আসছে বছর ঠিক হবে
আসছে বছর ঠিক হবে
পায়ের পাতায় সুড়সুড়িটা অনেকক্ষণ থেকেই লাগছিল। পা নাড়িয়ে পা ছুঁড়েও কাজ হচ্ছেনা দেখে অগত্যা চোখটা মিলতেই হল নোনতাকে। আর চোখ মেলেই তো তার চক্ষু চড়কগাছ, স্বয়ং দুই মূর্তিমান বসে তার পায়ের কাছে- খটকাই আর পটকাই। দনাই গ্রামের দুই বিখ্যাত যমজ ছানা ভূত। অবশ্য এই দুই ভাইয়ের কথা নোনতা, বল্টু আর ফটকে কেউ জানে না। আসলে খটকাই পটকাই না চাইলে অন্য কেউ ওদের দেখতেও পায় না তো তাই। আজকে দুই ভাইয়ের মুখেই দুস্টুমির হাসি। ওদের দেখে ধড়ফড় করে উঠে বসল নোনতা, "খটকাই পটকাই তোরা এই সাত সকালে!"
"আর তুই এখনও ভোঁসভোঁস করে ঘুমোচ্ছিলি কি হিসেবে?" বলল খটকাই। নোনতা অবাক হয়ে বলল, "কেন? কটা বাজে?"
পটকাই উড়ে এসে নোনতার সামনে একটা পাক খেয়ে বলল, "কেন জিজ্ঞেস করছিস আবার! আজ না মহালয়া, খুঁটি পোঁতা দেখতে যাবি না?"
পটকাইয়ের কথা শুনে নোনতার ভেতর থেকে একটা দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে এলো। দুই ভাই তা দেখে অবাক হয়ে বলল, "কিরে এমন দুঃখী দুঃখী ভাব করছিস কেন? তোর কি মনে ছিল না?"
"না থাকলেই বোধহয় ভালো হত, এমন মন খারাপ হত না অন্তত।"
"কেন শুনি? কিসের মন খারাপ? খুঁটি পোঁতা দেখতে যাবি না? মেলায় কটা দোকান আসবে খোঁজ নিতে যাবি না নাকি?"
"মেলা হলে তো যাবো। তার আগে বল তোরা কি করে জানলি আজ মহালয়া?"
"ওই তো বুড়ো বটের ডাল ধরে ঝুলছিলাম আমরা, তখন দুটো লোক মাঠ দিয়ে যেতে যেতে বলাবলি করছিল যে আজ মহালয়া। সেই শুনে আমরা ছুট্টে তোর কাছে এলাম।" বলল পটকাই।
"কিন্তু মেলা হবেনা কেন? নাগরদোলা আসবে না এইবার?" বড় বড় চোখে জিজ্ঞেস করল খটকাই।
নোনতা বলল, "তোরা কি দেখিসনি মেলার মাঠ ফাঁকা?"
"আমরা তো ওদিকে যাইনি, আমরা ভাবলাম তোদের সঙ্গে নিয়ে তবে যাবো। কিন্তু হয়েছেটা কি?"
"করোনা।"
"করোনা? সেটা কি জিনিস?"
"একটা ভাইরাস।"
"ভাইরাস? সেটা আবার কি?"
"উফফ তোরা না কিচ্ছু জানিসনা। আচ্ছা ধরে নে সেটা একটা দুস্টু দানো।"
"সেকি! খুব বড় নাকি রে? ওই বুড়ো বটগাছের সমান হবে?"
"আরে না না একে তো চোখেই দেখা যায়না।"
"ও বাবা!" ঠোঁট উল্টে খটকাই বলল, "যাকে চোখে দেখা যায়না, তাকে নিয়ে এতো ভয়ের কি আছে!"
"আছে রে আছে। তাকে নিয়েই তো ভয়। এই দুস্টুটা জানিস তো চুপটি করে লোকের শরীরে ঢুকে শরীর খারাপ করে দেয়। আবার যার শরীরে ঢুকেছে তার শরীর থেকে আরও অন্য লোকের শরীরেও চলে যায়।"
"বলিস কি! সেতো ভয়ানক ব্যাপার। এমন করে তো সবার শরীর খারাপ হয়ে যাবে!"
