Shilpi Dutta

Others

1  

Shilpi Dutta

Others

শুভ+ইচ্ছা=শুভেচ্ছা

শুভ+ইচ্ছা=শুভেচ্ছা

4 mins
550


আজ শুভেচ্ছার বৌভাত। চৌধুরি বাড়ির একমাত্র ছেলে শৌনকের সাথে বিয়ে হয়েছে তার। সমস্ত বাড়িটা আলোর রোশনাইতে ঝলমল করছে। আত্মীয়স্বজন যেন আর ধরছেনা উত্তর কোলকাতার এত বড় বাড়িটাতে। এদের মধ্যে অধিকাংশকেই সে চেনেনা। দক্ষিণ কোলকাতার অতি আধুনিকা মেয়ে হলেও বিয়েটা সে বাবার পছন্দের ছেলের সঙ্গে সম্বন্ধ করেই করেছে। অতি ভিড়ের মধ্যেও শুভেচ্ছার দৃষ্টি নিজের অজান্তেই চলে যাচ্ছিল তার তুলনায় একটি অল্পবয়সী মেয়ের দিকে।

    কালকে এই বাড়িতে আসার পর থেকে অবশ্য সে দু একবার মেয়েটিকে দেখেছে তবে সেভাবে পরিচয় বা কথা হয়নি। আর বিয়ের দিন মেয়েটাকে সে দেখেনি বরযাত্রীদের মধ্যে এটা তার স্পষ্ট মনে আছে।

   মেয়েটার মধ্যে যেন কি একটা না বলতে পারা কথা, কিছু জমাট বাঁধা ব্যথা আছে বলে মনে হচ্ছিল শুভেচ্ছার। বারবার মনে হচ্ছিল মেয়েটাকে ডেকে তার সাথে কথা বলে। কিন্তু কেন যেন বলে ওঠা হচ্ছিল না নানারকম আচার অনুষ্ঠানের ব্যস্ততায়।

   দুপুরের দিকে বৌভাতের আচারঅনুষ্ঠান শেষ হলে শুভেচ্ছা একটু একা পেয়ে শৌনককে জিজ্ঞাসা করল—

—‘ঐ মেয়েটি কে গো?’

—‘কোন মেয়েটি?’ শৌনক পাল্টা প্রশ্ন করল

—‘যে মেয়েটির সঙ্গে বিয়ে বাড়িতে এত লোকজন থাকলেও কেউ কথা বলছেনা।’

—‘ও আমার একমাত্র বোন নিপা।’

—‘সত্যি? ওর ব্যাপারে তো কোনদিন কিছু বলনি! এমনকি বিয়ের দিনও ও সঙ্গে যায়নি!’

—‘তোমাকে একটা কথা বলি শুভেচ্ছা ওকে কিছু জিজ্ঞাসা করতে যেও না বা বাড়ির কারোর সাথেও নিপার ব্যাপারে কথা বলার দরকার নেই।’

—‘কিন্তু কেন?

—‘আমি জানি তুমি সব ব্যাপারটা না জেনে কিছুতেই থামবেনা। তোমার সঙ্গে বিয়ের আগে দুএকবার যা দেখা হয়েছে, কথা হয়েছে তাতে আমি এটা বুঝেছি যে তুমি শুধু পোষাক, কথাবার্তাতেই আধুনিকা নয়। আধুনিক চিন্তাভাবনাও মনে পোষন কর। তবে নিপার ব্যাপারটা অন্যরকম। এক বিয়ে বাড়িতে ওকে দেখে জয়ন্তর বাবার পছন্দ হয়। উনি বাবার কাছে জয়ন্ত ও নিপার বিয়ের প্রস্তাব দেন। আর বাবাও বনেদী পরিবার দেখে রাজি হয়ে যান। ওদের বিয়ে হয়ে যায়। কিন্তু বিয়ের কিছুদিন পর থেকেই শুরু হয় নিপার উপর অমানুষিক অত্যাচার। অনেকবার নিপা সে কথা বাবাকে বলে। কিন্তু বাবা আবার বুঝিয়ে ব্যাপারটা মিটিয়ে দেয়। সাময়িকভাবে মিটে গেলেও কয়েকদিন পর থেকে আবার শুরু হয় একই মারধর, অশান্তি। জয়ন্তর নাকি নিপাকে পছন্দ ছিলনা শুধু ওর বাবার চাপে পড়ে বিয়ে করেছে। আমাদের বিয়ের দিন দশেক আগে নিপা একদিন সকালে হঠাৎ ওর শ্বশুরবাড়ি থেকে এখানে চলে আসে আর কোনদিন ওবাড়িতে ফিরে যাবে না বলে। কিন্তু বাবার বক্তব্য হল যত যাই হোক শ্বশুরবাড়িই মেয়েদের আসল বাড়ি তাই নিপাকে ফেরত যেতেই হবে।’

