না-মানুষের গল্প
না-মানুষের গল্প
গায়ে ছ্যাঁক করে কিছু লাগতেই চমকে উঠে আকাশের দিকে তাকাল ডিঙো। বৃষ্টি নেমেছে। ছুটে গিয়ে গাছগাছালি ঘেরা তার নিজস্ব ছাউনির মধ্যে ঢুকতে গেল সে, কিন্তু একি! সেখানে ইতিমধ্যেই আরও অনেক পশু আশ্রয় নিয়েছে। ডিঙোর শরীর জ্বলছিল। বাকিদের কোনোমতে ঠেলে ভেতরে ঢুকল সে। ছাউনির এক কোণে বসে বৃদ্ধ বাঘ মারুক একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল, "আগে বৃষ্টি হলে কি আনন্দই না হত আমাদের। বৃষ্টি মানেই আনন্দে স্নান, জঙ্গলের গাছে নতুন প্রাণ। আর এখন…"
"তোমার মুখে ওই কথা প্রায়ই শুনি কিন্তু আমরা তো অমন বৃষ্টি একবারও দেখলাম না দাদু। এখন বৃষ্টি পড়লেই তো গায়ে ছ্যাঁকা লাগে, চামড়া পুড়ে যায়।" বলে উঠল ফিচকে বানর মাঙ্কু।
"কি আর করবি বল, সবই আমাদের দুর্ভাগ্য। মানুষ করল দোষ, ফল ভোগ করছি আমরা।" আবার একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলল মারুক।
"মানে? কি বলছ দাদু?"
"দাদু ঠিকই বলছে রে মাঙ্কু।" বলে উঠল ডিঙো, "আমার দাদুও একই কথা বলত। মানুষ নাকি নিজেদের বড় প্রমাণ করতে প্রকৃতি মায়ের ইচ্ছার বিরুদ্ধে সব কাজকর্ম করে আর তাতে প্রকৃতি মা অভিশাপ দেয় সকলকে। এই আমাদেরই দেখ না, আগে নাকি হরিণের শিং এর বাহার ছিল দেখার মত। আর আমার শিং দেখ।"
খরগোশ রোবু বলে উঠল, "এতো ভারী অন্যায় ডিঙো দাদা। ওরা করবে দোষ আর শাস্তি পাবো আমরা!"
"এটাই তো হচ্ছে রে।"
"না না এ হতে দেওয়া যায়না। আমরা কি কিছুই করতে পারব না?"
★★★
আজ সকাল থেকে বৃষ্টি হচ্ছে। ভুতো কাঁচের জানালায় মুখ রেখে বৃষ্টি দেখছে এক মনে, হলুদ হলুদ বৃষ্টি। রাস্তা দিয়ে হুশহাশ গাড়ি চলে যাচ্ছে মাঝেমাঝে। রিঙ্কির বাবা এসে ভুতোর মাথায় হাত বুলিয়ে দিলেন। অস্বস্তি লাগল ভুতোর। সে রিঙ্কিকে খুব ভালোবাসে কিন্তু ওর বাবাকে কেন না জানি ঠিক ভালো লাগে না ভুতোর। লোকটা আজ মনে হয় অস্থির হয়ে আছে কোনোকারণে, নয়তো ভুতোর দিকে তাকাবারই সময় হয় না যার সে আবার ওকে আদর করছে!
"ড্যাডি তুমি আজ অফিসে যাবে না তো?" রিঙ্কি এসে জড়িয়ে ধরল তার বাবাকে।
"অফিসে যাওয়াটা তো খুব দরকার কিন্তু তোমার মাম্মি যেতে দিচ্ছে কই?"
