ওর মাথায় নাকি খুব বুদ্ধি। সেটা অবশ্য ঠিক ওর বন্ধুদের যে পড়াটা তৈরী করতে একঘন্টা লাগে সেই পড়াটা আধঘণ্টায় শেষ করে বাকি বুদ্ধি ও সময়টা হিমু বিভিন্ন সৃজনাত্বক কাজে ব্যবহার করে। অবশ্য ওর বাড়ির লোকজন সেগুলোকে ধ্বংসাত্বক নামে আখ্যায়িত করে। সে যাই হোক হিমুর মাথায় আবার সেই অদ্ভুত প্রজাপতিটা কোকুন ভেঙে নড়াচড়া করতে আরম্ভ করেছে। এই প্রজাপতিটা সবসময় উড়তে চায় তাই তো হিমু স্থির থাকতে পারে না। এই এখন যেমন হিমুর মনটা ছটফট করছে একটা পেরিস্কোপ বানাবার জন্য। কাল রাত্রিবেলাই ছোটকার দেওয়া বইটায় পেরিস্কোপ বানাবার সহজ প্রণালী পড়েছে সে। কিন্তু বানাব বললেই তো হলো না জিনিসপত্র জোগাড় করতে হবে। অবশ্য এসব কাজে হিমু সিদ্ধহস্ত। আজ পর্যন্ত তার লক্ষ্য পূরণ হয়নি এমন ঘটনা ঘটে নি। যেখান থেকে হোক সে তার প্রয়োজনীয় জিনিস সংগ্রহ করে নেয়। তার জন্য তার কপালে বাবার বেতের বাড়ি, মায়ের বকুনি, কাকুর কানমলা ইত্যাদি অবশ্যই জোটে। হিমুর মতে তার প্রতিভার কদর এ বাড়ির একজনই করে সে হলো ছোটকা ক    “ কই গো আমার মা লক্ষ্মী কই গো।” হিমু পিসিঠাম্মার গলাটা শুনেই চিনল। বাংলার স্যার একদিন বলেছিলেন বাঙালিদের নাকি পায়ের তলায় সর্ষে। বাকি বাঙালিদের কথা জানা নেই তবে পিসিঠাম্মার পায়ের তলায় যে সর্ষে সে ব্যাপারে হিমু নিশ্চিত। মানুষটা সারাবছর শুধু হয় আত্মীয় বাড়িতে নয় তো কাশী, বৃন্দাবন ঘুরে বেড়ান ।হিমুর পিসিঠাম্মাকে একবারে ভালো লাগে না। হিমু জানে বড়দের সম্পর্কে এরকম কথা বলতে নেই কিন্তু উনি শুধু শুধু হিমুর মাকে উল্টো পাল্টা কথা শোনান কারণ আর কিছুই না হিমুদের বাড়ির সবার মধ্যে ওর মায়ের গায়ের রঙটাই শ্যামলা বাকি সবাই খুব ফর্সা। এই যে মা লক্ষ্মী বলে ডাকলেন সেটা কাকিমার উদ্দেশ্যে। অথচ হিমু ভালো করেই জানে ওর মা এক্ষুনি চা, শরবত, জলখাবার সব তৈরি করবে পিসিঠাম্মার জন্য কিন্তু তাও পিসিঠাম্মা মায়ের সব কাজে খুঁত ধরবেই। পিসিঠাম্মা ছাড়া ওদের বাড়ির সবাই , আত্মীয়স্বজন সকলে বলে হিমুর মা নাকি দশভুজা। হিমুর তখন কি যে ভালো লাগে! হিমুর মাকে অপমান করার ফল পিসিঠাম্মাকে মাঝে মাঝেই ভোগ করতে হয়। সেটা অবশ্যই হিমুর কৃতিত্ব কিন্তু তখন আবার যেমন মা তার তেমনি ছেলে এসব বলতে থাকেন। হিমু ওসবের পরোয়া করে না। আবার পিসিঠাম্মার গলা পাওয়া গেল, “ কি গো নীলিমা তুমি বেরিয়ে এল“ মীরা তুলতুলকে নিয়ে বাপেরবাড়ি যাবে তাই রেডি হচ্ছে। আপনি শরবতটা খান পিসিমা।“ ও । তা তোমার গুণধর পুত্রটি কই? “