    শৌনকের মুখে সব কথা শুনে শুভেচ্ছা অবাক হয়ে গেল। কিন্তু শৌনককে কিছু বলল না। কারণ সে বুঝতে পারলো যা বলার তা বলতে হলে একমাত্র তার শ্বশুরমশাইকেই বলতে হবে। 

    কিছুক্ষণ পরে বিউটিপার্লারের মহিলাটি এসে তাকে বিকেলের রিসেপশনের জন্য খুব সুন্দর করে সাজিয়ে দিয়ে গেল। কিন্তু তার মনের মধ্যে কিছুতেই সে শান্তি পাচ্ছিলনা।

    শুভেচ্ছার সাজগোজের পর সবাই নিজেদের সাজগোজ করতে চলে গেলে যখন অনুষ্ঠানের আসরে যাওয়ার আগে সে ঘরে একা বসে ছিল তখন সেখানে প্রবেশ করলেন তার শ্বশুরমশাই ও শাশুড়ি মা।

    একটা সোনার সীতাহার বাক্স থেকে বের করে নতুন বৌমার হাতে দিয়ে শ্বশুরমশাই বললেন,

— ‘শোনো বৌমা এটা আমার মায়ের হার। এতদিন এটা তোমার শাশুড়ি মা পরেছেন। আর আজকে থেকে আমাদের বংশের নিয়ম অনুযায়ী তুমি পরবে।’

    শুভেচ্ছা শ্বশুরমশাই ও শাশুড়ি মাকে প্রণাম করে সেটা হাতে নিল। শাশুড়ি মাকে প্রণাম করতে গিয়ে সে দেখল তাঁর মুখটা একটু ভারাক্রান্ত , আর এর কারণ যে নিপার জীবনের অশান্তি সেটা বুঝতে শুভেচ্ছার অসুবিধা হলনা। তার নিজের মায়ের মুখটা মনে পড়ে গেল। সে শ্বশুরমশাইকে বলল,

—‘বাবা আপনাকে একটা কথা বলতে চাই। ’

—‘হ্যাঁ বলো মা।’

—‘আমি নিপার সম্বন্ধে সব জানি। আপনি জানেন আমি অনেক ছোটবেলায় বাবাকে হারিয়েছি। বাবার কথা ভালো করে মনেও নেই, তবে এটুকু বিশ্বাস করি নিপার জায়গায় যদি আমি হতাম তাহলে আমার বাবা আমাকে কখনোই ওরকম একটা জায়গায় ফিরে যেতে বলতেন না যেখানে ফিরে যাওয়া মানে একটু একটু করে মৃত্যুর দিকে এগিয়ে যাওয়া। আর সব বাবারা যাঁরা মেয়েদের ভালোবাসেন তাঁরা কখনোই মেয়েকে নিশ্চিত মৃত্যুর দিকে ঠেলে দেবেন না।’

—‘কিন্তু বৌমা সমাজ বলেও তো কিছু একটা আছে। লোকে কি বলবে!’

—‘বাবা আপনি আমাকে আশীর্বাদ করার সময় বলেছিলেন আমি আপনার ছেলের বৌ হলেও আপনার মেয়ের মতোই থাকবো। সেই দাবীতেই এত কথা বলার সাহস পেলাম। আপনি একটা পরের মেয়েকে যদি এতটা স্নেহ করেন তবে নিজের মেয়েকে কখনোই ওই নরকে পাঠাতে চাইবেন না। আর সমাজ ও লোকজনের সাথে আমার ছোটবোন নিপার জন্য না হয় আমরা বাবা আর মেয়ে মিলেই লড়াই করে নেবো। একটা নতুন জীবন পাবে নিপা।’

    শ্বশুরমশাই নিপার মাথায় হাত দিয়ে বললেন,

— ‘তবে তাই হবে মা। আমিও চাইনা মেয়েটা ওখানে আর ফিরে যাক তবে নিজের পুরানো চিন্তাভাবনা থেকে বেরতে পারছিলাম না। তুমি এসে আধুনিক চিন্তার আলোয় সব অন্ধকার সরিয়ে দিলে।’

    শুভেচ্ছার শাশুড়ি মা মুখে কিছু না বললেও দুচোখ ভরা জল নিয়ে মনভরে এই আধুনিকা বৌমাটিকে আশীর্বাদ করে বললেন,

—‘তুমি সুখী হও, তোমার মঙ্গল হোক। ’


Rate this content
Log in