ভুলোদার বাঘ দেখা
ভুলোদার বাঘ দেখা


কোচিং থেকে লাফাতে লাফাতে ফিরছিল ভুলোদা। রাস্তায় আমাদের সঙ্গে দ্যাখা। আমরা মানে আমি, বুড়ি আর আমার বোন পর্ণা । আমাদের দেখেই প্রশ্ন করলো ভুলোদা,” বলতো প্যান্থেরা টাইগ্রিস বেঙ্গালেন্সিস কার নাম?”
তিনজনেই ভ্যাবলার মত তাকিয়ে রইলাম।
“ কিছুই তো শিখলি না......” বলে আমাদের তিনজনের মাথায় তিনটে চাঁটি মেরে বলল,” বাঘ রে বুদ্ধু বাঘ! আমাদের রয়্যাল বেঙ্গল টাইগার।“
“ তা বাংলায় বললেই হয়...।” বলে উঠলো বুড়ি।
“ বাংলা নয় ল্যাটিন, ল্যাটিন, এটা হল বাঘের সাইন্টিফিক নেম। বুঝলি?” বিজ্ঞের মত বলে উঠলো ভুলোদা।
আমি আমার অজ্ঞতায় লজ্জিত আর ভুলোদার জ্ঞানে মুগ্ধ।
“অ্যাই ভুলোদা তুই এতো জানলি কি করে রে?” আমার বিগলিত প্রশ্ন।
“ জানতে গেলে পড়তে হয়। রাস্তায় রাস্তায় ঘুরে বেড়ালে তো আর জ্ঞানবৃদ্ধি হয় না। একটা রয়্যাল বেঙ্গল টাইগারের গর্জন তিন কিলোমিটার দুরে পর্যন্ত শোনা যায়। জানতিস? কিছুই তো খবর রাখিস না । রয়্যাল বেঙ্গল টাইগারের অনেক গল্প আমি জানি। শুনতে চাস তো বিকালবেলায় আমার বাড়ী চলে আসিস।“ বলতে বলতে ভুলোদা চলে গেলো।
“ ভুলোদাটা কত জানে না?” বলল পর্ণা।
“ তোর মুণ্ডু!” ঝাঁঝিয়ে উঠলো বুড়ি। “ সব এস ডি স্যার বলেছে।”
“অ্যাঁ?”
“অ্যাঁ নয় হ্যাঁ। ভুলোদা কোথা থেকে ফিরছে? কোচিং ক্লাস থেকে । আজ নিশ্চয়ই স্যার ওদের এই সব শিখিয়েছে , আর সেগুলো ও এখানে এসে শোনাচ্ছে।” বলল বুড়ি।
“ বিকালবেলা যাবি নাকি?” আমি ভয়ে ভয়ে জিজ্ঞাসা করলাম।
“ যাওয়াই যায়।” অবজ্ঞার সঙ্গে বলে, বাড়ী চলে গেলো বুড়ি।
বিকালবেলায় ভুলোদার বাড়ী গিয়ে দেখি বুড়ি আগেই পৌঁছে গেছে আর খুব হেসে হেসে গল্প করছে। আমরা ঘরে ঢুকতেই বুড়ি বলে উঠলো,” ভুলোদা কি মজার মজার গল্প বলছে দ্যাখ!”
আমরাও গিয়ে গুছিয়ে বসলাম গল্প শুনতে।
“ বুঝলি, সুন্দরবনের বাঘই একমাত্র বাঘ, যা নদীর থেকে মাছ আর কাঁকড়া ধরে খেতে পারে। এরা এতো ভালো সাঁতার কাটে, যে জলেতে নেমে কুমিরের সাথে লড়াই করে শিকারও ছিনিয়ে নিতে পারে। এমন ভয়ঙ্কর বাঘ সারা পৃথিবীতে আর নেই। কিছুদিন আগে সুন্দরবনে হরিণের তুলনায় বাঘের সংখ্যা বেড়ে যাওয়ায় কিছু বাঘকে দেশের অন্যান্য অভয়ারণ্যে পাঠিয়ে দেওয়া হয়েছিল। কিন্তু কিছুদিন বাদেই সেই বাঘেদের আবার সুন্দরবনে ফেরত পাঠিয়ে দেওয়া হয়। কারণ ওরা নাকি ওখানকার বাঘেদের চরিত্র খারাপ করে দিচ্ছিল।“ বলে হাহা করে হেসে উঠল ভুলোদা।
আমরা চোখ গোলগোল করে গল্প শুনছি।
ভুলোদা বলে চলল,” সবচেয়ে ডেঞ্জারাস বাঘ কোনগুলো জানিস?”