“ ওপরের ঘরে পড়াশোনা করছে।” শান্ত কণ্ঠে বললেন হিমুর মা।“ পড়ছে না ছাই ঠিক কোনও বদমাইশি বুদ্ধি ভাঁজছে।” হিমুর মা নিরুত্তর রইলেন। বিয়ের পর থেকে পিসিশাশুড়ির এরকম ব্যবহারে তিনি অভস্থ্য। প্রথম প্রথম খারাপ লাগলেও এখন তাঁকে কিছু বললে আর তাঁর গায়ে লাগে না কারণ বাকি সবাই তাঁকে খুব ভালোবাসে কিন্তু তাঁর ছেলেটাকে গালমন্দ করলে খুব কষ্ট হয় তাঁর। হিমু খুব দুস্টু একথা সত্যি কিন্তু তিনি তো মা তিনি অনুভব করতে পারেন হিমুর এই চঞ্চল প্রকৃতির আড়ালে একটা শান্ত নদীর মতো মন আছে যেখানে হীরের কুচির মতো স্বছ জল টলটল করে।


    “ দাভাই টা টা। জেম্মা টা টা।” 

লাল টুকটুকে ফ্রক পরা তুলতুলকে দেখে একটা জ্যান্ত পুতুল মনে হচ্ছিল। বাবা, মার হাত ধরে সে নাচতে নাচতে মামা বাড়ি চলে গেল। বাড়িটা ফাঁকা ফাঁকা লাগছে হিমুর। দাদু-ঠাম্মা কলকাতা গেছে ছোটকার কাছে। মা রান্নাঘরে ব্যস্ত। বাবা দোকানে চলে গেছে। হিমুর বাবার সার আর বীজের বড় ব্যবসা। গ্রীষ্মের ছুটি চলছে তাই স্কুলও নেই। হিমুর হাত-পা নিশপিশ করছে কিছু একটা করার জন্য। তার মত কর্মঠ ছেলের এরকম নিষ্কর্মা হয়ে বসে থাকা পোষায় না। এমন সময় হিমুর চোখ গেল পিসিঠাম্মার দিকে। তার ঠোঁটের কোণে একচিলতে দুস্টু হাসি খেলে গে    “ মা গো বাবা গো। পিঁপড়েয় খেয়ে গেল গো ।” পিসিঠাম্মার চিৎকার শোনা যাচ্ছে নীচ থেকে। হিমু ভালমানুষের মতো মুখ করে নিজের ঘরে অংক কষছে। একটু আগে হিমুর মাকে কথা শুনিয়েছিল এবার বোঝ ঠেল“ এ ঠিক তোমার ঐ বজ্জাত ছেলের কাজ নইলে আমার কাচা কাপড়ে এত পিঁপড়ে এল কি করে! কি ছেলে যে পেটে ধরেছ বাবা রে!”   হিমু আড়চোখে একবার মায়ের দিকে দেখল। পিঁপড়ে কাণ্ডের পর থেকে মা তার সঙ্গে একটাও কথা বলেন নি। হিমুর একটু একটু কান্না পাচ্ছে। হিমু ক্লাসে ফাস্ট হয় প্রতি বছর। ও যখন মার্কশিটটা নিয়ে বাড়ি আসে মা ওকে জড়িয়ে ধরে খুব আদর করেন। হিমুর তখন কি যে ভালো লাগে ও কাউকে বলে বোঝাতে পারবে না। মায়ের গা থেকে একটা কি সুন্দর মা মা গন্ধ বেরোয়। সবাই বলে হিমুর ভয় ডর কিছু নেই কিন্তু কেউ জানে না হিমুর পৃথিবীতে একটা ব্যাপারে ভীষণ আতঙ্ক সেটা হলো ওর প্রতি মায়ের বিমুখতা। মা ওর প্রতি যখন খুব বেশি রেগে যান তখন হিমুর ভীষন কষ্ট হয়। সন্ধ্যে নেমে আসছে। মা চুপচাপ ওর সামনে দুধ-মুড়ি আর একটা কলা রেখে গেলেন। হিমু বাধ্য ছেলের মতো খেতে লাগল। 

