মৃত্যুদূত

মৃত্যুদূত

19 mins
341


"না গো দাদা,গ্রামটার যেন কি একটা হয়েছে। যদিও বাইরে থাকি এখন একটু কাজে, তাও শুনেছি প্রতি অমাবস্যার আঁধার রাতে যখন বিশ্বচরাচর ডুবে যায় নিকষ অন্ধকারে,তখন এই গ্রামের রাস্তায় মধ্যরাত্রে কালো ঘোড়ায় করে আপাদমস্তক কালো কাপড়ে মুড়ে ঘুরে বেড়ায় মৃত্যুদূত। মুখ ঢাকা থাকে কালো ঘোমটায়। সাথে থাকে বিশাল কালো দুই হিংস্র ভয়াল কুকুর। গভীর রাতে সেই মৃত্যুদূতের সামনে এসে পড়লে তো মৃত্যু ঘটবেই,এমনকি কেউ যদি দূর থেকে মৃত্যুদূত বা তার কালো কুকুরদের দেখে ফেলে,তিনচার দিনের মধ্যে তার অপঘাতে মৃত্যু অনিবার্য।" এতটা বলে থামলেন মলয়দাদু।

হো হো করে হেসে উঠল তন্ময়দা। "দাদু ,তুমিও না ভালো গল্প ফাঁদতে পার। বিক্রম ভাটের নেক্সট রাজ সিরিজের গল্পের প্লট তোমাকেই লেখা উচিত। আর সত্যি কথা বলছি, আষাঢ়ে গল্প বলায় তোমার জুড়ি মেলা ভার। "মলয়দাদুর মুখমণ্ডল ম্লান হয়ে গেল। "না না,বিশ্বাস কর। ঘটনাটার শুরু হয় আগের বছর সেপ্টেম্বর মাসে। তারিখটাও ছিল,দাঁড়া মনে করতে দে, বয়স হয়ে যাবার সাথে সাথে স্মৃতিশক্তি দুর্বল হয়ে গিয়েছে তো। হ্যাঁ ,মনে পড়েছে,15 তারিখ। সেদিনও ছিল অমাবস্যা। গভীর রাতে টহল দিচ্ছিল পাহারাদার রতনলাল সিং। পরের দিন সকালে রহস্যজনক ভাবে গ্রামের রাস্তার ওপর তার মৃতদেহ পাওয়া যায়। মৃত্যুর কারণ ছিল সম্পূর্ণ রহস্যজনক। কারণ তার শরীরে রক্তের ছিঁটেফোটাও ছিল না। সারা শরীর ছিল বিবর্ণ,রক্তশূন্য। অথচ শরীরে কোনো ক্ষতচিহ্নও নজরে পড়ে নি। কেউ যেন শূন্য থেকে ওর শরীরের সমস্ত রক্ত শুষে নিয়েছে।"আমি মন্ত্রমুগ্ধ হয়ে মলয়দাদুর গল্প শুনছিলাম। এই সোনালী সকালেও দিনের আলোয় কেমন যেন ভয় ভয় করছিল! কিন্তু আশ্চর্য। তন্ময়দার মুখমণ্ডলে ভয়ের লেশমাত্র নেই।হাসি হাসি মুখে তন্ময়দা দাদুকে বলে উঠল,"বাহ। ভালো চলছে। ক্যারি অন।" সেই সোনালী সকালে বসন্তের দখিনা হাওয়ার মধ্যে আমরা দাদুর মুখে শুনতে লাগলাম এক অনুপম রোমহর্ষক গল্প। দাদুর জবানীতেই বলি।


এই গ্রামে ঢোকার মুখে এক বড়ো জলা পরে। স্থানীয় লোকে বলে সেটাকে বাওড়। দেওয়ালির দিন। শব্দবাজির আওয়াজ আর আলোর রোশনাইয়ে সারা গাঁয়ের ভোল পালটে গেছে। কিন্তু রাত দেড়টা বাজে। গভীর রাতে মেয়ের শ্বশুর বাড়ি থেকে ফিরছেন গাঁয়ের সম্ভ্রান্ত লোক নলিনী ঘোষ। বাওড়ের কাছাকাছি এসেই তিনি শুনতে পান ঘোড়ার খুরের শব্দ। ঘোড়া তো এদিকে খুব একটা আসে না। তারপরই তাঁর রক্ত জল হয়ে যায় কালো কুকুরের ভয়াল ডাক শুনে। তখনই তাঁর চোখে পড়ে আপাদমস্তক কালো পোষাক পরা মূর্তিটা। ঘন কুয়াশা ভেদ করে যেন তার দিকেই এগিয়ে আসছে। সাথে বিশাল দুই ভয়াল কুকুর,তাদের দু'জোড়া চোখ যেন আদিম হিংস্রতায় অগ্নিবর্ষণ করছে। ঘোড়াটাও বিশাল,আর মনে হল সেটি যেন মাটির ওপর দাঁড়িয়ে না থেকে বাতাসে ভাসছে।ভাসতে ভাসতে তাঁর দিকে ধীরে ধীরে এগিয়ে আসছে। চোখের সামনে এই বিভীষিকাকে দেখে কিছু মুহূর্তের জন্য হতচকিত হয়ে গেলেন নলিনীবাবু। আর তারপরই তার মনে পড়ল পুরো ঘটনাটা।

আজ একে অমাবস্যা ,তায় আবার শনিবার। কৈশোর থেকেই নলিনীবাবু ইংরেজি সাহিত্যের ভক্ত। তিনি অনেকবারই পড়েছেন,এরকম দুটো ভয়াল কালো হাউন্ড স্বয়ং শয়তানের অনুচর। এদের সামনে পড়লে তো মৃত্যু অনিবার্যই বা কেউ যদি এদের দেখে ফেলে,সেই দুর্ভাগারও দু চারদিনের মধ্যে মৃত্যু ঘটবে। কিন্তু এই লোকটা!লোকটার দিকে নলিনী বাবু টর্চ মারেন,টর্চের আলো লোকটাকে ভেদ করে বাইরে গিয়ে পড়ে। এইসময় লোকটার হাতের দিকে চোখ পড়ে নলিনীবাবুর,যে হাতে আঙুলের জায়গায় ক্ষুর। তবে কি সাক্ষাৎ শয়তান তাকে নরকে নিয়ে যেতে এসেছে। কোনোওমতে কাঁপতে কাঁপতে হরিনাম জপ করতে করতে বাড়ি ফিরে আসেন নলিনীবাবু। এই কথা তিনি তার কাছের মানুষদের জানান। দু কান থেকে কথা পাঁচ কান হয়,সারা গ্রামে শোরগোল পড়ে যায়। নলিনীবাবু সম্ভ্রান্ত লোক ,তায় শিক্ষক,তিনি তো মিথ্যা কথা বলার লোক নন।কিন্তু দু দিন পরেই সকালে নলিনীবাবুর মৃতদেহ পাওয়া যায় বাওড়ের জলে ভাসতে। কেন তিনি বাওড়ের কাছে গিয়েছিলেন, আর কি ভাবে তিনি জলে ডুবে মারা গেলেন,সে সম্পর্কে সবাই অন্ধকার। মৃত্যুর কারণ হিসাবে বলা হল যে,জলে ডুবে মৃত্যু হয়েছে।এবারও বলা বাহুল্য তার শরীর ছিল রক্তশূন্য।কেউ যেন শরীরের সমস্ত রক্ত শুষে নিয়েছে কোনো এক অদৃশ্য মন্ত্রবলে!