"হ্যাঁ রে। ওই দানো এমনই ভয়ানক। আর তাই তো আমাদের ইস্কুল ছুটি দিয়ে দিয়েছে। সবাইকে বলছে ঘরের মধ্যে থাকতে।"
"কিন্তু রাস্তায় যে লোক দেখি?"
"ছোটো বাচ্চারা বেরোয়না কিন্তু বড়দের অনেক সময় দরকারে তো বেরোতেই হয়।"
"আচ্ছা এই দানোকে কেউ মারতে পারবে না?"
"সব দেশের বিজ্ঞানীরা এই দানোকে মারার কৌশল খুঁজছে রে কিন্তু এখন অবধি ঠিক কৌশলটা আবিষ্কার হয়নি যেটায় করে দানোটাকে পুরোপুরি মেরে ফেলা যায়।"
"তাহলে এখন দানোটাকে আটকানোর কোনো উপায় নেই?"
"উপায় আছে।"
"কিরকম?"
"এই যেমন ধর আমাদের সবাইকে বাড়িতে থাকতে হবে, অপ্রয়োজনে কারুর বাড়ি যাওয়া চলবেনা, দরকারে বেরোলেও মাস্ক পরতে হবে মুখে, সবসময় পরিষ্কার থাকতে হবে। ভালো করে হাত ধুতে হবে।"
"এতো খুব সহজ কাজ।"
"কিন্তু তাও তো অনেকেই কাজগুলো করছেনা। বাবা বলে সবাই যদি ঠিকঠাক করে এসব মেনে চলত তাহলে দানোটার এতো বাড় বাড়ত না।"
" তাহলে সবাই কেন এসব মেনে চলছে না?"
"জানিনা রে। গাঁয়ের খটরমটর জ্যেঠু আর পাঁচু দাদুকে চিনিস তো? ওরা বলেন আমাদের গাঁয়ে নাকি কিচ্ছু হবেনা। আর ওনারা বলেন বাতাসার সঙ্গে বিছুটিপাতা বেটে খেলে নাকি করোনা হবেনা।"
"তাই বুঝি?"
"ধুর ধুর বাবা বলে এসব বাজে কথা। কিছু দুস্টু লোক এসব গুজব ছড়াচ্ছে আর খটরমটর জ্যেঠুর মত কেউ কেউ সেই গুজবে বিশ্বাস করে কোনো নিয়ম মানছেন না। খটরমটর জ্যেঠু তো মাস্ক ছাড়াই এদিক সেদিক ঘুরে বেড়াচ্ছেন আর পাঁচু দাদু রোজ পাড়ার লোকের বাড়ি বাড়ি ঘুরছেন। বারণ করলেও ওরা শুনছেননা। আমার না খুব ভয় লাগছে জানিস।"
"আহা নোনতা ভয় পাচ্ছিস কেন?"
"পাবো না? এমন করে লোক যদি কোনো নিষেধ না মানে তাহলে তো করোনার আরও বেশটি করে জাঁকিয়ে বসবে। পরের বছরও রথ হবে কিনা…"
"না না এমন কথা বলিসনা নোনতা। আমাদের কিছু একটা করতেই হবে…"
★★★
রোজকার মত টাকে হাত বোলাতে বোলাতে খটরমটর কর্মকার বাজারে এসেই সবজি বাছতে লাগলেন। সবজি ওয়ালা বাধা দিতে যেতেই এমন এক ধমক দিলেন যে সে বেচারা আর কিছু বলার সাহস পেলোনা। দুই কেজি আলু নিয়ে পেছন ঘুরতেই খটরমটর বাবু দেখতে পেলেন জানাদের বাড়ির আলুকে। ছেলেটা এখন শহরের কলেজে পড়ে। আলুর মুখে মাস্ক, হাতে গ্লাভস। খটরমটর বাবু তা দেখে একটা অবজ্ঞার হাসি হেসে আলুর কাছে গিয়ে তার কাঁধ চাপড়ে বললেন, "শহরে গিয়ে একেবারে শহরের বাবু হয়ে গেছিস দেখছি, আরে বাছা আমাদের গাঁয়ে এসবের দরকার নেই।"
আলু মিনমিন করে বলল, "ওটা ভুল ধারণা জ্যেঠু।"
"চোপ, দুদিনের ছেলে আমাদের শেখাবি? এরকম কত্ত ভাইরাসকে দেখে নিলাম জীবনে, এ আর এমন কি? তা বলি বাছা তুই কি ভয় পাচ্ছিস নাকি আমার থেকে?"