আমরা মাথা নেড়ে জানালাম জানিনা।
“ম্যানইটার। এখন তোরা জিজ্ঞাসা করবি বাঘ ম্যানইটার হয় কেন? সাধারণত বাঘ যখন বুড়ো হয়ে যায়, তখন ওদের দাঁতগুলো ক্ষয়ে যায় আর ওরা বেশী ছুটতেও পারে না, তখন ওরা ম্যানইটার হয় । আবার যদি কোন বাঘ জখম হয়ে যায় যেমন ধর থাবায় সজারুর কাঁটা বা গাছের শ্বাসমূল ফুটে গেলো অথবা পোচারদের গুলিতে জখম হল তখনও বাঘ মানুষখেকো হয়ে যায়। আর একবার বাঘ মানুষখেকো হয়ে গেলে তাকে নিয়ে মহামুশকিল।”
“মুশকিল কেন ?”
“মানুষখেকো বাঘ যেমন চালাক তেমন হিংস্র । একবার একটা মানুষখেকো বাঘকে মারার জন্য এক ফরেস্ট রেঞ্জার তার ওপর গুলি চালায়। বাঘটা জখম হয় কিন্তু মরে না। তারপর থেকে সেই বাঘটা ওই রেঞ্জারের ওপর তিনবার অ্যাটাক করে। প্রথম দুবার অ্যাটাক হবার পর তাকে সুন্দরবনেরই অন্যদিকে ট্রান্সফার করে দেওয়া হয়েছিল। প্রায় পঞ্চাশ কিলোমিটার দূরে। কিন্তু বাঘটা ঠিক খুঁজে খুঁজে পৌঁছে গিয়েছিল সেখানে। তৃতীয়বার অ্যাটাক হবার পর ওনাকে সুন্দরবনের থেকে বাইরে পাঠিয়ে দেওয়া হয়।”
আমাদের গায়ে কাঁটা দিচ্ছে। আমরা বাকরুদ্ধ।
তখনই ভুলোদা বোমাটা ফাটালো, “পরের মাসে স্যার আমাদের পেঞ্চ জঙ্গলে বেড়াতে নিয়ে যাচ্ছেন। ওনার এক বন্ধু ফরেস্ট রেঞ্জার। তিনি আমাদের জঙ্গলের একদম ভিতরে একটা ফরেস্ট বাংলোতে থাকার ব্যবস্থা করে দেবেন বলেছেন। ওখানে সাধারণ লোকেরা যেতেই পারে না।”
খবরটা শুনে মনটা খুব খারাপ হয়ে গেলো। আর গল্পও শুনতে ইচ্ছা করলো না। ইস আমরা যদি যেতে পারতাম! ভুলোদার বাড়ী থেকে বেরিয়ে এইসব আলোচনা করতে করতে আমরা ফিরছি । এখন আমাদের গরমের ছুটি তাই আমরা মামারবাড়ীতে এসেছি। বাড়ীতে ঢুকেই বড়মাসীর গলার আওয়াজ পেলাম। আনন্দে লাফিয়ে উঠলাম আমরা। ছুটে গেলাম বড়মাসীর কাছে।
“কখন এলে? জানতো এস ডি স্যার না ভুলোদাদের জঙ্গলে বেড়াতে নিয়ে যাচ্ছে।” আমাদের আর তর সইল না। এই ধরনের সমস্যাতে বড়মাসীই আমাদের ত্রাণকর্ত্রী।
“জঙ্গলে? সেতো ভালো কথা।”
“জানো ওরা ফরেস্ট বাংলোতে থাকবে, ওয়াচ টাওয়ার থেকে বাঘ দেখবে।” উৎসাহে আমাদের চোখ জ্বলজ্বল করছে।
“বলিস কিরে?” বড়মাসীর চোখগুলোও উৎসাহে বড়বড় হয়ে গেছে , “এই এস ডি স্যারটা কে রে?”