নলিনীবাবুর মৃত্যুর পরে শোরগোল পড়ে গেল সারা গ্রামে। লোকেরা অনেক আলোচনা করল,মৃত্যুর কারণ কি হতে পারে। কিন্তু কোনোভাবেই সুরাহা হল না। পরের দুমাস কিছুই ঘটল না। ঘটনাটা ভুলতে বসল সবাই। কিন্তু, ডিসেম্বরের অমাবস্যার রাতে ঘটল আবার অঘটন। এবার শিকার হলেন গ্রামের জমিদার হেমন্ত চৌধুরী। কিন্তু এবার ঘটনাটা ঘটল আগের বারের মতো আর গভীর রাতে রাস্তায় নয়,বরং জমিদার প্রাসাদের ছাদে। 


এককালে চৌধুরী বংশের রমরমা খুব ছিল। সারা গাঁয়ে তাদের নামে বাঘে গরুতে একঘাটে জল খেত। কিন্তু এখন আর আগের সোনার সময় নেই। নামেই তাঁরা জমিদার। বাড়িটার অবস্থাও তথৈবচ।কিন্তু , হেমন্ত চৌধুরীকে গাঁয়ের সবাই জমিদার বলেই মানে। সেইমতো খাতিরও করে। যাই হোক,সেদিনও অমাবস্যা,তায় আবার শনিবার। রাত তখনো গভীর হয় নি,ঘড়ি ঢং ঢং করে বেজে জানিয়ে দিল যে রাত এগারোটা বেজেছে। কিন্তু গ্রাম বাংলা তো! সারা গ্রাম নিঝুম হয়ে গেছে। আশেপাশে চাপ চাপ কুয়াশা। আকাশে তারারা আলোকপ্রদীপের মতো মৃদু উজ্জ্বলতা বিকিরণ করছে। কালপুরুষ যেন হাতছানি দিয়ে ডাকছে!চৌধুরীবাড়ি দু তলা আর তার উপর ধূ ধূ ছাদ। একপ্রান্তে একটি চিলেকোঠার ঘর বর্তমান।আজ রাতে চারদিকে কেমন যেন এক অদ্ভূত নিস্তব্ধতা,বিশ্বসংসার যেন কোনো এক অদৃশ্য শক্তির বশীভূত হয়ে সম্পূর্ণ নীরবতা পালন করছে। হেমন্ত চৌধুরীর ষষ্ঠেন্দ্রিয় সাড়া দিয়ে উঠল যে, আজ রাতেই খুব অঘটন কিছু একটা ঘটতে চলেছে,খুব অশুভ অনভিপ্রেত একটা কিছু একটা। হেমন্ত বাবুর গা ছমছম করে উঠল। এমন সময় যেন ছাদের এক প্রান্তে সম্পূর্ণ শূন্য থেকে এসে উপস্থিত হল সেই আপাদমস্তক কালো পোষাক পরা মূর্তি। সাথে সেই তুরীয় ঘোড়া এবং সেই বিশাল দুই ভয়াল হাউন্ড। মূর্তিটার সমস্ত শরীর যেন ধোঁয়াটে,কুয়াশা দিয়ে তৈরি। হাওয়ায় ভাসতে ভাসতে হেমন্তবাবুর দিকে এগিয়ে এল মূর্তিটা। না অবশেষে সম্বিৎ ফিরল হেমন্তবাবুর।দেড় মাস আগেই নলিনী বাবুর সাথে ঘটে যাওয়া ঘটনাটা পুরো মনে আছে তার। হুড়মুড় করে সিঁড়ি দিয়ে নেমে এলেন একতলায়।তারপর কুলদেবতা রাধাগোবিন্দের নাম করতে লাগলেন।

পরের দিন তিনি গল্পটা বললেন নায়েবকে, নায়েব বলল গোমস্তাকে, এইভাবেই সারা গ্রামে ছড়িয়ে পড়ল কথাটা। জমিদার হেমন্ত চৌধুরী রাতের বেলা জমিদারবাড়ির ছাদে নিজের চোখে স্বয়ং মৃত্যুদূতকে দেখেছেন। দেখেছেন তার দুই বিকট ভয়াল কুকুরকে। আগের বারের ঘটনা পুরো মনে ছিল গ্রামের মানুষের। রুদ্ধশ্বাসে সারা গাঁয়ের মানুষ প্রতীক্ষা করতে থাকল যে, কি ঘটে জমিদার হেমন্ত চৌধুরীর সাথে। আদৌ কি তাদের গাঁয়ে শনিবারের অমাবস্যায় আগত এই মৃত্যুদূতের কাহিনী সত্য, না কি নলিনীবাবুর চোখের দেখার ভুল হয়েছিল, আর তাঁর মৃত্যুর ব্যাপারটা নিছক কাকতালীয়।

ঘটনাটা ঘটল ঠিক তিন দিন পর।চৌধুরীবাড়িতে পাওয়া গেল জমিদার হেমন্ত চৌধুরীর মৃতদেহ। মাথা ফেটে রক্ত বেরোচ্ছে।অন্ধকার রাতে দোতলায় উঠতে বা দোতলা থেকে নামতে সিঁড়ি থেকে পড়ে মৃত্যু হয়েছে। সারা শরীর আশ্চর্যজনকভাবে রক্তশূন্য। দুচোখ যেন ঠেলে বেরিয়ে আসছে,চোখমুখে এক আতঙ্কের অভিব্যক্তি, যেন তিনি কোনো মূর্তিমান বিভীষিকাকে দেখেছেন। তার মৃত্যুর রহস্য কেন্দ্রীভূত হয়ে রয়েছে বিস্ফারিত হয়ে যাওয়া তার চোখের তারায়।

সারা গ্রামে ছড়িয়ে পড়ল ভয়। সারা গ্রাম কাঁপতে লাগল এক অজানা আতঙ্কে। দুটো মৃত্যু আলাদা রকম হলে কি হবে, একদিক থেকে দেখতে গেলে দুটোর মধ্যেই হুবহু মিল প্রতীত হবে। মৃত্যুর কয়েকদিন আগে সেই কালো কাপড় পরা মূর্তি, সেই ভয়াল দুই কুকুর, তারপর সেই বিভীষিকাকে দেখার তিন চারদিনের মধ্যে যে দেখেছে তার মৃত্যু, সেই বিস্ফারিত হয়ে যাওয়া চোখের তারা, সেই রক্তহীন বিবর্ণ দেহ। সব হুবহু মিলে যাচ্ছে। এমনকি যাদের মৃত্যু হবার কথা শুধু তারাই দেখতে পায় ঐ আপাদমস্তক কালো কাপড় পরা রহস্যময় মূর্তিকে , সেই আতঙ্ক যেন বন্দি হয়ে যায় তাদের চোখের তারায়, আর তারপর তিন চারদিনের মধ্যে ঘটে তাদের মৃত্যু। সত্যিই যেন এক অজানা বিভীষিকা গ্রামে পা দিয়েছে। আর যেদিন শনিবার আবার তায় অমাবস্যা থাকে , সেদিনই মৃত্যু তার শিকার খোঁজে। গ্রামের বয়স্ক মানুষরা আন্দাজ করলেন যে, তাদের গ্রাম গোবিন্দপুর কোনো এক অজানা অভিশাপের ফলে মৃত্যুর বেড়াজালে জড়িয়ে পড়েছে ওতপ্রোতভাবে।


