Sayandipa সায়নদীপা

Children Stories

3  

Sayandipa সায়নদীপা

Children Stories

মহেশগড়ে মহাবিপদ

মহেশগড়ে মহাবিপদ

29 mins
755



পূব আকাশে একফালি লাল আভা দেখা দিয়েছে সবে, পাখিরাও সব আলমোড়া ভাঙতে ব্যস্ত এখনো, বিছানায় শুয়েই ঝিলমিল শুনতে পেলো শব্দটা। রাজবাড়ির ঘোষকের বাদ্যির আওয়াজ। একটা দীর্ঘশ্বাস ফেললো ঝিলমিল, ঘোষণার টুকরো টুকরো শব্দ কানে এসে লাগছে তার। অবশেষে তবে সেই দিনটা চলেই এলো!


                     ১


  রাজ্যের নাম মহেশগড়। পাহাড়-পর্বত, গাছ-গাছালি, নদী দিয়ে ঘেরা এক শান্ত জায়গা। রাজ্যের রাজামশাইও ভীষণ ভালো মানুষ, প্রজাদের সুখ দুঃখের দিকে সদাই তাঁর নজর। কিন্তু এহেন রাজমশাইয়ের চরিত্রের এমন একটি দুর্বলতা রয়েছে যার জেরে মহেশগড়ের প্রজাদের আজ চরম দুঃসময় এসে উপস্থিত - রাজকুমারী বিম্ববতী, রাজমশাইয়ের একমাত্র কন্যা। মা মরা এই মেয়েটি রাজমশাইয়ের চোখের মণি, মেয়ের সব আব্দার মেটাতে তিনি সদাই প্রস্তুত। বিম্ববতী বিবাহযোগ্যা হওয়ার পর থেকেই তার বিবাহ নিয়ে রাজমশাইয়ের চিন্তার অন্ত নেই। এই কিছুদিন আগেই বিম্ববতী গিয়েছিল পাশের রাজ্য কুন্দপুরে, সেখানকার রাজকুমারী কুমুদকুমারী বিম্ববতীর সখী। রাজামশাই ভেবেছিলেন মেয়ে সখীর কাছ থেকে ফিরলেই ধুমধাম করে স্বয়ম্বরের আয়োজন করবেন, দেশ বিদেশ থেকে বড় বড় সব রাজকুমারদের আমন্ত্রণ জানাবেন স্বয়ম্বরে। কিন্তু বিধি বাম। সখীর সঙ্গে সাক্ষাৎ করে ফিরে এসে রাজকুমারী বাবার কাছে এক আব্দার করে বসল। সে বলল বিবাহ করলে এই রাজ্যেরই কোনো যোগ্য সুপুরুষকে বিবাহ করবে নচেৎ নয়। এই অবধি তো সব ঠিকই ছিল, কিন্তু তারপরেই রাজকুমারী দিলো তার অদ্ভুত শর্ত। সে বলল রাজ্যের সব যুবককে এক প্রতিযোগিতায় অংশ নিতে হবে, যে শেষমেশ উত্তীর্ণ হবে সব খেলায় সেই রাজকুমারীর পানিগ্রহণ করতে সক্ষম হবে। প্রতিযোগিতার সব খেলা স্থির করবে রাজকুমারী নিজে এবং খেলার বিষয় সকলকে তাৎক্ষণিক জানানো হবে, আগের থেকে কেউ কোনোরকম প্রস্তুতি নিতে পারবে না। রাজকুমারীর শর্তে গোটা রাজ্যজুড়ে এক অন্যরকম উন্মাদনা দেখা দিল, সব যুবকরা টগবগ করে ফুটতে শুরু করল উত্তেজনায়। সবাই ভাবল দারুণ কিছু একটা ঘটতে চলেছে, কিন্তু সে যে এমন দারুণ রকমের ভয়ঙ্কর হতে চলেছে তা তখন ঘূর্ণাক্ষরেও টের পায়নি কেউ। প্রথমদিনের খেলায় রাজকুমারী শর্ত দিলো তাদের রাজ্যের পাশ দিয়ে বয়ে চলা মহেশ নদের জলে সারারাত করে সাঁতার কাটতে হবে প্রতিযোগিদের। এমনিতে মহেশপুরের বলিষ্ঠ যুবকদের কাছে এ খেলা কোনো ব্যাপারই নয় কিন্তু এখন যে শীতকাল! রাতে মহেশ নদের জল বরফের চেয়েও ঠান্ডা হয়ে ওঠে, তাই তো এহেন খেলার কথা শুনে শিউরে উঠল সবাই। কিন্তু রাজকুমারীর শর্ত কেউ প্রতিযোগিতা থেকে পিছিয়ে আসতে পারবেনা, যেই পিছিয়ে যাবে তাকেই শূলে চড়ানো হবে। অগত্যা আর উপায় কি, এদিকেও বিপদ সেদিকেও বিপদ। পাঁচদিন ধরে ভাগ ভাগ করে প্রতিযোগিতার আসরে নামলো রাজ্যের সকল যুবক। কয়েকজন দুর্ভাগ্যের শিকার হল আর কয়েকজন ঠান্ডায় জমতে জমতেও উত্তীর্ণ হয়ে গেল কোনোক্রমে। এর কয়েকদিন পর দ্বিতীয় খেলার শর্ত দিলো রাজকুমারী। আরও ভয়ঙ্কর এক খেলা, সে খেলার নাম শুনেই হৃৎপিণ্ড লাফিয়ে ওঠে সবার। ফাঁকা ময়দানে এক পাগল ষাঁড়ের সঙ্গে একা হাতে লড়াই করতে হবে প্রতিযোগীদের। রাজকুমারী নাকি শুনেছে দক্ষিণের কোন রাজ্যে এই খেলা নাকি ভারী জনপ্রিয়। তা যাইহোক, বলাই বাহুল্য এই ভয়ানক খেলায় রাজ্য থেকে হারিয়ে গেল আরও কয়েকজন যুবকের নাম। রাজামশাই আতঙ্কিত হয়ে কন্যাকে অনুরোধ করলেন এ খেলা বন্ধ করতে কিন্তু রাজকুমারী অনড়। কেন কে জানে রাজামশাই মেয়ের এই নিষ্ঠুর ইচ্ছের বিরুদ্ধে আর কিছু বলতে পারলেননা, শুধু মুখ বুজে দেখলেন কত তরতাজা প্রাণকে হারিয়ে যেতে, তার রাজ্যের যারা বল ছিল তাদের শেষ হয়ে যেতে। যারা ষাঁড়ের সঙ্গে লড়াইতে টিকে গেছে তাদেরও শরীরের বেহাল দশা, ক্ষতয় ক্ষতয় জরাজীর্ণ তাদের সারা শরীর। কিন্তু এহেন দৃশ্য দেখেও রাজকুমারীর মনে বিন্দুমাত্র মায়া জাগলোনা, সে বরং বেশ আরাম করে উপভোগ করল এই মারণ খেলা। সবাই অবাক হলো বিম্ববতীর এই পাথরের ন্যায় আচরণে, কিন্তু তাকে বাধা দেবে কার সাধ্যি!


                    ২


  ঝিলমিলদের বাড়ি এই রাজ্যেরই শেষ প্রান্তে। ওর দাদাও রাজকুমারীর এই বিশেষ প্রতিযোগিতার একজন প্রতিযোগী। সেদিন ষাঁড়ের সঙ্গে লড়াই করে ফিরে আসার পর থেকে সে শয্যাশায়ী, ফর্সা ত্বক বদ্যিমশাইয়ের লাগানো লতার প্রলেপে কালো। দাদার দিকে একবার তাকিয়ে মায়ের কাছে এলো ঝিলমিল, তারপর হতাশ গলায় বলল, “দাদা এই অবস্থায় কি করে খেলবে পরের খেলা?” 

“সে নিয়ে তোকে ভাবতে হবে না।” বিছানায় শুয়েই ঝাঁঝিয়ে উঠল দাদা, মাও চুপ করে রইল। ঝিলমিল আর কিছু না বলে চুপচাপ সরে এলো সেখান থেকে। সে জানে তার গায়ের রং কালো বলে তাকে কেউ পছন্দ করেনা। দাদা তো নিজের বোন বলে পরিচয় দিতে লজ্জা পায়। আগে আগে কষ্ট পেতো ঝিলমিল, এখন আর গায়ে মাখে না এসব।


   ঝিলমিলের বাবা ধরে ধরে ওর দাদাকে রাজবাড়ির প্রাঙ্গনে আনল। সেখানে এসে দেখল বাকি প্রতিযোগিদের অবস্থাও প্রায় একই রকম, কেউ হাঁটতে অবধি পারছেনা ঠিক করে। ঝিলমিল অবাক হয়ে ভাবল এই অবস্থায় এরা সবাই খেলবে কি করে! আর রাজকুমারীর পরের খেলাটা হবেই বা কি! 

