Dola Bhattacharyya

Others Children

4  

Dola Bhattacharyya

Others Children

বিশুর কীর্তি

বিশুর কীর্তি

10 mins
713


 সরযুবালার তিন ছেলে আর দুই মেয়ের মধ্যে বিশু ওরফে বিশ্বগোপাল ভট্টাচার্য হচ্ছে কনিষ্ঠ সন্তান । বড় দুই ছেলে সুজয় আর বিজয়ের পর দুই মেয়ে অমলা আর কমলা। তারপর বিশু ।কোন ছোটবেলায় বাবা মারা গেছেন ওদের। একা হাতে পাঁচটা ছেলেমেয়েকে মানুষ করেছেন সরযুবালা। অমলা আর কমলা খুবই শান্ত মেয়ে । ভালো ঘরে বিয়ে হয়েছে তাদের। বড় ছেলে সুজয়েরও বিয়ে হয়েছে কয়েকবছর হল। সুজয় পড়াশোনা শেষ করে চাকরি করছে এখন। আর মেজ বিজয় কলেজে পড়ে। বিশু হচ্ছে বিচ্ছুর শিরোমণি । ক্লাস নাইন এ পড়ে । প্রতিবেশীদের কাছ থেকে পনেরো বছর বয়সী বিশুর নামে নালিশ শুনতে শুনতে নাজেহাল সরজুবালা। কি করবেন! এতবড় ছেলেকে তো ঘরে বেঁধে রাখা যায় না। তবে প্রতি সপ্তাহেই একটা করে পাখার বাঁট ভাঙতে হয় বিশুর পিঠে। তবু ছেলের লজ্জা নেই। গত বছর কালীপুজোর সময়ে ন্যাড়া বাগদীর কালো কুচকুচে নধর ছাগলটাকে চুরি করে ক্লাবের ছেলেরা মিলে ফিস্ট করেছিল। কালীপুজোর চাঁদা দিতে অস্বীকার করেছিল ন্যাড়া বাগদী। তার ওপর এভাবেই শোধ নেওয়া হল। বুদ্ধিটা দিয়েছিল এই বিশু। ন্যাড়া বাগদীর বৌ এসে কেঁদে পড়েছিল সরজুবালার কাছে, "ও ভটচাজ গিন্নী! তোমার বিশেটা আমার কি ক্ষেতি করে দিল গো"! ন্যাড়া বাগদীর বৌ কে কটা টাকা দিয়ে বিদায় করলেন সরজুবালা। শয়তান ছেলেটার জন্য এরকম খয়রাতি মাঝে মধ্যেই করতে হয়। মেরে মেরে পিঠের ছাল তুলে দিলেও শিক্ষা হয় না বাঁদরটার। 

এখনকার ছেলেপুলেদের অবশ্য এত মারধর করা যায় না। ওদের আবার একটুতেই মানের কানা ভেঙে পড়ে। তখন আবার মা বাপকেই আদর সোহাগ করে ভোলাতে হয়। না হলে তারা কখন যে কি করে ঠিক আছে নাকী! অবশ্য এ গল্পটা এখনকার নয়। এ আমার বাবা জ্যেঠাদের আমলের গল্প। তখন আমাদের জন্মই হয়নি। যাইহোক, গল্প টা বলি। 

বড় বৌদি সঞ্চিতার কালো রঙের সিল্কের শাড়িটা পাওয়া যাচ্ছে না। কোথায় গেল শাড়ি টা! সঞ্চিতার খুব পছন্দের শাড়ি ওটা। শাড়ি না পেয়ে মুখ হাঁড়ি করে ঘুরছে বৌটা। কেন যেন বিশুকে সন্দেহ হচ্ছিল সরজুবালার।বিশু তখন সাইকেল নিয়ে বাড়ির বাইরে যাবার জন্য প্রস্তুত। সরজুবালা জিজ্ঞেস করলেন, "কি রে! বড় বৌমার পছন্দের শাড়িটা পাওয়া যাচ্ছে না। তুই লুকোস নি তো?" ছেলে তো আকাশ থেকে পড়ল, "সেকী মা! অত সুন্দর শাড়িটা কোথায় গেল!" তারপর বৌদি কে উদ্দেশ্য করে বলল, "ও বৌমণি, একদম চিন্তা কোরো না গো। আমি বাড়ি ফিরে তোমার শাড়ি খুঁজে দেব" ।ওর সাইকেলের ক্যারিয়ারে একটা চটের থলিতে কিসব জিনিস রয়েছে। সরজুবালা জিজ্ঞেস করলেন," ওই থলিতে কি আছে রে?" 

