Debdutta Banerjee

Others

3  

Debdutta Banerjee

Others

বেঁচে থাকার উৎসব

বেঁচে থাকার উৎসব

5 mins
9.7K


ঘুম ভাঙলো এক ঝলক মিষ্টি রোদ্দুরের ছোঁওয়ায়। বাঁশের চাটাইয়ের এক ধারে কেটে একটা আলো হাওয়া আসার ব‍্যবস্থা, সেখান দিয়ে আসা রোদ্দুরের ছোট টুকরোটা নিতার ঠিক মুখেই পড়েছে। তবে রোদের টুকরোটা মনটা ভাল করে দিল আজ।

অবশেষে প‍্যাঁচপ‍্যাঁচে বৃষ্টিটা থেমেছে। আকাশের যে টুকরোটা শুয়ে শুয়ে ও দেখতে পাচ্ছে তার রঙ নীল। একটা দুটো তুলোর মত সাদা টুকরো ভাসছে মাঝে মাঝে।

লাফ দিয়ে উঠে পড়ে নিতা। এ কয়দিন বৃষ্টিতে সব বন্ধ ছিল। আজ নিশ্চই কাজে বের হতে পারবে। ঘরের বাইরে এসে দেখে ভাইটা একটা ছেঁড়া ঘুড়ি নিয়ে খেলছে। মা ওধারের কলে জল ধরতে গেছে। বাবা কাজে বেরিয়ে গেছে।

নিতা মুখ ধুয়েই বেরিয়ে যায়। দেরি করলে আবার ভিড় হয়ে যাবে। রেললাইনের ধারে কলমি শাক আর ঢেকির শাক ভালোই হয়। বৃষ্টির জন‍্য এ কয়দিন বিক্রি করতে পারেনি।

আজ শাক বিক্রি করে বাড়ি ফেরার পথে রঙিন কাগজ আর কঞ্চি কিনে নিতে হবে। বৃষ্টি কমেছে যখন ঘুড়ি বানালে হয়তো বিক্রি হবে। ও পাড়ায় খোকাদার দোকানে ঘুড়ি দিতে পারলেই হাতে কটা টাকা আসবে।

নিতার মা শালু বাজারে ফুল বিক্রি করে। পূজা পার্বণ উপলক্ষ‍্যে ফল ফলাদিও তোলে। বাবা নিতাই জন খাটে, আবার এ সব পালা পার্বনের মধ‍্যে বেলুন, রঙিন বাঁশি, চরকি,আর কাগজের খেলনা ফেরি করে। উৎসবের মরশুমে ওরা দু'বেলা পেট পুরে খেতে পায়। বাকি দিনগুলো কপালে থাকলে ফ‍্যান ভাত আর কলমি সেদ্ধ।

কিন্তু উৎসব তো রোজ রোজ থাকেনা। তার ওপর আছে বর্ষা। তখন শালু ফুল বেচতে পারেনা। নিতাইয়ের কাজ বন্ধ থাকে। ঘরে জল ঢুকে যায়। আকাশের কান্না তবু থামেনা।

নিতার মা এই পাশের যে উঁচু উঁচু ফ্ল্যাটের একটাতে রান্নার কাজ করে। নটায় নিতা গিয়ে দোকান সামলায় আর মা কাজে যায়। নিতা দেখে তার মত ছোট মেয়েরা কি সুন্দর জামা জুতা পরে স্কুলে যায়!! ওদের ঘরে বোধহয় রোজ উৎসব। দুঃখ ঢুকতেই পারেনা।

নিতাও আগে স্কুলে যেত। পেট ভরে খেতে পেত স্কুলে। কিন্তু এখন ওরা আর ওকে খেতে দেয়না। বলে ও বড় হয়ে গেছে। নিতা এখন মা এর সাথে রোজগার করে।

উৎসবের আগে পরে ওদের ভালো কাটে। রঙ খেলার এক সপ্তাহ আগে থেকে ওরা রঙের ব‍্যবসা করে ফুটপাতে। রঙ্গিন কাগজের টুপি, বেলুন, রঙ সব বিক্রি করে। কিন্তু রঙ খেলার শেষে জীবনের রঙগুলো কেমন হারিয়ে যায়। রাস্তায় পড়ে থাকা রঙের ছিটে আর ফাটা বেলুনের মত সব জীবনের চাহিদা গুলো থেকে যায়, সব খুশি শেষ হয়ে যায়।

রথের মেলার আগে রাত জেগে মা মেয়ে মাটির পুতুল বানায়। কাগজের খেলনা আর মুখোশ বানায়। রথের দিন দুপুর থেকে ছোট ভাইটাকে নিয়ে মেলার মাঠে ঝুড়ি করে চিনি, কলা বিক্রি করে নিতা।নিতাই তখন বেলুন, মুখোশ, বাঁশি আর খেলনা ফেরি করে। শালু ফুল-ফল ছেড়ে সেদিন পথের ধারে পাঁপড় ভাজা বিক্রি করে। রথের মেলা চলে প্রায় দশ দিন। মেলা ভাঙ্গার পড়ে মাঠটায় ছেঁড়া কাগজ আর শুকিয়ে যাওয়া রথের চাকার দাগ মনে করায় কয়েকদিন তারা পেট ভরে খেয়েছিল।

আজকাল লোকে তেলেভাজা খেতে চায়না। বাচ্চারাও আর কাগজের খেলনায় খুশি হয়না। এ বয়সেই এসব জেনে গেছে নিতা।