এরপর ঘটনাটা ঘটল গৌতম রায়ের সাথে। গ্রামের ছেলে, ছোটবেলা থেকেই মেধাবী। বরাবরই স্কুলে ফার্স্ট হয়েছে।এখন নামী ইঞ্জিনিয়ার। নাসিকে চাকরি করে। কাজের ছুটি নিয়ে দেশের বাড়িতে ঘুরতে এসেছিল গৌতম।অনেকদিন পরে ছেলে বাড়ি আসায় যেমন খুশি বাবা মা, তেমন খুশি সবাই।


খানিকক্ষণের জন্য থামলেন মলয়দাদু। জল খেয়ে গলা ভিজিয়ে নিলেন। আর আমাদের দুজনের দিকে জল আর রসগোল্লার প্লেট এগিয়ে দিলেন।আমরা দুজনেই নির্নিমেষ চক্ষে অবাক হয়ে মলয়দাদুর মুখে মৃত্যুর বেড়াজালের গল্প শুনছি ।ও যা এতক্ষণ তো আসল গল্প বলাই হয় নি এবার বলি । 


তন্ময়দা,তন্ময় ব্যানার্জী আমার থেকে সাত বছরের বড়ো,আমার মাসতুতো দাদা। মাঝে মাঝে আমি বুড়োদা বলে ডাকি।এখন একদিকে পি এইচ ডি করছে জুলজিতে কোলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে,আরেকদিকে সিভিল সার্ভিসের জন্য খাটছে। প্রিলিমিনারি সবে হয়ে গেছে। আর তন্ময়দাও একঘেয়েমি থেকে রেহাই পেতে আমাকে নিয়ে ওর দাদুর বাড়ি গোবিন্দপুরে এসেছে। গোবিন্দপুর গ্রামটা আসানসোল থেকে পাঁচ মাইল দূরে, একপাশ দিয়ে বয়ে যাচ্ছে বরাকর নদী,আরেকপাশে বাওড়। বহু দূরে দিগচক্রবালে ঝাড়খণ্ডের ধূসর পর্বতশ্রেণী। গ্রামে যেমন বাঁশবাগান রয়েছে,যেমন রয়েছে ধানক্ষেত, তেমন রয়েছে উঁচু নিচু জমি,আর পোড়ো বাড়ি। কাছাকাছি কোলিয়ারি রয়েছে, বিকেলবেলা সেদিক থেকে ধূসর ধোঁয়া বেরিয়ে আকাশকে ধূলিধূসরিত করে।গ্রামটা বর্ধিষ্ণু।গ্রামে মোটামুটি শিক্ষিত উচ্চ মধ্যবিত্ত লোকের বাস। জাতীয় সড়কও খুব দূরে নয়। এই রকম এক সমৃদ্ধ গ্রামে এরকম বিভীষিকা ,এরকম একটা আতঙ্কের ছায়া। এরকম এক কুসংস্কার! জাস্ট অবাক করে।


তন্ময়দার দাদু মারা গেছেন। মলয়দাদু তন্ময়দার দাদুর বন্ধু হন। কর্মজীবনে দুজনে কোলকাতার একই অফিসে কাজ করতেন। সেখান থেকেই বন্ধুত্ব আর সেখান থেকেই আত্মীয়তা। এই গ্রাম মোটামুটি আমাদের আত্মীয় স্বজনে ভর্তি। যাই হোক,সময়টা মার্চ মাসের শুরুর দিক। এক সোনালী সকালে আমরা মলয়দাদুর বাড়ি এসেছি এই গ্রাম ও গ্রামের ইতিহাস নিয়ে জানতে।


যাই হোক,মলয়দাদুর কথায় ফিরে আসি। মলয়দাদু বললেন জানুয়ারী মাসের শেষের দিক। আর একতলায় গৌতমের শোবার ঘরটা একদম রাস্তার ধারে। গভীর গহন রাত। শনিবার, আবার এই রাত অমাবস্যার রাত। চারিদিক নিশুতি অন্ধকার।শোনা যাচ্ছে রাতজাগা এক অজানা পাখির একটানা ডাক। দূরেই কোথায় ডেকে উঠল একপাল শিয়াল।আগের মৃত্যুগুলো তো এইরকম রাতেই হয়েছিল, শনিবারের অমাবস্যা। আর আজকেও সেইরকম এক দিন। গ্রামের মানুষদের অস্থিমজ্জা থেকে এখনো কুসংস্কারের আঁধারকে মুছে ফেলা সম্ভব হয় নি,তা সে তারা যতোই শিক্ষিত হোক না কেন। তাই আজ অন্ধকার নামবার সাথে সাথে গোটা গ্রামের লোক নিজের বাড়ির দরজা জানালা বন্ধ করে দিয়েছে। বাইরে কেউ বেরোয় নি, আগের তিনটি মৃত্যুর ভয়াবহতা সবারই মনে আছে।গাঁয়ের মানুষ এতো সহজে দুর্ঘটনা ভোলে না। চারিদিকে এক অদ্ভূত সূচীভেদ্য নিস্তব্ধতা।

অনেকদিন পর গাঁয়ে এসে ঘুম আসছে না গৌতমের। বুঝতে পারছে না, মা তাকে কেন রাতে দরজা খুলে বাইরে বেরোতে বারণ করেছে। বাবা মা তাকে বারবার বারণ করে দিয়েছে যে, কেউ বাইরে থেকে চেনা গলায় নাম ধরে ডাকলেও না। এমনকি সে যেন জানালাও না খোলে। অনর্থ হতে পারে।

নিজের মনেই হাসি পেল গৌতমের। গ্রামের মানুষ এখনো নিশিতে বিশ্বাস করে,সত্যিই এদের নিয়ে আর পারা গেল না। বদ্ধ ঘরে কি যে গরম লাগছে, জানালা বন্ধ থাকায় বাইরে থেকে ভেসে আসা শীতল দখিনা বাতাসকেও উপভোগ করা যাচ্ছে না। তার মনে পড়ে গেল প্রেমিকা নিশার কথা।কতো সুন্দর,কতো মনোরম,কতো রোম্যান্টিক ছিল নিশার সাথে কাটানো প্রত্যেক রাত।