"ওঃ! ওতে আমার কিছু পুরোনো জামাকাপড় রয়েছে। আসলে দেশের বাড়ি থেকে বিজুর মামাতো ভাই এসেছে। খুব গরীব ওরা। কেমন ছেঁড়া জামাকাপড় পরে রয়েছে। বিজুদের অবস্থাও তো তেমন ভালো না, যে ওদের কিছু সাহায্য করবে। আমি বলেছিলাম, আমার কিছু পুরোনো জামাকাপড় আছে, দেবো খন। তাই নিয়ে যাচ্ছি "। আর কিছু বললেন না সরজুবালা। ফুর্তি তে শিস দিতে দিতে বেরিয়ে গেল বিশু। 

বড় বৌমাকে ডেকে সরজুবালা বললেন," ও বৌমা, আজ যে ভুত চতুর্দশী। মাটির প্রদীপগুলো ছাদে দিয়ে এসো। মাটি কাঁচা থাকলে অনেক তেল খাবে। আর একটু শুকোক । বিকেলের আগে আবার মনে করে নামিয়ে এনো কিন্তু"। 

     দুপুর বেলায় সকলের খাওয়া হয়ে গেল। বিশুর পাত্তা নেই ।কোথায় গেল ছেলেটা। অতিষ্ঠ হয়ে উঠেছেন সরজুবালা। বড় বৌমা সেই কখন থেকে ভাতের হাঁড়ি আগলে বসে আছে। " বৌমা, আর কতক্ষণ বসে থাকবে ও ছোঁড়ার জন্যে। এবার খেতে বস তুমি। আজ আর বেশিক্ষণ বিশ্রাম নিতে পারবে না। চোদ্দ ফোঁটা আছে। চোদ্দ প্রদীপ দিতে হবে। তারপর আবার রাতের রান্না । কতরকম কাজ রয়েছে। আজ ওবেলায় দুরকম পদ বেশি হবে বুঝলে । কতদিন পর মেয়ে জামাই এসেছে বাড়িতে। আর আজ একটু ক্ষীর বানিও । মেয়েটা আমার ক্ষীর খেতে খুব ভালবাসে। 


সুকুমারদের বাড়িতে এই মুহুর্তে আড্ডা জমে উঠেছে বেশ। সুকুমার আর বিশুর সাথে রয়েছে আরও দুই বন্ধু, পিংলে আর ন্যাশপাতি। আজ কিছু আত্মীয় এসেছেন সুকুমারদের বাড়িতে । মস্ত একটা ভেটকী মাছ এনেছেন সুকুমারের বাবা। তার সাথে কচি পাঁঠার ঝোল। এসব দেখে ওখানেই জমে গেছে ওরা । সুকুমার বলল, "আজকের রাতের প্ল্যান তাহলে রেডি তো!" তিনজনে সমস্বরে বলে উঠল, "রেডিইইই"। 

"বিজু কে ভুতের ভয় দেখানো হচ্ছে তো!" 

"হ্যাঁআ্যঁআ্যঁ" । 

কদিন আগে ক্লাবঘরে বসে জোর গুলতানি চলছিল ওদের, ভুত নিয়ে। বিজু জোর গলায় বলেছিল, "ভুত ফুত বলে কিছু নেই। ওসব আমি বিশ্বাস করি না।" ওরা সবাই মিলে চেপে ধরেছিল বিজু কে, সেকী রে! রাত দুপুরে যদি হঠাৎ দেখিস, একটা কঙ্কাল তোর সামনে নেত্য করছে, তাহলেও ভয় পাবি না! "

" দূর! কঙ্কাল হল স্কেলিটন। ওটা সব মানুষের শরীরেই থাকে। শুধু কঙ্কাল উঠে দাঁড়িয়ে নেত্য করবে, এ কখনো হতেই পারে না।" জোর গলায় কথাগুলো বলেছিল বিজু। পিংলে বলে উঠেছিল, রাত দশটার পর একা শ্বশানে যেতে পারবি?" 

সদর্পে বলেছিল বিজু,"কেন পারব না! নিশ্চয় পারব ।" 

বিশু বলেছিল, "এতবড় কথাটা ভেবে বলছিস তো! ভয় পাবি না?" 

