তিতলি ইমলি ও ডলফিন
তিতলি ইমলি ও ডলফিন
ছোট্ট তিতলির পড়াশোনা করতে একটুও ভালো লাগে না। অথচ বাবা মা খালি পড়তে বলে। তিতলি এবার কেজি থেকে ওয়ানে উঠেছে। কিন্তু স্কুলে ওর ভালো বন্ধু নেই কেউ। ওর বেঞ্চে ওর পাশে বসে রাই, শুধু পড়ে। একটুও গল্প করে না। তিতলির ছবি আঁকতে ভালো লাগে, নাচ করতে ভালো লাগে, খেলতে ভালো লাগে কিন্তু পড়তে একটুও ভালো লাগে না। স্কুল যেতেও ভালো লাগে না। এই ওয়ানের মিসটা বড্ড পচা। কি কঠিন কঠিন বানান শেখায়, আবার নামতা পড়ায়। ছড়া বলে না, গান গায় না, গল্প করে না। একদম খেলতে দেয় না। বাবাকে বললে বাবা বলে ও নাকি বড় হচ্ছে। তাই এসব পড়তেই হবে। মা তো মিসের থেকেও পচা। হাতের লেখা লেখায় কেমন পেঁচিয়ে পেঁচিয়ে। তিতলির ছোট্ট আঙ্গুল গুলো কি অত চাপ নিতে পারে? ব্যথা তো হবেই। অমনি মা বলবে পেট ভরে না খেলেই ব্যথা হবে। জোর করে দুধ খাওয়ায় মা।
তিতলির একমাত্র বন্ধু এই পুপসি পুতুলটা। তিতলি ওর নাম রেখেছে ইমলি। রোজ দুপুরে ও ওর দুঃখের গল্প ইমলিকে বলে। ইমলি ওর গলা জড়িয়ে শুয়ে শুয়ে সব শোনে। একেক সময় মনে হয় ইমলি যদি কথা বলতে পারত কি ভালো হতো!
সেদিন মা আর বাবা ওকে রেখা দিদির কাছে রেখে অফিসের পার্টিতে চলে গেল। বলল রাত হবে ফিরতে,ও যেন লক্ষ্মী মেয়ে হয়ে খেয়ে ঘুমিয়ে যায়। ভোরে উঠে স্কুল যেতে হবে আবার। খুব রাগ হয়েছিল তিতলির। নিজেরা পার্টিতে কত কি খাবে,ওর জন্য শুধু ডাল আর চিকেন স্টু!! একটু আইসক্রিমও নেই ফ্রিজে!! একটা পেষ্ট্রিও রাখেনি কেউ ওর জন্য।
রেখা দিদি ওকে খেতে দিয়ে যখন টিভিতে সিরিয়াল দেখছিল ও ডাল আর ভাতটা কমোডে ফেলে দিয়েছিল চুপিচুপি। শুধু চিকেনের পিসটা খেয়েই শুয়ে পড়েছিল। ইমলিকে মনের দুঃখের কথা বলতে বলতে দু চোখে নেমেছিল বন্যা।
হঠাৎ দুটো ছোটছোট নরম হাত ওর চোখের জল মুছিয়ে দিয়ে ওকে আদর করতে শুরু করেছিল। তিতলি প্রথমে অবাক হলেও যখন দেখল ইমলি হাত পা নেড়ে ওকে আদর করছে ওর ভারি মজা হল। কচি গলায় ইমলি ওকে বলল,
-''সত্যি ভারি অন্যায় করে সবাই তোমার সাথে। তুমি চল আমার সাথে আমার দেশে।ওখানে পড়াশোনা নেই, শুধুই খেলা। আর কত খাবার, যা চাইবে তাই পাবে।''
উত্তেজনায় উঠে বসেছিল তিতলি। প্রথমে তো বিশ্বাস হচ্ছিল না যে ইমলি কথা বলছে। তারপর ইমলিকে চোখ পিটপিট করতে দেখে এক পাক নেচে নিলো ও। দু হাতে ইমলির গলা জড়িয়ে বলল,
-"কোথায় তোমার দেশ ?''
