প্রথম লেখা (তাতাইয়ের গল্প-৮)
প্রথম লেখা (তাতাইয়ের গল্প-৮)


সকাল থেকে এক নাগাড়ে কেঁদেই চলেছে তাতাই। তার চিৎকারের জেরে আজ পাঁচিলের ওপর একটাও কাক বসতে পারেনি। দাদু অনেকবার তাকে চুপ করানোর চেষ্টা করেও ব্যর্থ হয়ে অবশেষে বাড়ির থেকে উধাও হয়েছেন।
★★★★★
এবার আপনারা নিশ্চয় ভাবছেন তাতাইয়ের মত পাকা বুড়ির হঠাৎ কি হল যে সকাল থেকে এমন ত্রাহি ত্রাহি রব তুলেছে সে! তাহলে ঘটনাটা গোড়ার থেকেই বলা যাক। ব্যাপারটার সূত্রপাত মাস দুয়েক আগের সন্ধ্যায়। এ বছরের রেকর্ড গরমের কথা তো কারুর অজানা নয়। গ্রীষ্মের দাবদাহে সবার প্রাণ অতিষ্ট। তবুও সেদিন দুপুরবেলা আচমকাই আকাশের কোণে উঁকি দিয়েছিল এক ঝাঁক কালো মেঘ। মাঠে চরতে থাকা গরু, ছাগলরা ত্রাহি ত্রাহি চিৎকার করে জানান দিয়েছিল সাবধান হতে, কালবৈশাখী আসছে। সত্যিই সেদিন বছরের প্রথম কালবৈশাখী এসেছিল। আকাশ বাতাস কেঁপে উঠেছিল তার আতিশয্যে। সামনের মিত্তির কাকিমার সাধের নারকেল গাছের ডালগুলো দুলছিল ভয়ঙ্কর ভাবে, বেল গাছ থেকে টিনের চালে বেল পড়ছিল দুমদাম করে। আর ক্ষণে ক্ষণে বাজের শব্দে মায়ের কোলে মুখ লুকিয়ে বসেছিল তাতাই, ঠাম্মি ওর ভাই পিচাইয়ের কানে হাত চাপা দিয়ে ওর কচি কান দুটোকে এই শব্দ দানবের হাত থেকে রক্ষা করতে চেষ্টা করছিলেন। তা সেদিন কালবৈশাখী চলছিল প্রায় ঘন্টা দুয়েক ধরে। তারপর সব শান্ত হয়ে গিয়েছিল সহসা। সেদিন অফিস থেকে ফিরে বাবা আর ছাদে ছোটেননি হাওয়া খেতে। এমনিতেই ঠান্ডা হয়ে গিয়েছিল ওয়েদারটা। কিন্তু তাতাইয়ের মনটা বড্ড উশখুশ করছিল। বাবা ফিরলেই রোজ সে বাবার সঙ্গে ছাদে চলে যায়; তারপর উইচিংড়ের মত সারা ছাদে লাফিয়ে লাফিয়ে খেলে বেড়ায়, কখনও আবার অন্ধকারে লুকিয়ে বাবাকে ভুতের ভয় দেখায়। তাই আজ সেসবের সুযোগ না পেয়ে মনটা কেমন ফাঁকা ফাঁকা লাগছে।
---- বৌমা কিসের যেন একটা আওয়াজ হচ্ছে না?