কিছুক্ষণের মধ্যেই বাদ্যি বাজার শব্দ ভেসে এলো, সভাসদ পরিবেষ্টিত হয়ে রাজকুমারী আর রাজামশাই প্রবেশ করলেন প্রাঙ্গণে। আর তারপরেই রাজকুমারী ঘোষণা করলো তাঁর শেষ খেলা, “আজকে আমি একটা তীর নিক্ষেপ করবো নিজের হাতে, প্রতিযোগিদের কাজ হবে সেই তীরটাকে খুঁজে আনা। যে আমার কাছ অবধি তীরটা নিয়ে পৌঁছাতে পারবে সেই হবে বিজয়ী।”

রাজকুমারীর কথা শেষ হওয়া মাত্রই চাপা গুঞ্জন ওঠে সকলের মধ্যে। একটা তীর… কিন্তু প্রতিযোগী একাধিক। এই আপাত সহজ খেলাটার জন্য তো তারমানে প্রতিযোগীদের নিজেদের মধ্যে লড়াই করতে হবে! এমন হলে তো সমূহ সর্বনাশ। রাজামশাই প্রতিবাদ করতে গেলেন এবার কিন্তু রাজকুমারী তাঁর চোখের দিকে একবার তাকাতেই থমকে গেলেন রাজামশাই। দু'জন দাসী রাজকুমারীর জন্য তীর-ধনুক আনল। কিন্তু আসল বিস্ময়ের এখনও অনেক বাকি ছিলো। তীর ধনুক হাতে নিয়ে রাজকুমারী একটি নির্দিষ্ট দিকে তা তুলে ধরতেই আরেকবার শিউরে উঠল উপস্থিত সকলে। ওইদিকেই তো কুখ্যাত গনগনের জঙ্গল! সে জঙ্গলে তো হিংস্র জন্তুর সঙ্গে সঙ্গে দৈত্য দানোর বাস, কেউ এমনিতেই জঙ্গলের পাশ দিয়ে যেতে ভয় পায় আর এখন…! কিন্তু বিম্ববতী কারুর কথা শোনার পাত্রী নয়, সে সজোরে তীরটা নিক্ষেপ করলো গনগনের জঙ্গলের দিকে। তীরটা যেন কিছুটা গিয়ে মিলিয়ে গেলো বাতাসে। রাজামশাই একটা দীর্ঘশ্বাস ফেললেন, তারপর কাঁপা কাঁপা গলায় বললেন, "প্রতিযোগীরা চাইলে আগে একবার বাড়ি ফিরে প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র নিয়ে তারপর যাত্রা শুরু করতে পারে।"


                       


                     ৩


বাড়িতে মা উদগ্রীব হয়ে অপেক্ষা করছিলেন ওদের ফিরে আসার। বাড়ির কাছাকাছি ওদের দেখতে পেয়েই ছুটে ঘর থেকে বেরিয়ে এলেন মা। উদ্বিগ্ন স্বরে জানতে চাইলেন, "শেষ খেলাটা কি?"

বাবা মা'কে সব কথা খুলে বলার পরেই ডুকরে কেঁদে উঠলেন তিনি। আর ওদিকে কে যেন চিৎকার করে উঠল আচমকা, "রাক্ষসী… রাক্ষসী… ও রাক্ষসীর কোনোদিনও ভালো হবে না দেখে নিও তোমরা…" 

ঝিলমিলরা তাকিয়ে দেখল পাশের বাড়ির সরলা কাকিমা কখন যেন এসে দাঁড়িয়েছেন ওদের কাছে। সরলা কাকিমার ছেলে পবন দাদা ক'দিন আগেই ষাঁড়ের খেলায় প্রাণ হারিয়েছে, তারপর থেকে কাকিমা কেমন পাগল পাগল হয়ে গিয়েছেন। বাবা একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে দাদাকে বললেন, "ঘরে চল।" কিন্তু দাদা এগোতে যেতেই টলে গেল বাবার কাঁধের ওপর। আসলে দুর্বল শরীরে এতটা যাতায়াতের ধকল নিতে পারেনি। পবন দাদার বাবাও ইতিমধ্যে এসে উপস্থিত হয়েছিলেন সেখানে। তিনি বললেন, "এখনই যে দাঁড়াতে পারছেনা সে গনগনের জঙ্গলে তীর খুঁজতে যাবে কিভাবে?" 

কাকুর কথার পর আর কথা বলতে পারল না কেউই। কোনোমতে দাদাকে ধরে এনে খাটে শুইয়ে দিল ঝিলমিল আর বাবা। মা সেই তখন থেকে কেঁদেই যাচ্ছেন এক নাগাড়ে। বাবার কপালেও চিন্তার ভাঁজ। সত্যিই এ কার পাল্লায় পড়ল তারা! অন্য যুবকদের পরিণতির কথা মনে পড়তেই শিউরে উঠল ঝিলমিল। দাদা তাকে যতই অবহেলা করুক, সে দাদাকে খুব ভালোবাসে।


   গুটিগুটি পায়ে রান্নাঘরে এসে দাদার ক্ষতগুলোয় লাগানোর জন্য জড়িবুটি বাটতে লাগল ঝিলমিল, আর বাটতে বাটতেই তার মনের মধ্যে একটা ভাবনা ঝিলিক দিয়ে উঠল। সবাই তো বলে সে নাকি হুবহু দাদার মত দেখতে, শুধু গায়ের রং টাই যা কালো। তাহলে…

জরিবুটি বাটা থামিয়ে রেখে ছুটে দাদার ঘরে এসে ঢুকলো ঝিলমিল। ওকে খালি হাতে আসতে দেখে ধমকে উঠলেন মা, কিন্তু ঝিলমিল সেদিকে আমল না দিয়ে বলে উঠল, "আচ্ছা দাদার পরিবর্তে যদি আমি যাই গনগনের জঙ্গলে?"

ওর কথা শুনে বাকিরা সবাই এতটাই হতভম্ব হয়ে গেল যে কেউ কোনো কথা বলতে পারলনা প্রথমে। তারপর দাদা তাচ্ছিল্য ভরে বলে উঠল, "আহা সবাই যেন চোখে ঠুলি পরে থাকে, কেউ বুঝতে পারবে না যেন কিছু?"

বাবা দাদাকে সমর্থন করলেন। ঝিলমিল বলল, "আহা তোমরা একবার ভেবেই দেখোনা। আমি দাদার পোশাক পরে মুখ ঢেকে বেরোবো তো। কেউ কিচ্ছু বুঝতে পারবে না।"

ঝিলমিলের কথা শুনে এবার আর মুখে কথা ফুটলো না কারুর। ঝিলমিল সেই দেখে বলল, "দাদা এই শরীর নিয়ে কি করে যাবে জঙ্গলের দিকে! কিন্তু আবার না গেলেও যে চলবে না। রান্নাঘর থেকে এই মাত্র উঁকি দিয়ে দেখে এলাম রাজকুমারীর লোক নজর রাখছে আমাদের বাড়ির দিকে।"

"সেকি! উফফ কি রাক্ষুসী মেয়ে বাবা ওই রাজকুমারী!" বিলাপ করে উঠলেন মা। বাবা বললেন, "চুপ চুপ কেউ শুনে ফেললে মুশকিল।"

"তাহলে দাদার বদলে আমি যাই...কেমন?"


  রাতের অন্ধকারে দাদার পোশাক পরে মুখে একটা কাপড় জড়িয়ে বেরিয়ে পড়ল ঝিলমিল। বাইরে এখন কনকনে ঠান্ডা, হিম পড়ছে জোরদার। দাঁতে দাঁত কপাটি লেগে যাচ্ছে, কিন্তু তাও উপায় নেই। এগিয়ে যেতেই হবে। দু'হাতের তালু পরস্পরের সঙ্গে ঘষতে ঘষতে এগিয়ে চলল ঝিলমিল। মাথার ওপর চাঁদটা ছাড়াও আরও একজন সাক্ষী আছে ওর এই নিশুতি অভিযানের। ঝিলমিল স্পষ্ট টের পেলো ওর পেছন পেছন চুপিসাড়ে আসছে কেউ। ও জানে ওটা রাজকুমারীর চর। ঝিলমিল গনগনের জঙ্গলে না ঢোকা অবধি পেছন পেছন আসবে লোকটা, এটাই রাজকুমারীর নির্দেশ। অন্য প্রতিযোগিতারা বিকেল থাকতেই বেরিয়ে পড়েছিল, ঝিলমিল ইচ্ছে করেই রাতের অপেক্ষা করেছে যাতে তাকে কেউ চিনতে না পারে। ঝিলমিল মনে মনে ভাবল সে যদি না ফিরতে পারে তাহলে মা বাবা যেন দাদাকে নিয়ে এই রাজ্য ছেড়ে অন্য কোথাও পালিয়ে যায়, এই ভয়ঙ্কর রাজ্যে যেন আর না থাকে। ঝিলমিলের আর কোনোদিনও ওদের সাথে দেখা হবে কিনা কে জানে! একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলল ও। চাঁদের আলোয় দেখতে পেলো একটা ঝোপের নীচে একটা ছোট্ট বেড়াল পরম নিশ্চিন্তে ঘুমোচ্ছে তার মায়ের কোলে। ঝিলমিল এখন এই পরম নির্ভর আশ্রয় ছেড়ে এগিয়ে যাচ্ছে এক অজানা পথে… ঘরবাড়ি গুলো পেছনে ফেলে এগোতে এগোতে অবশেষে গনগনের জঙ্গলের প্রান্তে উপস্থিত হল ঝিমলি। এতটা হাঁটার ফলে এখন আর তত ঠান্ডা লাগছেনা, শরীরটা বেশ গরম হয়ে উঠেছে। একটা জোরে নিঃশ্বাস নিলো ঝিলমিল। ও জানে গনগনের জঙ্গলে ঢোকা মাত্রই রাজকুমারীর চর এবার ফিরে যাবে মহলে। এতক্ষণ তাও একটা মানুষ আসছিল সঙ্গে সঙ্গে, এবার ওকে এগোতে হবে সম্পূর্ণ একা। গ্রামের সীমানা পেরিয়ে গনগনের সীমানায় পা রাখা মাত্রই কেমন একটা অজানা শিহরণ খেলে গেল ঝিলমিলের শিরদাঁড়া দিয়ে, কারণটা ঠিক বুঝতে পারলোনা ও। একবার পেছন ফিরতেই দেখতে পেলো একটা অস্পষ্ট ছায়ামূর্তি পেছন ফিরে হেঁটে চলেছে গ্রামের দিকে। একটা গাছের তলায় এবার বসল ঝিলমিল। পা দুটো ব্যাথা করতে শুরু করেছে আস্তে আস্তে, শীতকাল বলে শরীরের ক্লান্তিটা এখনও সেভাবে টের পাওয়া যাচ্ছেনা। ঝিলমিলের মনে দ্বিধা, এখন কি একটু বিশ্রাম নেওয়া উচিৎ নাকি এগিয়ে যাওয়া উচিৎ জঙ্গলের আরও ভেতরে! বাকি প্রতিযোগিরা নিশ্চয় অনেকটা এগিয়ে গিয়েছে এতক্ষণে। নাহ, সময় নষ্ট করার মানে হয়না। যতক্ষণ না শরীরটা একদম ক্লান্ত হয়ে পড়ে ততক্ষণ এগিয়ে যাবে বলে মনস্থির করল ঝিলমিল। যেমন ভাবা তেমন কাজ, সঙ্গে আনা লণ্ঠনের বাতিটা একটু উস্কে দিয়েই উঠে দাঁড়াল ঝিলমিল। তারপর গাছ গাছালির ফাঁক দিয়ে এগোতে থাকলো একটু একটু করে। 


