সংসারে এক সন্ন্যাসী
সংসারে এক সন্ন্যাসী


প্রণতিদেবীর মত এমন সৎ, ধর্মপরায়ণ,পরোপকারী মানুষ এ সংসারে বিরল। তাঁকে দেখলেই মনে হয় অন্য জগতের মানুষ, যেন সাধারণের ধরাছোঁয়ার বাইরে। না না,সন্ন্যাসী তিনি নন,সংসারী মানুষ হয়েও সর্বদাই মনে তাঁর ঈশ্বর চিন্তা। সব কাজই তিনি করেন তবু যেন এক আধ্যাত্মিক জগতে বিচরণ করেন। স্বামী বীরেনবাবু প্রভূত সম্পত্তির মালিক,কিন্তু স্ত্রী তাঁর নিরাসক্ত,আসক্তিকে তিনি জয় করেছেন। এত বিষয় সম্পত্তির মধ্যে থেকেও বিষয়ে তাঁর মন নেই। স্বামী আক্ষেপ করে কখনও বলেন, "কোনোদিন তো আমার কাছে কিছু চাও না? আমার এত অর্থ, টাকাপয়সা, তোমার মনে হয় না হিরে জহরত পরি,ভারী ভারী সোনার গহনা পরি? " হাসেন প্রণতিদেবী,বলেন,"ভালই তো আছি, খারাপ কি?"কোনো কিছুতেই তাঁর আসক্তিও নেই বিরক্তিও নেই। সংসারের সব দায়দায়িত্ব সামলান স্থির চিত্তে। বিপদেও তিনি অটল,স্হির বিশ্বাস এ বিপদ তিনি কাটিয়ে উঠবেন,সর্বশক্তিমানে আস্থা তাঁর অটুট।
নিঃস্বার্থ,ত্যাগী,নির্লোভ এই মানুষটি সবদিক সামলান হাসিমুখে। নিজের পরিবার ভিন্ন তাঁর চারিপাশে যারা আছে,তাদের সর্বরকমভাবে সহায়তা করা,কে স্কুলের বই কিনতে পারছে না,ত৷ তার বই কিনে দেওয়া,কার মেয়ের বিয়ের দানের বাসন তো কার বিয়ের বেনারসী বা নমস্কারি কিনে দেওয়া তাঁর চলতেই থাকে। এতে তাঁর প্রগাঢ় শান্তি মেলে,এমনটা আর কিছুতেই পান না তিনি। মনে করেন তিনি,"এসব আমি দিচ্ছি না, ঈশ্বর দিচ্ছেন আমার হাত দিয়ে,আমি নিমিত্ত মাত্র।
বহুরূপে সম্মুখে তোমার ছাড়ি কোথা খুঁজিছ ঈশ্বর
জীবে প্রেম করে যেইজন,সেইজন সেবিছে ঈশ্বর।
সংসারে থেকেও এভাবেই তিনি ঈশ্বরসেবা করে চলেছেন। এসবে যে আনন্দ তিনি পেতেন,লক্ষ কোটি টাকার হিরে জহরত তাঁকে সে আনন্দ দিতে পারত না। পুজোর সময় নিজের কাপড় কেনাতে তাঁর আগ্রহ ছিল না যতটা ছিল পাড়ার দুঃস্থ ঘরের ছেলেমেয়েদের জামা কেনার। শীতে কম্বল দান ছিল তাঁর ফি বছরের উৎসব। সারাজীবন এভাবে কাটিয়ে বৃদ্ধ বয়সে স্বামী যখন মারা গেলেন,মেয়েরা তাঁর কেঁদে আকুল। দাহকর্ম মিটে গেলে মেয়েদের তিনি বোঝান,"কাঁদিস না,তোদের বাবা বেশ গেছেন। এরপর বেঁচে থাকলে উনিও কষ্ট পেতেন আর বিছানায় পড়ে থাকলে নিজের কষ্টের সঙ্গে বাড়ির সকলের কাছেও উনি বোঝা হয়ে থাকতেন। সেটা খুব কষ্টকর হত। আর তাছাড়া জীবনে সবই তো ওনার পাওয়া হয়ে গেছে, তোদের সকলের ছেলেমেয়ে দেখেছেন,নাড়াচাড়া করেছেন,এরপর বেঁচে থাকলে ওনার পাওনা হত কেবল কষ্ট।" মেয়েরা কান্না ভুলে মায়ের মুখের দিকে তাকায়,"মা এত মনের জোর কোথায় পায়? যে মানুষের সঙ্গে প্রায় ৫০বছর পাশাপাশি কাটালেন, তাঁর শোকটা তিনি এত সহজে মেনে নিলেন কিভাবে?আমরা তো পারি না?" ভাবে তারা।
তবু যে মানুষ সারাজীবন অন্যায় করলেন না সৎ পথে আধ্যাত্মিক পথে থাকলেন,সর্বশক্তিমানের ওপর ভরসা করে,আস্থা রেখে জীবন কাটালেন,তাঁকে পরীক্ষা নেওয়া যেন সর্বশক্তিমানের আর হয়ে ওঠে না। তাই বৃদ্ধ বয়সে নিজের প্রথম সন্তানকে হারাতে হল তাঁকে। মায়ের সঙ্গে রাতে ফোনে কথা বলে খেয়েদেয়ে শুয়ে,সে মেয়ে আর সকালে বিছানা থেকে উঠল না। সামলাতে সময় লাগলেও নিজেই তার ব্যাখ্যা খুঁজে নিলেন। ঈশ্বরের তাকে প্রয়োজন তাই ডেকে নিলেন তাকে।