মাকে উদ্দেশ্য করে কথাগুলো বললেন ঠাম্মি। মা একটু কান পেতে কি যেন শুনলেন, তারপর বললেন,
---- ঠিক বলেছো মা। কিছু একটা ডাকছে মনে হয়।
এই বলে মা আবার রান্নাঘরের কাজে ব্যস্ত হয়ে পড়ল। আর তাতাই সঙ্গে সঙ্গে ব্যস্ত হয়ে পড়ল এই শব্দের উৎস অনুসন্ধান করতে। এদিক সেদিক কান পেতে শুনতে শুনতে সিঁড়ির কাছে আসা মাত্রই তাতাইয়ের মনে হল শব্দটা যেন অনেকখানি তীব্র এখানে। যে ডাকছে সে এক নাগাড়ে ডেকে চলেছে। কে হতে পারে…! ভাবতে ভাবতেই তাতাইয়ের আচমকা মনে পড়ে গেল কয়েকদিন আগেই এক চড়ুই দম্পতি এসে আশ্রয় নিয়েছিল ওদের বাড়ির চিলেকোঠার ফাঁকে, মা বলেছিলি মেয়ে চড়ুইটা নাকি ডিম পাড়বে। কথাটা মনে হতেই মায়ের কাছে ছুটল তাতাই,
---- মা মা আমি বুঝতে পেরেছি কে ডাকছে।
---- কে?
---- ওই চড়ুই পাখিগুলো
---- ওহ আচ্ছা।
---- মা মা দেখবো চলো না কি হয়েছে।
---- পরে যাবো বাবা, এখন কারেন্ট নেই তো।
---- টর্চ নিয়ে চলো না।"
---- টর্চ নিয়ে দেখা যাবে না। পরে কারেন্ট এলে যাবো।
---- মা প্লিজ প্লিজ….
---- তাতাই একবার বললাম না পরে যাবো। এখন যাও রান্নাঘর থেকে।
মায়ের ধমক শুনে চুপচাপ রান্নাঘর থেকে বেরিয়ে এলো তাতাই। কিন্তু মা রাজি হলোনা বলে দমে যাওয়ার পাত্রী সে নয়। বাবা, ঠাম্মি, দাদু সবাইকে একবার করে অনুরোধ করে দেখে নিল সে, কোনো লাভ হল না। কি আর করা যাবে! কেউ এলো না যখন তখন একা একাই দেখতে যেতে হবে তো ব্যাপারটা কি, এমনও তো হতে পারে চড়ুই পাখির কোনো দরকার। সবাই এখন ড্রইংরুমে বসে আছে। তাতাই পা টিপে টিপে দাদুর ঘরে চলে গেল। দাদুর বিছানায় সবসময় টর্চ পড়ে থাকে। সন্তর্পণে টর্চটা জ্বালিয়ে সিঁড়ি দিয়ে উঠে গেল তাতাই। ভাগ্যিস কেউ দেখতে পায়নি তাকে! সিঁড়ির মাথায় উঠে ল্যান্ডিংয়ে টর্চের আলো ফেলতেই বুকটা ধক করে উঠল তাতাইয়ের। সে দেখলো দুটো ছোটো ছোটো চড়ুই পাখি উল্টে পড়ে আছে সেখানে, আর তাদের মা পাশে বসে কেঁদে যাচ্ছে এক নাগাড়ে। ওদের দেখে তাতাইয়ের কান্না পেয়ে গেল হঠাৎ। সে ছুটে সিঁড়ি থেকে নেমে রান্নাঘরে এসে জড়িয়ে ধরল মাকে। মা তো অবাক,
---- কি হল? কাঁদছিস কেন?
---- মা ওরা মরে গেছে।
---- কে মরে গেছে সোনা?