  খানিকটা এগোবার পরেই এবার ভীষণ ক্লান্ত লাগতে শুরু করেছিল ঝিলমিলের। ও টের পেলো যে ফাঁকা রাস্তায় হাঁটা আর জঙ্গলের রাস্তায় হাঁটার মধ্যে অনেক পার্থক্য রয়েছে। একে গাছ গাছালির ফাঁক দেখে দেখে পেরোনো, আর তার ওপর তা যদি হয় আবার পাহাড়ের ঢালে বেড়ে ওঠা জঙ্গল তাহলে পরিশ্রমটা হয় আরও দ্বিগুণ। ঝিলমিল বুঝলো বিশ্রাম নেওয়ার সময় উপস্থিত, শরীরটাকে এবার একটু বিশ্রাম না দিলে আর সঙ্গ দিতে রাজি হবেনা সে। কিন্তু জঙ্গলের মধ্যে তো আর মাটিতে শুয়ে পড়া যায়না, কখন কোন হিংস্র পশু আক্রমণ করে বসবে কে জানে! লণ্ঠনটাকে নিভিয়ে ঝোলায় পুরে ফেলল ঝিলমিল, তারপর ঝোলাটাকে শক্ত করে কাঁধের সঙ্গে বেঁধে নিয়ে সে তরতর করে উঠে পড়ল গাছে। গাছটায় উঠতে উঠতে ওর মনে পড়ে গেল ওদের বাড়ির পাশেই ডালপালা মেলে দাঁড়িয়ে থাকা লম্বা পেয়ারা গাছটার কথা। ওই গাছের পেয়ারা পাড়ার অজুহাতেই তো ঝিলমিলের গাছে চড়ায় হাতে খড়ি। আর কোনোদিনও গাছটায় উঠে পেয়ারা পাড়তে পারবে কিনা কে জানে! দীর্ঘশ্বাস ফেলে ঝোলার থেকে একটা ওড়না বের করল ঝিলমিল। তারপর সেই ওড়না দিয়ে নিজের শরীরটাকে একটা ডালের সঙ্গে যথাসম্ভব শক্ত করে বেঁধে নিলো, নয়তো ঘুমের ঘোরে যদি পড়ে যায়! সব ব্যবস্থাপনার শেষে গাছের গুঁড়িতে মাথা ঠেকানো মাত্রই সারারাতের পথশ্রমের ক্লান্তি ঘুম হয়ে নেমে এলো চোখে।


  কতক্ষণ ঘুমিয়েছে খেয়াল নেই ঝিলমিলের। ঘুম ভাঙলো একটা প্রচন্ড গর্জনে। সে গর্জনের তীব্রতা এতোই যে গাছসুদ্ধ কেঁপে উঠল ঝিলমিল। গাছের ওপর থেকে নীচের দিকে তাকাতেই শরীরের রক্ত জল হয়ে গেল ওর। গাছটার ঠিক নীচেই দাঁড়িয়ে আছে একটা অতিকায় বাঘ, বাঘটার দৃষ্টি ঝিলমিলের দিকে। বুকের মধ্যে হাতুড়ি পেটার শব্দ শুরু হল ঝিলমিলের। কি করবে ও এখন! নীচে নামারও উপায় নেই আর একটু পরেই তো নিশ্চয় বাঘটা ওপরে ওঠার চেষ্টা করবে! মনে মনে ভগবানকে একবার স্মরণ করে নিলো ঝিলমিল। বাঘটা গর্জন করতে করতে এবার গাছটাকে ধাক্কা দিতে শুরু করেছে। সামনের ডালটাকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরল ঝিলমিল। কি করবে কিছুই মাথায় আসছেনা ওর। কিছুক্ষণ এভাবে ধাক্কা দিয়েও কাজ হলোনা দেখে বাঘটা এবার গাছের ওপর চড়ার প্রস্তুতি নিতে লাগল। ঝিলমিল বুঝলো ওকে যা করার তাড়াতাড়িই করতে হবে, হাতে আর বেশি সময় নেই। চোখ বন্ধ করে একটা জোরে নিশ্বাস নিলো ও। তারপর চোখ খুলে দেখলো ওর কাছে এখন দুটো রাস্তা খোলা; এক, বাঘটার শিকার হয়ে যাওয়া, আর দুই, এই গাছ থেকে ঝাঁপ দেওয়া। ঝিলমিল তাকিয়ে দেখলো গাছটার ওপাশে গভীর খাদ। ঝাঁপ দিলে ওই খাদে গিয়ে পড়া ছাড়া গতি নেই। কিন্তু আরেকটা কথাও ঠিক যে বাঘের নাগালে পড়লে মৃত্যু নিশ্চিত কিন্তু গাছ থেকে যদি ঝাঁপ দেয় তাহলে সামান্য হলেও বেঁচে থাকার সম্ভাবনা আছে। যেমন ভাবা তেমনি কাজ, আর দেরি করলোনা ঝিলমিল। ও চটজলদি ওড়নার বাঁধনটা খুলতে লাগলো। কাল পড়ে যাওয়ার ভয়ে বেশ শক্ত করে বেঁধেছিল ওটা, এখন তাই বাঁধন খুলতে রীতিমতো বেগ পেতে হলো ওকে। এদিকে বাঘটাও উঠে আসছে একটু একটু করে। ভয় উৎকণ্ঠায় ঝিলমিলের হাত ঘামে ভিজে পিছলে যাচ্ছে বারবার। ও চেষ্টা করছে বাঘটার দিকে না তাকিয়ে নিজের কাজটা করে যেতে। বুকের ভেতর কেমন উথালপাথাল হচ্ছে। আচমকা বাঘটার নিঃশ্বাস পড়ল ওর ঘাড়ের কাছে, আর তৎক্ষণাৎই বাঁধন খুলে গিয়ে ঝিলমিল গড়িয়ে পড়ল খাদের দিকে, তলিয়ে গেল অতল অন্ধকারে….



                    ৪


কেউ যেন মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছে। হাতটা খানিক খসখসে কিন্তু তাও বেশ আরাম লাগছে ঝিলমিলের। ও কি আর বেঁচে নেই! ও কি স্বর্গে চলে গিয়েছে আর কোনো পরী তার মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছে! চোখ দুটো আস্তে আস্তে খুলল ঝিলমিল, আর খুলতেই যাকে দেখতে পেলো তাকে দেখে সজোরে চিৎকার করে উঠল ও। সে অবাক হয়ে বলল, "কিগো মেয়ে এভাবে চিৎকার করলে কেন?"

ধড়ফড় করে উঠে বসে ঠকঠক করে কাঁপতে লাগল ঝিলমিল। এতদিন যাদের কথা গল্পের ছলে শুনে ভয়ে কেঁপেছে আর তাদের সামনে থেকে দেখলে ভয় লাগবে না! ঝিলমিল দেখলো একটা আস্ত দানো বসে আছে ওর সামনে। দানোরটার গাছের রং হলুদ, মাথায় কালো লম্বা কোঁকড়ানো চুলের ভেতর থেকে উঁকি দিচ্ছে দুটো লাল লাল সিং। দানটার কপালে একটাই গোল অতিকায় চোখ আর চোখের একটু নিচের দুটো ততোধিক বড় ঠোঁট, একেবারে এ'কান থেকে সে'কান অবধি চলে গিয়েছে তারা। কানদুটোও আবার আমাদের মত নয়, বরং হাতির কানের মত খানিকটা। দানোটাকে দেখে মনে হচ্ছে এটা একটা বাচ্চা মেয়ে দানো। 

ঝিলমিলকে ওভাবে তাকিয়ে থাকতে দেখে এবার বেশ বিরক্ত হল দানোটা, "কিগো মেয়ে অমন ড্যাবড্যাব করে কি দেখছো?"

"আ… আ…" গলা দিয়ে স্বর ফুটল না ঝিলমিলের। 

দানোটা বলে উঠল, "আহা ভয় পেয়ো না ভয় পেয়ো না, তোমায় আমি মারবো না। তুমি আমার প্রাণ বাঁচিয়েছো, তোমায় কি আমি মারতে পারি!"

"আমি প্রাণ বাঁচিয়েছি তোমার!" এতক্ষণে কথা ফুটল ঝিলমিলের মুখে। 

দানোটা বলল, "বাঁচিয়েছোই তো। জানো তো আমি খেলা করতে করতে এদিকে চলে এসেছিলাম আর হঠাৎ করে দেখি একটা বাঘুয়া দাঁড়িয়ে আমার সামনে। উফফ তুমি যদি না থাকতে বাঘুয়াটা আমায় খেয়েই নিতো।" কথাগুলো বলতে বলতে দানোটার চোখটা গোলগোল ঘুরতে লাগল। অবাক হয়ে ঝিলমিল জিজ্ঞেস করল, "আমি কিভাবে বাঁচালাম?"

"ওই তো বাঘুয়াটা যখন আমার ওপর ঝাঁপিয়ে পড়তে গেল তখন বীরের মত ওপর থেকে ঝাঁপিয়ে পড়লে ওর ওপর আর তারপর তোমার থলির থেকে কি এক মন্ত্রপূত রস ঢেলে দিলে ওর চোখে আর দিতেই তো বাঘুয়াটা লাফাতে লাফাতে গর্জন করতে করতে উল্টে পড়ল।"

"মন্ত্রপূত রস!"