"তোমার মনে নেই ডক্টর কি বলেছে? বৃষ্টি তোমার জন্য খুব খারাপ, তোমার অ্যাসথেমার সমস্যাটা…"
মায়ের কথা শেষ হওয়ার আগেই কলিংবেল বেজে উঠল। দরজা খুলতেই দেখা গেল তিনজন লোক অ্যাসিড বৃষ্টি নিরোধক বর্ষাতি পরে হাতে ব্রিফকেস নিয়ে ঢুকে পড়ল। ওদের দেখে রিঙ্কির বাবার ঠোঁটের কোণে একটা মৃদু হাসি ফুটে উঠল। ভুতো বুঝল এদের জন্যই অপেক্ষা করছিলেন উনি। ওদের নিয়ে রিঙ্কির বাবা তাঁর অফিস ঘরে চলে গেলেন। ভুতো মনে মনে আনন্দিত হল। রিঙ্কি এবার নিশ্চয় তাকে নিয়ে খেলবে।
★★★
"একি দাঁরু কাকা তুমি বৃষ্টিতে এভাবে...!" দাঁড়কাক দাঁরুকে বৃষ্টিতে ভিজে ভিজে ওদের কাছে আসতে দেখে বেশ অবাক হল ডিঙো। বৃষ্টির ছোটে দাঁরুর শরীরের অনেক জায়গায় পালক পুড়ে গেছে।
"আর কি করব বল! এই টানা বৃষ্টির চেয়ে ঘোর অমঙ্গল অপেক্ষা করছে আমাদের জন্য।" হাঁফাতে হাঁফাতে বলল দাঁরু।
"হেঁয়ালী না করে খুলে বলো দেখি ব্যাপারখানা কি!" অধৈর্য্য হয়ে বলল মাঙ্কু।
"বৃষ্টিটা থামতে খাবারের সন্ধানে গিয়েছিলাম শহরের দিকে। ওখানে আমার এক বন্ধু থাকে ভুতো। রিঙ্কি বলে একটা মেয়ের পোষা কুকুর সে। ভুতোর মুখেই শুনলাম ভয়ানক খবরটা।"
"কি খবর?"
"ভুতো বলল রিঙ্কির বাবা, মানুষের রাজা আর ওই বিজ্ঞানী না কি যেন বলে না… ওরা সব মিলে এক মারাত্মক জিনিস বানাচ্ছে যুদ্ধ করবে বলে। রিঙ্কি ভুতোকে বলেছে ওই যুদ্ধ হলে নাকি পৃথিবী ধ্বংস হয়ে যাবে। আমরা কেউ বাঁচব না রে।" কাঁদো কাঁদো গলায় বলল দাঁরু।
মাঙ্কু বলল, "বাহ রে পৃথিবীটা কি ওদের একার যে ইচ্ছে হলেই ধ্বংস করে দেবে!"
"ওরা তো তাই ভাবে রে।" গলাটা একটু ঝেড়ে নিয়ে বলল মারুক। ডিঙো অবাক গলায় বলল, "আর ওই রিঙ্কি বলে মেয়েটা সব জেনেও কিছু করবে না?"
"আরে সে তো বাচ্চা মেয়ে, সে কি করবে?"
"কিন্তু আমরা তো বড়, আমরা কি করছি?" গম্ভীর গলায় বলল শেয়াল শিলু। মাঙ্গা হাতি বলল, "আমরা তো পশু, মানুষের সঙ্গে এঁটে উঠব কি করে?"
"আমরা যদি এক জোট হই তাহলে মানুষ পারবে আমাদের সঙ্গে? আমরা কিছু না করা সত্ত্বেও মানুষ আমাদের কাছাকাছি আসতে ভয় পায়, তাহলে আমরা যদি একজোট হই তাহলেও আমরা কিছু করতে পারব না?" কান নাড়িয়ে বলল শিলু। মারুক বলল, "আমি শিলুর সঙ্গে একমত। আমরা চেষ্টা করি না তাই পারি না। কিন্তু এবার আমাদের চেষ্টা করতেই হবে। এমনিতেই মানুষের খামখেয়ালীপনার জন্য আমরা কম কষ্ট পাচ্ছি না, আবার নতুন করে যদি কিছু হয় তাহলে কেউ বাঁচব না আমরা।"
"ঠিক। তাই আমাদের এক জোট হয়ে রুখে দাঁড়াতেই হবে। কি রাজি বন্ধুরা?"
"রাজি" "রাজি"....
