Indrani Bhattacharyya

Children Stories Action Inspirational

4.9  

Indrani Bhattacharyya

Children Stories Action Inspirational

সংকল্প

সংকল্প

6 mins
22.7K


তিনদিন ধরে টানা বৃষ্টিতে একাকার হয়ে গেছে মাঠ ঘাট নদী নালা। সুন্দরবনের কোলে সুন্দরী গাছের শিকড় আগলে ভেসে থাকা এই পল্লী আজ সম্পূর্ণ রূপে মূল ভূখণ্ড থেকে বিচ্ছিন্ন। যেদিকে দুচোখ যায়, চোখে পড়ে শুধু ফুলে ফেপে ওঠা রাশি রাশি জল। তারই মধ্যে আজ সকালে বৃষ্টি একটু ধরতে না ধরতেই তিতির , মণি, রাজা, শিবু, জোছন একে একে জল ভেঙে, সাপ খোপ বাঁচিয়ে, টোঙা মাথায় দিয়ে হাজির হয়েছে ইসকুল মাঠে। সেই তিনদিন আগে ইস্কুল থেকে বাড়ি ফেরার পরই যে মুষল ধারে বৃষ্টি শুরু হয়েছিল, তারপর থেকে তারা আসতেই পারেনি এদিক পানে। কিন্তু মন যদিও পড়েছিল ইস্কুলের মাঠেই।

আজ এখানে এসে তারা একেবারে বেকুব বনে গেল। ইস্কুল বাড়ির এতটা দুর্দশা তাদের যে দুঃস্বপ্নেও আসেনি। তারা বসবে কোথায়? স্যারই বা পড়াবেন কোথায়? ঝড়ে টিনের নতুন লাগানো চাল কোথায় উড়িয়ে নিয়ে গেছে কে জানে! চারটে দেওয়ালের মধ্যে কোনরকমে দুটো দেওয়াল মাটি কামড়ে দাঁড়িয়ে আছে। একটু দূরে কালো বোর্ড়খানার একটা কোনা জলের ওপর ভাসছে দেখা যাচ্ছে। তারা হতভম্ব হয়ে সেদিকে তাকিয়ে রইল কিছুক্ষন। এর মধ্যেই রাজা হঠাৎ তিতিরকে পিঠে গুঁতো দিয়ে বলল - " এই তিতির , ঐ দ্যাখ স্যার আসছে।" 

-"কই?"

-"ওই যে দেখ, ঐ পুব দিকে।" সকলেই চোখ ছোটো করে দেখলো , সত্যিই তো! কালো একখান বড় ছাতা ভাসতে ভাসতে এগিয়ে আসছে বটে এদিক পানে। এত বড় ছাতা আর কার আছে এখানে! এ তাদের প্রিয় গৌর স্যারই বটে ।

ওদের অনুমান একেবারে সঠিক ছিল। স্যার কাছে এসে ওদের ক'জনকে দেখে বললেন - "কিরে এই দুর্যোগে ঘর থেকে বেরিয়েছিস কেনো?"

মণি বলল - "সে তো তুমিও এসেছো।"

স্যার একটু হাল্কা হেসে বললো - "আমাকে তো আসতেই হত রে হতভাগা। তোরা ঘরে যা। ময়নাতলার বাঁধ ভেঙেছে শুনে এলাম। হু হু করে জল ঢুকছে। পারলে বাড়ির সবাইকে নিয়ে চন্ডীতলার বড়ো পাকা ইসকুল বাড়িটায় চলে যা।"


শিবু শুনে বলল -"আচ্ছা, যাচ্ছি। কিন্তু আমাদের ইসকুল যে আর নেই স্যার। "

স্যার যেন এবার একটু গম্ভীর সুরে বললেন - "আগে যেটা বলছি, শোন সেটা। সময় নষ্ট করিস না। ঘর যা এখনই। আমি আছি তো। দেখছি, কি করা যায়। ইসকুল তো আর চার দেওয়ালের গল্প নয়। তোরা চাইলে ইসকুল আবার বসবে।"