----- তুনু চড়াই দুটো। ওদের মা খুব কাঁদছে।
এই বলে আরও জোরে ফুঁপিয়ে উঠল তাতাই।
সেদিন সারারাত ভালো করে ঘুমোতে পারল না সে। বারবার চোখের সামনে ভেসে উঠতে লাগলো চড়াই বাচ্চাদুটোর চেহারা। খুব ভোর বেলা সেদিন ঘুম ভেঙে গেল তাতাইয়ের। পাশেই ঠাম্মি আর দাদু অঘোরে ঘুমোচ্ছেন তখনও। আস্তে আস্তে খাট থেকে নেমে পড়ল তাতাই। মনটা ভীষণ ছটফট করছে তার। মা চড়াইটা সারারাত কেঁদে কেঁদে বোধহয় ক্লান্ত, এখন থাকতে থাকতে কেঁদে উঠছে মাঝেমাঝে। পা টিপে টিপে আবার সিঁড়ি দিয়ে উঠে এলো তাতাই। চড়াই বাচ্চাদুটো এখনও পড়ে আছে সেখানেই। তাতাই ভালো করে ওদের দেখবে বলে একটু কাছের দিকে এগিয়ে যেতেই ওকে চমকে দিয়ে একটু নড়ে উঠল একটা বাচ্চা। তাতাই ভয়ে পিছিয়ে গেল কয়েক পা। তারপর আবার সাহস করে কাছে এসে ঝুঁকে পড়ল পাখিটার দিকে, ছোট্ট পাখিটা… ওটা বেঁচে আছে এখনও। চোখ মেলে তাতাইকে একবার দেখলো সে। তারপর তাতাইকে আবার অবাক করে দিয়ে ঠোঁট দুটো একবার ফাঁকা করল পাখিটা। তাতাই বড়বড় চোখ করে ওর দিকে তাকিয়ে বলল,
"জল খাবি?"
উত্তর দিলো না পাখিটা। তাতাই ছুটে রান্নাঘরে এসে একটা বাটিতে করে জল নিয়ে গেল পাখিটার কাছে। পাখিটা আবার হাঁ করল ওকে দেখে।
"এই যে জল খা…"
বলল তাতাই। কিন্তু জলে মুখ অবধি দিলোনা তুনু চড়ুই।
"আরে বাবা খা না।"
এবারেও খেলো না সে। তাতাই মাথা নেড়ে বলল, "তুই তো বড় আহ্লাদী! না খাওয়ালে খেতেই চাস না।"
এই বলে বাটি সুদ্ধ জলটা পাখিটাকে খাওয়াতে গেল সে, কিন্তু জলটা ওর ঠোঁটের ফাঁকে কতটা গেল বলা যায়না, তার চেয়ে বেশি ঢালা হয়ে গেল পাখিটার গায়ে। ঠান্ডায় কাঁপতে লাগলো পাখিটা। ভয় পেয়ে গেল তাতাই।
এদিকে হয়েছে কি ঠাম্মি ঘুম থেকে উঠে তাতাইকে দেখতে না পেয়ে এদিক সেদিক খুঁজতে খুঁজতে এখানে আসতেই দেখতে পেলেন দৃশ্যটা।
---- আরে আরে কি করলি!
আর্তনাদ করে উঠলেন ঠাম্মি। তাতাই অপরাধীর মত গলায় বলল,
---- এবার কি হবে?
---- কি আর…
এই বলে ঠাম্মি আস্তে করে পাখিটাকে তুলে নিলেন নিজের হাতের তালুতে। তারপর সোজা চলে এলেন ছাদে। তখন সূর্যের প্রথম কিরণ এসে পড়ছে পূর্ব দিকে। পাখিটাকে সেখানে নামিয়ে দিলেন ঠাম্মি। ভোরের আলো পড়তেই খানিক চাঙ্গা হয়ে উঠল পাখিটা। কিন্তু তাতাই খেয়াল করল পাখিটা সোজা হয়ে দাঁড়াতে পারছেনা, ওর বাম পা'টা কেমন যেন একটা হয়ে আছে। ঠাম্মিকে বিষয়টা বলতেই ঠাম্মি বললেন,
---- কাল অতো উঁচু থেকে পড়ে গিয়ে পা'টা জখম হয়ে গিয়েছে মনে হয়।
---- তাহলে এখন কি হবে? আমার চিচি কি খোঁড়া হয়ে যাবে?
---- চিচি! বাহ্ এরই মধ্যে নামও ভাবা হয়ে গেল?
---- হুঁ। তুমি বলো না ঠাম্মি চিচি কি খোঁড়া হয়ে যাবে?