এইসময় সে শুনতে পেল জানালার বাইরে ঘোড়ার খুরের শব্দ।

জানলার পাশে ঘোড়ার খুরের শব্দ হতেই এক অদম্য কৌতুহল চেপে বসল গৌতমের মনে। এই গ্রামে ঘোড়ায় করে তো খুব একটা লোক আসে না, তাও আবার এই অমাবস্যার রাতে এখন প্রায় 12 টা বাজে। গহন নিস্তব্ধ রাত। ঘোড়ায় করে যে এসেছে, সে মনে হয় জানালার সামনেই দাঁড়িয়ে গেছে। খুব জোরে কেউ গভীর শ্বাস ফেলছে, সেটাও শুনতে পেল গৌতম। না, গভীর নিশির অন্ধকারে গাঁয়ের বুকে ঘোড়ার পিঠে বিচরণ করা মৃত্যুদূত সম্পর্কে কোনো সতর্কবার্তাই তার কানে প্রবেশ করেনি। আর ভয় কাকে বলে গৌতম তা জানে না। তার শরীরে টগবগ করে ফুটছে যৌবনের তাজা রক্ত। আর নিশার যৌবনের স্বাদ পাওয়ার পর সেটার উষ্ণতা আরোও বেড়ে গিয়েছে।


না,আর নিজের কৌতুহলকে দমন করতে পারল না  

 গৌতম,একটানে খুলে ফেলল জানালা, আর তখনই নিজের চোখে দেখতে পেল অমাবস্যা তিথির শনির নিশার বিভীষিকাকে। আপাদমস্তক কালো পোষাকে ঢেকে তার সামনে দাঁড়িয়ে আছে এক পৈশাচিক মূর্তি এই ব্রহ্মাণ্ডের সমস্ত ভয়াবহতা নিয়ে। তার কুহকের আবরণে ঢাকা মুখ কালো ঘোমটা দিয়ে আবৃত। তাতেও তার মুখমণ্ডলের যতোটা দৃশ্যমান ,তাতে মনে হয় এর মুখমণ্ডলে রক্ত মাংসের কোনো অস্তিত্ব নেই,শুধুই হাড়। দু চোখ দিয়ে যেন বহ্নিশিখা নির্গত হচ্ছে। এ যেন ইহজগতের কোনো ব্যক্তি নয়,সাক্ষাৎ রসাতল থেকে উঠে আসা শয়তান। আর তার সাথে ভয়াল ভয়ঙ্কর দুই বিদেশী কুকুর,যাদের চোখ বিশ্বের সমস্ত আদিম হিংস্রতা নিয়ে জ্বলছে। 


এতো ঠাণ্ডা লাগছে কেন,চারিপাশের তাপমাত্রা যেন এক লাফে মাইনাসে নেমে গিয়েছে। চারিদিক ভরে গিয়েছে এক মৃদু নীলাভ মায়াবী আলোয়। হাঁ করল কুকুরদুটি আর সেই অপার্থিব নীলাভ আলোয় গৌতমের চোখের তারায় ভেসে উঠল তাদের লালা ঝরা চোয়ালে বড়ো বড়ো বাঁকানো ধারালো দাঁত। ভয়ে বুক শুকিয়ে গেল গৌতমের। কোথায় গেল তার সেই দর্প, সেই অদম্য সাহস, এখন তার সামনে স্বয়ং বিভীষিকা এসে দাঁড়িয়েছে।

গৌতমের দিকে তাকিয়ে কিছু বলতে চাইল অশ্বারোহী মূর্তিটি। হাড়ের ঠোকাঠুকির শব্দ হল। আর থাকতে পারল না গৌতমের। সেখানেই জ্ঞান হারিয়ে লুটিয়ে পড়ল। 


পরের দিন অনেক দেরিতে ঘুম ভাঙল গৌতমের। আগের দিন রাতের ঘটনা দুঃস্বপ্ন বলেই মনে হল। উফ,কি ভয়ঙ্কর ছিল দুঃস্বপ্নটা। তার মতো একজন সাহসী যুবকের রক্ত জল করে দেওয়ার জন্য যথেষ্ট। কিন্তু, তার হাতে এটা কিসের দাগ।এ যেন evil eye,শয়তানের ভয়াবহ চোখের তারা। আর থাকতে পারল না গৌতম। তার মা রমাদেবীকে ঘটনা সব খুলে বলল। রমাদেবী আগে থেকেই অবগত ছিলেন মৃত্যুদূতের কাহিনী নিয়ে। কিন্তু কিছু বললেন না গৌতমকে, ফালতু ছেলেটা ভয় পাবে। আর মৃত্যুভয় যেকোনো মানুষকে ভীত করার জন্য যথেষ্ট। তার চেয়ে তিনি গৌতমকে কড়া নজরে রাখা শুরু করলেন। বাইরে তো বেরোতে দিতেনই না, ঘরেও সারাদিন নজরে রাখতেন। মহাদেবের পবিত্র রুদ্রাক্ষ পরিয়ে দিলেন গৌতমকে।   তিনি আন্দাজে বুঝতে পেরেছিলেন, শয়তানের নজর বা অভিশাপ কেটে যাবে তিন চারদিন পার হলেই। ততোদিন ভালোয় ভালোয় কাটাতে পারলে চিত্তির। এদিকে বাড়ির কাজের লোক মারফত আবার সব জানতে পারল গ্রামের লোকরা। আবার মৃত্যুদূত তার শিকার খুঁজে পেয়েছে।তটস্থ হয়ে থাকল গোটা গ্রাম। কি হয়, কি হয়।


তিন চারদিন কি এক সপ্তাহেও কিছু হল না। আনন্দে ফেটে পড়ল গ্রামের মানুষ। না, এবার শুভশক্তির জয় হয়েছে,মৃত্যুদূত ব্যর্থ হয়েছে।যথাসময়ে গৌতম ফিরে গেল নাসিক আর যোগ দিল নিজের কাজে। কিন্তু কে জানত, মৃত্যুদূত কখনো ব্যর্থ হয় না। কারণ মৃত্যু জীবনের অন্তিম পরিণতি ,এক অব্যর্থ সত্য। মৃত্যুদূতকে দেখা মাত্রই মৃত্যু বন্দি হয়ে গিয়েছে গৌতমের চোখের তারায়।  কিছুদিন পরেই রমাদেবী ও সুজয়বাবু(গৌতমের বাবা) নাসিক থেকে পেলেন দুঃসংবাদ। গলায় ফাঁস দিয়ে ফ্ল্যাটের মধ্যেই গৌতম আত্মহত্যা করেছে। গৌতমের এক বন্ধু ফোন করেছিল। তার কাছে তাঁরা শুনলেন এক রহস্য। গৌতমের প্রেম হয়েছিল নিশা আগরওয়াল নামের এক তরুণীর সাথে, অনেকদিন চলেছিল এই রিলেশনশিপ। খুব অন্তরঙ্গ ছিল ওরা এক অপরের। কিন্তু সম্প্রতি কোনো কারণে বিচ্ছেদ ঘটে নিশা আর গৌতমের । নিশা অন্য একটি ছেলের ঘনিষ্ট হয়। অতল ডিপ্রেশনে ডুবে যায় গৌতম,শুরু করে মদ খাওয়া। আর এই ডিপ্রেশনকেই গৌতমের আত্মহত্যার কারণ বলে মনে করছে পুলিশ এমনকি গৌতমের বন্ধুরাও। 


