ম্যাংগো
ম্যাংগো
আচ্ছা সবাই যদি কোনো কারণে তোমাদের নিয়ে হাসাহাসি করে তখন তোমাদের কেমন লাগবে? ভালো না নিশ্চয়! ম্যাংগোরও না মোটেও ভালো লাগতো না যখন ওর বন্ধুরা ওকে নিয়ে হাসাহাসি করত কিংবা দলের বয়োজ্যেষ্ঠ সদস্যরাও বিভিন্ন ভাবে ওর পায়ের খুঁতটা নিয়ে রঙ্গ তামাশা করতেন।
ওহো ম্যাংগো কে সেটাই তো তোমাকে বলা হয়নি এখনও তাই না! আরে ম্যাংগো হলো গিয়ে একটি ছোট্ট বুনো হাতি। জঙ্গলে সে তার মায়ের সঙ্গে থাকে। অবশ্য শুধু তার মা নয়, তাদের একটা বেশ বড়সড় দল আছে, সেই দলের সঙ্গেই থাকে পুঁচকে ম্যাংগো। কিন্তু জানো তো ম্যাংগোর না ভারী দুঃখ। ওর একটা পা যে ছোটোর থেকেই খুঁতো। সেই অনেকদিন আগের কথা, তখন ম্যাংগো আরও অনেকটা পুঁচকে ছিলো। সেই সময় একদিন পা পিছলে ও পড়ে গিয়েছিল একটা গর্তে আর তাতেই ওর পায়ে চোট লেগে যায়। মা সহ দলের বাকিরা অনেক কসরৎ করে ওকে গর্ত থেকে টেনে তুললেও ওর পায়ের আঘাতটা সারাতে পারেনি কেউই। তখন থেকে ম্যাংগো খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে হাঁটে। দলের সবার পেছনে পেছনে চলে সে। এই নিয়ে সবাই তাকে উপহাস করে। বন্ধুদের সাথে লাফিয়ে ঝাঁপিয়ে খেলতে পারেনা বলে বন্ধুরাও তাদের আনন্দে সামিল করতে চাইনা ম্যাংগোকে। এসব নিয়ে ভারী দুঃখে থাকে ম্যাংগো। রাত হয়ে গেলে যখন দলের সবাই ঘুমিয়ে পড়ে তখন ম্যাংগো মায়ের পেটে মুখ গুঁজে খুব কাঁদে মাঝেমাঝে। ম্যাংগোর কান্না দেখে মায়েরও চোখে জল এসে যায়। তবুও মা ওকে সান্ত্বনা দিয়ে বলেন যে এমন একদিন ঠিক আসবে যেদিন ম্যাংগোও বীরের মত কোন কাজ করতে আর সবাই জয়জয়কার করবে ওর। মা বলেন ম্যাংগো সবার থেকে আলাদা তাই সবার চেয়ে সেরা সে। মায়ের কথাগুলো শুনলেই ম্যাংগোর মনটা ভালো হয়ে যায়। মা যখন ওকে শুঁড় তুলে আশীর্বাদ করেন তখন ম্যাংগো বুকের মধ্যে বল পায়, সে মনে মনে নিজেকে বলে সেও একদিন ঠিক বীরের মত কিছু একটা করে দেখাবে।
ম্যাংগোরা যে জঙ্গলে থাকে সেই জঙ্গলের মধ্যিখানে আছে একটা প্রকান্ড জলাশয়। সেখানে সক্কাল সক্কাল একবার আর সন্ধ্যে নামার মুখে একবার ম্যাংগোরা দল বেঁধে যায় জল খেতে। শুধু খেতেই না, স্নান করে জল নিয়ে খেলাও করে তারা খুব। কিন্তু ম্যাংগোর ভাগ্যে কি আর এতো আনন্দ আছে! দলে সে সবার পেছন পেছন চলে, ফলে পৌঁছাতে তার খানিক দেরি হয় অন্যদের চেয়ে। আবার জলাশয়ের বেশি গভীরের দিকে গেলে আর উঠতে পারবে না বলে ম্যাংগো সামনের দিকের অগভীর অংশে নেমেই নিজের কাজ সারে। দূরে ওর বন্ধুদের জল নিয়ে খেলা করতে দেখলে ম্যাংগোর বুকটা হুহু করে ওঠে।
তা যেদিনটার গল্প তোমাদের বলছি, সেই দিনটা ছিল গ্রীষ্মকালের অন্যতম গরম একটা দিন। সারাদিন সূর্যের তেজে জ্বলে পুড়ে ম্যাংগোর দলের সবাই অনেক আগেই ছুটে ছুটে চলে গেছে জলাশয়ের কাছে। এদিকে ম্যাংগো পড়ে রয়ে গেছে অনেক পেছনে। এই গরম কালে পথ চলতে যেন আরও কষ্ট। দুলকি চলে হাঁটছিল ম্যাংগো। বিকেল নামতেই জঙ্গলের ভেতরে একটা মৃদু বাতাস দিতে শুরু করেছে, মন্দ লাগছিল না বাতাসটা। কিন্তু আচমকাই বাতাসের সঙ্গে একটা অদ্ভুত গন্ধ ভেসে এসে লাগলো ম্যাংগোর নাকে। ভালো করে গন্ধটা শোঁকার চেষ্টা করতেই ম্যাংগো বুঝলো এটা বনের কোনো পশুর গন্ধ ন