“ নীলিমা, নীলিমা। কোথায় তুমি ? সর্বনাশ হয়ে গেছে।” হিমুর বাবা ছুটতে ছুটতে আসছেন“ কি হয়েছে? এরকম করছ কেন?” উদ্বিগ্ন স্বরে বলেন হিমুর মা। হিমুর বাবা প্রত্যুত্তরে জানালেন যে হিমুর মেজকা একটু আগে ফোন করে জানিয়েছেন তুলতুল বিকেলবেলায় তার মামাদাদুর সাথে দোকানে যাচ্ছিল চকলেট কিনতে। রাস্তা পার হওয়ার সময় একটা চারচাকা গাড়ি হঠাৎ করে খুব জোরে এসে ওদের ধাক্কা মারে। তুলতুলের মামাদাদু ওখানেই মারা গেছেন আর তুলতুলকে হসপিটালে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। একথা শুনে হিমুর মা কেঁদে ফেললেন আর বাবা ছুটলেন হিমুর বড় দাদু মানে ওনার বড় জেঠুর বাড়িতে খবর দিতে। কিছুক্ষনের মধ্যে হিমুর বাবা, মা আর ওবাড়ির ছোট জেঠু তুলতুলের মামাবাড়ির উদ্দেশ্যে রওনা হলেন। হিমু আর পিসিঠাম্মা রইল ওবাড়ির সবার দায়িত্বে। হিমুর ভীষন কষ্ট হচ্ছে। বনুকে খুব ভালোবাসে ও। তাছাড়া ভালদাদু মানে তুলতুলের মামাদাদুর জন্যও মন খারাপ লাগছে। খুব মজাদার মানুষ ছিলেন। হিমুকেও    এই ঘটনার পর একমাস কেটে গেছে কিন্তু হিমুদের বাড়ির পরিবেশ থমথমে। ওদের বাড়ির সেই চেনা আনন্দের সুরটা কোথায় যেন হারিয়ে গেছে। সেই দিনের দুর্ঘটনায় তুলতুলের শারীরিক ক্ষতি বিশেষ একটা হয় নি কিন্তু ওর মনে এক গভীর ক্ষত সৃষ্টি হয়েছে। সেই আঘাতের ব্যাপ্তি এতটাই যে তুলতুল একদম নিশ্চুপ হয়ে গেছে। চার বছরের তুলতুলের অনর্গল আধো আধো কথায় ওদের বাড়ি মুখরিত হয়ে থাকত। বাড়িময় সারাদিন ছুটোছুটি করে বেড়াতো মেয়েটা। ওকে নিয়ে মজা করার জন্য ওবাড়ির সবাইও যখন তখন ওকে নিয়ে চলে যেত কিন্তু এখন সারাদিনে একটা কথাও বলে না তুলতুল। চুপচাপ এক জায়গায় বসে থাকে। ওর সাথে কথা বললে ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে থাকে কোনও উত্তর দেয় না। কলকাতায় মানসিক রোগের ডাক্তার দেখান হয়েছে। ডাক্তার বলেছেন চোখের সামনে দাদুকে ঐভাবে রক্তাক্ত অবস্থায় পড়ে থাকতে দেখেছে তুলতুল তারপর দাদুর মৃতদেহও দেখেছে। ওর কচি মনে এই ঘটনার মারাত্মক প্রভাব পড়েছে। তুলতুলের কাউন্সিলিং করান হয়েছে। ওষুধও চলছে কিন্তু কোনও উন্নতি হচ্ছে না। হিমুদের সারাবাড়িটা যেন গুমরে গুমরে কাঁদছে। কারুর মুখে হাসি নেই। কাকিমা, মা, ঠাম্মা যখন তখন ডুকরে কেঁদে উঠছে। কাকু কেমন যেন উদ্ভ্রান্তের মত ঘুরছে। হিমু কত চেষ্টা করে বনুর সাথে কথা বলার কিন্তু বনু একবারও দাভাই বলে ডাকে না। কোলে করে বাইরের দিকে ঘুরতে নিয়ে যায় কিন্তু বনুর কোনও ভাবান্তর ঘটে না। ওর কাঁধে মাথা দিয়ে চুপটি করে শুয়ে থাকে। হিমুর যখন বনুর জন্য খুব মন খারাপ লাগে তখন ও নদীর ধার    শনিবার বিকেলে হিমু বনুকে কোলে নিয়ে ঘুরতে গিয়েছিল। বড় ঠাম্মা ওদের দেখতে পেয়ে ডাকলেন। এমন সময় হঠাৎ ঝমঝমিয়ে বৃষ্টি নামায় হিমু ওবাড়িতে আটকে গেল। বৃষ্টি কমতে মিন্টুদাদা ছাতা নিয়ে ওদের বাড়িতে পৌঁছতে এল। বারান্দায় পা দিয়েই হিমু শুনতে পেল, “ ওই যে এসেছেন । লাই দিয়ে দিয়ে তুমি ছেলেটাকে মাথায় তুলছ বড় বৌমা। ক্লাস এইটে পড়া ছেলে তুই কোন আক্কেলে অসুস্থ বাচ্চাটাকে নিয়ে পাড়া বেড়াতে বেরোলি! আমি তো চিন্তায় মরছি।” হিমুর মায়ের উদ্দেশ্যে পিসিঠাম্মার বাক্য বান বর্ষিত হচ্ছে। হিমুর মাথাটা গরম হয়ে গেল। বেশ জোরেই বলল, “ চিন্তার কি হয়েছে? মিন্টু“ বাবা রে ছেলের মুখ হয়েছে দ্যাখ! ক্লাসে ফাস্ট হলেই কি আর মানুষ হওয়া যায়। তার জন্য মাকে শিক্ষা দিতে হয“ হিমু খেয়ে নিয়ে পড়তে বসবে যাও।” শান্ত কণ্ঠে বললেন ম“ আমি খেয়ে এসেছি মা।”“দেখেছ বৃষ্টি-বাদলায় অসুস্থ বোনকে নিয়ে গিয়ে গ্যান্ডে পিণ্ডে গিলেছেন উনি!” পিসিঠাম্মা আবার শুরু করলেন।