ব্যাস! কাজ হয়ে গেছে।
বুড়ি গড়গড় করে বলে গেলো, “ওনার পুরো নাম শ্যামল ধর। এ পাড়ায় নতুন এসেছেন । প্রেসিডেন্সি কলেজের প্রাণীবিদ্যার প্রফেসর। বাড়ীতে স্টুডেন্টদের বায়োলজি পড়ান। ভুলোদা ওনার কাছে পড়ে।”
সব শুনে বড়মাসী বলে উঠলো, “শ্যামল! ও তো আমার ক্লাসে পড়তো। দাঁড়া আমি কথা বলে দেখি।”
তারপর আর কি, পরের মাসে বড়মাসী আর আমরা তিনজন, ভুলোদাদের সঙ্গে রওনা হলাম বাঘ দেখতে।
কোলকাতা থেকে নাগপুর অবধি ট্রেনে । তারপর পেঞ্চ অবধি গাড়ীতে। সারা রাস্তা আমরা এস ডি স্যারের কাছ থেকে বাঘের গল্প শুনতে শুনতে গেলাম।
“ভারতবর্ষে মোট পঞ্চাশটা ব্যাঘ্রপ্রকল্প আছে। তাতে সারা পৃথিবীর ৭০ শতাংশ বাঘ থাকে। ২০১৪ সালের বাঘসুমারিতে দ্যাখা গেছে এখন এদেশে বাঘের সংখ্যা বেড়ে হয়েছে ২২২৬।” বললেন এস ডি।
“আচ্ছা এই বাঘসুমারিতে যখন বাঘেদের গোনা হয় তখন একটা বাঘ থেকে আরেকটা বাঘকে আলাদা করে কি করে?” জিজ্ঞাসা করলেন বড়মাসী।
“প্রত্যেক বাঘের গায়ের ডোরার প্যাটার্ন আলাদা হয়। বাঘেদের ছবি তুলে এই প্যাটার্ন গুলো আইডেনটিফাই করা হয়। ছবি তোলার জন্য জঙ্গলের নানা জায়গায় ক্যামেরা লাগিয়ে দেওয়া হয়, আর ফরেস্ট গার্ডরাও ক্যামেরা নিয়ে জঙ্গলে ঘোরে।”
“বাপরে, এভাবে এক একটা বাঘ চেনা তো খুবই কঠিন ব্যাপার!”
“আর সুন্দরবনের কথাটা ভেবে দ্যাখো। দুই তৃতীয়াংশ বাংলাদেশে। বাঘেরা দুই দেশের মধ্যে ঘোরাফেরা করে।”
শুনে আমাদের মাথা ভোঁ ভোঁ করছে। ভাগ্যিস ট্রেনটা নাগপুর পৌঁছে গেলো।
স্টেশনে স্যারের বন্ধু গাড়ী পাঠিয়ে দিয়েছিল। ফরেস্ট বাংলোতে পৌঁছতে পৌঁছতে বিকাল হয়ে গেলো। ব্যবস্থা বেশ ভালোই। ইংরেজ আমলের বাংলোটাতে মোট তিনটে ঘর। দুটো থাকার আর একটা খাবার। রান্নাঘর বাড়ীর বাইরে। একটা ঘরে আমরা বড়মাসীর সাথে আর অন্য ঘরে এস ডি স্যার, ভুলোদা, সায়ন্তনদা আর রাজাদা।
কেয়ারটেকার মঙ্গেশভাউ বেশ মজার লোক আমাদের নানারকম জঙ্গলের গল্প বলল। একবার নাকি এক জঙ্গলের গার্ড সাইকেলে করে যাচ্ছিল। ওর সাইকেলে নানারকম লাল, নীল প্লাস্টিকের ফুলপাতা লাগানো ছিল। হঠাৎ ওর মনে হয় রাস্তার পাশের ঝোপটা যেন একটু নড়ছে। আড়চোখে চেয়ে দেখল একটা বাঘ। আর ব্যাস ভয়ের চোটে ও তো সাইকেল ফেলে লাগাল দৌড় ফরেস্ট অফিসের দিকে। ফরেস্ট অফিসার বন্দুক টন্দুক নিয়ে এসে দেখে সেই বাঘটা তখনও সাইকেলের চাকাটা ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে খেলছে।
মঙ্গেশভাউ আমাদের বাংলোর চারপাশটা ঘুরিয়ে দেখাল। বাংলোর দেয়ালটা অনেক জায়গাতেই ভাঙ্গা। এই ভাঙ্গা দেয়াল পেরিয়ে বাঘ আসে কিনা জিজ্ঞাসা করাতে ভাউ বলল আগে বাঘ, চিতা এসব এসে বাংলোর খোলা বারান্দায় শুয়ে থাকতো। এখন লায়লা ছাড়া থাকে কম্পাউন্ডে, তাই কেউ আসেনা।