"হ্যাঁ গো। ওই তো আমি তোমার রসের পাত্রটা যত্ন করে রেখেছি ঐখানে।"

ঝিলমিল তাকিয়ে দেখল ওর লণ্ঠনটার দিকে ইশারা করছে দানোটা। ঝিলমিল বুঝল তারমানে ওই মন্ত্রপূত রস আর কিছুই নয়, কেরোসিন। অতো ওপর থেকে পড়াতে কোনোভাবে লণ্ঠন থেকে গড়িয়ে পড়েছে সেটা। এত বিপদের মধ্যেও এবার হাসি পেয়ে গেলো ঝিলমিলের। সে দানোটার দিকে তাকিয়ে বলল, "তোমার নাম কি?"

"আমার নাম রিংরিং। আর তোমার?"

"আমি ঝিলমিল।"

"বাহ্ কি সুন্দর নাম গো তোমার।" রিং রিং এর কথা শুনে হাসলো ঝিলমিল, তারপর জিজ্ঞেস করল, "আচ্ছা বাঘুয়াটা কিরকম প্রাণী?"

"এমা তুমি বাঘুয়া চেনো না! এই এত্তো বড়… ওই যে ওই দূরের দিকে দেখো, পড়ে আছে বাঘুয়াটা।" 

রিংরিং এর আঙুলের ইশারা লক্ষ করে তাকালো ঝিলমিল। এতক্ষণে ও খেয়াল করলো যেখানটায় ওরা বসে আছে সেটা আসলে একটা ফাঁকা নদীর তট। এখানে না আছে কোনো গাছপালা আর না আছে লোকজন। ওদের থেকে কিছুটা দূরে নদীর একদম পাড়ের কাছেই পড়ে আছে সেই প্রাণীটা… একটা হাতির আকারের বাঘের মত প্রাণীটা। ওটাকে দেখেই বুকটা ধক করে উঠল ঝিলমিলের। কাছাকাছি গেলে হয়তো প্রাণীটাকে ভালো করে দেখা যেতো, কিন্তু সাহস হলো না ওর। সেই সঙ্গে অবাক লাগল এই ভেবে যে এমন অতিকায় প্রাণীটাকে ও নিজের অজান্তেই মেরে ফেলল! আর রিংরিং এর কথা মতো তো ওর চোখে লণ্ঠনের কেরোসিন চুঁইয়ে পড়ায় কুপোকাত হয়েছে প্রাণীটা। সত্যিই যে প্রাণী যতই বড় হোক না কেন, একটা দুর্বল জায়গা সবার থাকে। 

"কি ভাবছো গো?" রিংরিং এর প্রশ্নে সম্বিৎ ফিরল ঝিলমিলের, "হুঁ? কিছু না।"

রিংরিং একগাল হেসে বলল, "এসো আমার সঙ্গে এসো, আমার বাড়িতে চলো। আমার বাবা এই দানোদের গাঁয়ের প্রধান।" এই বলে রিংরিং ঝিলমিলের হাত ধরে টানতে লাগলো। ঝিলমিলও কোনোক্রমে উঠে দাঁড়িয়ে হাঁটতে লাগল ওর সঙ্গে।


  রিংরিং দের বাড়িটা গ্রামের অন্যান্য বাড়ির তুলনায় বেশ বড়। দেখলেই বোঝা যায় প্রধানের বাড়ি বলে। রিংরিং এর সঙ্গে ঝিলমিলকে দেখে অন্যান্য দানোরা সব অবাক হয়ে নেমে আসছিল রাস্তায়। ঝিলমিলের তো ওই প্রকান্ড দানোগুলোকে দেখে বেশ গা ছমছম করছিল; মাঝেমাঝে তো মনে হচ্ছিল এই বুঝি ওরা ওকে ধরে খেয়ে নেবে। কিন্তু যদি খেয়েও নেয় ঝিলমিলের তো কিছু করার নেই এখন। তারচেয়ে দেখাই যাক ভাগ্যে কি আছে। 

বাড়ির মধ্যে ঢুকে রিংরিং ঝিলমিলকে নিয়ে এলো একটা বিশাল বড় হলঘরে। সেই হল ঘরে গোল হয়ে বসে রয়েছে প্রায় জন দশেক দানো। গোলের মাঝামাঝি জায়গায় তুলনামূলক উঁচু আসলে যে দানোটা বসে রয়েছে তার আকৃতি দেখে তো ঝিলমিলের দাঁত কপাটি লেগে যাওয়ার জোগাড়। এর আয়তন বোধহয় রিংরিং এর তিনগুণ হবে। রিংরিং ছুট্টে গিয়ে ওই প্রকান্ড দানোটার কোলে চড়ে বসল। ঝিলমিল বুঝলো ওটাই রিংরিং এর বাবা। বাবার কোলে চড়ে রিংরিং তার বাঘুয়া অভিযানের কথা সবিস্তারে বলে ফেলল এক নিঃশ্বাসে। রিংরিং এর কথা শেষ হতেই ওর বাবা ওকে কোল থেকে নামিয়ে আসন ছেড়ে উঠলেন, তারপর সোজা এসে দাঁড়ালেন ঝিলমিলের সামনে। ঝিলমিলের মনে হল ওর হৃদয়টা বুঝি আতঙ্কে শরীর ছেড়ে লাফ দিয়ে পড়ল কোনখানে। কিন্তু দানোটা ওকে অবাক করে দিয়ে মাথাটা সামান্য ঝোঁকালো, তারপর বলল, "তুমি আমার যা উপকার করলে আমি সারাজীবন তোমার কাছে কৃতজ্ঞ থাকবো। মানুষরা তো আমাদের ঘৃণা করে জানতাম কিন্তু আজ আমার মেয়ের প্রাণ বাঁচিয়ে তুমি আমার ধারণা ভুল প্রমাণিত করে দিলে। বলো তোমার কি চাই? তুমি যা চাইবে আমি তাই দেবো।"

একটা ঢোক গিলল ঝিলমিল। এই মুহূর্তে ওর কি বলা উচিত কিছুই মাথায় এলোনা। ওর মুখ দেখে রিংরিং এর বাবা কি বুঝলেন কে জানে, তিনি ওর মাথায় হাত রেখে বললেন, "আপাতত আমার বাড়িতে বিশ্রাম নাও তুমি, খাওয়া দাওয়া করো। তারপর আমাকে ভেবে বোলো তোমার কি চাই।"

ঘাড় নেড়ে সম্মতি জানালো ঝিলমিল। রিংরিং ছুটে এসে ওর হাত ধরে বলল চলো তোমাকে আমার ঘরে নিয়ে যাই, ঝিলমিলও হেসে বেরোতে গেল ওর সঙ্গে। ঠিক তখনই ঝিলমিলের কানে এসে লাগলো একটা দানোর কথা, "আর এভাবে চলতে দেওয়া যায়না রাজা। দুষ্ট ম্যাকমকের বাঘুয়া আজ আমাদের রিংরিংকে একা পেয়ে আক্রমণ করেছিল, কাল হয়তো গ্রামে ঢুকে আসবে, কি হবে তখন!"

"কথাটা আমিও ভাবছি নোঙ। কিছু একটা বিহিত করতেই হবে এর। কিন্তু কিভাবে?"

ওদের কথা শুনে ঝিলমিল ফিসফিস করে রিংরিংকে জিজ্ঞেস করল, "ম্যাকমকটা আবার কে?"

রিংরিং বলল, "ম্যাকমককে জানো না? সে খুব দুষ্ট দানো। আমাদের গ্রামের পাশেই একটা পেল্লাই বাড়িতে সে থাকে। ওই বাঘুয়াটা তো তারই ছিল।"

"তাই বুঝি?"

"হ্যাঁ গো। ওর ওরকম তিনটে বাঘুয়া আছে। ম্যাকমক তো জাদু জানে, জাদু করে ও ছোটো বাচ্চাদের ভয় দেখায়। আর বাবা বলে যত রাজ্যের খারাপ কাজ করেই ও আনন্দ পায়।"

"খুব দুষ্ট লোক তো তাহলে।"

"হ্যাঁ গো। জানো তো ম্যাকমকের বাড়িতে না কি সুন্দর একটা মেয়ে থাকে। মেয়েটা কে আমি জানিনা, শুধু ওপরের জানালায় তার মুখ দেখেছি মাঝেমাঝে। অতো সুন্দর মুখেও সবসময় কেমন না জানি কালো মেঘের ছায়া ঘুরে বেড়ায়! আমি একবার হাত নেড়ে কথা বলতে গিয়েছিলাম কিন্তু একটা বাঘুয়া এমন গর্জন করে উঠেছিল যে আমি ছুট্টে পালিয়ে আসি।"

"বাবারে… একা একা আর কখনও যেও না ঐদিকে।"


  "ম্যাকমককে এখন পাবে কোথায়? সে তো বাঘুয়াগুলোকে বাড়ি পাহারায় রেখে কোনখানে যেন চলে গিয়েছে, মাঝেমধ্যে রাতের অন্ধকারে আসতে দেখেছি।" আর একটা দানোর কথা কানে যেতেই আবার ওদের দিকে ঘুরে তাকাল ঝিলমিল। আরেকটা দানো আগের দানোটার কথার রেশ টেনে বলল, "ঠিকই বলেছিস। আজকাল তো আবার মানুষদের সঙ্গে ওর খুব ভাব হয়েছে। ও নিরুদ্দেশে যাওয়ার আগে আমি ঐ কুন্দপুর না কি যেন রাজ্যের রাজাকে প্রায় আসতে দেখতাম ওর কাছে।"

কুন্দপুর! নামটা কানে যেতেই চমকে উঠল ঝিলমিল। এতো তাদের পাশের রাজ্যের নাম! সেখানকার রাজকুমারী হলেন রাজকুমারী বিম্ববতীর সখী। তা সেই কুন্দপুরের রাজার ওই দুষ্ট দানোর সঙ্গে কি কাজ থাকতে পারে! উঁহু… ব্যাপারটা খুব সন্দেহজনক লাগছে। 

ঝিলমিল আবার সেই দানোগুলোর দিকে এগিয়ে এসে বলল, "রাজামশাই এই বিপদ থেকে রক্ষা করতে আমি কি কোনো সাহায্য করতে পারি?"