“ পিসিঠাম্মা তুমি এরকম বলছ কেন? ওরা আটকে পড়েছিল তাই মা হিমুকে খেতে দিয়েছিল আর তুলতুলকেও খাইয়েছে।” মিন্টুদা আর থাকতে না পেরে বল“ তুই থাম মিন্টু। এ ছেলেকে আমার চিনতে বাকি নেই।”


   পিসিঠাম্মা স্নানে গেছেন। সকাল সকাল স্নান করা অভ্যেস ওনার। হিমুর কাছে এই সুযোগ। আয়নাটা নিয়ে একছুট্টে নিজের ঘরে চলে এল হিমু। ছোটকার পরামর্শেই ক্লাস সেভেন থেকে হিমুর জন্য একটা আলাদা ঘর বরাদ্দ হয়েছে। এই ঘরটায় হিমুর একটা আলাদা জগৎ আছে। আজ সেখানেই সে পেরিস্কোপ তৈরিতে ব্যস্ত। মাসখানেক আগে ঘটে যাওয়া দুর্ঘটনার কারনে হিমুর এই কাজটা থমকে গিয়েছিল। সমস্ত জিনিস জোগাড় হয়ে গিয়েছিল। শুধু একটা আয়না কম পড়ছিল। পিসিঠাম্মা আবার বড় আয়নায় চুল আঁচড়াতে পারেন না তাই হিমুর ঠাম্মি পিসিঠাম্মা এলেই এই ছোট আয়নাটা বের করে দেন। কাল পিসিঠাম্মার ওই রকম আচরণের পরই হিমু ঠিক করে নিয়েছিল পিসিঠাম্মার আয়না দিয়েই তার পেরিস্কোপ সম্পূর্ণ করবে। আয়না তার হাতে এসে গিয়েছে এবার এটাকে ঠিক মতো সাইজ করতে হবে। হিমু মন দিয়ে কাজে লেগে পড়ল। প্রায় ঘন্টা খানেক পরে তার কাজ সাঙ্গ হলো। হিমুর মুখে এক চিলতে তৃপ্তির হাসি উঁকি দিচ্ছে। তার পেরিস্কোপ তৈরি। ছোটকাকে ফোন করে খবরটা দিতে হবে। এতক্ষন দরজা ভেজিয়ে একমনে কাজ করার ফলে হিমু জানতেই পারল না আয়না খুঁজে না পেয়ে পিসিঠাম্মা কি প্রলয় নৃত্য শুরু করেছেন নিচে। সেই সঙ্গে হিমুর মায়ের প্রতি তীক্ষ্ণ বাক্যবান বর্ষণ কারণ উনি নিশ্চিত আয়“ হিমু।” মায়ের কড়া গলার ডাকে পেছন ফিরে চমকে উঠল হিমু। মা যে কখন এসে ওর পেছনে দাঁড়িয়েছেন ও বুঝতেই পারেনি। মা ঘরের চারিদিকে একবার চোখ বুলিয়েই বুঝে গেলেন কি ঘটেছে। হঠাৎ করে মায়ের হাতটা আছড়ে পড়ল হিমু“ তুই কি আমাকে একটু শান্তিতে বাঁচতেও দিবি না। তোর জন্য আমাকে এত কথা শুনতে হয়। লোকে এত গালি দেয় তোকে তাও তোর লজ্জা নেই। তোর মতো ছেলের মা হওয়ার চেয়ে মরে যাওয়া অনেক ভালো।” হিমুর কাছ থেকে কোনও উত্তরের প্রত্যাশা না করে মা ঘর থেকে বেরিয়ে গেলেন। হিমুর ঠোঁটে নোনতা জলের ধারা এসে পড়ছে। গালটাও জ্বালা জ্বালা করছে কিন্তু তার চেয়েও ওর মনের কষ্টের মাত্রাটা অনেক বেশি। বুকের ভেতর কান্না গুমরোচ্ছে। এই প্রথম মা ওর গায়ে হাত তুললেন আর মা কীসব কথা বলে গেলেন       হিমু নদীর পাড়ে বসে খানিক্ষণ কাঁদল। কাউকে বুঝতে না দিয়ে চুপচাপ বাড়ি থেকে বেরিয়ে এসেছে ও। মাই যখন বলল যে ওর মতো ছেলের দরকার নেই তখন বাড়িতে কার জন্য থাকবে“ হিমু এই হিমু। কি করছিস এখানে?”