নিজের জায়গা থেকে এক পা নড়ে নি বিজু, "একদম না।" 

তখনই ঠিক হয়ে যায় সব কিছু। বিজু কে ওরা বলে," ভুত চতুর্দশীর দিন রাত দশটার পর শ্বশানে গিয়ে, মড়া পোড়ানোর গোল ঘরটার পাশে যে অশ্বত্থ গাছটা আছে, ওটার গায়ে নিজের পুরো নামটা লিখে রেখে আসতে হবে।"বিশু বলে," দ্যাখ ভাই, নিজেদের সাহসী বলে আমরা কেউ দাবী করিনি। কিন্তু তুই করেছিস। তাই, এ পরীক্ষা তোকে একাই দিতে হবে।"রাজি হয়ে যায় বিজু। এই হল পুরোনো ঘটনা। 

রান্নাঘর থেকে মাংস রান্নার গন্ধ ভেসে আসছে। বুক ভরে সুগন্ধি বাতাস টেনে নিয়ে বিশু বলে, "ঠিক আছে । আজ তবে হয়ে যাক বিজুর পরীক্ষা। তার আগে কিন্তু ওই ন্যাড়া বাগদীর ব্যাটা, ওই মদনাটার হিসেব চোকাবো আমি। ব্যাটা বড্ড বাড় বেড়েছে। খালি আমার নামে নালিশ করে যাচ্ছে মায়ের কাছে। আর কটা পাখার বাঁট আমার পিঠে ভাঙবে বল তো! পাখা গুলোর দাম নেই নাকী !" সকলে হো হো করে হেসে উঠল ওর কথায়। 

                         ॥2॥


বিকেল গড়িয়ে যেতে বাড়ি ঢুকল বিশু। ছেলের সাড়া পেয়ে ঘর থেকে বেরিয়ে এলেন সরজুবালা," বলি, সারা দুপুর ধরে খিদে তেষ্টা ভুলে কোন রাজা উজিরটা মারা হল শুনি।" কাঁচুমাচু মুখ করে মায়ের সামনে এসে দাঁড়াল বিশু," আসলে বিজুদের বাড়ি থেকে বেরিয়ে সুকুমারদের বাড়িতে গিয়েছিলাম। ওদের বাড়িতে আজ মাংস রান্না হচ্ছে। সুকুমারের মা বলল, দুপুরে আজ খেয়ে যাস বিশু। বন্ধুর মা, গুরুজন হয় তো। কি করে অগ্রাহ্য করি বল! তাআআই… "

" হ্যাঁ তাআআই! বাড়ির নিরামিষ খাবার তো মুখে রুচবে না। জানি তো। অ বৌমা! ভাতের হাঁড়ি তে জল ঢেলে রেখে দাও দেখি। ছেলে আমার আজ বন্ধুর বাড়িতে রাজভোগ খেয়ে এলেন "। মায়ের সামনে আর দাঁড়িয়ে থাকা বেশ বিপজ্জনক দেখে মানে মানে কেটে পড়ে বিশু। সন্ধ্যা বেলায় আবার মায়ের সামনে দিয়েই বেরোতে হবে। কি করে সেটা সম্ভব! ভেবে কুল পায় না বিশু।  

                           হাতে চন্দন আর সিঁদুর গোলার বাটি নিয়ে দরজায় দরজায় ঘুরে বেড়াচ্ছে বড় বৌদি। মহা সমারোহে চলছে চোদ্দো ফোঁটা পর্ব। মা মাঝে মাঝে শাঁখে ফুঁ দিচ্ছে। সেদিকে হাঁ করে তাকিয়ে থাকতে থাকতেই মতলবটা ভেঁজে ফেলল বিশু। এবার নিশ্চিন্ত। 