-----------------------------------------


থামলেন মলয়দাদু। টিনের কৌটো থেকে এক টিপ নস্যি নিলেন। এদিকে লাফিয়ে উঠল তন্ময়দা। বলল,"দেখলে তো,আমি আগেই বলেছিলাম এই মৃত্যুদূত গ্রামের মানুষের বদ্ধ ভয় আর কুসংস্কারের মিশ্রণ ছাড়া আর কিছুই নয়। আর গল্পে গরু তো গাছে উঠবেই। যত্ত সব আষাঢ়ে গল্প। আরে একটা ছেলে ব্রেক আপের ফলে ডিপ্রেশনে পড়েছে আর সুইসাইড করেছে।আর একটা বয়স্ক লোক সিঁড়ি দিয়ে পা পিছলে পড়ে মাথা ফেটে স্পট ডেড। আর একজন শিক্ষক সাঁতার জানে না, পা পিছলে বাওড়ের অতল জলে ডুবে শ্বাসরোধ হয়ে অকাল মৃত্যু, আরেকজন পাহারাদার যে মনের মধ্যে প্রচণ্ড ভয় নিয়ে অমাবস্যার রাতে গ্রাম পাহারা দিচ্ছে-দমবন্ধ করা ভয় আর টেনশন,সো কিছু একটা দেখে হার্টফেল হয়ে মারা গেছে। এতে অবাস্তব বা অলৌকিক ব্যাপারটা কোথায় আছে শুনি,হ্যাঁ!"খেঁখিয়ে উঠল তন্ময়দা। 

ধীর স্থির ভঙ্গিতে আরো একটিপ নস্যি নিলেন মলয়দাদু। বেলা বাড়ছে। গম্ভীর কিন্তু শান্ত গলায় তিনি বললেন,"আমি জানতাম,তোমরা শহুরে আধুনিক ছেলেরা এসব কথা বিশ্বাস করতে চাইবে না। এসব তোমাদের কাছে গাঁজাখুরে বা অর্বাচীন বলেই মনে হবে। কিন্তু কি জানো, এখনোও পৃথিবীতে এমন জিনিস ঘটে থাকে,যেগুলি যুক্তি তর্ক দিয়ে ঠিক বিচার করা যায় না,কিন্তু তাও সেগুলি ঘটে। যাই হোক,তোমার সাথে বেশি তর্কে যাব না। কিন্তু ,তাও একটা ব্যাপার বলে রাখি,নাসিকের ফ্ল্যাটে পাওয়া যাওয়া গৌতমের ডেডবডি ছিল পুরোপুরি রক্তশূন্য,তার চোখমুখে ছিল এক অজানা আতঙ্কের ছাপ আর তার চোখের তারা ছিল বিস্ফারিত।"

মলয়দাদুর কথা শুনে এই দিনের বেলাতেও শিউরে উঠলাম আমি। তন্ময়দার দিকে তাকালাম। চোখে মুখে ভয়ের লেশমাত্র নেই। স্থির হয়ে মলয়দাদুর দিকে নির্নিমেষ চক্ষে তাকিয়ে থাকল তন্ময়দা। সম্পূর্ণ নীরবতা। পিন পড়লেও শোনা যাবে।তারপর নিজের স্বভাবসিদ্ধ ব্যক্তিত্ব ও কন্ঠস্বরের দৃঢ়তা নিয়ে বলল,"আজ তো একটা বিশেষ দিন। একে শনিবার,তায় অমাবস্যা। প্রেতাত্মাদের কাছে সত্যিই একটা স্পেশাল দিন। আজ রাত জাগতেই হবে আমায়। রাতে মৃত্যুদূতের ইন্টারভিউ নিয়েই কাল তোমার বাড়ি আসব।চল অরিজিৎ।"

এই বলে আমায় নিয়ে হনহন করে বেরিয়ে এল তন্ময়দা।

---------------------------------------------------------------

বিকেল বেলা। পশ্চিম দিগন্তকে লাল রঙে রাঙিয়ে অস্তাচলে চলেছেন দিবাকর। বইছে মন ফুরফুর করে দেওয়া হাওয়া। সেই হাওয়া ধানক্ষেতের ওপর ঢেউ তুলে বয়ে যাচ্ছে। 'ধানের ওপর ঢেউ খেলে যায় বাতাস কাহার দেশে।'তন্ময়দার সাথে কথা হচ্ছিল গ্রামের পঞ্চাননতলায়। তন্ময়দা বলেছে আজ রাতে সে মৃত্যুদূতের সঙ্গে এখানেই মুখোমুখি হবে,যদি আদৌ মৃত্যুদূতের অস্তিত্ব থেকে থাকে তো। পড়ন্ত বিকেলে বাংলার গ্রামের সৌন্দর্য অপরূপ,মোহময়। একবার আসলে বারবার আসতে ইচ্ছা করে। একটা কথাই মনে হয়,পৃথিবীর বুকে যতদিন বেঁচে থাকবে সবুজ,ততদিন থাকবে অনাবিল আনন্দ আর মন উজাড় করা ভালোবাসা।

আমি বললাম,"দাদা তোমার সাহসের বলিহারি। কিন্তু ভয় করছে না ঐ মৃত্যু গুলির ইতিহাস শুনে। মৃত্যুগুলির কথা ভাবলে আমার তো এখনো ভয় করে। আর তুমি আজ মধ্যরাত্রে ঐ ভয়ঙ্কর বিভীষিকার সাথে দেখা করবে। ভয় করে না তোমার,যদি কিছু হয়ে যায়।"

তন্ময়দা বলল,"দুর পাগলা,কিসসু হবে না। বললাম তো মৃত্যুগুলি কিভাবে হয়েছে! একটার মধ্যেও অলৌকিকতা বা মৃত্যুদূতের কেরামতি নেই। আর শোন্ ,যদি মৃত্যুদূত সত্যিই থেকে থাকে,তাহলে ওকে দেখামাত্রই আমি আমার চোখের পাতা বন্ধ করে নেব। যাতে তার মৃত্যুর অভিশাপ আমার চোখের তারায় বন্দি না হয়ে যায়। "

তন্ময়দার দিকে তাকিয়ে থাকলাম আমি। তন্ময়দা বলে চলল,"শোন্ ভাই,মলয়দাদুর গল্প শুনে যা বুঝলাম, যতক্ষণ না মৃত্যুদূতের অভিশপ্ত প্রতিবিম্ব আমার চোখের তারায় বন্দি না হচ্ছে,ততক্ষণ মৃত্যুদূত আমার কিসসুটি করতে পারবে না। ও আমার ওপর লাফিয়ে পড়ুক বা কালো হিংস্র কুকুরদুটি ক্রুদ্ধ হয়ে গগনবিদারক গর্জন করতে করতে আমার ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ুক,আমার কিছুই হবে না,যতক্ষণ না আমি চোখ খুলে ওর দিকে তাকাই।"চুপ করল তন্ময়দা। আমি মনে মনে দাদার বুদ্ধি,বিচক্ষণতা আর সাহসের প্রশংসা না করে পারলাম না। দাদার জন্য প্রচণ্ড গর্ব হল।