হিমু চোখ মুছে পেছনে তাকিয়ে দেখল বাদল দাঁড়িয়ে আছে। বাদল ওর ক্লাসেই পড়ে। হিমু শুকনো গলায় বলল, “ কিছু না এমনি বসে আছি।” বাদল উৎসাহিত হয়ে বলল, “ তাহলে আমার সাথে চল। ওপারের জঙ্গলে যা ডাঁসা ডাঁসা পেয়ারা হয়েছে না কি বলব তোকে! যাবি?” হিমু মাথা নেড়ে বলল, “ চল।” আসলে হিমুর পেটে ছুঁচো ডন দিচ্ছে এখন তাছাড়া একলা বসে করবেই বা কি। বাঁশের সাঁকোটা পেরিয়ে দুজনে চলল ওপারের জঙ্গলে। হিমুদের গ্রামের নদীটা নামেই নদী আসলে এটা একটা বড় খাল। তার ওপারে হালকা একটা জঙ্গল আছে। বাদলের কাছে নুন-লঙ্কা ছিল তাই দিয়ে বেশ মজা করে পেয়ারা গাছের মোটা ডালটায় বসে দুজনে পেয়ারা খাচ্ছিল। হিমুর হঠাৎ চোখ পড়ল একটু উঁচু একটা ডালে বিশাল বড় তিনটে পেয়ারা ঝুলছে। হিমু গাছ বেয়ে আরও ওপরে উঠে গেল। সবে একটা পেয়ারা তুলেছে এমন সময় তার দৃষ্টি চলে গেল একটু দূরের একটা গাছের দিকে। একী! ওই “ বাদল, তাড়াতাড়ি গাছ থেকে নাম। ঐদিকে একটা লোক গলায় দড়ি নিচ্ছে। বাঁচাতে হবে।” গাছ থেকে নেমে প্রানপনে ছুটল দুই কিশোর। লোকটা গলায় ফাঁসটা পরতে যাবে এমন সময় হিমু এক ধাক্কায় তাকে মাটিতে ফেলে দিল আর বাদল তাড়াতাড়ি করে গাছে উঠে দড়িটা খোলার চেষ্টা করতে লাগলো। মাটিতে পড়ে যাওয়া বৃদ্ধ মানুষটি বিস্মিত হয়ে দেখলেন তাঁর মুক্তির আশায় জল ঢেলে দিয়ে তাঁকে এই দুঃখ কষ্টের পৃথিবীতে আটকে দেওয়া দুই কিশোর জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকিয়ে   “ দাদা, হিমুকে কোথাও খুঁজে পেলাম না।” চিন্তিত কণ্ঠে বললেন হিমুর মেজকা। 