-''সে এক খুব সুন্দর জায়গা, ওখানে রামধনু রঙের আকাশ, নদীর জল সরবতের মতো, পাহাড় গুলো আইসক্রিমের, নুড়ি পাথর সব ক্যান্ডি চকলেট, গাছে গাছে কত বিদেশী চকলেট আর কেক পেস্ট্রি। ওখানে কেউ পড়ে না, শুধুই খেলা।''
-''আমি যেতে চাই। নিয়ে যাবে আমায়?'' তিতলি তো নতুন দেশ দেখার জন্য উদগ্ৰীব।
ওর খেলনা ঘরের দরজা খুলে ঠিক ডোরেমনের মত ও ইমলির সাথে চলল নতুন দেশে। দেশ দেখে তিতলি খুব খুশি। প্রথমেই ও গোলাপি রঙের ট্রবেরি পাহাড়টা খেয়ে দেখল। কি মিষ্টি!! ঝর্নার জল তো মাজার মত। সত্যি সত্যি গাছে গাছে কত চকলেট। পেট ভরে খেয়ে তিতলি খেলতে গেলো একটা সুন্দর পার্কে। কত পুতুল খেলছে পার্কে । ছোট্ট টাট্টু ঘোড়া, সাদা নরম লোমের কুকুর ছানা, বাদামি টেডিবিয়ার সবাই আছে। ফুলের দোলনায় বসে দোল খেতে খেতে তিতলি বাড়ির কথা ভুলেই গেছিল। রামধনু রঙের আকাশে নাম না জানা রঙিন পাখির ঝাঁক আর প্রজাপতি দেখে তিতলি খুব খুশি। লিমকার পুকুরে রঙ্গিন মাছের ঝাঁক খেলে বেড়াচ্ছে। খেলতে খেলতে এক সময় তিতলির ঘুম পায়। কিন্তু এ দেশে সব সময় আলো। আর বাড়ি বা বিছানাও নেই। তবুও ক্লান্ত তিতলি একসময় ঘুমিয়ে পড়ে নরম ঘাসের ওপর।
ঘুম থেকে উঠে ওর খুব খিদে পেয়েছিল। দুটো চকলেট খেয়ে গাটা গুলিয়ে উঠল। চারদিকে মিষ্টি খাবার। নোনতা কিছুই নেই। যাই হোক ও ইমলিকে বলল,
-''কটা বাজে এখন?''
ইমলি গালে হাত দিয়ে বলল,
-''এখানে তো কেউ পড়াশোনা করে না। স্কুল যায় না।ঘড়ি দেখতেও জানে না। ঘড়িও নেই এ দেশে।''
তিতলির তাতে বয়ে গেছে, ও খেলতে গেলো সবার সাথে। একটা সাদা কালো বেড়াল ছানাকে ঘিরে একটু জটলা দেখে তিতলি এগিয়ে গেলো। গিয়ে দেখে বেড়াল ছানার পা ভেঙ্গে গেছে। খুব ব্যথায় কষ্ট পাচ্ছে। তাই দেখে তিতলি বলল,
-''ওকে ডাক্তারের কাছে নিয়ে যাই চলো।"
-''এ দেশে তো কেউ পড়াশোনা করে না তাই ডাক্তার নেই।'' বলল আরেকটা পুতুল।
তিতলি এমন আজব কথা কখনো শোনে নি। ও বলল -''তাহলে বিড়াল ছানা ঠিক হবে কি করে?''
-''ও এমনি থাকবে। কষ্ট পাবে। কিছুই করার নেই আমাদের।'' সবাই বলে উঠল।
-"তোমাদের শরীর খারাপ হলে কি করো?''