পশ্চিম দিগন্তে সূর্য অস্ত গেছে।পৃথিবীর বুকে গোধূলির মায়াবী আলো। আমি তন্ময়দাকে জিজ্ঞাসা করলাম সেই প্রশ্ন ,যেটা এতক্ষণ ধরে আমার মনে খচখচ করছিল।"তুমি তো সম্পূর্ণ প্রস্তুত হয়ে রেডিয়ামের টর্চ নিয়ে পঞ্চাননতলায় মৃত্যুদূতের জন্য অপেক্ষা করলে,কিন্তু মৃত্যুদূত যদি তোমার সামনে এসে উপস্থিত না হয় তো! ধর আজকে ও বাওড়ের কাছে ঘুরে বেড়াল শিকারের খোঁজে। তাহলে তো ওর সাথে তোমার মুখোমুখি সাক্ষাৎ এর কোনো প্রশ্নই নেই।তাহলে কি হবে!"


আমাকে অভয় দিয়ে তন্ময়দা বলল,"তুই এখনো ব্যাপারটা বুঝলি না রে অরিজিৎ। গল্পটা ঠিক করে ভাব। দাদুর গল্পের সূত্র ধরেই বলি, মৃত্যুদূত অশরীরী। আগে থেকেই সে জেনে রাখে কোথায় গেলে সে তার শিকারকে পাবে। সে জানত যে,গৌতম তার সম্পর্কে জানে না। তাই সে গৌতমকেই টার্গেট করল। সে জানত সবাই বাড়িঘরের ঝাঁপ বন্ধ করে দেবে আর জমিদার হেমন্ত চৌধুরী ছাদে যাবে। তাই সে জমিদারবাড়ির ছাদে এসে উপস্থিত হল তার বাহন কালো ঘোড়াকে নিয়ে।এবার বুঝলি তো কেসটা! দাদুর গল্প যদি সত্যি হয় বা মৃত্যুদূত যদি থেকে থাকে ,তাহলে আমার সাথে ওর দেখা আজ রাতে হবেই। হ্যাঁ,এই পঞ্চাননতলাতেই হবে। আর গল্পটা ভুল হলে তো সোনায় সোহাগা আমার,যাই হোক আশা করছি আজ রাতেই আমি গ্রামের লোককে এই অভিশপ্ত মৃত্যুর বেড়াজাল থেকে মুক্তি দেব।কারণ বিদেশী গল্পে পড়েছি,যদি এইরকম মৃত্যুদূত সত্যিই থাকে আর একবার যদি সে ব্যর্থ হয়,তখন তার শক্তি নষ্ট হয়ে যেতে বাধ্য।"কথা বলতে বলতে লক্ষ্য করছিলাম তন্ময়দার মুখচোখে এক অপরূপ আত্মবিশ্বাস ফুটে উঠেছে। গলার স্বরই বদলে গিয়েছে। না,এবার দাদার অভীষ্ট সিদ্ধ হবেই।


সন্ধ্যার সাথে সাথেই লক্ষ্য করতে লাগলাম পরিবর্তন। এই সন্ধ্যাটা আর এই গ্রামে অপর পাঁচটা সাধারণ সন্ধ্যার মতো নয়,সেটা গোধূলির আলো ম্লান হয়ে আসার সঙ্গে সঙ্গেই প্রতীত হচ্ছিল। রাস্তাঘাটে লোকচলাচল আসতে আসতে কমে এল।দোকানপাটের ঝাঁপ পড়তে লাগল,বাড়িঘরের দরজা জানালা বন্ধ হয়ে গেল দুড়দাড় করে। সন্ধ্যা সাড়ে সাতটা বাজার সঙ্গে সঙ্গে সারা গাঁ নিস্তব্ধ,নিঝুম।শুধু ঝিঁঝির ডাক আর মাঝে মাঝে দূর থেকে শিয়ালের হুক্কাহুয়া। 


আমি এসে ঢুকলাম মলয়দাদুর বাড়ি আর তন্ময়দা জিন্সের প্যান্ট আর ব্র্যান্ডেড গেঞ্জি পরে হাতে রেডিয়াম টর্চ নিয়ে বেরিয়ে গেল পঞ্চাননতলার উদ্দেশ্যে। 


আমি আজ রাত মলয়দাদুর বাড়িতেই থাকব। কাল সকালে মিশন সেরে তন্ময়দা এসে উপস্থিত হবে। আর আমি ওর সাথে চলে যাব। তার আগে আজ রাতের খাবারের আগে মলয় দাদুর সাথে লুডো খেলার চ্যালেঞ্জ আছে।দাদা ব্যস্ত থাকবে ওর মিশনে আর আমি ব্যস্ত থাকব লুডো খেলায়। মৃত্যুদূতের সাধ্য কি যে আমাদের টেনশন দেয়।


মলয়দাদুর বাড়ি গিয়ে দেখলাম কাজের লোক গণেশদা আগেই রান্না বান্না সেরে বাড়ির উদ্দেশ্যে রওনা দিয়েছে। বুঝতে পারলাম মৃত্যুদূতের ভয়ে গ্রাম এখন কি রকম প্রভাবিত!তবে রান্নার আয়োজনের ত্রুটি রাখেন নি মলয়দাদু। আইটেম হয়েছে খিচুড়ি আর আলুর দম। শুনেই জিভে জল চলে এল। আর সত্যি কথা বলতে কি,গণেশদার রান্নার হাতও দারুণ।


মলয়দাদু সকালবেলা গল্প বলে ভয় পাইয়ে দিলে কি হবে,মানুষটা সত্যিই ভালো। সরল,বিনয়ী,কোনোরকম খারাপ ব্যবহার করতে দেখি না।এরকম মানুষ কি কখনো মিথ্যা ভয় দেখাতে পারেন!


খেলা চলতে চলতে দেখছিলাম দাদু অন্যমনস্ক হয়ে পড়ছেন,বারবার তাল কেটে যাচ্ছে।বুঝলাম খুব চিন্তিত হয়ে পড়েছেন। একসময় নিজের মনে বলেই উঠলেন,"বারবার যেতে না করলাম,তাও ছেলেটা গেল এই অশুভ রাতে। কিছুতেই শুনল না আমার বারণ।এখন যে কি হবে,আরে বাপ,সব ঘটনা যুক্তি তর্ক দিয়ে বিচার করা যায় না। এখনোও এমন অনেক ঘটনা ঘটে যা যুক্তি তর্কের বাইরে। মৃত্যুদূত সত্যিই আছে,আর ওর হাত থেকে বেঁচে আসা দুঃসাধ্য।"বুঝতে পারলাম,মলয়দাদু বিয়ে থা না করলেও তন্ময়দাকে নিজের নাতির মতোই ভালোবাসেন। আর দাদাকে শাসন করলেও সবসময় তার মঙ্গলের কথাই চিন্তা করেন। 