---- উম্ম চিচির জন্য একটু ওষুধের বন্দোবস্ত করতে হবে। তাহলেই পা'টা সেরে উঠবে।
---- কি ওষুধ গো? কোন ডাক্তারের কাছে পাবো? তুমি দাদুকে বলো না ওষুধ দিতে।
---- ঠাম্মি ওর চুলগুলো ঘেঁটে দিয়ে বললেন ঠাম্মিই তো ডাক্তারবাবু।
---- ধুরর।
---- তুমি দেখোই না।
এই বলে ঠাম্মি একটুকরো কাপড় কেরসিনে ভিজিয়ে এনে বেঁধে দিলেন চিচির পায়ে। তাতাই তো অবাক,
---- এই ওষুধ।
---- হুমম। এবার দেখবে তোমার বন্ধুর পা কেমন ম্যাজিকের মত সেরে ওঠে।
★★★★★
সেইদিন থেকে চড়ুই পাখিটা হয়ে গেল তাতাইয়ের বন্ধু। সে থাকতে লাগলো তাতাইয়ের সিঁড়ির এক কোণে। মা একটা ছোটো বাটি আর ড্রপার দিলেন তাতাইকে, যাতে করে সে না আর জল খাওয়াতে গিয়ে ভিজিয়ে ফেলে চিচিকে। মা রোজ চারবেলা বাটিটায় করে চালগুঁড়ি গুলে দিতেন, তাতাই সেটা ড্রপারের ডগা দিয়ে খাইয়ে দিত চিচিকে। আর চিচিটাও খেতে খেতে এতো পেটুক হয়ে উঠল যে সে তাতাইকে দেখতে পেলেই হাঁ করে খাবার চাইত। খুব মজা লাগতো তাতাইয়ের। এইভাবেই বেশ কেটে যাচ্ছিল দিনগুলো। খেয়ে খেয়ে চিচিও বেশ নাদুসনুদুস হয়ে উঠেছিল। তার পা'টাও সেরে গিয়েছিল প্রায়। চিচি যখন একদম ছোটো তখন তার মা দূর থেকে তাকে দেখতো। মাঝে মাঝে ডাক দিয়ে কিছু বলতো, আর এপাশ থেকে চিচিও সাড়া দিত তার নিজস্ব ভাষায়। এরপর চিচি একটু বড় হওয়ার পর যখনই ওর ধারে কাছে তাতাইরা কেউ থাকতো না তখন চিচির মা মুখে করে খাবার এনে ওকে খাওয়াতো। আড়াল থেকে এসব দেখতো তাতাই।
এরই মাঝে একদিন ঘটে গেল এক ভয়ানক ঘটনা। তাতাই রোজগার মতোই সেদিন স্কুল থেকে ফিরে লাফিয়ে লাফিয়ে দেখতে গেছে চিচিকে। কিন্তু সিঁড়ির মুখে যেতেই ভয়ে তার বুকটা ধক করে উঠল। সে দেখলো একটা মোটা বিড়াল কখন যেন চুপিসারে সিঁড়ি দিয়ে উঠে পৌঁছে গেছে চিচির কাছে। চিচি অবশ্য একা নয়, চিচির মা দাঁড়িয়ে আছে ওর সামনে। দুষ্টু বিড়ালটার দৃষ্টি পাখি দুটোর দিকে। যে কোনো মুহূর্তে ওদের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়বে সে, এখন প্রস্তুতি নিচ্ছে মাত্র। কিন্তু বিড়ালটা কিছু করার আগেই চিৎকার করে ওর দিকে ছুটে গেল তাতাই। তাতাইয়ের এই রণমূর্তি দেখে ভয় পেয়ে লেজ তুলে পালালো বিড়ালটা। খুব বড় বিপদের হাত থেকে আজ রক্ষা পেল চিচি আর তার মা। চিচির মা আগে তাতাইকে দেখলেই উড়ে পালাত, কিন্তু আজ আর সে উড়ে গেল না। বরং তাতাইয়ের দিকে তাকিয়ে ওর ভাষায় কিসব যেন বলল। ওর কথার বুঝতে পারল না তাতাই কিন্তু মনটা ভালো হয়ে গেল তার।