লায়লা একটা পাহাড়ি কুকুর, ওর মাকে লেপার্ডে খেয়ে গিয়েছিল। মঙ্গেশ ভাউ ওকে জঙ্গলে খুঁজে পেয়ে এখানে নিয়ে আসে, দু বছর আগে। সেই থেকে ও এখানেই আছে। আগের মাসে লায়লার আবার তিনটে ছানা হয়েছে। তার দুটি ছেলে আর একটি মেয়ে। ছেলে দুটোর নাম সুরজ আর পবন। আর মেয়েটির নাম সিতারা। সিতারাকে একদম ওর মায়ের মত দেখতে। ভুলোদা পকেট থেকে বিস্কুট বার করে ওকে খেতে দিতেই ও ভুলোদার বন্ধু হয়ে গেলো। সবসময় ভুলোদার পিছন পিছন ঘুরতে লাগলো।
স্যারের বন্ধু অখিলেশ সামন্ত এলেন সন্ধ্যে নাগাদ। আমাদের সঙ্গে ডিনার করলেন। খাবার মেনু খুবই সাধারণ অড়হরের ডাল, লাউএর তরকারি আর রুটি। শেষপাতে পেয়ারা আর কলা। এখানে আমিষ খাওয়া মানা।
খাবার পর অনেক রাত অবধি গল্পও করলেন উনি।
“ইদানিং একটা নতুন ঝামেলা শুরু হয়েছে জঙ্গলে। পোচিং, মানে চোরা শিকারি। দুটো হরিণ মেরেছে। কিন্তু কাউকে এখনও ধরতে পারা যায় নি।” বললেন অখিলেশ।
“তোমাদের গার্ডরা কি প্রপারলি ট্রেনড ...... মানে ... ” এস ডি একটু ইতস্তত করলেন।
“আরে, গার্ডরা যতই ট্রেনড হোক, এলাকা প্রায় ১২০০ বর্গ কিলোমিটার, যার মধ্যে নদী আছে, লেক আছে, পাহাড় আছে । অত সোজা নয়। মুশকিল হচ্ছে হরিণ দুটোকে মারা হয়েছে কোর এরিয়ার খুব কাছে। এই জঙ্গলে প্রায় ৪৫ টা বড় বাঘ আর ৭-৮ টা বাচ্চা আছে। মনে হচ্ছে খুব শিগগির ওরা বাঘ মারার চেষ্টা করবে।”
“ তাহলে?”
“তাহলে আর কি আমরা চেষ্টা করে যাব, তারপর রাখে হরি তো মারে কে? “ বলে ম্লান হাসলেন অখিলেশ।
পরেরদিন সকালে আমাদের জঙ্গলে সাফারি করাতে নিয়ে যাবার জন্য এলো ফরেস্ট গার্ড নকুল রাউত আর তার সঙ্গে এলো দুটো হাতি। আমরা অবাক। নকুলজি আমাদের ওই হাতিদের সাথে পরিচয় করিয়ে দিলেন। ছেলে হাতিটির নাম মহারাজা আর মেয়েটির নাম মহারানী। এরা বনবিভাগের কর্মচারী। পোচারদের ধরার জন্য ফরেস্ট অফিসাররা এই হাতিতে চড়েই জঙ্গলে ঘুরে বেড়ায়। হাতিতে চড়ে জঙ্গলে যাবার সুবিধা হল এরা রাস্তার পরোয়া করে না, বনের সর্বত্র এদের গতি।
“এরা মাইনে পায়?” ভুলোদা জিজ্ঞাসা করলো।
“নিশ্চয়ই! রোজ সকালবিকাল দশকিলো আটার রুটি, পাঁচ কিলো করে গুড় এদের খেতে দেওয়া হয়। এছাড়া ওরা যখন রিটায়ার করে যাবে তখনও সকাল-বিকাল পাঁচ কিলো আটার রুটি আর আড়াই কিলো করে গুড় পাবে রোজ, যতদিন বাঁচবে। এটা ওদের পেনশন।” বললেন নকুল রাউত।
আমরা সবাই দুই দলে ভাগ হয়ে হাতিতে চড়ে জঙ্গলে রওনা হলাম। হাতি দুলকি চালে ঝোপ জঙ্গলের মধ্যে দিয়ে চলতে লাগলো। আমরা যে জায়গা দিয়ে ঘুরতে লাগলাম সেই জায়গাগুলো সাধারণ সাফারিতে দেখানো হয় না। চিতল হরিণ, সাম্বার, বুনো শুয়োর আর অনেক রকম পাখী দেখলাম আমরা। সবচেয়ে ভালো লাগলো একটা ময়ুরকে নাচতে দেখে। সত্যি অপূর্ব!