"আরে না না। তুমি আমাদের অতিথি, বিশ্রাম নাও তুমি। আমরা ঠিক কিছু একটা উপায় বের করে ফেলব।" বললেন রিংরিং এর বাবা।

নোঙ বলে দানোটা তখন বলে উঠল, "রাজা ওর সাহায্য নিলে ক্ষতি কি? রিংরিং তো বলল ওর কাছে নাকি কি এক মন্ত্রপূত রস আছে যার সাহায্যে ম্যাকমকের একটা বাঘুয়াকে ও মেরে ফেলেছে। ও কি আমাদের আবার সাহায্য করবে না? শুনেছি মানুষদের মনে নাকি অনেক দয়া মায়া থাকে!"

"কিন্তু…" রিংরিং এর বাবাকে কথাটা সম্পূর্ণ করতে না দিয়ে ঝিলমিল বলল, "আপনাদের সাহায্য করতে পারলে আমার খুব ভালোলাগবে রাজামশাই। আমাকে একটা সুযোগ দিন ওই বাকি বাঘুয়া দুটোকে মারার।" 

ঝিলমিলের চোখের দিকে তাকিয়ে রাজা অবশেষে বলল, "ঠিক আছে।"


                    ৫


রাত এখন গভীর। মাথার ওপরে চাঁদটা একটা রুপোলি আলো ছড়াচ্ছে চারিদিকে। সেই আলোতেই পা টিপে টিপে হেঁটে চলেছে ঝিলমিল, নোঙ আর মোং নামের আরেকটা দানো। ওরা তিনজন ছাড়া বাইরে আর কোনো জনপ্রাণীর চিহ্ন নেই। গ্রামের পাশ দিয়ে বয়ে চলা নদীটার কুলকুল শব্দ ছাড়া আর কোনো শব্দও নেই চারিপাশে। রাজার সাথে কথা বলে ওরা ঠিক করেছে বাকি দুটো বাঘুয়াকেও মেরে ফেলতে হবে আজ রাতের মধ্যেই। ওই বাঘুয়াগুলোর জন্যই ম্যাকমক যতই দৌরাত্ম চালাক গ্রামের লোকেরা প্রতিবাদ জানাতে ম্যাকমকের বাড়ির ধারে কাছেও যেতে পারেনা কখনও। শুধু কি তাই বাঘুয়াগুলো যখন তখন যেদিকে সেদিকে চলে আসে আর ওদের দেখলেই গ্রামের সবাইকে কাজ ছেড়ে ছুটে পালাতে হয় এদিক সেদিক। তাই সবার আগে ওই বাঘুয়া দুটোকে শেষ করতে হবে। 

হাঁটতে হাঁটতে ভারী অদ্ভুত লাগছিল ঝিলমিলের--- এতদিন যাদের কথা শুনে ভয় পেয়ে এসেছে, আজ তাদের কাছাকাছি এসে দেখছে তারাও কত অসহায়, তারাও কারুর ভয়ে ভয়ে দিন কাটায়।


  ম্যাকমকের বাড়ির কাছাকাছি আসতেই নোঙ এর নির্দেশে একটা গাছের আড়ালে চলে এলো ওরা। আড়াল থেকে তাকিয়ে দেখলো দুটো বাঘুয়া বাড়ির সামনে এপ্রান্ত থেকে সেপ্রান্ত হেঁটে হেঁটে পাহারা দিচ্ছে। এই রাতেও ঘুম নেই ওদের চোখে। চাঁদের আলোতেই ঝিলমিল টের পেলো বাঘুয়াগুলো অতিকায় বাঘের মত দেখতে হলেও ওদের মুখটা বাঘের চেয়েও অনেক বেশি হিংস্র, অনেক বেশি ভয়ঙ্কর। ভয় যে একেবারে লাগছে না তা নয়, কিন্তু কাল থেকে যা যা ঘটেছে তাতে করে এখন ঝিলমিল মনটাকে অনেক বেশি শক্ত করে নিয়েছে। সে একবার হাত দিলো নিজের কোমরের কাছে। ওখানেই আছে আসল জিনিসটা। জঙ্গলে আসার আগে মা একটা পাত্রে করে খানিকটা কেরোসিন তেল দিয়েছিলেন লণ্ঠনটার জন্য। আজ ওরা বাঘুয়া শিকারে বেরোবে শুনে রিংরিং দের গ্রামের এক কারিগর একটা আশ্চর্য পাত্র উপহার দিয়েছে ঝিলমিলকে। সেই পাত্রে কেরসিনটা ঢেলে নিয়েছে ঝিলমিল, ওই পাত্রের সরু মুখটা দিয়ে খুব সহজেই বাঘুয়ার চোখটাকে নিশানা করে তেলটা ছিটিয়ে দেওয়া যাবে। কিন্তু সমস্যা হল দুটো বাঘুয়াকে তো একসঙ্গে আক্রমণ করা যাবেনা, অথচ ওরা ওখানে ঘুরছে একসাথে। 


"এখন কি হবে? ওদের একসঙ্গে আক্রমণ করব কিভাবে?" ফিসফিস করে জিজ্ঞেস করল ঝিলমিল।

মোং বলল, "চিন্তা কোরো না, আমি একটার মনোযোগ অন্যদিকে ঘোরাচ্ছি, সেই সুযোগে তোমরা আক্রমণ করে দিও আরেকটাকে।"

"ঠিক আছে।" বলল ঝিলমিল।

মাথা নেড়ে গুটিগুটি পায়ে গাছের আড়াল ছেড়ে বেরিয়ে গেল মোং। তারপর মাটির থেকে একটা মাঝারি মাপের পাথর কুড়িয়ে ছুঁড়ে মারল একটা বাঘুয়ার গায়ে। বাঘুয়াটা ঘোঁৎ করে শব্দ করে দাঁড়িয়ে গেল, তারপর মাথা ঘুরিয়ে এদিক সেদিক দেখতে লাগলো। এমন সময় মোং আবার একটা ছোটো পাথর ছুঁড়ল তার গায়ে। বাঘুয়াটা এবার মোংকে দেখতে পেয়ে ছুটে সরে এলো বাড়ির সামনে থেকে। মোং তড়িঘড়ি একটা গাছে চড়ে বসল। বাঘুয়াটা গাছের নীচে দাঁড়িয়ে ঘোঁৎ ঘোঁৎ শব্দ করতে লাগল। এই সুযোগে নোঙ ঝিলমিলকে ইশারা করে বেরিয়ে এলো গাছের আড়াল থেকে। তারপর সোজা পৌঁছে গেল বাড়ির কাছে থাকা বাঘুয়াটার সামনে। নোঙকে হঠাৎ করে সামনে আসতে দেখে প্রথমে খানিকটা হতভম্ব হয়ে গেলো বাঘুয়াটা কিন্তু তারপরেই প্রবল আক্রোশে গর্জন করে ঝাঁপিয়ে পড়ল নোঙ এর দিকে। মুহূর্তের মধ্যে নোঙ এর হাতে উঠে এলো একটা ধারালো অস্ত্র। নোঙ সেটা বিঁধিয়ে দিতে চাইলো বাঘুয়াটার পেটে, কিন্তু বাঘুয়ার মোটা চামড়া ভেদ করে সেটা ঢুকতে পারলোনা, ভেঙে গেল। বাঘুয়াটা চড়ে বসল নোঙ এর ওপর, তারপর ছুরির ফলার মত তীক্ষ্ণ দাঁতগুলো বের করে কামড়ে নিতে গেল নোঙ এর ঘাড়। কিন্তু তখনই ঝিলমিল লাফ দিয়ে গিয়ে ওর একটা চোখে ছিটিয়ে দিলো কেরোসিন। বাঘুয়াটা আর্তনাদ করে নোঙকে ছেড়ে ছিটকে পড়ল মাটিতে। ঝিলমিল তখন ওর আরেকটা চোখেও কিছুটা তেল ছিটিয়ে দিতেই ছটফট করতে করতে একসময় নিস্তেজ হয়ে গেল বাঘুয়াটা। এদিকে ঠিক তখনই ওরা শুনতে পেলো মোং এর চিৎকার। ঝিলমিল আর নোঙ তাকিয়ে দেখলো বাঘুয়ার ধাক্কায় মোং গাছের ডাল ভেঙে পড়ে গেছে মাটিতে। ঝিলমিল পা টিপেটিপে পৌঁছে গেলো ওদের কাছে, মোংকে আক্রমণ করার প্রস্তুতি নিতে থাকা বাঘুয়াটা টেরই পেলোনা ঝিলমিলের উপস্থিতি, সে দাঁত বের করে মোংকে আক্রমণ করতে যাবে এমন সময় ঝিলমিল ওরও চোখ লক্ষ্য করে ছুঁড়ে দিলো তেল। কিছুক্ষণের মধ্যেই এই বাঘুয়াটাও একেবারে নিস্তেজ হয়ে পড়ল। নোঙ আর মোং আনন্দে নাচতে শুরু করে দিলো। বুকটা প্রচন্ড ঢিপঢিপ করছিল ঝিলমিলের কিন্তু তাও এই প্রকান্ড দুটো দানোকে এভাবে নাচতে দেখে হাসি পেয়ে গেল ওর। নোঙ বলল, "চলো গ্রামে ফিরে গিয়ে সবাইকে খুশির খবরটা দিই।"

মোং বলল, "চলো চলো…"

"না।" ঝিলমিল বলল। ওরা দুজন অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করল, "কেন?" 