"না জ্যেঠু মানে ভাইরাস কিন্তু আমার থেকেও আপনার ছড়াতে পারে।"
"যা যা আমার…"
কথাটা সম্পূর্ণ করার আগেই খটরমটর বাবুর মনে হল কি যেন একটা তাঁর মুখে চেপে বসেছে, কথা বলতে চেয়েও বলতে পারলেন না তিনি। আর এই সুযোগেই আলু ছুটে পালাল। মুখে কি চেপে বসেছে দেখার জন্য হাতটা ওপরে তুলেই আঁতকে উঠলেন খটরমটর বাবু। নাহ… এ অসম্ভব… তাঁর হাতে এখন অনাসায়ে হেঁটে বেড়াচ্ছে বেশ কয়েকটা অদ্ভুত দর্শন জিনিস, এদের ছবি তিনি খবরের কাগজে দেখেছেন। কিন্তু ওদের তো খালি চোখে দেখা যায়না, তাহলে? ওরা এতো ভয়ংকর! ভয়ে চিৎকার করতে গিয়েও চিৎকার করতে পারলেন না তিনি। আর তখনই কানের কাছে কে যেন ফিসফিস করে বলে উঠল, "চিৎকার করতে ইচ্ছে করছে তাই না?"
মাথাটা ওপর নীচে করলেন খটরমটর বাবু। তখন আবার সেই অদৃশ্য গলা বলে উঠল, "যদি রোগটা হয়ে যায় তখন চিৎকার করলেও কেউ বাঁচাতে পারবেনা। এই দুস্টু দানোগুলো কিন্তু গ্রাম শহর যে কোনো জায়গায় যেতে পারে।"
আবার মাথা নাড়ালেন খটরমটর বাবু।
"আপনি মাস্ক না পরে বেরোলে আপনারও ক্ষতি হবে আর অন্যদেরও।"
"উঁ উঁ উঁ" কিছু বলার চেষ্টা করলেন খটরমটর বাবু। অদৃশ্য কন্ঠ হেসে বলল, "এবার থেকে আর মাস্ক ছাড়া বেরোবেন?"
মাথাটা দুই দিকে নাড়ালেন তিনি। তারপর হাত পা নেড়ে মুখটা আলগা করার জন্য অনুরোধ করলেন। অদৃশ্য কন্ঠ বলল, "আপনি যদি নিজে মাস্ক না পারেন তাহলে কিন্তু…"
খটরমটর বাবু আচমকা অনুভব করতে পারলেন মুখের বাঁধনটা আলগা হয়ে গেছে হঠাৎ। তিনি আনন্দে চিৎকার করে বললেন, "আর হবেনা এরকম আমি এক্ষুণি যাচ্ছি মাস্ক পরতে।"
ওনার চিৎকারে বাজারের সব লোক আবার হয়ে তাকালেন তাঁর দিকে, কিন্তু সেদিকে ভ্রূক্ষেপ না করে খটরমটর বাবু ছুটলেন বাড়ির দিকে।
★★★
আজকে দশমী। যদিও আজকে লোক বাড়ির থেকে বেরোচ্ছে না, মেলা বসেনি কিন্তু পাঁচু ঘোষ ভাবলেন আজকের দিনে জিলিপি আর কষা মাংস না খেলে চলবেনা। নোনতার মা ভালো জিলিপি বানাতে পারেন, আর কষা মাংস রাঁধতেও তার জুড়ি মেলা ভার। অতএব আজ ওদের বাড়িতেই ঢুঁ মারা যাক। এই বুড়ো জ্যেঠশ্বশুরের অনুরোধ নিশ্চয় ফেলতে পারবে না নোনতার মা। দশমীর দিনেও আকাশ মেঘলা, তাই কালো ছাতাটা নিয়ে বের হলেন পাঁচু ঘোষ। বেশ খোশমেজাজেই হাঁটছিলেন তিনি কিন্তু আচমকা তাঁর ছাতাটা গেল পটাক করে খুলে। চমকে উঠলেন পাঁচু বাবু, হাওয়া নেই কিছু নেই অথচ এতো বড় ছাতা নিজে নিজে খুলে গেল! ভাবতে ভাবতেই ছাতাটা পাঁচু ঘোষকে টেনে একেবারে শূন্যে ভাসিয়ে দিল। আতঙ্কে চিৎকার করে উঠলেন পাঁচু ঘোষ। তিনি শুনেছেন কেউ মারা গেলে নাকি তার পা মাটিতে পড়ে না, তাহলে তিনি কি…! না না তা কি করে হয়, জিলিপি খাওয়া হল না যে!