সেদিন রাত থেকে চরাচর এক করে আরো প্রবল বেগে বৃষ্টি এলো। মাতলা নদী ফুঁসতে ফুঁসতে ময়ালের মত আষ্টেপিষ্টে গ্রামটিকে বেঁধে আত্মসাৎ করে ফেলল। তাও যেনো মিটলো না তার ভয়ঙ্কর খিদে। গ্রাম উজাড় করে সব লোক ঠাঁই নিলো চন্ডীতলার বড় পাকা স্কুল ঘর আর পঞ্চায়েত অফিসে।

আরো দিন দুই একই ভাবে আকাশ কাঁদল, নদীতে তুফান উঠলো, মাতন লাগলো। তারপর একসময় ধীরে ধীরে প্রকৃতি শান্ত হয়ে এলো। হপ্তা খানেক পর থেকে জলও নামতে শুরু করলো। কিন্তু তাতে মানুষগুলোর কপাল ফিরলো কই। সকলের কোনমতে খাবার বাসস্থানের সংস্থান হতে হতেই কেটে গেলো মাস। লেখাপড়ার কথা তখন কারুর সুদূর কল্পনাতেও এলো না । 


যদিও কারুর এলো না বলা ভুল হবে।মণি, রাজা, জোছন, কানাই,শিবু,তিতির ওরা তখনও সময় পেলেই ভাবে তাদের সেই ফেলে আসা ভাঙাচোরা ইসকুল বাড়িটার কথা, সামনের মাঠে দৌড়ে বেড়ানোর কথা, বিজ্ঞান বইয়ে ছবি মিলিয়ে ফুল আর পাখি খুঁজে বের করার কথা, স্যারের কাছে নামতা শেখার কথা, স্যারের মুখে নানান দেশের গল্প শোনার কথা....

গল্পের কথা মনে পড়তেই তিতির বলল - "এই, বৃষ্টি আসার আগে যেদিন আমাদের শেষ ইসকুল হয়েছিল, মনে আছে সেদিন স্যার আমাদের একটা গল্প বলছিল।" শিবু সায় দিয়ে বলল - "হ্যাঁ তো, পিপড়েদের গল্প। ওদেরও একবার খুব ক্ষতি হয়েছিল। ঠিক এরকমই। আমাদের মত।" কানাই গল্পের রেশ টেনে বলল - "কে যেন এক দুষ্টু লোক পুরো শিমুল গাছটা গুঁড়ি সমেত উপরে ফেলেছিল।" তিতির বলল -" ঠিক বলেছিস। ওই গাছের নিচেই তো ছিল পিপড়েদের বাসা। তবে তারা কিন্তু এই ঘটনায় মোটেই দমে যায়নি। নতুন উদ্যমে সকলে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে খুঁড়েছিল পাশের এক পিপুল গাছের কাণ্ডে ছোট্ট একটা কোটর। তারপর সেখানে বয়ে এনেছিল মাটি, শষ্যদানা, গাছের বীজ, আর ফলের ছোট্ট ছোট্ট টুকরো। ধীরে ধীরে যত্ন নিয়ে আবার বানিয়ে তুলেছিল তাদের নিজেদের বাড়ি।" রাজা এবার রাজার মতই বেশ ভারিক্কি চালে বলল-" তবে তো আমরাও ভেবে একটা উপায় নিশ্চয়ই বের করতে পারি যাতে আমাদের ইসকুল শুরু হয় আবার।" সকলেই সেই প্রস্তাবে মহানন্দে তাল মেলালো।


পরদিন সকলেই নিজেদের বাড়ির লোকের কাছে বায়না জুড়ল ইসকুল খুলে দেবার জন্য। বাড়ির লোকের তখন সেই সব কথা শোনার মত ফুরসৎ কই? তাদের মাথায় তখন ঘুরছে রাজ্যের চিন্তা। জল নামলেও মাঠের ফসল নষ্ট হয়ে গেছে মাঠেই। ভিটে মাটি আঁকরে বসে থাকলেও মাথার ওপর খোলা আকাশ। গাই গরুও ভেসে গেছে জলের তোড়ে। ত্রাণের সামান্য চিড়ে গুড় আর ত্রিপল পাবার জন্য হন্যে হয়ে ঘুরছে গায়ের মাতব্বরদের দোরে দোরে।ছোটদের দুঃখ ঘোচানোর মত লোক তখন গোটা গায়েই অমিল।