★★★★★
বিড়ালের কান্ডটার পরের দিন থেকেই চিচির মা ওকে উড়তে শেখাচ্ছে রোজ। চিচিটা চেহারায় যতই নাদুসনুদুস হয়ে যাক, এমনিতে কিন্তু আলুভাতে। ওর মা কত করে চেষ্টা করছে, তাও সে উড়তেই চায়না। একটু ডানা মেলেই আবার হাঁফিয়ে বসে পড়ে। ওর মা ধমক দেয় ওকে, তখন চিচি পেট ফুলিয়ে ডাকতে শুরু করে। তাতাই বেশ বোঝে চিচি তাকে ডাকছে। তাতাই এতক্ষণ আড়াল থেকে নজর রাখছিল ওর ওপর,এবার চিচির কান্না শুনলেই আড়াল থেকে বেরোতেই হয় তাতাইকে। তারপর চাল গুঁড়ি গুলে নিয়ে গিয়ে আদর করে খাইয়ে দিতে হয় বিচ্ছুটাকে। তবে গিয়ে সেটা শান্ত হয়। একেক সময় বেণী দুলিয়ে তাতাই পাকা গিন্নির মতো বলে ওঠে,
"তোর আবদার সামলাতে সামলাতে আমার আর কোনো কাজ করার জো নেই। উফফ আর পারিনা তোকে নিয়ে।"
চিচিও কি বোঝে কে জানে, কিচিরমিচির করে কিসব বলে দেয় তাতাইকে।
এমনিই করেই বেশ কেটে যাচ্ছিল দিনগুলো। চিচি এখন আগের চেয়ে অনেক ভালো করে উড়তে শিখে গেছে। ওকে উড়তে দেখলেই আনন্দে তাতাইও নেচে ওঠে। ওর মনে পড়ে যায় সেই ঝড় বৃষ্টি দিনের পরের সকালটা। কিভাবে ছোট্ট চিচিকে পেয়েছিল সে। বাড়িতে যেই আসে সেই চিচিকে দেখে তাতাইয়ের প্রশংসা করে, বলে তাতাইয়ের জন্য নাকি একটা প্রাণী প্রাণ ফিরে পেয়েছে। তাতাই এতো শত নিয়ে মাথা ঘামায় না। তার একমাত্র আনন্দ সে একটা নতুন বন্ধু পেয়েছে, চিচি হচ্ছে তার বেস্ট ফ্রেন্ড। তাই তো চিচিকে উড়তে দেখলে তারও মনটা যেন আকাশে পাখা মেলে দেয়।
★★★★★
এই আনন্দের মাঝেই হঠাৎ আজ সকালে ঘুম ভাঙতে রোজগার মত তাতাই ছুটে যায় সিঁড়িতে। দেখে চিচির খাওয়ার বাটি, ড্রপার সব পড়ে আছে, কিন্তু চিচি নেই সেখানে। তাতাইয়ের মনটা অজানা আশংকায় কেঁপে ওঠে। সে প্রথমে সিঁড়ি ছাদ সব খুঁজে দেখে, তারপর গোটা বাড়ি তন্ন তন্ন করে খুঁজে ফেলে কিন্তু কোথাও দেখতে পায়না চিচিকে। চিৎকার করে চিচিকে ডাকে তাতাই; কিন্তু আজ আর কিচিরমিচির করে সাড়া দেয়না কেউ। চিলেকোঠার কোণের দিকে তাকিয়ে তাতাই বেশ বুঝতে পারে চিচির মা বাবাও নেই ওখানে। এবার কেঁদে ফেলে তাতাই। মা তার মাথায় হাত বুলিয়ে বলেন,
---- চিচি তো পাখি, ওর ঠিকানা আকাশে। সিঁড়ির অন্ধকারে নয়।
তবুও কান্না থামে না তাতাইয়ের। ঠাম্মি সান্ত্বনা দিয়ে বলে ওঠেন,
---- চিচির এখানে থাকতে খুব কষ্ট হত দিদিভাই। মাকে ছেড়ে থাকতে কি কারুর ভালো লাগে?