“ বৌমা যে কেন ওর গায়ে হাত তুলতে গেল। প্রচন্ড অভিমান হয়ে গেছে ছেলেটার।” হিমুর দাদু শুকনো গলায় বললেন। হিমুর বাবা এমনিতে একটু কম কথা বলেন কিন্তু আজ তাঁর পিসীমার সামনেই বললে “ নীলিমার কি দোষ বলত বাবা?কোনও কারণ ঘটল কি না ঘটল পিসিমা নীলিমাকে আর সেই সাথে আমার ছেলেটাকে যা নয় তাই বলে অপমান করতে থাকে। একটা মানুষ কত সহ্য করবে? আজ নীলিমার ধৈর্যচ্যূতি ঘটেছে। পিসীমাকে তো কিছু বলতে পারবে না তাই সেই রাগটা হিমুর ওপর গিয়ে পড়েছে“ শুধু শুধু আমাকে দোষ দিস নি অমিত। যা বদমাইশ ছেলে তোর!” পিসিঠাম্মা তেড়েফুঁড়ে উঠলেনহিমুর বাবা ঠান্ডা গলায় তাঁর দিকে তাকিয়ে বললেন, “ হিমু একটু দুস্টু কিন্তু ও কোনও দিন কারুর ক্ষতি করে না। ওর স্কুলের স্যার, ম্যাডামদের সবার প্রিয় হিমু। তাঁরা যখন বলেন অমিত বাবু আপনার হিরন্ময় হয়ত একটু চঞ্চল কিন্তু ওর জোড়া ছেলে আমাদের স্কুলে আর দুটি নেই । ওর ওপর আমাদের অনেক আশা। তখন গর্বে আমার বুকটা ফুলে ওঠে। কিন্তু হিমু কেন বার বার তোমার পেছনে লাগে জানো কারণ তুমি ওর মাকে অপমান করো। ওর বয়সে ও এইভাবেই প্রতিবাদের পন্থা খুঁজে পিসিঠাম্মা কোনও উত্তর দিতে পারলেন না।

নীলিমাদেবী নিঃশব্দে বাড়ীর কাজ সেরে যাচ্ছেন। বুকের মধ্যে ক্রমাগত রক্তক্ষরণ হয়ে যাচ্ছে তাঁর কিন্তু বাড়ির একটা মানুষকেও তিনি অনুরোধ করেননি হিমুকে খুঁজে এনে দেওয়ার জন্য। নিজের ওপরে ভীষণ রাগ হচ্ছে তাঁর কেন তিনি একটু রাগ সামলাতে পারলেন না। তিনি তো হিমুর মা, ভালো করেই জানেন কেন হিমু ওর পিসিঠাম্মার সাথে এরকম করে। দুপুর দুটা বেজে গেল এখন পর্যন্ত তিনি কিছুটি দাঁতে কাটেন নি। তাঁর ছেলেটা কোথায় গেল, কি করছে কে জানে। শুধু মনে হচ্ছে এক্ষুনি হিমু দৌড়ে এসে তাঁর আঁচল ধরে বলবে মা খেতে দাও, খুব খিদে পেয়েছে। সবার অলক্ষ্যে চোখের জল মুছলেন হিমুর মা। হিমুর ঠাম্মা তো ঠাকুরের সামনে হত্যে দিয়ে পড়ে আছেন। কাকিমা বাইরের বারান্দায় তুলতুলকে আঙ্গুর খাওয়াতে খাওয়াতে ডুকরে কেঁদে উঠলেন, “ ঠাকুর, আমার মেয়েটাকে তো তুমি পাষাণ করে দিয়েছ। হিমুটাকে অন্তত ফিরিয়ে দাও   




      তুলতুলকে বসিয়ে রেখে তার মা একটু ভেতরে গিয়েছিলেন। সে শূন্য দৃষ্টিতে আকাশের দিকে তাকিয়ে ছিল“টুনটুনি পাখি, কই গো আমার টুনটুনি পাখি। কোথায় তুমি?” তুলতুলের স্থবির হয়ে যাওয়া মন জগতে এই ডাকটা হিল্লোল তুলল। তার নির্বাক চোখদুটো যেন ভাষা খুঁজে পেল। সে দুচোখ মেলে বাইরের দিকে তাকালো। ওই তো গেটের বাইরে তার দাদান দাঁড়িয়ে আছে ধুতি, পাঞ্জাবী পরে। কাঁধে ঝোলা ব্যাগ, হাতে মিষ্টির হাঁড়ি। দাদান প্রতিবারই তো তার আর দাভাইয়ের পছন্দের মুগের জিলিপি আনে। 