কার্তিক মাসের সন্ধ্যা। তাড়াতাড়ি অন্ধকার হয়ে যায়। ঘরের জানালা দিয়ে দেখতে পাচ্ছে বিশু, মা আর বৌদি মিলে বাড়ির আনাচে কানাচে প্রদীপ জ্বালিয়ে দিচ্ছে। মায়ের গলা শোনা গেল, " এই এতবড় বাড়িতে অন্ধকার কোণ অনেক আছে। চোদ্দো কেন, বিয়াল্লিশ টা প্রদীপ জ্বালিয়ে দিলেও সব জায়গার অন্ধকার ঘুচবে না। আর এবাড়ির ভুত তো অন্ধকার নয়, আলোতেই দিব্য ঘুরে বেড়ায়"। মুখে আঁচল দিয়ে হাসি চাপা দিল বৌদি। হঠাৎ খুব রাগ হয়ে গেল বিশুর। মা কি ওকে ভুত বলল! যদি একবার সুযোগ পায় না , তাহলে ভুতের ভয় কাকে বলে মাকেও টের পাইয়ে দিতে হবে। 

রান্নাঘরের সামনে টানা লম্বা দালানটায় বসে মা আর বৌদির সন্ধ্যার চা পান পর্ব চলছে। এই মুহুর্তে আর কেউ নেই বাড়িতে। বইএর ঝোলা কাঁধে নিয়ে বিশুকে বেরোতে দেখে সরযুবালা জিজ্ঞেস করলেন, "এই যে নবাবপুত্তুর! এবেলা আবার কোথায়!" খুব মিষ্টি করে বিশু বলল, একটু ক্লাবে যাব। তারপর বিজুদের বাড়ি। ওখানেই সুকুমাররা আসবে। সবাই মিলে একটু পড়াশোনা করব। ফিরতে একটু রাত হবে। আসলে সামনেই পরীক্ষা তো।" পড়াশোনার কথা শুনে আর কিছু বললেন না সরযুবালা। 


 রাত ঠিক সাড়ে দশটায় বাড়ি থেকে বেরোবে বিজু। ওকে ঠিকঠাক সব বুঝিয়ে দিয়ে সন্ধ্যা সাড়ে সাতটা নাগাদ চার মূর্তি ক্লাবঘরে এসে বসল। সকালের সেই চটের থলিটা সুকুমার কে রাখতে দিয়েছিল বিশু। সেটা থেকে এবার বেরিয়ে এল কালো রঙের একটা সিল্কের শাড়ি। আর একটা কঙ্কালের মুখোশ ।ধর স্টুডিওর বীরেন দাদা এই মুখোশ গুলো বানাচ্ছে দেখে, তখনই বদবুদ্ধি গজায় বিশুর মাথায় ।কালোর ওপরে সাদা রং দিয়ে মুখ চোখ আঁকা। চোখের জায়গায় আবার সবুজ রং।অন্ধকারে সেটা আবার জ্বলজ্বল করে। যে কেউ দেখলেই ভয় পেয়ে যাবে। পাঁচ পয়সা দিয়ে একটা মুখোশ কিনে নেয় বিশু । 

রাত নটা নাগাদ ক্লাব থেকে সাঙ্গপাঙ্গ সমেত বেরিয়ে মেন রোডের পাশে ঝুপসি বটগাছটার নিচে এসে দাঁড়াল বিশু। গাছের তলায় ছায়া ছায়া অন্ধকারে ঢাকা জায়গাটায় দাঁড়িয়ে ঠিক মায়েদের মতো করে শাড়িটা পরে বেশ বড় একটা ঘোমটা টেনে দিল মাথায়। বেশ দক্ষতার সাথেই কাজটা করল বিশু। তারপর মুখোশ টা পরে সোজা গাছে উঠে গেল। 

  রাত সাড়ে নটা। দীপশ্রী সিনেমার শেষ শো ভেঙেছে। দারুণ একটা ভুতের বই চলছে। খুব ভিড় হচ্ছে। রিক্সায় সওয়ারী নিয়ে রেল স্টেশনের দিকে চলেছে মদন। রাস্তা নির্জন হয়ে এসেছে। দোকানপাটগুলোও বন্ধ হয়ে যাচ্ছে ঝপাঝপ। এত রাতে কে আর দোকান খুলে বসে থাকবে। দেখতে দেখতে বটগাছের কাছে এসে পড়ল মদনের রিক্সা। এ জায়গাটায় কেমন যেন ছায়া ছায়া অন্ধকার, না জানি কি রহস্য লুকিয়ে আছে ঘাপটি মেরে। জোরে প্যাডেল মেরে জায়গাটা পার হতে চাইছিল মদন। সহসা বটগাছের ডালপালাগুলো বিনা বাতাসে সজোরে আন্দোলিত হতে থাকল। রিক্সায় বসে থাকা সিনেমা ফেরৎ বিহারী বাবুটি সিয়ারাম সিয়ারাম জপ করতে লাগলেন। আর সেই শব্দে কে যেন ওপর থেকে জোর ধমক লাগাল, চোঁওপ! ধমকের চোটে বিহারী বাবুটি ভিরমী খেতে গিয়েও সামলে নিলেন নিজেকে। মদন হঠাৎ অনুভব করে রিক্সাটা কেউ যেন পেছন পানে টানছে। প্যাডেল করে ও কিছুতেই সামনে এগোতে পারছে না। ভয়ে ঘামতে থাকে মদন। বিহারী বাবু পরিস্থিতি দেখে রিক্সা থেকে নেমে কাছা কোঁচা সামলে চোঁ চাঁ দৌড় । রিক্সা ফেলে মদনও বিহারী বাবুকেই অনুসরণ করতে যাচ্ছিল। আর তখনই সেই কন্ঠস্বর আবার ধমক দিল, "এ্যাঁই মদনা! পাঁলাচ্ছিস নাকি! আমাকে নিয়ে যাঁবি না!" 