"বাঁচাও বাঁচাও…" চিৎকার করে উঠলেন তিনি।
"চোপ।" কে যেন ধমকে উঠল সঙ্গে সঙ্গে কিন্তু কাউকে দেখতে পেলেন না পাঁচু ঘোষ। এবার তিনি ভয়ে ভয়ে বললেন, "ক্ক কে? আমার পা কেন মাটিতে পড়ছে না? আমি কি মারা গেছি?"
"এখনও নয়, তবে এমন করে কোনো নিয়ম না মানলে সেটা হওয়াও বিচিত্র কিছু নয়। নীচের দিকে তাকিয়ে দেখো।"
সেই অদৃশ্য কন্ঠস্বর শুনে নীচের দিকে তাকাতেই পাঁচু ঘোষের আত্মারাম খাঁচা ছাড়া হওয়ার জোগাড় হল। নীচের দিকে তাকাতেই দেখতে পেলেন কত্ত ভাইরাস রাস্তার রোল রোল খেলছে। ওদের তো খালি চোখে দেখা যায়না, পেপারে ছবি দেখেছিলেন বলে চিনতে পারলেন।
"ওরা এতো ভয়ানক! আমাদের গাঁয়ের রাস্তায়...!"
"হুমম ওরা খুব ভয়ানক, আর ওরা শহর গাঁ কিচ্ছু মানেনা, চারিদিকে ছড়িয়ে যেতে পারে যখন খুশি। তাই যে নিয়ম মানার কথা সে নিয়ম মানুন, না মানলেই…"
"না না না আর কিচ্ছু বলতে হবেনা। যা বোঝার বুঝে গেছি আমি। এবার আমি বাড়ি যাবো।"
"এমনি এমনি আর বাড়ির থেকে বেরোবে না তো?"
"না না।"
এই বলে মাটিতে পা পড়া মাত্রই পাঁচু ঘোষ পুলপুল করে ছুটে সোজা বাড়ির মধ্যে ঢুকে পড়লেন। মাটিতে ভাইরাস সেজে রোল রোল করা খটকাই আর তার বন্ধুরা এবার নিজেদের আসল চেহারায় ফিরে এলো, এদিকে পটকাইও পাঁচু ঘোষের ছাতা ছেড়ে এলো ওদের কাছে।
খটকাই বলল, "নোনতার কাছে ছবি দেখে কেমন ভাইরাসের ছদ্মবেশ নিয়েছিলাম বল?"
"আমিও কি কিছু কম ভালো অভিনয় করলাম নাকি! তখন মাস্ক আর এখন ছাতা। আশা করি ওনাদের শিক্ষা হয়ে গেছে।"
"তাই যেন হয়। নোনতা বলেছে সবাই নিয়ম মেনে চললে সব ঠিক হয়ে যাবে নিশ্চয়।"
"হ্যাঁ তাহলে আসছে বছর ঠিক হবে।"
"একদম একদম হতেই হবে…"