বাবা বলেন,
---- চিচি এবার খুব আনন্দে থাকবে তাই বন্ধু ভালো থাকলে তোমারও তো আনন্দ পাওয়া উচিৎ তাই না? তুমি মনে মনে প্রার্থনা করো চিচি যেন খুব ভালো থাকে।
কিন্তু কারুর কথাতেই লাভ হয়না, কান্না থামেনা তাতাইয়ের। সে বুঝতে পারে ভীষণ কষ্ট হচ্ছে তার। ভীষণ ফাঁকা ফাঁকা লাগছে বুকের ভেতরটা। এই দু'মাস পড়াশুনার পাশাপাশি তার জীবন হয়ে উঠেছিল চিচি; সেই চিচি তাকে ছেড়ে চলে গেছে ভাবলেই অদ্ভুত রকমের কষ্ট হচ্ছে তাতাইয়ের। তাই সে কিছুতেই কান্না থামাতে পারছে না। মা বাবা ঠাম্মি কত রকম চেষ্টা করে যাচ্ছেন, কিন্তু কোনো খাবার বা খেলনার লোভও কাবু করতে পারছেনা তাকে।
দাদু তো তাতাইয়ের কান্নার চোটে অতিষ্ট হয়ে একটু বেলা হতেই বেরিয়ে গিয়েছিলেন বাড়ির থেকে। প্রায় দু'ঘন্টা পর ফিরলেন তিনি। দাদুকে দেখতে পেয়েই ঠাম্মি চোখ গোল গোল করে বলে উঠলেন,
---- কি লোক গো তুমি নাতনিটা এতো কাঁদছে, তাকে কোথায় শান্ত করবে তা না তুমি ঘুরতে বেরিয়ে পড়লে নিজে?
ঠাম্মির কথায় শুধু মৃদু হাসলেন দাদু। তারপর চলে এলেন তাতাইয়ের কাছে। ওর পাশে বসে বললেন,
---- চিচি চলে গেছে বলে মনে খারাপ আমার দিদিভাইয়ের?
দাদুর প্রশ্ন শুনে তাতাই নাক টানতে টানতে "হুঁ" বলে আরও জোরে কেঁদে উঠল। মা দাদুকে বললেন,
---- আহহ বাবা আমরা তখন থেকে ওর মনটা অন্যদিকে করার চেষ্টা করছি আর তুমি ওকে আরও মনে করাচ্ছ!
মায়ের কথায় দাদু মুখে কোনো উত্তর না দিয়ে আঙুলে কি যেন ইশারা করলেন, চুপ করে গেলেন মা। দাদু এবার তাতাইয়ের মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে বললেন,
---- আজ একটা কথা বলছি দিদিভাই। মন দিয়ে শোনো সেটা। আমরা যত ছোটো থেকে বড় হবো তত আমাদের জীবনে অনেক বন্ধু, অনেক মানুষ আসবে, তারপর আবার চলে যাবে তারা। কেউ হয়তো বেশিদিনের জন্য আসবে, আবার কেউ হয়তো কম দিনের জন্য। এমনটাই হয় দিদিভাই; আমার সাথেও হয়েছে, ঠাম্মি মা বাবা সবার সাথে হয়েছে, এখনও হয়। কিন্তু আমরা কি তোমার মতো কান্নাকাটি করি বলো?