সমবেত কণ্ঠের সম্মতি শুনে উঠে দাঁড়াল শিলু। তারপর মুখটা ওপরের দিকে তুলে ডাক ছাড়ল, "হুক্কা হুয়া… বিদ্রোহ শুরু…"
★★★
রিঙ্কির মনটা ভালো লাগছিল না। ভেবেছিল আজকে বাবার সঙ্গে খেলা যাবে, কিন্তু তা না বাবার অফিসের লোকজন চলে এলো বাড়িতেই আর মিটিং শুরু হয়ে গেল। মিটিং আবার শেষও হচ্ছে না। এই নিয়ে চতুর্থ বার ওদের রোবট ভৃত্য জিগি স্ন্যাকস আর কফি নিয়ে ঢুকছে বাবাদের মিটিং এর ঘরে। এই সুযোগে রিঙ্কি একবার এসে উঁকি দিল ওই ঘরে। দেখল বাবা আর বাকিদের মুখগুলো কেমন গম্ভীর। এমনিতে ঘরটা সাউন্ড প্রুফ হলেও এখন দরজা খোলা থাকায় রিঙ্কির কানে এসে লাগল কয়েকটা শব্দ।
"স্যার আমরা যদি আগে বোমাটা নিক্ষেপ করি প্রতিবেশী দেশের ওপর তাহলে কিন্তু তৃতীয় মহাযুদ্ধ লাগতে বাধ্য।"
"জানি চৌধুরী, কিন্তু আমরা এগিয়ে না গেলে ওরাই আগে আমাদের আক্রমণ করবে। মহাযুদ্ধ লাগবেই। এড়িয়ে যাওয়ার উপায় নেই। তারচেয়ে… আর আমাদের হাতে এই শক্তিশালী পারমাণবিক অস্ত্র তো আছেই।"
বাবার কথাটা শেষ অবধি শোনার আগেই ঘরের দরজা বন্ধ হয়ে গেল। রিঙ্কির মনটা খচ খচ করতে লাগল। মহাযুদ্ধ মানে কি! তৃতীয় বলছ, মানে আগেও এই যুদ্ধ হয়েছে! এখন আর ইতিহাস পড়ানো হয় না তাই যুদ্ধবিগ্রহের ব্যাপারে বিশেষ কিছু জানে না রিঙ্কি। এখন ইস্কুলে শুধু বিজ্ঞান, গণিত, অর্থনীতি, বাণিজ্য এইসব পড়ানো হয়। তবুও রিঙ্কির অতীতকে জানতে ভালো লাগে বলে সে মাঝেমাঝেই তার স্পেশ্যাল কম্পিউটার খুলে অতীতের গল্প পড়ে। কিন্তু মহাযুদ্ধের ব্যাপারটা তার অজানা। তাই আর দেরি না করে রিঙ্কি তার ঘরে গিয়ে কম্পিউটার খুলে বসল। ভয়েস সার্চে গিয়ে বলল "মহাযুদ্ধ"....
একটার পর একটা পাতা খুলে যেতে থাকল, একটার পর একটা ছবি খুলে যেতে থাকল চোখের সামনে… আতঙ্কে রিঙ্কির সারা শরীর দিয়ে হিম শীতল স্রোত বয়ে গেল। দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের সঙ্গে পারমাণবিক বোমার সম্পর্ক পড়তে পড়তে আর থাকতে পারল না রিঙ্কি, ভুতোকে কোলে নিয়ে ডুকরে কেঁদে উঠল।
বাবারা তো সব জানে, তাও কেন আবার…!
★★★
ভোর চারটা…
যাঁরা অস্ত্র তৈরির কারখানায় সারারাত কাজ করছিলেন তাঁরা কোয়ার্টারে গিয়ে একটু বিশ্রাম নেবেন বলে প্রস্তুতি নিচ্ছেন। নাইট ডিউটিতে থাকা অন্যান্য কর্মচারীদেরও চোখ ঢুলু ঢুলু। মর্নিং শিফটের কর্মচারীরা আড়মোড়া ভাঙতে ব্যস্ত।
আচমকা কারখানার মাটিটা কেঁপে উঠল। সবাই চমকে উঠে ভাবল ভূমিকম্প নাকি! কিন্তু বেশি কিছু বোঝার আগেই দেখল একরাশ ধুলো এগিয়ে আসছে ওদের দিকে… ওই ধুলোর ঝড়ের মধ্য থেকে ভেসে আসছে সমবেত চিৎকার। মনে হচ্ছে যেন জঙ্গলের সব পশু একজোট হয়ে ধেয়ে আসছে এ'দিকেই।
কারখানার মধ্যে থাকা মানুষগুলো যে যেদিকে পারল ছুটে পালাল। ধুলোর ঝড়টা কারখানার মধ্যে ঢুকে পড়ল হুড়মুড়িয়ে…
"না এ হতে পারে না…"
টেলিমোবটা অফ করে ধপ করে সোফায় বসে পড়লেন রিঙ্কির বাবা। থরথর করে কাঁপছেন তিনি। রিঙ্কি আর ওর মা ছুটে এল, "কি হল? কি হল?"