পথে একটা নদী পড়ল, প্রায় শুকনো। তার জলে দুজন মহিলা কাপড় কাচছিল।
রাউতজি হাঁক দিলেন, “কউন হ্যায়? ”
মহিলারা কোন উত্তর না দিয়ে কাপড় নিয়ে দৌড় দিলো।
“এই গ্রামের লোকদের নিয়ে খুব মুশকিল। জঙ্গলে এসে গাছ কাটে, গরু চরায়। সব ঘাস খারাপ হয়ে যায়।“
“গরু চরালে ঘাস কেন খারাপ হবে?” আমি জিজ্ঞাসা করলাম।
“গরু যখন ঘাস খায় তো শিকড়টা অবধি ছিঁড়ে নেয়। তাতে ঘাসটা মরে যায়। বনের জানোয়াররা যখন খায় তখন ওপর থেকে পাতাটা খেয়ে নেয় শিকড়টা রেখে দেয়, তাই ঘাসটা আবার গজায়।“ বললেন রাউতজি।
“আচ্ছা ময়ূররা কি মাটিতে ঘুমায়?” জিজ্ঞাসা করলো পর্ণা।
“কেন বলতো?” জিজ্ঞাসা করলেন রাউতজি।
তারপরই পর্ণার আঙুল অনুসরণ ওরে আমরা সবাই দেখলাম একটা ঝোপের তলায় প্রায় অদৃশ্য ভাবে একটা ময়ূর পড়ে আছে। রাউতজি সঙ্গে সঙ্গে নেমে গেলেন হাতির পিঠ থেকে। ঝোপের তলা থেকে টেনে বার করলেন মরা ময়ূরটাকে। পেটে গুলি লেগেছিল ময়ূরটার।
“পোচারদের কাজ। গুলি খেয়ে সঙ্গে সঙ্গে মরেনি ময়ূরটা, পালিয়ে এই ঝোপের তলায় লুকায়। তারপরে মারা যায়। তাই ওরা একে খুঁজে পায়নি।“
খুব আদর করে ওটাকে হাতিতে তুলে নিলেন রাউতজি। আমাদের সকলের মনখারাপ হয়ে গেলো।
“চেকপোস্ট চলো।” মাহুতকে বললেন রাউতজি।
হাতি ঘুরল চেকপোস্টের দিকে। ওখানে পৌঁছে ময়ুরের লাশটাকে ওখানকার গার্ডদের হাতে দিয়ে গেলেন ওয়্যারলেসে হেড অফিসে খবর দিতে। আর আমরা ওখানের টিউবওয়েলের জলে হাত মুখ ধুয়ে গেলাম রান্নাঘরে চা খেতে। ছোট্ট রান্নাঘর। তাতে একটা উনুন আর সামান্য কিছু বাসনপত্র। উনুন থেকে একটু দূরে দুটো বেঞ্চি পাতা। আমরা সবাই সেগুলোর ওপর বসলাম।
হঠাৎ ভুলোদা আর রাজাদা উনুনের পাশের একটা কিছু নড়তে দেখে ওখানকার গার্ডকে জিজ্ঞাসা করলো,” ওয়াঘমারেজি ...... উও ক্যা হ্যায়?”
ওদিকে দেখেই উনি চেঁচিয়ে উঠলেন, “হট যাও...... সাঁপ হ্যায়।”
বলার সঙ্গে সঙ্গে আমরা সবাই বেঞ্চির ওপরে। উনি উনুনের পিছন থেকে লেজ ধরে টেনে বার করলেন একটা প্রায় আট হাত লম্বা কেউটে সাপ। এক হাতে তার ল্যাজ আর অন্য হাতে তার মাথাটা ধরে তাকে ছেড়ে দিয়ে এলেন জঙ্গলে।
আমাদের দাঁতে দাঁত লেগে যাবার জোগাড়। আমাদের অবস্থা দেখে উনি হেসে বললেন, “জঙ্গলমে এটা রোজকার ব্যাপার। ওদের না ছেড়লে ওরা কিছু করে না।”
সেদিন রাতে আমরা জঙ্গলের ওয়াচ টাওয়ারে চড়ে বাঘ দেখব। রাউতজি আমাদের নির্দেশ দিলেন সেন্ট, পাউডার, গন্ধ সাবান কিচ্ছু ব্যবহার করা যাবে না ওইদিন। জন্তুরা যদি দূর থেকে গন্ধ পায় তাহলে আর জল খেতে আসবেনা।
আমরা মনে মনে খুব রোমাঞ্চিত। সন্ধ্যা সাতটায় গাড়ী এলো আমাদের নিতে। আমরা জলের বোতল, বাইনোকুলার সব নিয়ে পৌঁছলাম। ওয়াচ টাওয়ারটা সিমেন্টের তৈরি। প্রায় তিরিশ ফুট উঁচু। অনেকটা জলের ট্যাঙ্কের মত দেখতে। সরু একটা কলাম উঠে গেছে তার মাথায় গোল বসার জায়গা। দরজা খুলে আমরা কলামটার ভিতর ঢুকলাম । নিচে একটা ছোট টয়লেট, তার পাশ দিয়ে পেঁচান সিঁড়ি উঠে গেছে। সেই সিঁড়ি দিয়ে আমরা পৌঁছলাম আমাদের বসার জায়গায়।