---- চিচি…
---- জানি তো চিচি খুব ভালো বন্ধু ছিল তোমার। আসলে কি বলোতো দিদিভাই, আমাদের যদি খুব বেশি বন্ধু হয়ে যায় তাহলে আমরা কি সবার সমান খেয়াল রাখতে পারবো বলো?
আবার ফোঁপাতে ফোঁপাতে ঘাড়টা দুদিকে নাড়ল তাতাই। দাদু বললেন,
---- হুমম। সেই জন্যই তো… চিচি তো খুব ভালো বন্ধু, তাই ঠাকুর ভাবলেন চিচি তো অনেকদিন তাতাইয়ের বন্ধু হয়েছে, এবার চিচি অন্য এমন কারুর ভালো বন্ধু হোক যার কোনো বন্ধু নেই। আর এদিকে তাতাইও তো খুব সোনা বন্ধু তাই তাতাইকেও এবার অন্য নতুন কারুর সোনা বন্ধু হতে হবে।
---- কিন্তু চিচি…
---- কিন্তু চিচিও সারাজীবন তোমার বন্ধু থাকবে দিদিভাই। চোখের সামনে থেকে কেউ চলে গেলেই কি বন্ধুত্ব শেষ হয়ে যায়? দেখেছো তো আমি আর ব্রতীন দাদু কত দূরে দূরে থাকি, তাও কি আমাদের বন্ধুত্ব শেষ হয়ে গেছে?
---- না।
---- তেমনই তো চিচি তোমার বন্ধু ছিল, বন্ধু থাকবে। আর তোমাদের বন্ধুত্ব যাতে অটুট থাকে তার জন্য আমি একটা ব্যবস্থা করেছি।
---- কি?
---- এই দেখো।
এই বলে দাদু তাঁর ব্যাগ থেকে বের করে আনলেন একটা চকচকে লাল মলাট দেওয়া মোটা খাতা, আর সেই সঙ্গে একটা বার্বি ডল পেন্সিল। সেই দুটো তাতাইয়ের হাতে দিয়ে দাদু বললেন,
---- এই দুটো হল তোমার মনের আয়না।
---- সে আবার কি?
---- এবার থেকে যখনই তাতাইয়ের কোনো কিছু ভালো লাগবে, খারাপ লাগছে সেই সব কথা এই খাতাটার মধ্যে লিখে ফেলবে। তাতে কি হবে জানো?
এই খাতাতে তুমি যাই লিখবে সেটা সারাজীবনের জন্য তোমার কাছে রয়ে যাবে।
---- সত্যিই?
---- একদম সত্যি। আজ তুমি এক কাজ করো। এক্ষুণি রুমে গিয়ে এই খাতাটায় তোমার আর চিচির বন্ধুত্বের গল্পটা লিখে ফেল, কিভাবে সেদিন চিচিকে পেয়েছিলে তুমি, কিভাবে তাকে বড় করলে… সব কিছু লিখে ফেল।
এরপর যখনই তোমার চিচির কথা মনে পড়বে তখনই এই লেখাটা পড়বে একবার করে। দেখবে তখন মনে হবে চিচি কোথাও যায়নি, তোমার সঙ্গেই আছে।
---- সত্যি?
---- তিন সত্যি। আর দিদিভাই আরেক দিক দিয়ে দেখতে গেলে এই খাতাটা আজ থেকে হয়ে উঠল তোমার নতুন বন্ধু, এ এমন এক বন্ধু যে কিন্তু তোমাকে কোনোদিনও ছেড়ে যাবে না।
দাদুর কথা শুনে আজ এতক্ষণ পর কান্না থামলো তাতাইয়ের। সে তার ঘরে চলে গিয়ে দাদুর দেওয়া খাতাটা খুলে বসল। ফোঁপাতে ফোঁপাতে মার্জিনের ওপর সে লিখে ফেলল তার প্রথম গল্পের শিরোনাম ---- "তাতাইয়ের বন্ধু"।