গতিক মন্দ বুঝে আবার একদিন ছোটরা জমায়েত হল বুড়ো অশ্বত্থের নিচে। তারা বুঝেছে , ইস্কুল নিয়ে ভাবার সময় বড়োদের হাতে নেই। তাদেরকেই একটা উপায় মাথা খাটিয়ে ভাবতে হবে । জোছন বলল - "এখন ইস্কুলবাড়ি কোনো মতেই সারানো সম্ভব নয়। আমাদের তো নিজেদেরই বাড়ির চাল চুলো নেই। ত্রিপল টাঙিয়ে, বস্তা বেঁধে কোন মতে আছি।" মণি হতাশ হয়ে বললো-" তবে উপায়?" তিতির অনেকক্ষণ চুপ করে থেকে বলল -"একটা উপায় আছে বন্ধু। মনে করে দেখ স্যার কি বলেছিলেন শেষ দিন।" বাকিরা শুধোলো- " কি বলতো"? তিতির হেসে বললো - "কেনো স্যার তো বলেইছিল, ইস্কুল মানে কোনো চার দেওয়াল বা কোনো বাড়ি নয়। ইস্কুল মানে আমরা। আমরা চাইলে গাছতলায় বসে পড়তে পারি। ঠিক যেমন করে রবি ঠাকুরের কাছে পড়ত ছাত্র ছাত্রীরা। কিন্তু এখন তাতে সমস্যা আছে। প্রথমত সকলের এই সময় বাড়ি থেকে এখানে আসা সম্ভব নয়। বাঁধ ভেঙে গেছে, গাছ পড়ে রাস্তা আটকে গেছে।অনেক জায়গায় নদীতে ভাঙন ধরেছে। অনেকে বাড়ির কাজে সাহায্য করছে। অনেকের আবার শরীর খারাপ হয়েছে। আর দ্বিতীয়ত ইস্কুলের মাঠে তেমন কোন বড় গাছ নেই যার নিচে বসা যেতে পারে। এই সময় খোলা জায়গায় ভিজে মাটিতে বসলে অন্য বিপদ হতে পারে। সাপ ব্যাঙের উপদ্রব হতে পারে। বৃষ্টি বাদলের কথা নয় বাদই দিলাম। " মণি হতাশ হয়ে বলল - " তাহলে বললি কেনো যে উপায় আছে!" তিতির মনিকে থামিয়ে বললো - " পুরোটা শোন আগে, তারপর বলিস। আমরা কজন মুখে মুখে ছড়িয়ে দেবো পড়া। রাজা হাততালি দিয়ে বলে উঠলো-" তবে তো দারুণ হয়। চল তবে এখনই যাই।"ছেলে মেয়েদের এই প্রস্তাব শুনে সকলেই সাধুবাদ দিল। সব থেকে খুশি হলেন স্যার। তিতিরদের পিঠ চাপড়ে বললেন - " শিক্ষক হিসেবে আমার আজ গর্ব হচ্ছে যে আমি তোমাদের ছাত্র ছাত্রী হিসেবে পেয়েছি।"


তারপর থেকে আর চিন্তা রইল না তাদের। দুদিন পর থেকেই শুরু হয়ে গেলো তাদের ইস্কুল। তবে এখন শুধু রাজা, তিতির নয়, স্যারের পড়া শুনতে লাঙ্গল হাতে, বাসন ধুতে ধুতে, ঘাটে নাইতে যেতে যেতে, ঘর বাঁধতে বাঁধতে, রাস্তা কাটতে ভিড় জমায় আরো অনেক অসমবয়সি ছাত্র ছাত্রী যাদের হয়ত ইস্কুলের ত্রিসীমানায় দেখা যায় নি কোনোদিন।

সাধে কি আর বলে - ইচ্ছে থাকলেই উপায় হয়।


Rate this content
Log in