"রিংরিং বলেছিল ও নাকি এই বাড়িতে একটি মেয়েকে দেখেছে কয়েকবার। আমার ধারণা ম্যাকমক মেয়েটিকে বন্দি করে রেখেছে। মেয়েটিকে আমাদের উদ্ধার করতেই হবে।"

"কিন্তু রাজার অনুমতি ছাড়া… আমরা কাল আরও লোক নিয়ে এসে উদ্ধার করবো মেয়েটিকে। এখন তো বাঘুয়াগুলোও শেষ, আর ভয় কিসের?"

"ভয় অন্য জায়গায়। যদি কাল আমরা আসার আগেই ম্যাকমক ফিরে আসে, সে তো বাঘুয়াগুলোকে দেখলেই বুঝতে পারবে কেউ আক্রমণ করেছিল এখানে। এবার ও যদি মেয়েটার কোনো ক্ষতি করে দেয় বা অন্য কোথাও নিয়ে চলে যায় তখন কি হবে?" বলল ঝিলমিল।

মোং ওর কথায় সম্মতি জানিয়ে বলল, "ঠিক বলছো তুমি। সকালের অপেক্ষা করার কোনো মানেই হয়না। চলো এখনই যাই।"

কথা বলা যত সহজ করা যে তত সহজ নয় তা ওরা টের পেল ম্যাকমকের বাড়ির দরজার সামনে এসে। দরজায় কোনো তালা নেই কিন্তু দরজাটা এমন ভাবে বন্ধ যে অনেক চেষ্টা করেও ওরা খুলতে পারলো না কিছুতেই। মোং বলল, "এখন কি হবে?"

ঝিলমিল বা নোঙ মোং এর কথার জবাব দেওয়ার আগেই কে যেন খোনা গলায় বলে উঠল, "কে রে রাত বিরেতে বিরক্ত করছিস আমায়?"

ঝিলমিলরা চমকে উঠল তিনজনই। দেখলো দরজার মধ্যে থেকে একটা অদ্ভুত কালচে মাথা বের হয়ে প্রশ্নটা করেছে ওদের। নোঙ বলল, "সর্বনাশ! এ যে তিন ডাইনির দরজা।" আর্তনাদ করে উঠল নোঙ।

"সে আবার কি?" জানতে চাইল ঝিলমিল।

নোঙ বলল, "এ এক জাদু দরজা, এই রকম তিনটে দরজা থাকবে একটা বাড়িতে। মালিক ছাড়া কেউ দরজা খুলতে এলে ডাইনি তাকে একটা করে কাজ দেবে বা কোনো ধাঁধা দেবে, সেই কাজ না করতে পারলে বা ধাঁধার উত্তর না দিতে পারলে ডাইনি তাকে মেরে ফেলবে।"

"ওরে বাবা তাহলে ফিরে চলো এখান থেকে।" বলল মোং।

ঝিলমিল কয়েক মুহূর্ত ভেবে নিয়ে বলল, "তোমরা চাইলে ফিরে যেতে পারো কিন্তু আমি যাবোনা, তাতে যা হবে হবে।"

"বোকামি কোরো না।"

"বোকামি করছিনা। যে ভেতরে এতদিন ধরে বন্দি হয়ে আছে তাকে উদ্ধার করতেই হবে আমাকে।" দৃঢ় গলায় বলল ঝিলমিল।

নোঙ বলল, "তাহলে তাই হোক। আমরাও ফিরবো না।"

মোং তাকে সমর্থন করে বলল, "একদম, একসঙ্গে যখন এসেছিলাম ফিরবোও একসঙ্গে।"

ঝিলমিলের মনটা আনন্দে ভরে উঠল। ও এবার দরজার দিকে তাকিয়ে বলল, "আমি ঘরের ভেতর যেতে চাই।"

"সেখানে তো এমনি এমনি যেতে দেওয়া যায়না তোকে।" খোনা গলায় জবাব দিলো প্রথম ডাইনি। 

"আমাকে কি করতে হবে ভেতরে যেতে গেলে?" জানতে চাইল ঝিলমিল।

"উম্ম… একটা প্রশ্ন আছে বুঝলি যার উত্তর আমি অনেক দিন থেকে খুঁজছি পারবি সেই প্রশ্নের উত্তর দিতে?"

"জিজ্ঞেস করেই দেখো না।"

"উত্তর দেওয়ার কিন্তু একটাই সুযোগ পাবি মাত্র।"

"ঠিক আছে।"

"নাই হাত নাই পা

নাই গা নাই মাথা,

তবুও সে বাড়ে

তরতর করে,

দিন যায় ছুটে

সময়ের সাথে।

বল তো কার কথা বলছি?"

ডাইনির প্রশ্নে মোং আর নোঙ নিজেদের মধ্যে উত্তর আলোচনা করতে ব্যস্ত হয়ে পড়ল। ঝিলমিল চুপচাপ দাঁড়িয়ে একমনে চিন্তা করতে লাগল। ভুল উত্তর দেওয়া যাবে না কোনোমতেই। নাই হাত নাই পা, নাই গা নাই মাথা… মানে এমন কোনো জিনিস হবে যার কোনো আকৃতি নেই। কিন্তু সে বাড়ে… ভাবতে ভাবতে হঠাৎ করে ঝিলমিলের মাথায় বিদ্যুৎ প্রবাহ খেলে গেল। তার মনে পড়ে গেল কাল তার অজান্তেই বাঘুয়াটার চোখে কেরোসিন পড়তেই বাঘুয়াটা মারা গিয়েছিল, আর তাই তো আজ সে সাহস করে দু দুটো বাঘুয়াকে মারতে আসতে পারল। 

"উত্তর আমি পেয়ে গিয়েছি।" ঝিলমিলের কথায় চমকে উঠল নোঙ আর মোং। মোং বলল, "ভালো করে ভেবে নিয়েছো তো।"

"হ্যাঁ।" দৃঢ় গলায় জবাব দিলো ঝিলমিল।

ডাইনি বলল, "বল দেখি তাহলে কেমন উত্তর খুঁজে পেয়েছিস।"

"উত্তর হবে অভিজ্ঞতা। হাত, পা, গা, মাথা কিছুই নেই কিন্তু তাও যত দিন যায় সময়ের সাথে সাথে আমাদের অভিজ্ঞতা বাড়ে।"

"বাহ্ বাহ্ বাহ্ তোর তো ভারী বুদ্ধি দেখছি। তা আরেকটা প্রশ্নের উত্তর দে দিখি।"

"এটা কেমন হল ডাইনি দিদা, তুমি তো বলেছিলে একটা প্রশ্নের উত্তর দিতে হবে, এখন কথার খেলাপ করছো কেন?" রাগত স্বরে জানতে চাইল ঝিলমিল।

"হাঃ হাঃ" করে হেসে উঠল ডাইনি। তারপর বলল, "দেখছিলাম তুই কতখানি সতর্ক থাকিস সবসময়। ঠিক শুনেছিলিস আমার কথা। যা ভেতরে যা।" 

এই বলে ঘড়ঘর শব্দ করে দরজা খুলে দিলো ডাইনি। ওরা তিনজন হৈহৈ করে ঢুকে গেল ঘরের ভেতর। ঢুকতেই প্রথমে যে ঘরটা সামনে পড়ল সেই ঘরটা অদ্ভুত সব আসবাবে ভর্তি। টিমটিম করে আলো জ্বলছে সেখানে। ঘরটার পাশ দিয়েই একটা সিঁড়ি উঠে গিয়েছে। ঝিলমিল বলল, "রিংরিং বলেছিল মেয়েটাকে ও ওপরের ঘরে দেখতে পেয়েছিল। চলো আমরা উঠে দেখি।"

এই বলে ওরা তিনজন উঠে এলো সিঁড়ি দিয়ে। ওঠার পরেই যে ঘরটা সামনে পড়ল সেই ঘরের কাছে আসতেই ওরা স্পষ্ট শুনতে পেলো ভেতরে যেন কেউ কাঁদছে। ওরা তিনজন পরস্পর মুখ চাওয়াচাওয়ি করল। তারমানে মেয়েটা এই ঘরেই আছে। কিন্তু দরজাটার দিকে তাকাতেই ওরা দেখতে পেলো একটা ডাইনি দরজার মধ্য থেকে মাথা বের করে মিটিমিটি করে হাসছে ওদের দেখে। নোঙ বিড়বিড় করে বলল, "দ্বিতীয় ডাইনি।"

ঝিলমিল এগিয়ে গিয়ে বলল, "দরজা খুলে দাও ডাইনি দিদা।"

ডাইনি বলল, "আমার দিদির কাছে নিশ্চয় জেনে এসেছিস যে এমনি এমনি দরজা খুলতে পারবো না আমি।"

"হুমম। বলো কি করতে হবে আমায়।"

"বাহ্ এই তো সোনা মেয়ে। উম্ম কি করতে দেওয়া যায় বলতো তোকে?"

"তুমিই বলো।"

"আচ্ছা তবে বল দেখি তো


নয় সে সাদা শুধুই কালো

এই হল তার বেশ

খালি চোখে যায়না দেখা

কোনোই যে তার রেশ।

বুঝবে যখন দুস্টুমি তার

সব কিছু তখন শেষ।

কার কথা বলছি?"


কয়েক মুহূর্ত ভাবতে একটু সময় নিলো ঝিলমিল। ওর কানে লাগছে নোঙ আর মোং এর মধ্যে কেউ ম্যাকমকের নামটা একবার উচ্চারণ করল। মুহূর্তের মধ্যে হাসি ফুটল ঝিলমিলের ঠোঁটে। ম্যাকমকের বাড়িতে দাঁড়িয়ে এই ধাঁধার উত্তর আর কি হতে পারে!