রাউতজি বললেন, “খুব দরকার না হলে নিচের টয়লেট ব্যবহার করবেন না। বাঘকে কোন ভরসা নেই। আমি যাবার সময় দরজায় তালা দিয়ে যাব। আর আপনারাও ভিতর থেকে খিল বন্ধ করে নিন। পাশে ইলেকট্রিক ফেন্স আছে। আমি কারেন্ট চালু করে দিয়ে যাচ্ছি।”
ওয়াচ টাওয়ারের চারিদিকে জলের পরিখা। সারা বনের আর সব জলের জায়গাই মোটামুটি শুকিয়ে গেছে। আর তার ওপর পরিখার ধারে রাখা হয়েছে একটা নুনের বস্তা। এইটির লোভে জন্তুরা আসবেই।
আমরা নিঃশব্দে বসে আছি। ধীরে ধীরে অন্ধকার নেমে আসছে জঙ্গলে। আমরা সবাই মাঝে মঝে বাইনকুলার চোখে লাগিয়ে দেখছি নিচে জলের ধারে কোন প্রাণীকে দ্যাখা যায় কিনা। ভুলোদা শুধু, বাইনোকুলার নিয়ে নিচের দিকে না দেখে আকাশ, বাতাস, গাছ, পাখী এসব দেখছে। এই নিয়ে আমরা সবাই হাসাহাসি করছি। ভুলোদার বাঘ গাছ থেকে বেরোবে, কেউ বলল উড়ে আসবে।
রাত যখন প্রায় বারোটা, আমরা দেখলাম এক দল বাইসন জল খেতে এলো। তারপর হরিণ, সম্বর, শুয়োর কিন্তু বাঘের দ্যাখা নেই। শুনেছি এখানে পঞ্চাশের ওপর বাঘ আছে তাদের কি তেষ্টা পায় না?
হঠাৎ দেখলাম জল খেতে আসা হরিণগুলো দৌড়ে পালিয়ে গেলো। আমরা সবাই পিঠ সোজা করে বসলাম। দ্যাখা গেলো জলের কাছের ঝোপ থেকে বেরিয়ে এলো একটা বাঘ। অন্তত বারো ফুট। চাঁদের আলোয় খালি চোখেই বেশ পরিষ্কার দ্যাখা যাচ্ছে। আমরা এক মনে বাইনকুলার লাগিয়ে বাঘ দেখছি।
ভুলোদা বাইনকুলারটা নিয়ে কি যেন একটা দেখল। তারপর স্যারকে বাইনোকুলারটা ধরিয়ে দিয়েই দুদ্দাড় করে ছুটল সিঁড়ি দিয়ে নিচে। কয়েক সেকেন্ডের মধ্যে আমরা দেখলাম নিচের বাথরুমের আলোটা জ্বলে উঠলো। উফ! এখনি ভুলোদার বাথরুমে যাবার দরকার পড়ল। আলো দেখে বাঘটা নিশ্চয়ই পালিয়ে যাবে। খুব রাগ হচ্ছিল।
কিন্তু আমাদের সবাইকে হতবাক করে দিয়ে বাঘটা এক লাফে পরিখাটা পেরিয়ে চলে এলো ইলেকট্রিক ফেন্সের পাশে তারপর এক অনায়াস লাফে প্রায় পনেরো ফুট উঁচু ফেন্সটা পেরিয়ে ঢুকে এলো ভিতরে আর তারপর ছুটে গিয়ে বাথরুমের ঘুলঘুলির মত লোহার জানালাটায় মারলো এক থাবা। জানালাটা খেলনার মত ভেঙ্গে ভিতরে ঢুকে গেলো। এই পুরো ঘটনাটা ঘটতে লাগলো মাত্র তিরিশ সেকেন্ড। বাঘটা মিনিট দুয়েক জানালা দিয়ে মাথাটা ভিতরে ঢোকানোর চেষ্টা করলো, যখন পারলো না, তখন যেভাবে এসেছিল ঠিক সেভাবেই ফেরত চলে গেলো।
বাঘটা চলে যেতেই এস ডি স্যার আর তার পিছনে আমরা ছুটলাম নিচে। ভুলোদাকে পাওয়া গেলো সিঁড়ির সামনে অজ্ঞান অবস্থায়। জল ছিটিয়ে ভুলোদার জ্ঞান ফিরল বটে কিন্তু ভুলোদা কিছু বলতে পারলো না। আমরা সবাই সিঁড়ির ওপর বসে রাউতজির অপেক্ষা করতে লাগলাম।
সকাল সাতটা নাগাদ রাউতজি এলে আমরা ভুলদাকে নিয়ে গেলাম হাসপাতালে।
ডাক্তারবাবুর চিকিৎসায় খানিকটা সুস্থ হয়ে উঠলে ভুলোদাকে এস ডি স্যার জিজ্ঞাসা করলেন, “তুমি নিচে যেতে গেলে কেন?”