"কো কোথায় আপনি? আর যাবেনই বা কোথায়?" 

"এঁই যেঁ,এঁখানে ।ওঁপরে ।দ্যাঁখ" ।

ওপর দিকে তাকাতেই মদন দেখে একটা বেশ মোটা ডালে ঠ্যাং ঝুলিয়ে বসে আছে একটা কালো কাপড় পরা কঙ্কাল মূর্তি। দুটো চোখে তার সবুজ আগুন ধ্বক ধ্বক করে জ্বলছে। মূর্তিটা দোল খেতে খেতে বলল," শ্মঁশানঘাঁটে যাব। আমায় নিয়ে যাঁবি মদনা "। আর নিতে পারল না মদন। ঢলে পড়ল রাস্তার ওপরেই। রিক্সার পেছন থেকে নেমে এল বিচ্ছু গুলো। বিশুও নেমে এল গাছ থেকে। একটা কাজ সারা হল। বিজুর পরীক্ষা নেওয়াটা শুধু বাকি রইলো। হাতে এখনও কিছুটা সময় রয়েছে। এদিকে পেটে ছুঁচোয় ডন মারছে। একটু তো বাড়িতে যেতে হবে। নাহলে খাবার জুটবে না। 

বাড়ি পৌঁছে খেয়াল হল বিশুর, এই পোষাকে ভেতরে যাবে কি করে। শুধু গেলেই তো হবে না। আবার বেরোতেও তো হবে। ভাবতে ভাবতেই পাঁচিল টপকে বাড়ির বাগানে নেমে পড়ল বিশু। রান্নাঘরের জানালাটা খোলা রয়েছে। আরে! উনুনের ওপর দুধের হাঁড়ি বসানো রয়েছে। ব্যাস ব্যাস। ওতেই হবে। বাগানের এককোণে কিছু প্যাকাটি রাখা ছিল। বেশ লম্বা দেখে একটা প্যাকাটি নিয়ে জানলার কাছে এসে দাঁড়াতেই মনটা আনন্দে নেচে উঠল। দুধ নয়। ক্ষীর রাখা আছে হাঁড়ি তে। হাঁড়ির মধ্যে প্যাকাটি ডুবিয়ে চোঁ চোঁ করে টানতে লাগল বিশু। 