"উত্তর হবে দুটো, অহং আর লোভ।"

"কি? কি?" ঝিলমিলের দিকে তাকাল মোং আর নোঙ। ঝিলমিল বলল, "লোভ আর অহং দুটোই আমাদের মনের অন্ধকার দিক, তাই তাদের বেশ সবসময় কালো। এদের এমনিতে খালি চোখে দেখা যায়না, কিন্তু এরা আমাদের ক্ষতি করতে থাকে ভেতরে ভেতরে। যতক্ষণে আমরা টের পাই এদের অস্তিত্ব ততক্ষনে আমাদের সব শেষ হয়ে যায়।"

"বাহ্ বাহ্ তুই তো খুব বুদ্ধিমতী মেয়েরে। একদম ঠিক উত্তর।"

নোঙ আর মোং আনন্দে হাততালি দিয়ে উঠল। ঝিলমিল বলল, "তাহলে দরজাটা এবার খুলে দাও ডাইনি দিদা।" 

ডাইনি ঘড়ঘর শব্দ করে খুলে দিল দরজাটা। ভেতরে যে মেয়েটা বসে ছিল, সে আওয়াজ শুনে তার অশ্রুসজল চোখে তাকিয়েছিল দরজাটার দিকে। ভেবেছিল ম্যাকমক বুঝি ফিরে এলো, কিন্তু ম্যাকমকের পরিবর্তে ঝিলমিলদের দেখে সে অবাক হল ভীষণ। ভয় আর বিস্ময় মিশ্রিত গলায় প্রশ্ন করে উঠল, "কে তোমরা?"

মেয়েটার মুখের দিকে তাকিয়েই চমকে উঠল ঝিলমিল। সে ছুটে মেয়েটার কাছে গিয়ে বলল, "রাজকুমারী বিম্ববতী!"

মেয়েটা অবাক হয়ে বলল, "তুমি চেনো আমায়?"

"চিনবো না কেন, আমি যে মহেশগড়েই থাকি।" উত্তর দিলো ঝিলমিল।

বিম্ববতী আনন্দে ঝিলমিলকে জড়িয়ে ধরে বলল, "সত্যি বলছো তুমি?"

"হ্যাঁ রাজকুমারী, একদম সত্যি। আমার নাম ঝিলমিল।

কিন্তু রাজকুমারী তুমি এখানে তাহলে মহেশগড়ে যে আছে সে কে?"

ঝিলমিলের প্রশ্নে চোয়ালদুটো শক্ত হয়ে উঠল বিম্ববতীর। সে বলল, "ওটা দুষ্ট ম্যাকমক।"

"ম্যাকমক!"

"হ্যাঁ। ম্যাকমক আমাকে এখানে বন্দি করে রেখেছে। পনেরো দিন ছাড়া ছাড়া গভীর রাতে সে আসে, আমার মাথার থেকে একটা করে চুল ছিঁড়ে নিয়ে যায়। আর সেই সঙ্গে আমার একফোঁটা চোখের জল মিশিয়ে সে এমন এক মিশ্রণ তৈরি করে পান করে যেটা পান করলেই ও আমার মতো দেখতে হয়ে যায় আগামী পনেরো দিনের জন্য।"

"কি সর্বনেশে কথা!"

"অনেক চেষ্টা করি যাতে চোখে জল না আসে কিন্তু ওই দুষ্ট ঠিক বাবার কথা, বাড়ির কথা বলে আমাকে কাঁদিয়েই ছাড়ে…" একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলল বিম্ববতী।

ঝিলমিল অবাক হয়ে বলল, "কিন্তু ম্যাকমক তোমাকে বন্দি করলো কখন?"

"আমি যখন কুন্দপুরে বেড়াতে গিয়েছিলাম। আসলে আমি বুঝতে পারিনি ষড়যন্ত্র করে আমাকে ওখানে আমন্ত্রণ জানানো হয়েছিল।"

"ষড়যন্ত্র!"

"হ্যাঁ। আমি কুন্দপুরে যেতেই আমাকে বন্দি করা হল রাতের অন্ধকারে, আমার সেনাদের অলক্ষ্যে। কুন্দপুরের রাজার সঙ্গে ম্যাকমকের খুব বন্ধুত্ব। সব কিছু আগে থেকেই ঠিক করা ছিল। আমার চুল আর চোখের জল নিয়ে ম্যাকমক বানিয়ে ফেলল ওর জাদু মিশ্রণ, তারপর সেটা পান করতেই হুবহু আমার মতন দেখতে হয়ে গেল। আমার সেনারা টেরই পেলো না যে ওদের সামনে যে গিয়ে উপস্থিত হল সে আসলে আমি নয়, ম্যাকমক। এদিকে রাত থাকতেই ম্যাকমক আমাকে এনে বন্দি করলো ওর বাড়িতে।"

"ওরে বাবা এসব শুনেই তো আমার গায়ে কাঁটা দিচ্ছে!"

"বাবা কেমন আছেন?" কাতর গলায় জানতে চাইল বিম্ববতী।

ঝিলমিল মুখ কালো করে বলল, "ভালো নেই। ম্যাকমক তুমি সেজে প্রচন্ড দৌরাত্ম চালাচ্ছে রাজ্য জুড়ে।" এরপর ঝিলমিল এক এক করে সব ঘটনা বলে গেল। দু'হাতে মুখ ঢাকা দিয়ে ডুকরে কেঁদে উঠলেন বিম্ববতী। ঝিলমিল ওর কাঁধে হাত রেখে বলল, "কেঁদো না রাজকুমারী। কুন্দপুরের রাজা খুব গভীর ষড়যন্ত্র করেছিলেন। উনি জানতেন সরাসরি আমাদের রাজ্যের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করলে কোনোদিনও উনি জিততে পারবেন না। তাই ম্যাকমককে দিয়ে ভেতরে ভেতরে আমাদের রাজ্যকে শেষ করে দিতে চাইলেন। রাজ্যের শক্তি কত যুবক এই মারণ খেলার ফাঁদে পড়ে প্রাণ হারাল, আর এদিকে রাজা মশাইও ভেতরে ভেতরে দুর্বল হয়ে পড়লেন।"

"এখন কি হবে ঝিলমিল? কিভাবে ঠিক হবে সব?" কাঁদতে কাঁদতে জিজ্ঞেস করল বিম্ববতী।

ঝিলমিল বলল, "ঠিক তো করতেই হবে। আচ্ছা রাজকুমারী তুমি তো এতদিন এখানে আছো, বলতে পারো এমন কোনো জিনিস যাকে দিয়ে ম্যাকমককে ধ্বংস করা যায়।"

কিছুক্ষণ ভেবে নিয়ে বিম্ববতী বলল, "ম্যাকমককে ধ্বংস করতে হলে সবার আগে ওর জাদুঘরটা ধ্বংস করতে হবে, কারণ আমার মনে হয়েছে ম্যাকমকের নিজস্ব কোনো শক্তি নেই, যা আছে সব ওই জাদুঘরের দৌলতেই।"

"সেই জাদুঘরটা কোথায়?" এতক্ষণ সব কিছু চুপচাপ শুনছিল নোঙ আর মোং। এবার সুযোগ পেয়ে প্রশ্ন করল তারা।

বিম্ববতী মুখটা শুকনো করে বলল, "তা তো জানিনা ঠিক, আমাকে এই ঘর থেকে তো ও বেরোতেই দিত না।"

ঝিলমিল আচমকা উঠে দাঁড়িয়ে বলে উঠল, "আমি জানি কোথায় ঘরটা।"

"তুমি জানো!" একসঙ্গে জিজ্ঞেস করে উঠল বাকিরা।

ঝিলমিল মৃদু হেসে বলল, "আমরা তিন ডাইনির দরজার দুটো দরজা পার করে ফেলেছি। এখনও বাকি আছে একটা। ওইটা নিশ্চয় ম্যাকমকের জাদুঘরের দরজা হবে। দুটো তলায় দুটো দরজা পেলাম। এর ওপরের তলায় গিয়ে আগে দেখা যাক আগে, আমার বিশ্বাস ঘরটা সেখানেই হবে।"


  সিঁড়ি দিয়ে ওপরে আসতেই দেখা গেল ঝিলমিলের অনুমান নির্ভুল। এই তলাতেই রয়েছে তৃতীয় ডাইনি বোনের দরজা। ডাইনি ওদের দেখতে পেয়ে মিটিমিটি হাসছে আর খোনা গলায় বলছে, "কিরে ভেতরে যাবি নাকি?" 

"হ্যাঁ গো দিদা আমরা ভেতরে যাবো।" বলল ঝিলমিল।

ডাইনি সুর করে বলল, "এমনি এমনি কি আর যেতে দিতে পারি তোদের।"

"বলো তোমার ধাঁধা, আমি উত্তর দিতে প্রস্তুত।" পরপর দুটো দরজা পার হয়ে ঝিলমিলের আত্মবিশ্বাস অনেকটাই বেড়ে গিয়েছে এখন। 

কিন্তু ডাইনি বলে উঠল, "আমার দুই দিদির ধাঁধার তো তুই সমাধান করে ফেলেছিস,কিন্তু অতো সোজা ধাঁধা যে আমি দেবো না রে…"

"তাহলে?" জানতে চাইল মোং।

ডাইনি খিকখিক করে হাসতে হাসতে বলল, "আমার বহুদিনের একটা শখ আছে, তোরা যদি সেটা মিটিয়ে দিতে পারিস তাহলে আমি দরজাটা খুলতে পারি।"

"কি শখ?" জানতে চাইল ঝিলমিল।

"আমার না বহুদিনের শখ একটা আলোর নোলক পরব। পারবি তোরা এনে দিতে?" কতগুলো বলেই খিলখিল করে হেসে উঠল ডাইনি। 

মোং রেগে গিয়ে বলল, "এ আবার কেমন শখ তোমার! আলোর নোলক আবার হয় নাকি?"

"হয় কি না হয় আমি অতো জানিনা বাপু। তোরা এনে দিবি কিনা তোদের ব্যাপার। না এনে দিতে পারলে কি হবে জানিস নিশ্চয়?