“আমি দেখলাম দূরে একটা গাছের ওপর দুটো লোক, তাদের হাতে বন্দুক। তারা বাঘটার দিকে বন্দুক তাক করছে। আমি ভেবেছিলাম আলো দেখলে লোকগুলো পালিয়ে যাবে। তাই......” দুর্বল ভাবে উত্তর দিলো ভুলোদা।
“এখন আপনারা পেশেন্টকে নিয়ে যেতে পারেন। কিন্তু কোন উত্তেজনা এখন একদম ঠিক নয়।“ বললেন ডাক্তার বাবু।
আমরা যখন হাসপাতাল থেকে বেরোচ্ছি তখন যে আদিবাসী ওয়ার্ড বয় ভুলোদাকে দেখাশোনা করছিল সে বড়মাসীকে ডেকে বলল,” আপ লোগ অউর ইধার মত রহো। চলে যাও। খতরা ......“
বড়মাসী ভীষণ ভয় পেয়ে, কাঁদো কাঁদো গলায় চেঁচিয়ে উঠলো,” ও শ্যামল! দ্যাখ এ কি সব বলছে।“
“ক্যা উলটা পুলটা বোল রহে হো?” এস ডি স্যার কিছু বলার আগেই অখিলেশ সামন্ত চেঁচিয়ে উঠলেন,উনি এই মাত্র হাসপাতালে এসে পৌঁছেছেন।
ওয়ার্ড বয়টা অখিলেশকে দেখে খুব ভয় পেয়ে গেলো, কিন্তু তবুও ধীরে ধীরে বলল,” উলটা পুলটা নহি সাব, খাতরা ... খাতরা......”
“চলতো, যত বাজে কথা।“ উনি আমাদের হাসপাতাল থেকে বের করে নিয়ে এলেন।
ভুলোদাকে নিয়ে আমরা বাংলোতে ফেরত এলাম । ভুলোদাকে দেখেই লায়লা ছুটে এলো। কিন্তু কি একটা কারণে একটু থমকে গেলো, তারপর লেজটা গুটিয়ে কুঁই কুঁই আওয়াজ করে ঘরের এককোণে সরে গেলো।
বেলার দিকে রাউতজি আরও কয়কজন আর গার্ডকে নিয়ে ভুলোদার সঙ্গে দ্যাখা করতে এলো। দরজা বন্ধ করে ভুলোদার সঙ্গে ওরা কি সব আলোচনা করলো। তারপর লায়লাকে নিয়ে ওরা জিপে করে চলে গেলো।
অখিলেশ সামন্ত আমাদের সঙ্গে বাংলোতেই রয়েছেন । আমাদের সঙ্গে লাঞ্চ করবেন। দুপুর একটা নাগাদ আমরা খেতে বসেছি । রাউতজিরা ফিরলেন। সঙ্গে দুজন লোক আর দুটো হরিণের চামড়া।
“ স্যার কাজ হয়ে গেছে।” রাউতজি একগাল হেসে অখিলেশ সামন্তকে বলল।
“ কোথায় পেলে?”