সামনে দেওয়ালে টাঙানো ছিল মা কালীর ফটো। হঠাৎই এক অবাক কাণ্ড করে বসলেন মলয়দাদু। শুনেছিলাম,মলয়দাদুরা বংশপরম্পরায় শাক্ত,মা শক্তি তথা মা কালীর ভক্ত।ভিতরের ঘর থেকে মলয়দাদু নিয়ে আনলেন একটা টকটকে লাল রক্তজবা। তারপর সেটা মায়ের ফটোর সামনে রেখে করতে থাকলেন আকুল প্রার্থনা। আমি অবাক হয়ে দেখতে লাগলাম।দু চোখ বেয়ে জল পড়তে লাগল তাঁর। গদগদ স্বরে বললেন,"মা,তুমি তো আমার কুলদেবী,এই জগতের আদিশক্তি। জন্ম থেকে তোমাকেই পূজা করি। জানই তো,ছেলেটা অবুঝ -অবোধ। মৃত্যুদূত সম্পর্কে বলতে গেলে কিছুই জানে না। ওকে রক্ষা কর মা। শয়তান যেন ওর কোনো ক্ষতি করতে না পারে। তেমন হলে আমার প্রাণের বিনিময়ে তুমি ওর প্রাণ বাঁচিয়ে দাও,কিন্তু শয়তান যেন ওর কোনো ক্ষতি না করতে পারে।"তাঁর দুচোখে বইতে লাগল জলের ধারা। আমারও চোখে চলে এল জল। সত্যিই ভালোবাসা এতো গাঢ় হতে পারে,প্রার্থনার ফলাফলের প্রসঙ্গে আসব না,কিন্তু নিজের প্রাণের বিনিময়ে আরেকজনের প্রাণের ভিক্ষা করা,কতোটা ভালোবাসা আর আবেগের তীব্রতা থাকলে এটা করা সম্ভব। সেদিন মন শ্রদ্ধায় অবনত হয়ে গেছিল এক গ্রাম্য বৃদ্ধের প্রতি। 


কিছুক্ষণ পরে মলয়দাদু আবার স্বাভাবিক হয়ে এসে বসলেন। খেলা আর জমল না। আমরা তাড়াতাড়ি খেয়েদেয়ে এসে শুয়ে পড়লাম। শোবার ঘরে দুটো খাট পাশাপাশি রাখা হয়েছে। একটা খাটে আমরা শোব,আরেকটার কারণ জিজ্ঞাসা করতে মলয়দাদু বললেন,"কিছু বাজে যদি ঘটে যায়। তন্ময় যদি রাতে ফিরে আসে,আর!কি ঘটবে কিছু কি বলা যায়!"কিন্তু আমি শিওর হয়ে আছি ,তন্ময়দা জয়ী হয়ে কাল সকালে আসবে।


রাত বাড়ছে,চারিদিক একেবারে নিস্তব্ধ। দূর থেকে ভেসে আসছে অজানা পাখির ডাক। আমরা দুজনেই জেগে আছি। মলয়দাদু চোখ বুজে কোনো এক দুর্বোধ্য মন্ত্র বিড়বিড় করছেন,আর আমারও টেনশন হচ্ছে। সত্যিই তন্ময়দা সাকসেসফুল হবে তো।


শুনতে পেলাম দূরে,বহুদূরে ঘোড়ার খুরের শব্দ। আমার মনে হল মনের ভুল। মলয়দাদুকে দেখলাম কপালে ভাঁজ পড়েছে। তারপর আবার নীরবতা।একের পর এক প্রহর অতিবাহিত হচ্ছে, কাছাকাছি ভয়াল স্বরে ডেকে উঠল একজোড়া কুকুর।কি হিংস্র গর্জন!এই গর্জন যেন উঠে আসছে নরকের কোনো অতল কোণ থেকে।মলয়দাদু ধড়মড় করে বিছানায় উঠে বসলেন। আমিও টেনশনে পড়ে গেলাম,তাহলে কি মৃত্যুদূত সত্যিই উপস্থিত।


কিছুক্ষণ পর বাইরে হাঁকডাক শুনতে পেলাম। গলা শুনে মনে হল তন্ময়দা। কিন্তু তন্ময়দাকে আমি চিনি।ও কি যুদ্ধ ছেড়ে পালিয়ে আসবে!ও কোনোদিনই রণে ক্ষান্ত দেওয়ার ছেলে নয়।তা ছাড়া মৃত্যুদূতকে হারানোর উপায় সে জানে।

আচ্ছা,এটা মৃত্যুদূত তন্ময়দার গলা নকল করছে না তো। হয়তো তন্ময়দাকে পরাজিত না করতে পেরে সে তন্ময়দা সেজে এসেছে আমাদের ভোলাতে। আজ যদি সে শিকার না পায় তাহলে তার শক্তি সম্পূর্ণ বিলুপ্ত হয়ে যাবে। তাই আজ এই অমাবস্যার রাতে এক তাজা প্রাণ তার যে খুব জরুরী!

আমার কথা মলয়দাদু শুনল না। আমাকে ঘরে থাকতে বলে তিনি দরজা খুললেন আর তন্ময়দা ভেতরে ঢুকল।

কিন্তু একি চেহারা হয়েছে তন্ময়দার। দেখেই বোঝা যাচ্ছে অনেকখানি পথ দৌড়াতে হয়েছে।হাঁফাচ্ছে আর দরদর করে ঘামছে। মাথার চুল উসকো খুশকো,চোখমুখে আতঙ্কের ছাপ স্পষ্ট।মলয়দাদু ভেতরে ঢুকলেন ঠাণ্ডা জল আনতে আর দাদার জন্য খিচুড়ি গরম করতে। আর তখনই তন্ময়দা ফিসফিস করে বলল,"জানিস অরিজিৎ,সে আছে।আজ দেখলাম তাকে।মৃত্যুদূত তো নয়,স্বয়ং মৃত্যু। তাকে দেখে ভুলেই গেলাম চোখ বন্ধ করার কথা। "তন্ময়দার চোখের নীল হয়ে যাওয়া মণির দিকে তাকিয়ে ছিলাম আমি। বেশ বুঝতে পারছিলাম,আমার আইডল দুঃসাহসী তন্ময়দা হেরে গেছে। মৃত্যু এসে প্রবেশ করেছে তার চোখের তারায়।


এইসময় ভেতর থেকে কলসীর ঠাণ্ডা জল নিয়ে আর একহাতে ঐ রক্তজবা নিয়ে ঢুকলেন মলয়দাদু। সেই রক্তজবা তন্ময়দার মাথায় ঠেকিয়ে বললেন ,"দেখলি তো আমার কথা সত্যি কিনা। কিন্তু,তোর কোনো ক্ষতি ও করতে পারবে না। মায়ের আশীর্বাদ আছে তোর ওপর। মা স্বয়ং তোকে রক্ষা করবেন।"এই বলেই তিনি দুহাত সেই উচ্চতর ঐশ্বরিক শক্তির উদ্দেশ্যে নমস্কার করার ভঙ্গিতে জোড় করে তা কপালে ঠেকালেন।


বাথরুম থেকে মুখে চোখে জল দিয়ে  ফ্রেশ হয়ে এসে  খেয়েদেয়ে শুয়ে পড়ল তন্ময়দা। ক্লান্ত ছিল প্রচণ্ড,তাই শুয়েই ঘুমিয়ে পড়ল। আমার বুক ঢিবঢিব করতে লাগল,চিন্তা হচ্ছিল তন্ময়দার জন্য।তাহলে কি এবার তন্ময়দার মৃত্যু হবে!