আর শোন পালাবার চিন্তাও করিসনা। আমার বড়দিদি কিন্তু তোদের বেরোতে দেবে না আমার শখ না মেটালে।"

নোঙ কিছু একটা বলতে যাচ্ছিল, ঝিলমিল তার হাত ধরে টেনে থামিয়ে দিলো। তারপর ডাইনিকে বলল, "চেষ্টা করব আমরা।"

"যা ভালো মেয়ে। তবে শোন দিনের আলোর ফোটার আগেই কিন্তু আমার আলোর নোলক চাই। নয়তো…" কথাটা অসম্পূর্ণ রেখেই খিলখিল করে হেসে উঠল ডাইনি।


  নীচের তলায় নেমে এলো ওরা চারজন। মোং রাগে গরগর করতে করতে বলল, "ঘর থেকে তো বেরোতেও দেবে না তাহলে কি করে খুঁজে আনবো আলোর নোলক!"

নোঙ বলল, "তোর কি মনে হয় এমন নোলক খুঁজলেও পাওয়া যাবে!"

"একদম ঠিক বলেছো নোঙ দাদা। ঐরকম নোলক খুঁজলেও কোথাও পাওয়া যাবেনা। তাই আমাদের বুদ্ধি দিয়ে ভাবতে হবে।" বলে উঠল ঝিলমিল। বাকিরা সায় দিলো ওর কথায়। এরপর ভাবতে বসল সকলে মিলে। ভাবতে ভাবতে কতটা সময় কেটে গেল খেয়ালই করেনি কেউ। আচমকা জানালার গরাদের ফাঁকে আকাশের দিকে তাকিয়ে বিম্ববতী কাতর স্বরে বলে উঠল, "তাড়াতাড়ি কিছু একটা ভাবো সবাই, ভোর হতে কিন্তু বেশি দেরী নেই।"

"ধুরর কি যে হবে এবার!" লাফিয়ে উঠল মোং, আর পেট থেকে অদ্ভুত একটা আওয়াজ বেরোলো। খিদে পেয়ে গেছে ওর। মোং এর পেটের শব্দ শুনে ওর দিকে মুখ তুলে তাকাল ঝিলমিল, আর তৎক্ষণাৎ একটা বুদ্ধি ঝিলিক দিয়ে উঠল ওর মাথায়। ঝিলমিল তাড়াতাড়ি বলল, "মোং দাদা তোমার কানের ওই লোহার মাকড়িটা খুলে দাও দেখি।"

"আমার মাকড়ি নিয়ে করবে?"

"আহা তুমিই দাওই না।"

আর প্রশ্ন না করে মাকড়িটা কান থেকে খুলে দিলো মোং। ঝিলমিল এবার বলল সবাই তাড়াতাড়ি সাঁড়াশি জাতীয় কিছু একটা জিনিস খুঁজে দেখো, নয়তো কাজ হবেনা। ঝিলমিলকে প্রশ্ন করে সময় নষ্ট করলো না কেউ, সবাই বিনা বাক্য ব্যয়ে খুঁজতে লাগল গোটা ঘরে। বেশ কিছুক্ষণ খোঁজাখুঁজির পর বিম্ববতী একটা সাঁড়াশি জোগাড় করে আনলো। ওটা দেখেই চকচক করে উঠল ঝিলমিলের মুখ। সে তড়িঘড়ি সাঁড়াশিটা নিয়ে তার মুখে আটকে দিলো মোং এর মাকড়িটা। তারপর ঘরটায় থাকা একটা পিদিমের আলো উস্কে দিয়ে তার মধ্যে সাঁড়াশির মুখে আটকানো মাকড়িটাকে ধরল ঝিলমিল।


  "এই নাও দিদা তোমার আলোর নোলক।" এই বলে আগুনের তাপে লাল গনগনে হয়ে যাওয়া মাকড়িটা তুলে ধরল ডাইনির নাকের কাছে। ডাইনি চোখ গোলগোল করে কিচ্ছুক্ষণ দেখলো সেটা; তারপর আহ্লাদিত গলায় বলল, "ওরে আজ আমার খুব আনন্দ হচ্ছে রে। এইটুকু পুঁচকে মেয়ের কি বুদ্ধি। তুই খুব ভালো মেয়ে। দেখবি তোর সব ভালো হবে।"

এই বলে ডাইনি ঘড়ঘর শব্দে খুলে দিলো ম্যাকমকের জাদুঘরের দরজা। ঘরটায় ঢুকতেই তো ওদের চক্ষু চড়ক গাছ। কি বিচিত্র এই ঘর! কি বিচিত্র গন্ধ চারিদিকে! ঘরটার স্থানে অস্থানে কত রকমের শিশিতে কত রঙের তরল রাখা, কিছু শিশিতে আবার মরা সাপ ব্যাঙ চুবিয়ে রাখা আছে। শুধু কি তাই বিভিন্ন পাত্রে হাতের নখ, মাথার চুল, শুকনো ফুল থেকে শুরু করে কর রকমারি জিনিস সাজানো। বিম্ববতী বলে উঠল, "তাড়াতাড়ি চলো এই ঘর থেকে, গন্ধে বমি বমি পাচ্ছে আমার।"

ঝিলমিল মাথা নেড়ে ইশারা করল মোং আর নোঙ এর দিকে। তারপর ওর সঙ্গে থাকা বাকি কেরোসিন টুকু ছড়িয়ে দিলো ঘরে, নোঙ আর মোং দুটো পিদিম এবার ছুঁড়ে ফেলল ঘরটার মধ্যে। কেরোসিন আর আগুনের সংস্পর্শে দাউদাউ করে জ্বলে উঠল ঘরটা। ওরা ছুটে বেরিয়ে এলো বাইরে। কিছুক্ষণের মধ্যেই গোটা ঘরটা পুড়ে ছাই হয়ে গেলো।


                     ৬


পরের দিন সকাল হতেই রিংরিং এর বাবার ব্যবস্থাপনায় একটা এক্কাগাড়ি ঝিলমিল আর বিম্ববতীকে পৌঁছে দিয়ে গেল মহেশগড়ে। বিম্ববতীকে দেখেই তো চমকে গেল সবাই। এ কি করে হয়! দু'দুটো রাজকুমারী! ঝিলমিল তখন সবাইকে পুরো গল্পটা বলল সবিস্তারে। রাজকুমারীবেশী ম্যাকমক তো সেনাদের আদেশ দিয়ে ফেলল ঝিলমিল আর বিম্ববতীকে বন্দি করার কিন্তু কোনো সেনাই তার আদেশ শুনলো না। আসলে এতদিন ধরে কারুর যেন বিশ্বাসই হতে চাইছিল না যে তাদের প্রিয় রাজকুমারী এভাবে রাতারাতি পাল্টে গিয়েছেন। আজ আসল বিম্ববতীকে দেখে আর ঝিলমিলের মুখে সব টুকু শুনে কারুর মনে আর বিশেষ শঙ্কা রইল না। বিম্ববতী নির্দেশ দিল তার রূপধারী ম্যাকমককে বন্দি করে রাখতে। আজকেই পনেরো দিন পূর্ণ হচ্ছে, তাই আজ রাতে জাদু রস পান করতে না পারলে ম্যাকমকের আসল রূপ বেরিয়ে যাবে সবার সামনে। আর ঠিক ঘটলও তাই, রাত হতে না হতেই ম্যাকমকের আসল ভয়ঙ্কর রূপটা বেরিয়ে পড়ল সবার সামনে। যাদের যাদের মনে তখনও একটু শঙ্কা রয়ে গিয়েছিল তাদের শঙ্কাও এবার দূর হয়ে গেল। এদিকে ম্যাকমক যে রাজামশাইকে মোহাচ্ছন্ন করে রেখেছিল, সেই মোহের আবেশও কেটে গেল সঙ্গে সঙ্গে। আর রাজামশাই এবার ফেটে পড়লেন ক্রোধে, তিনি সিদ্ধান্ত নিলেন ম্যাকমককে শুলে চড়ানো হবে পরের দিনই, আর কুন্দপুরের সঙ্গে শীঘ্রই একটা বোঝাপড়ায় আসতে হবে। রাজমশাইয়ের প্রস্তাবে সায় দিলো সকলেই।


  পরের দিন সকাল হতেই রাজবাড়ির সামনে প্রজারা এসে ভীড় করতে লাগল। সবাই এক ঝলক দেখতে চায় তাদের প্রিয় রাজকুমারীকে। আর সেই সাথে দেখতে চায় রাজকুমারীর নতুন সখীকে, যার দুঃসাহস আর বুদ্ধির জোরে রাজকুমারী আবার ফিরে আসতে পেরেছেন মহেশগড়ে। 


  প্রজাদের ভীড় ঠেলে সামনের দিকে এগিয়ে এলেন ঝিলমিলের মা বাবা। ঝিলমিল আনন্দে ছুটে গিয়ে জড়িয়ে ধরল ওদের। এগিয়ে এলো ঝিলমিলের দাদাও। সে আস্তে আস্তে বলল, "আমায় ক্ষমা করিস বোন। তোকে এতদিন অনেক অবজ্ঞা করেছি কিন্তু তোর জন্যই আজ আমি প্রাণে বেঁচে গেছি, আর শুধু আমি কেন গোটা মহেশগড় রক্ষা পেয়েছে তোর জন্য। তুই সত্যিকারের বীর, এই রাজ্যের আলো।"

ঝিলমিল বলল, "এসব কথা আজ থাক দাদা। আজ আমার খুব আনন্দের দিন, তোমাদের আবার দেখতে পাবো কোনোদিনও ভাবিনি।"

এই বলে সে আনন্দে সে দাদার বুকে মাথা রাখল। আর মহেশগড়ের আকাশে শান্তির সূর্যটা আবার হেসে উঠল খিলখিলিয়ে।


Rate this content
Log in