“ ভুলু সাহাবনে জাহাঁ বোলা থা ওখানে গিয়ে দেখি সত্যি গাছের ওপর মাচা বেঁধেছে। একজন গার্ডকে তুলে দিলাম ওপরে। মাচা থেকে ওদের কিছু জিনিষ, যেমন খাবার ঠোঙা, একটা কাপড়ের টুকরো নিয়ে নেমে এলো । তারপরের কাজটা লায়লা খুব সহজেই করে দিল। ওই পাহাড়ির উপরে একটা ছোট গুহাতে ওদের আস্তানা বানিয়েছিল। ওরা ভাবতেই পারেনি যে আমরা ওদের ধরে ফেলব।” হেসে উঠলো রাউতজি।
“ভেরি ওয়েল ডান। ওদের ওপর নজর রাখো। আমরা লাঞ্চের পর বেরবো।” বলে ভিতরে এলেন অখিলেশ।
“শ্যামল তোর ছাত্র তো দারুণ কাজ করেছে। এই লোকগুলোকে অনেকদিন ধরে আমরা খুঁজছিলাম। কিছুতেই ধরতে পারছিলাম না। তোরা কাল সকালে ট্রেন ধরবি তো? ঠিক আছে আজ রাতটা তোরা এখানেই থাক। কাল সকালে আমি গাড়ী পাঠিয়ে দেবো তোদের স্টেশন পৌঁছানোর জন্য। যাবার পথে ভুলোকে আর তোদের টি ভি আর খবরের কাগজের জন্য ইনটারভিউ দিতে হবে। আমি সব ব্যবস্থা করে রাখব। এখন লাঞ্চের পর আমাকে এই বদমায়েশ গুলোকে নিয়ে পুলিশে দিতে হবে। তাই আমি তোদের সঙ্গে সন্ধ্যেটা কাটাতে পারবো না। “
লাঞ্চের পর অখিলেশ আঙ্কল ওনার লোকজন আর ওই পোচার দুটোকে নিয়ে চলে গেলেন।
আমরা ভীষণ উত্তেজিত। ভুলোদাকে ঘিরে আমরা সবাই বসে গতকালকের ঘটনা আর আগামিকাল কি হবে সেই আলোচনায় মত্ত। খোলা দরজার সামনে মাটিতে লায়লা কুণ্ডলী পাকিয়ে শুয়ে আছে। ওর বাচ্চাগুলো আমাদের কোলে। সামনে খোলা বারান্দা দিয়ে ফুরফুর করে হওয়া আসছে। একটু আগে সূর্যাস্ত হয়েছে। এখনও আকাশটা লাল।
হঠাৎ লায়লা গরগর করতে করতে উঠে দাঁড়ালো। তারপর ভীষণ জোরে ডাকটা ডাকতে খোলা বারান্দা দিয়ে বেরিয়ে গেলো। আমরা সবাই অবাক। রাজাদা আর সায়ন্তনদা কি হয়েছে দেখার জন্য বাইরে গিয়েই “ বাবা গো বাআআঘ!!!” চেঁচাতে চেঁচাতে ছুটে ঘরে ঢুকে দড়াম করে দরজা বন্ধ করে দিল।
“কি যা তা বলছিস !” ধমকে উঠলেন এস ডি।
“ সত্যি স্যার! বাউন্ডারি ওয়ালের সামনে।” কাঁপতে কাঁপতে বলল ওরা ।
মিনিট পাঁচেক বাদে দরজায় দুম দুম আওয়াজ , কেউ ধাক্কা দিচ্ছে। আমরা কেউ খাট থেকে নামছি না।
“ আপ লগ সাব ঠিক হো? দরওয়াজা খোলো।“ মাঙ্গেশ ভাউয়ের গলা।
আমাদের ধড়ে প্রান এলো। এস ডি স্যার দরজা খুলে দিলেন। হুড়মুড় করে ঘরে ঢুকে এলো মাঙ্গেশ ভাউ।
“ শের আয়া থা। হামে বাচানেকে লিয়ে লায়লা মর গয়ী সাব......উও হামারে লিয়ে মর গয়ী সাব...” হাউ হাউ করে কেঁদে ফেলল মাঙ্গেশ ভাউ।
“তুম তো বলে ইধার শের নহি আতে?” জিজ্ঞাসা করলেন এস ডি।
“নহি আতে। লেকিন......” তারপর কাঁদতে কাঁদতে যা বলল মঙ্গেশ ভাউ তার মানে এই দাঁড়ায় - বাঘটা ভুলোদার খোঁজে এসেছিল। বাঘ একবার শিকারের গন্ধ শুঁকে নিলে সে তার পিছন পিছন আসে। লায়লা ওকে বাধা দিতে যাওয়ায় এক থাবা মেরে ওকে চুপ করিয়ে দিয়েছে বাঘটা।
আমরা বাইরে গিয়ে দেখলাম বাউন্ডারি ওয়ালের গায়ে পড়ে আছে লায়লার রক্তাক্ত মৃতদেহ। মঙ্গেশজি ওয়্যারলেস করে বাঘ আসার খবর জানাতেই পাঁচজন ফরেস্ট গার্ড বন্দুক নিয়ে আমাদের সুরক্ষার জন্য চলে এলো।
সেদিন সন্ধ্যায় মাটি খুঁড়ে লায়লাকে বাংলোর বাগানেই পুঁতে দেওয়া হল।
ভুলোদা একেবারে ভেঙ্গে পড়েছে। লায়লাকে সত্যিই খুব ভালোবেসে ফেলেছিল ভুলোদা। আমরা কি করে ভুলোদাকে সামলাবো বুঝতে পারছিলাম না। এমন সময় মঙ্গেশ ভাউ এসে লায়লার একটা বাচ্চা সিতারাকে ভুলোদার কোলে দিয়ে বলল,” ইসকো আপ লেকে যাও। পালো । লায়লাকি আত্মা কো শান্তি মিলেগি।“
ভুলোদা বাচ্ছাটিকে পরম আদরে বুকে টেনে নিলো।