বাড়ির সকলের খাওয়া হয়ে গেছে। সবাই ঢুকে গেছে যে যার ঘরে। রান্নাঘরের সামনে বারান্দায় সঞ্চিতা আর সরযুবালার বড় মেয়ে অমলা খেতে বসেছে। ননদ ভাজের মধ্যে খাওয়ার চেয়ে গল্পটাই হচ্ছে বেশি। অমলার হঠাৎ চোখ পড়ল রান্নাঘরের জানলার দিকে। "ও বৌদি গো! ভু ভু ভুউত!" চোখ উল্টে গড়িয়ে পড়ল অমলা। অবয়ব টা সঞ্চিতাও দেখতে পেয়েছে। বেচারী কি করবে ভেবে পাচ্ছে না। ভয়ে কেঁপে মরছে। বিশু তো বুঝতেই পেরেছে, ওকে দেখেই ভয় পেয়েছে সব। তাতে ও মজাই পাচ্ছে বেশ। হাঁড়ি তে এখনও বেশ খানিকটা ক্ষীর আছে। ওটা সাঁটিয়েই কেটে পড়বে। চেঁচামেচি শুনে সরযুবালারও ঘুম ভেঙে গিয়েছে। "এ নিশ্চয়ই বিশেটার কাজ" বলে একটা লাঠি হাতে নিঃশব্দে বাগানে এসে বিশুর ঠিক পেছনেই দাঁড়ালেন সরযু। আচমকা লাঠির খোঁচা খেয়ে পেছনে তাকাতেই লাফিয়ে উঠল বিশু। "বিশেএএএ! আজ তোর একদিন কি আমারই একদিন"! হুংকার দিলেন সরযু। লাফিয়ে পালাতে গেল বিশু । পালানোর আগের মুহূর্তেই শাড়ির প্রান্ত ধরে টান মারলেন সরযুবালা। এক হ্যাঁচকা টানে শাড়িটা খুলে এল ওনার হাতে। আর বিশু পাঁচিল টপকে আবার পগার পার। ছেলেকে ধরতে না পারলেও বৌমার শাড়িটা পাওয়া গেল। গজগজ করতে করতে ঘরে ঢুকলেন সরযু। 


রাত সাড়ে দশটা নাগাদ গঙ্গা পারের নির্জন রাস্তা টা ধরে শ্মশানে এসে পৌঁছলো বিজু। অন্ধকার, গাছমছমে পরিবেশ। ভয় তো বিজু পায় না। দৃঢ় পায়ে অশ্বত্থ গাছটার কাছে এসে দাঁড়াল ও । প্যান্টের পকেট থেকে চক টা বের করে সবে নিজের নামটা লিখতে যাবে, আচমকা, কেউ যেন পেছন থেকে জড়িয়ে ধরল ওকে। মূহুর্তে সব সাহস হুউস করে উড়ে গেল বিজুর। "ভুউত! ভুউত!" গলা দিয়ে শব্দ বেরোচ্ছে না। গোঁ গোঁ করতে করতে ভুতেরই দুই হাতের মধ্যে এলিয়ে পড়ল বিজুর শরীর টা । টাল সামলাতে না পেরে বিজুকে কোলে নিয়েই বসে পড়ল ভুত। ঠিক তখনই আশপাশের কোনো গাছ থেকে শকুনের বাচ্চা কেঁদে উঠল মানুষের বাচ্চার মতো গলা করে। ভুত বাবাজি নিজেই তখন বেশ ভয় পেয়েছেন। কারণ আশেপাশে আর দ্বিতীয় প্রাণীটি নেই। বাকিরা বোধহয় কেটে পড়েছে ভয়ের চোটে। ভুত তখন বিজুকে ধরে বেশ জোরে জোরে ঝাঁকানি দিচ্ছে, আর বলছে, "বিজু! বিজু ওঠ! একবার তাকা! বিজু কোনোরকমে একটুখানি চোখটা খুলতেই দেখে, ওর মুখের ওপরেই দুলছে একটা কঙ্কালের মুখ। থেকে থেকে সেটা আবার বিজু বিজু বলে ডাকছে ওকে। ভ্যাঁ করে কেঁদে উঠল বিজু," দোহাই বাবা ভুত। আমায় ছেড়ে দাও এবারের মতো "। 

" ধ্যুত্তেরি নিকুচি করেছে তোর ভুতের", বলে নিজের মুখ থেকে মুখোশটা খুলে নিয়ে ছুঁড়ে ফেলে বিশু। "বিশে তুই"! বিজু অবাক। 

"হ্যাঁ। আমি। অনেক সাহস দেখিয়েছিস। ওঠ এবার।"

শ্মশানের গেট দিয়ে বেরোনোর সময়ে একদল শবযাত্রী হাজির। মধ্য রাতে এই নির্জন স্থানে হরিধ্বনি শুনে কেঁপে উঠল দুই দামাল কিশোর। ওরা নিজেরাই কত ভীতু, আবার অন্যের সাহসের পরীক্ষা নিতে চায়। দুই বন্ধুই লজ্জিত একে অপরের কাছে। মাথা নিচু করে ফিরে চলেছে ওরা নিজেদের নিরাপদ আশ্রয়ের দিকে। মনে শুধু চিন্তা, বাড়িতে সবার বকুনির হাত থেকে বাঁচবে কি করে। 


Rate this content
Log in