য়, বা গাছপালা থেকে ছড়ানো কোনো গন্ধও নয়। তাহলে…! জঙ্গলের ভেতর কি বাইরে থেকে কেউ এসে ঢুকেছে! একটু সতর্ক হয়ে এদিক ওদিক তাকাতে লাগলো ম্যাংগো। আর তখনই ব্যাপারটা নজরে পড়ল ওর। দেখলো দুটো মানুষ দুটো ইয়া বড় বন্ধুক হাতে দাঁড়িয়ে ফিসফাস করে কিসব কথা বলছে। মানুষের ভাষা ম্যাংগো বোঝে না, কিন্তু লোকদুটোকে দেখা মাত্রই ওর চোখের সামনে ভেসে উঠল কয়েক বছর আগের একটা দৃশ্য। এই রকমই বড় বন্ধুক হাতে কয়েকটা মানুষ এসে গুলি করে মেরে ফেলেছিল ম্যাংগোর বাবা সহ আরও একটা হাতিকে। দুমদাম গুলি চালিয়েছিল ওরা, তাতেই ছত্রভঙ্গ হয়ে পড়েছিল ওদের দলটা, ম্যাংগো কিভাবে যেন পালাতে গিয়ে পড়ে গিয়েছিল ওই গর্তে। সেখানেই ওর পা’টা চোট পায় আর শুরু হয় ওর চরম দুর্দশা। মায়ের কাছে শুনেছে এই লোকগুলো নাকি খুব দুষ্ট, খুব লোভী। এরা হাতিদের মেরে তাদের দাঁত খুলে নিয়ে যায়। মানুষের সমাজে নাকি হাতির দাঁতের খুব দাম।
পুরোনো কথা গুলো মনে পড়ে যেতেই আরও সতর্ক হলো ম্যাংগো। দেখলো একটা লোক চড়ে বসেছে একটা গাছের মাথায়, আর অন্য লোকটাকে অবশ্য দেখা যাচ্ছেনা। ম্যাংগো মুহূর্তের মধ্যে স্থির করে ফেলল তাকে কি করতে হবে। সে যতটা সময় দ্রুত এসে গাছটার গায়ে লাগল একটা মোক্ষম ধাক্কা। গাছের ওপরে চড়ে বসে থাকা লোকটা তখনও গাছের ওপর ঠিক যুৎ করে উঠতে পারেনি, আর এদিকে এমন আকস্মিক ধাক্কা আসতে পারে এটাও ছিল তার কল্পনার বাইরে। তাই ম্যাংগোর এক ধাক্কাতেই সে বাবা গো মা গো বলে পড়ল প্রপাত ধরণী তলে। ম্যাংগো শুঁড় তুলে একটা হুঙ্কার ছাড়লো, তারপর শুঁড়ে করে পেঁচিয়ে শূন্যে তুলে দিলো লোকটাকে। কিন্তু একি ওদিকে যে লোকটার সঙ্গীটা ওর চিৎকার শুনে এসে পড়েছে এদিকে। ম্যাংগোর দিকে তাক করে আছে বন্দুক। ঘাবড়ে গেল ম্যাংগো, কিন্তু পরমুহূর্তেই মায়ের বলা কথাটা মনে পড়ে গেল। মা সবসময় বলেন বিপদের সময় না ঘাবড়ে মাথা ঠান্ডা রাখতে হয়। একটা জোরে নিশ্বাস ছাড়লো ম্যাংগো, আর তারপরেই ওর শুঁড়ে পেঁচানো লোকটাকে আরও শূন্যে তুলে ছুঁড়ে ফেলে দিলো ওর সঙ্গীকে লক্ষ্য করে। প্রথম লোকটা গিয়ে পড়ল দ্বিতীয় লোকটার গায়ের উপর। লোকদুটো ব্যাথায় কঁকিয়ে উঠল। দ্বিতীয় লোকটার বন্দুক থেকে বেরোনো গুলিটা ছিটকে গিয়ে লাগলো একটা গাছে। ম্যাংগো আনন্দে আবার শুঁড় তুলে চিৎকার করে উঠল।
এদিকে ম্যাংগোর দলের লোকেরা এদিক থেকে বিভিন্ন আওয়াজ শুনতে পেয়ে স্নান করা ছেড়ে ছুটে এলো। দুটো বন্দুক সহ লোকদুটোকে ওভাবে পড়ে থাকতে দেখে ব্যাপারটা আর বুঝতে বাকি রইল না কারুরই। সবাই অবাক হয়ে দেখলো যে ম্যাংগোর ওপর এতদিন তারা হাসাহাসি করে এসেছে সেই ম্যাংগো আজ কেমন সবাইকে বিপদের হাত থেকে রক্ষা করেছে। দলপতি এগিয়ে এসে ম্যাংগোর মাথায় শুঁড় বুলিয়ে বললেন, “সাব্বাশ ম্যাংগো। তুমি সত্যিকারের একজন বীর।”
দলের বাকি সবাই তখন উল্লাসে ম্যাংগোকে এসে ঘিরে ধরে চিৎকার করে উঠল, “ম্যাংগো হিপ হিপ হুররে… হিপ হিপ হুররে।”
আর ভীড়ের ফাঁক দিয়েই ম্যাংগো দেখতে পেলো একটু দূরে দাঁড়িয়ে রয়েছে তার মা। মায়ের চোখে আজও জল, তবে ম্যাংগো বুঝলো এ জল দুঃখের নয়, এ জল গর্বের।
শেষ।