“ কই গো আমার টুনটুনি পাখি কি আকাশে উড়তে গেছে?” ওই তো সেই চেনা ডাক। তুলতুলের নিশ্চুপ হয়ে যাওয়া ঠোঁটে হাসি উপচে উঠল। বহুদিন পর সে আবার তার ছোট্ট ছোট্ট পা দুটো দিয়ে দামাল হওয়ার মতো বাগানের বুক চিরে গেটের দিকে ছুটে চলল। দাদানের পাশে তার দাভাইও দাঁড়িয়“ দাদান।” এতদিন পর তুলতুলের গলার স্বর শুনে আনন্দে হিমুর দু চোখ ভরে এল। কাছে এসে তুলতুল অবাক হয়ে দাঁড়িয়ে গেল। তার দাদানের মতো কিন্তু ঠিক যেন তার দাদান নয়। তার দিকে তাকিয়ে মিটিমিটি হা“ বনু দেখ আমি ভালো দাদুকে নিয়ে এসেছি।” তুলতুলকে কোলে তুলে নেয় হিমু“ দাদান এরকম দেখতে হয়ে গেল কি করে?” অবাক প্রশ্ন তুলতুলের। “ আরে বনু জানিস তো ভালো দাদু তো সেই শিব ঠাকুরের বাড়ি গিয়েছিল। সেখানে কার্তিক ঠাকুরের ময়ূরটা ভালো দাদুর মাথায় এমন নাচ শুরু করেছিল যে ভালো দাদু একটু বেঁটে হয়ে গেল। তারা তো ভালো দাদুকে আসতেই দিচ্ছিল না। আমি চুপিচুপি রামধনু ওপর দিয়ে স্লিপ খেয়ে খেয়ে ভালো দাদুকে নিয়ে আসছিলাম এমন সময় বাজ বুড়োটা এসে দাদুর গালে একটা গাঁট্টা মেরে দিল আর অমনি দাদু ফর্সা থেকে কালো হয়ে গেল। আর আসার সময় দাদু এত মেঘের আইসক্রিম খেল যে ঠান্ডায় গলাটাও কেমন যেন হয়ে গেল।”

“ ওও বুঝলাম।” বিজ্ঞের মতো ঘাড় নাড়লো তুলতুলতুলতুলের মা তুলতুলকে দেখতে না পেয়ে ভয়ে চিৎকার করে উঠতেই বাড়ির ভেতর থেকে সবাই বেরিয়ে এল। হিমুকে পাওয়া যাচ্ছিল না বলে ওবাড়ির জেঠুরা, দাদারা আর পাড়ার দু চারজনও ছিলেন। অবাক হয়ে সবাই দেখলেন হিমু তুলতুলের হাত ধরে নিয়ে আসছে, তার সঙ্গে একজন বৃদ্ধ মানুষ। সবচেয়ে আনন্দের কথা তুলতুল অনর্গল বকে চলেছে। এমন সময় আবার হিমুর ছোটকা গেটে ঢুকে বললেন, “ কেমন সারপ্রাইজ দিলাম? হঠাৎ করে   

       হিমু ভয়ে ভয়ে সবা দিকে তাকাচ্ছে। নিতাইদাদুকে দেখে হঠাৎ তার মাথায় বুদ্ধিটা আসে। যদি বনু ঠিক হয়ে যায় এই ভেবে সে মস্ত বড় একটা ঝুঁকি নিয়ে ফেলেছে। বনু তো মনে হচ্ছে ঠিক হয়ে গেছে। পুতুল নিয়ে খেলতে বসে গেছে কিন্তু তার কি হবে? এমনিতেই সবাই রেগে আছে তার ওপর। ছোটকা প্রথম মুখ খুলল, “ হিমু ব্যাপারটা আমাদের একটু খুলে বলবি? আমরা কিছু বুঝতে পারছি না।” হিমুর বদলে সেই বৃদ্ধ মানুষটি মুখ খুললেন, “ আমি যদি বলি আপত্তি আছে কি ক“ না না আপনি বলুন।” হিমুর বাবা বললেন।