-''কিছুই করি না । কষ্ট পাই সবাই।''
এবার তিতলির একটু ভয় লাগছিল। এ কেমন দেশ?!! এখানে সুয্যি মামা নেই, চাঁদ মামা নেই, ঘড়িও নেই, ডাক্তার নেই, নোনতা কোনো খাবার নেই!! দিন রাত্রির হিসাব নেই। খেলতে খেলতে হাঁফিয়ে গেলে ঘুম আর ঘুম থেকে উঠেই খেলা। খিদে পেলে চকলেট আর কেক পেস্ট্রি খাও যত খুশি। কিন্তু মন যে মানে না। খেলতে খেলতে হাফিয়ে ওঠে ছোট্ট তিতলি। মিষ্টি খেয়ে মুখ নষ্ট হয়ে গেছে ওর।
ছোট্ট বার্বি পুতুল যখন মা বার্বির আদর খায় তিতলির খুব বাড়ির কথা মনে পড়ে। কে জানে কতদিন ও বাড়ি যায় না!! এখানে সময় থমকে গেছে। দিনের হিসেব নেই। মা বাবা হয়তো ওকেও খুঁজছে!! কতদিন বাবা ওকে গল্প বলে না, মা খাইয়ে দেয় না। মা বাবার গায়ের গন্ধ পায় না ও। চারদিকে তাকিয়ে ও ইমলিকে খুঁজে পায় না। খুঁজতে খুঁজতে ও ঝর্ণা পার হয়ে জঙ্গলের কাছে আসে তিতলি। সাদা হাতির ছানাকে ও জিজ্ঞেস করে ইমলির কথা। হাতির ছানা বলে একটু এগিয়ে যেতে ওধারে। কিছুদূর গিয়ে ও হলুদ শেয়ালকে আবার জিজ্ঞেস করে ইমলির কথা। সে বলে আরো এগিয়ে যেতে। গহীন বনের মাঝে দেখা হয় কালো ভাল্লুকের সাথে। সে ইমলির কথা শুনে বলে,
-''একটা পুতুলকে দেখেছিলাম ওদিক পানে যেতে। অনেকক্ষণ আগে যদিও। দেখো গিয়ে।''
তিতলি পথ পায় না কোনো। এদের দেশে কেউ রাস্তা বানায় না। কেউ বাড়ি বানায় না। কেউ কাজ করে না। খেলা, খাওয়া আর ঘুমানো ছাড়া কারো কোনো কাজ নেই।
বনের শেষে কমলা নদী, তার পারে গিয়ে কাঁদতে থাকে তিতলি। একটা ডলফিন এসে ওকে বলে,
-"ও মেয়ে, তুমি কাঁদছ কেন ?''
-''আমার ইমলি পুতুল হারিয়ে গেছে।'' ভেজা গলায় বলে তিতলি।
-''ও তো ওর মায়ের কাছে গেছে। ঐ পাহাড়ের ওপারে।''
-''আমিও আমার মায়ের কাছে যেতে চাই। '' তিতলি কেঁদে কেঁদে বলে।
-''কেন? এই দেশে পড়তে হয় না। কত মিষ্টি খাবার। শুধুই খেলা আর ঘুম। তাও তুমি চলে যেতে চাইছ?''
-''আমার খেলতে আর ভালো লাগে না। এসব মিষ্টি খাবার আর ভালো লাগে না। মায়ের হাতের রান্না কত দিন খাই না। কতদিন স্কুলের বন্ধুদের দেখি না। বাবার সাথে খেলি না।আমি বাড়ি যেতে চাই।''
ডলফিন একটা ডুব দিয়ে আবার ভেসে ওঠে বলে,
-''ফিরে গেলেই পড়াশোনা করতে হবে গো মেয়ে!!"
-"তাও করবো। এখানে কেউ কোনো কাজ করে না। পড়ে না। ডাক্তার নেই। ঘড়ি নেই। কি একঘেয়ে জীবন!'' তিতলি বলে ওঠে।
-''তাহলে আমার পিঠে বসো, আমি তোমায় পৌঁছে দেবো। ইমলি কিন্তু যাবে না এখন। ও ওর মায়ের কাছে গেছে।'' ডলফিন বলে।
তিতলি তাতেই রাজি। ও পিঠে বসতেই ডলফিন একটা বড় ডুব দেয়।
-"তিতলি উঠে পড়ো। স্কুল যেতে হবে।'' তিতলি মায়ের ডাকে উঠে বসে। তবে কি ও স্বপ্ন দেখছিল? কিন্তু ও তো ইমলিকে নিয়ে শুয়েছিল। আর এখন ওর পাশে বিছানায় একটা বড় আকাশী রঙের ফারের ডলফিন।এই পুতুল তো ওর ছিল না! ইমলিকে কোথাও দেখতেই পায় না তিতলি। অনেকদিন পর ও মনের আনন্দে স্কুলের জন্য রেডি হয়। মা রুটি তরকারী দিতেই সোনা মুখ করে খেয়ে নেয়। ওকে পড়াশোনা করে বড় হতেই হবে। ডাক্তার হবে ও। তারপর যাবে ইমলিকে খুঁজতে ঐ দেশে।
ডলফিনকে বিছানায় সাজিয়ে রেখে ও স্কুলে চলে যায়। আজ থেকে রাইয়ের মতো ও মন দিয়ে পড়বে।