সেইরাতে আমার অনেক দেরিতে ঘুম এসেছিল। শুনতে পেলাম দুবার বাড়ির পাশ দিয়েই ঘোড়া চলে যাবার শব্দ। মলয়দাদুকে দেখতে পেলাম তখনো ঘুমোন নি। চিৎ হয়ে শুয়ে বুকের ওপর দুহাত জড়ো করে মা কালীর স্তোত্র জপ করছেন। একসময় আমার চোখও লেগে এল,তলিয়ে পড়লাম অতল ঘুমে। আর এভাবেই শেষ হল দুঃস্বপ্নের রাত।

-----------------------------------------------------------------


পরের দিন এক মন ভালো করা সোনালী সকালে একটু দেরিতেই ঘুম ভাঙল আমার। তন্ময়দা অনেক আগেই উঠে গিয়েছে। তন্ময়দাকে আজ একদম ফ্রেশ লাগছে,চোখের তারার নীলচে ভাবটাও চলে গিয়েছে দেখলাম,আজকের শরীরী ভাষার সাথে গত রাতের শরীরী ভাষার কোনো মিলই নেই। আবার আগের সেই হারানো সাহস আর আত্মবিশ্বাস ফিরে এসেছে। বুঝতেই পারলাম দাদার মনোবল এখন শিখরে।আগের রাতের কথাটা বলতেই সম্পূর্ণ এড়িয়ে গেল। "আরে ছাড় তো,তন্ময় ব্যানার্জী শরীরী অশরীরী কাউকে ভয় করে না। ঐ পঞ্চানন তলার সত্যতা যদি আগে থেকে জানতাম,তাহলে সাথে কার্বলিক অ্যাসিড না নিয়ে যেতাম না। বাবা,যা কালকেউটের উপদ্রব,সাক্ষাৎ যম।বুঝলি তো সাপটাকে দেখতে একটু দেরি হলেই রাতের অন্ধকারে আমায় উপরে পাঠিয়ে দিত একদম।" আমি বুঝতে পারলাম দাদা মিথ্যা কথা বলছে,কারণ আগের রাতে ওর আতঙ্কগ্রস্ত বিবর্ণ মুখ আমার পরিষ্কার মনে আছে। কিন্তু,মলয়দাদু কি আগের রাতে ঘুমোন নি,মুখমণ্ডল ম্লান,বিবর্ণ আর ওনাকে এত ক্লান্ত লাগছে কেন! যেন মনে হচ্ছে অসুখ করেছে!


সেদিনই গোবিন্দপুরকে বাই বাই করে কোলকাতায় ফিরে এলাম আমরা। তন্ময়দার এমন কি জরুরী কাজ পড়ে গেল সেটা একমাত্র তন্ময়দাই বলতে পারে।


তন্ময়দাকে নিয়ে যথেষ্ট ভয় পাচ্ছিলাম। তাই কোলকাতায় ফিরে কড়া নজর রাখলাম ওর প্রতি। আমাদের বাড়ির দূরত্ব খুব একটা বেশি নয়,পাশাপাশি পাড়ায়। রোজ বিকেলে ঘুরতে যেতাম ওর বাড়ি। তন্ময়দাও দেখলাম আগের চেয়ে বেশি এনার্জেটিক,বেশি ধীরস্থির আর বেশি সাহসী হয়ে গিয়েছে।

তিন চার দিন কি,এক মাসেও কিছু হল না। আমারই কেমন সন্দেহ হল। কিন্তু,তন্ময়দার ব্যক্তিত্বেও ঘটেছে এক আমূল পরিবর্তন। যে মানুষটা ঘোর নাস্তিক ছিল,সকাল বিকেলে ঠাকুর-দেবতা আর ধর্মের লৌকিকতা সম্পর্কে গালাগাল না করলে যার ঘুম আসত না,সে হঠাৎই যেন পরম ধার্মিক হয়ে উঠেছে। সপ্তাহে অন্তত একবার দক্ষিণেশ্বরে মায়ের মন্দিরে গিয়ে পুজো দিয়ে আসে। মাসীমা(তন্ময়দার মা) র কাছে এই খবরটা শুনে ঘোর আশ্চর্য হলাম।

ব্যাপারটা বুঝতে পারলাম আর দুদিন পর। যখন ফোনে শুনতে পেলাম তন্ময়দার কান্নায় ভেঙে পড়া গলা। হ্যাঁ,কোনোভাবে খবরটা জানতে তন্ময়দারই বিলম্ব হয়েছে। আমরা গোবিন্দপুর থেকে আসার দু সপ্তাহ পরে আশ্চর্যজনক ভাবে মারা যান মলয়দাদু। মৃত্যুর সময় তাঁর সারা দেহ ছিল কোনো এক অজ্ঞাত কারণে রক্তশূন্য ,কিন্তু চোখমুখে ছিল এক অনাবিল প্রশান্তি।


আমার চিন্তাভাবনার   সামনে এতক্ষণ যে মেঘ জমে ছিল,এই মুহূর্তে তা পরিষ্কার হয়ে গেল । হ্যাঁ,সেই রাতে তন্ময়দা পঞ্চানন তলায় সত্যিই দেখেছিল মৃত্যুদূতকে,আর মৃত্যু অনিবার্য ছিল তার। কিন্তু,তন্ময়দাকে বাঁচিয়ে দিল মলয়দাদুর আকুল প্রার্থনা ও অকুন্ঠ ভালোবাসা। মলয়দাদু নিজের প্রাণের আহুতি দিয়ে তন্ময়দাকে রক্ষা করলেন তার অনিবার্য করুণ পরিণতির হাত থেকে। সেই দুঃস্বপ্নের রাতের কথা মনে পড়ল। মায়ের সামনে করা তাঁর আকুল প্রার্থনা,"আমার প্রাণের বিনিময়ে তুমি ওর প্রাণ বাঁচিয়ে দাও।"আর তন্ময়দার প্রাণ বাঁচাবার লক্ষ্য সফল হয়েছে তাঁর,তাই তো তাঁর চোখমুখে বিরাজ করছে আজ অনাবিল প্রশান্তি।

কোথায় যেন আরব্য রজনীতে পড়েছিলাম যে,সত্যিকারের ভালোবাসা মৃত মানুষকেও পুনর্জীবিত করতে পারে। আর আজ মলয়দাদুর নিঃস্বার্থ ভালোবাসা বাঁচিয়ে দিল তন্ময়দার জীবন। ভালোবাসার এতোটাই শক্তি!


Rate this content
Log in

Similar english story from Fantasy