“ আমার নাম নিতাই সামন্ত। গোলডিহা গ্রামে বাড়ি। আমার নিজের কোনও ছেলেমেয়ে নেই। আমার স্ত্রী মারা যাবার পর ভাইপোরা আমার দেখাশোনা করবে বলে ভুলিয়ে ভালিয়ে সমস্ত সম্পত্তি লিখিয়ে নিয়ে আজ সকালে বাড়ি থেকে বের করে দেয়। আমি মনের দুঃখে জঙ্গলে গিয়ে আত্মহত্যার চেষ্টা করি কিন্তু আপনাদের হিমু আর তার বন্ধু আমার প্রাণ বাঁচায়। জানেন বড় ভালো ছেলে আপনাদের হিমু। ও আমায় জিগ্যেস করল মাত্র কয়েকটা খারাপ মানুষের জন্য আমি মরতে কেন যাচ্ছিলাম। পৃথিবীতে কত ভালো মানুষ আছে। তারপর ওর বনুকে ভালো করার জন্য আমার সাহায্য চায়। আমি ওকে না বলতে পারিনি।” নিতাই দাদু একটানা কথাগুলছোটকা হিমুর দিকে তাকিয়ে বললেন, “ তাহলে চ্যাম্প, প্ল্যান সাকসেসফুল। সত্যি নিতাই বাবুকে তুই এত অল্প সময়ে ট্রেনিংটাও দারুন দিয়েছিস। হিমু তোর মাথায় এই বুদ্ধিটা এল কি কর“ আমি ভাবলাম ভালদাদুর একসিডেন্ট, মারা যাওয়া এগুলোর জন্যই তো বনু ওরকম হয়ে গিয়েছিল তাই বনু যদি ভাবতে পারে ভালো দাদু বেঁচে আছেন তাহলে আবার আগের মতো হয়ে যাব“ হিমু আমি সারাজীবন তোর কাছে কৃতজ্ঞ থাকব।” মেজকা ধরা গলায় বললেন।একটু দোনামনা করে হিমু বলল, “ বাবা, একটা কথা বলব?”

“ বল না কি বলবি।”

“ নিতাই দাদুর কাছে তো টাকাপয়সা ছিল না। আমার কাছেও না তাই হাট পাড়ার “ রসময় মিষ্টান্ন ভান্ডার” থেকে তোমার নাম করে মিষ্টি কিনেছি আর সমর কাকুর দোকান থেকে ধারে ধুতি-পাঞ্জাবি। নিতাইদাদুর জামা কাপড় তো নোংরা হয়ে গিয়েছিল। আর বরুণ মাস্টারমশাইয়ের ঝোলা ব্যাগটা আজকের জন্য চেয়ে এনেছি।” হিমু ভীত সন্ত্রস্ত দৃষ্টিতে বাবার দিকে তাকাল। হিমুর কম কথা বলা রাশভারী বাবা হঠাৎ করে হা হা করে সারাবাড়ি কাঁপিয়ে হেস   হিমু তার খাটের উপর বসে আছে। ছোটকা বনুর ডাক্তারবাবুর সাথে ফোনে কথা বলেছে। তিনি বলেছেন এবার কিছু ওষুধ খেলেই বনু একদম ঠিক হয়ে যাবে। সত্যিটাও সহজে মেনে নিতে পারবে। হিমুর ওপর খুব খুশি হয়েছেন তিনি। সবাই তাকে খুব আদর করছে। এমনকি পিসিঠাম্মাও একশ আশি ডিগ্রী ঘুরে গেছেন। ঠাম্মা নিতাই দাদুকে দাদা পাতিয়ে ফেলেছেন। দাদু বলেছেন নিতাই দাদু এবার থেকে এখানেই থাকবেন। দাদুকে সাহায্য করবেন। সবই ভালো হচ্ছে কিন্তু এখন পর্যন্ত মা তার সঙ্গে একটাও কথা বলেন নি। মা বোধহয় এখনও রেগে আছেন। হিমুর তাই কিছুই ভালো লাগছে না। সে জানালা দিয়ে বাইরে বৃষ্টি দেখছে। “ হিমু।” মায়ের ডাকে ঘুরে তাকালো “ মায়ের ওপর তোর এত অভিমান হয়েছিল! কোথায় চলে গেছিলি মাকে না বলে?” মা হিমুকে জড়িয়ে ধরে ঝরঝর করে কেঁদে ফেললেন। হিমুর এত বুদ্ধি কিন্তু আজ পর্যন্ত সে এটা বুঝে উঠতে পারে নি যে তাকে খুব করে বকার পর মা নিজেই কেন কাঁদেন! হিমুও ছোটবেলার মতো মাকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরল। মা-ছেলে দুজনের চোখেই শ্রাবণের ধারা। বাইরে তখন বৃষ্টি থামার শেষে সোনালী রোদে ভেসে সাতরঙ্গা রামধনু উঁকি দিচ্ছে ।




Rate this content
Log in

More bengali story from Sayantani Palmal

Similar bengali story from Abstract