"সব শেষ" , দুহাতে মুখ ঢেকে ফেললেন রিঙ্কির বাবা, "কোথা থেকে পশুদের একটা বিরাট দল এসে সব শেষ করে দিল। আমাদের প্রধান অস্ত্র তৈরির কারখানা প্রায় ধূলিসাৎ হয়ে গেছে… হায় হায়..."
★★★
"বন্ধুগণ আমরা আমাদের প্রথম অভিযানে সফল হয়েছি। যদিও এই অভিযানে আমাদের কিছু বন্ধুকে শহীদ হতে হয়েছে, কিছুজন আহত হয়েছে। তবুও আমরা সফল হয়েছি বন্ধুরা। এবার আমাদের পরবর্তী অভিযানের প্রস্তুতি নিতে হবে।"
উঁচু পাথরটার ওপর দাঁড়িয়ে সকলের উদ্দেশ্যে চিৎকার করে কথাগুলো বলল ডিঙো।
"কিন্তু আমার একটা প্রশ্ন আছে বন্ধু।" বলল শিলু।
"বলো।"
"আমাদের পরিসর সীমিত। আমরা এইটুকু জায়গার মানুষদের পরিকল্পনা বানচাল করলাম। কিন্তু অন্য জায়গাগুলোর কি হবে? ভুতো দাঁরু ভাইকে বলেছিল প্রতিবেশী দেশও নাকি অমন ভয়ানক অস্ত্র বানাচ্ছে!" চিন্তিত মুখে কথাগুলো বলল শিলু।
"চিন্তা কোরোনা বন্ধুরা।"
আচমকা আকাশের দিক থেকে কথাটা ভেসে আসতেই মুখ তুলে তাকাল সবাই। দেখল একটা টিয়া এসে বসেছে গাছের ডালে। সে বলে উঠল, "চিন্তার কোনো কারণ নেই। আমি ও আমার পাখি বন্ধুরা উড়ে উড়ে চারিদিকে ছড়িয়ে পড়ছি যাতে অন্য জায়গায় পাখি বন্ধুদের সাথে সংযোগ স্থাপন করা যায়। আমরা ওদের সবটা বুঝিয়ে বলব, বলব আজকের এই অভিযানের সাফল্যের কথাও। এইভাবেই দূরে দূরে থাকলেও অন্য জায়গায় পশুপাখি বন্ধুরা আমরা ঠিক একজোট হয়ে নিজের নিজের জায়গার মানুষের দুষ্ট পরিকল্পনাকে বানচাল করে দিতে পারব।"
"খাসা পরিকল্পনা টিয়া বোন।" আনন্দে হাততালি দিয়ে উঠল রোবু, "মানুষরা কাছাকাছি যাওয়ার সুযোগ পেয়েও একজোট হতে পারে না তো কি হয়েছে, আমরা না-মানুষরা দূরে থেকেই একজোট হবো। একজোট হয়ে আমরা রক্ষা করব এই পৃথিবীকে, রক্ষা করব আমাদের পরবর্তী প্রজন্মকে।"
★★★
রিঙ্কিদের বাড়ির সবার আজ খুব মন খারাপ। ভুতো তাই ওদের বিরক্ত না করে ছাদে বসে আছে। তার আনন্দ আজ সীমাহীন। রিঙ্কি মাঝেমাঝে তার কম্পিউটার থেকে কবিতা পড়ে শোনায় ভুতোকে। আজকে ভুতোর একটা কবিতার কথা ভীষণ মনে পড়ছে। কি যেন বলেছিল রিঙ্কি ----
" এ বিশ্বকে এ শিশুর বাসযোগ্য করে যাব আমি—
নবজাতকের কাছে এ আমার দৃঢ় অঙ্গীকার।
অবশেষে সব কাজ সেরে,
আমার দেহের রক্তে নতুন শিশুকে
করে যাব আশীর্বাদ,
তারপর হব ইতিহাস।।"