ঘুড়ি বিক্রির দুশো টাকায় ভাইকে একটা ডোরেমন আঁকা গেঞ্জি কিনে দেবে ভেবেছিল নিতা। পাশের ঘরের বাকুর অমন গেঞ্জি আছে। ওর মায়ের কাজের বাড়ি থেকে দিয়েছে। ছোট ভাইটার খুব শখ অমন গেঞ্জির। কিন্তু বাবা বলেছে ঐ টাকায় অমন গেঞ্জি হবেনা।তার চেয়ে পূজার মাল তুলবে। দুর্গা পূজায় পাঁচ ছদিন ভাল ব‍্যবসা হয়।

রতন কাকা হাওয়াই মিঠাই বানায়। হাল্কা তুলোর মত গোলাপী হলুদ আর সাদা চিনির তুলো গুলো কেমন নরম স্বপ্নের মত। মা বলেছিল ঐ টাকার হাওয়াই মিঠাই বিক্রি করলে অনেক লাভ। অনেক দিন ওরা পেট ভরে খেতে পারবে। নতুন জামা কেনার মত বিলাসিতা ওদের সাজে না।

মা কাজের বাড়ি থেকে চেয়ে যে সব জামা আনে তাই দিয়ে ওদের হয়ে যায়। নিতা ভাবে ভাইকে বরং একটা হাওয়াই মিঠাই কিনে দেবে এবার।

উৎসব মানে ওদের কাছে বেঁচে থাকার লড়াই। একটু উপার্জনের চেষ্টা। এই আশাতেই সব পালা পার্বনের খবর রাখে ওরা। সেই উপলক্ষ‍্যে যদি কিছু রোজগার হয়। বড়দিনের আগে শালু মোমবাতি বানায়। মাটির জিশু বানায়। চার্চের ফুটপাতে মা মেয়ে পসরা নিয়ে বসে। আবার ঈদের আগে নিতাই ফেজ টুপি আর সেমুই নিয়ে ঘোরে মুসলিম পাড়াতে।

স্বাধীনতার উৎসবের আগে ওরা রাত জেগে সবুজ সাদা গেরুয়া কাগজ কেটে পতাকা বানায়। খোকাদা সব কিনে বেশি দামে বেচে। ঐ ফ্ল্যাটের ক‍্যাম্পাসের ছোট্ট শিশু উদ‍্যানে রঙ তুলি নিয়ে বাচ্চারা ছবি আঁকে। মাইকে ওদের নাম ডাকে। নিতার বানানো পতাকায় পথ ঘাট সেজে ওঠে। নেতারা আসে , ভাষন দেয়। নিতা হিসাব করে পতাকা বিক্রির টাকায় একমাস কি করে চালাবে!! একমাস পরে বিশ্বকর্মা পূজা। এই মাসটা বর্ষার মাস। বড্ড খারাপ সময়। নিতাইয়ের কাজ থাকে না বর্ষায়।

দুর্গা পুজোর আগে সাপের কামড় উপেক্ষা করে ভোর রাতে নিতাই যায় পদ্ম তুলতে নয়ান জুলিতে। কখনো পানি সিঙ্গারা পেয়ে যায় অনেক।ডোবাটায় আর নয়ানজুলিতে ভালোই পদ্মের কুড়ি ধরেছে। তবে পূজাটা এবার বড্ড আগে। ফুল ফুটবে বলে মনে হয় না।

নিতারা পলতে পাকায়, পুজার জন‍্য দূর্বা বেলপাতা জোগাড় করে, মালা গাঁথে। সন্ধ‍্যায় ওদের বয়সী বাচ্চারা যখন রঙ্গীন জামা জুতা পরে ঠাকুর দেখে ওরা হাওয়াই মিঠাই বিক্রি করে আর মনে মনে হিসাব করে কতটা চাল কিনলে পরের উৎসব আসা অবধি পেট ভরে খেতে পাবে।

দশমীর বিসর্জনের পরের দিন ভোর রাতে উঠে আবার নিতাই আর শালু ছোটে নদীর ধারে। মুর্তির নরম মাটি লুকিয়ে তুলে আনে যতটা পারে। প্রদীপ বানাতে বসে মা মেয়ে। এই প্রদীপ দীপাবলীর রাতে কত ঘরকে আলোকিত করবে।আর সেই আলোয় নিতারা পেট ভরে খাবে কয়েকদিন।

আজকাল নাকি সরকার থেকেও কত রকম উৎসব পালন হয়। মাঝে মাঝেই ওধারে বড় মাঠে গানের মেলা, আরো কি সব উৎসব হয়। নিতাই গেছিল বাদাম ভাজার ঝুরি নিয়ে। কিন্তু ঐ সব ক্লাবের দাদারা বলেছে ওখানে ব‍্যবসা করতে গেলে ওদের মোটা চাঁদা দিতে হবে। ফিরে এসেছিল নিতাই।

কত এনজিও পূজায় কাপড় দেয় কিন্তু ওরা পায় না। বস্তির তিনুদা বলেছে ওরা খেটে খায়। মা বাবা মেয়ে এমনকি আট বছরের ছেলেও রোজগার করে। এনজিও রা একদম গরীবদের দেয় সাহায‍্য। যারা অথর্ব, বেকার।

রাতে ফাটা দরমার ঘরে ফুটো হয়ে যাওয়া চালের নিচে শুয়ে নিতা স্বপ্ন দেখে সামনের উৎসবে তারাও নতুন জামা পরবে। সেজেগুজে ঠাকুর দেখবে। তেলেভাজা আর আইসক্রিম কিনে খাবে। ভাইএর গায়ে থাকবে ডোরেমন জামা। ও আরো খাটবে। আরো রোজগার করবে। একদিন ওরাও সবার মত করে উৎসব পালন করবে।এই খুশীর উৎসবের আশায় দুঃখের দিন গুলো পার হয়ে যায়।

-সমাপ্ত-


Rate this content
Log in