Maheshwar Maji

Others

1  

Maheshwar Maji

Others

মেঘমল্লার

মেঘমল্লার

4 mins
1.2K


(এক)


দুদিন আগেই খবর হয়ে গেছে।বঙ্গে মৌসুমী বায়ূ ঢুকছে।স্বভাবতই সকলের মনে অল্প হলেও স্বস্তি দেখা দিল।দিন কয়েকের গরমে নাভিশ্বাস হয়ে উঠেছে মহানাগরিক জীবনযাত্রা।


প্যাচপ্যাচে ঘাম মুছে বীরেণবাবু পাশের সিটে বসা তার বয়সী ভদ্রলোককে বলে উঠলেন,

----এ বছর সময়ের আগেই সজল মেঘ আসছে শুনে বাঁচলাম।আর পারা যায় না।একবার মেঘ ঢুকে গেলে মাঝে-মাঝে বেহিসেবী বৃষ্টির ঠান্ডা ছোঁয়া পাওয়া যাবে।

পাশের ভদ্রলোকটি বীরেণবাবুর কথাটা শুনলেন কিনা বোঝা গেল না।উনি একহাতে গালের ঘাম মুছে অন্যহাতে স্মার্টফোনে ফেসবুকে কমেন্ট লিখছেন।বীরেণবাবুর খেয়াল সেদিকে নেই।তিনি তো প্রাণের কথা বলতে ব্যস্ত হয়ে পড়েছেন।কেউ শুনল বা না শুনল তাতে তার কিছু আসে যায় না।

---যাই বলুন দাদা,বর্ষায় ভিজতে খাসা লাগে কিন্তু।আমরা তো পূর্ব বঙ্গ থেকে এসেছি।ওখানেই শৈশব কেটেছে আমার।পদ্মার পাড়ে বাড়ি ছিল।বর্ষায় তার বুকটা প্রসূতি মায়ের মতই ফুলে উঠত।ভয়ঙ্করী লাগলেও।একটা মাতাল আনন্দ অনুভব করতাম প্রাণে। ভাঙা টালির ফাটল বেয়ে বর্ষার জল টুপটুপ করে মেঝেতে পড়ত।মা একটা পুরনো জামবাটি বসিয়ে দিত।যাতে না মেঝেটা ভিজে। আমি সন্ধ্যাবেলায় পড়তে বসতাম।তবে খেয়ালটা ওই টুংটাং শব্দ শোনার দিকেই ঝুঁকে থাকত।একটা ফোঁটা পড়ার কতক্ষণ পর দ্বিতীয় ফোঁটাটা পড়ল।মনে মনে তার একটা হিসেব কষতাম।বললে বিশ্বাস করবেন না, কী করে যে একশো পর্যন্ত গুনে ফেলেছিলাম আমি নিজেই শুনে অবাক।ইস্কুলে প্রতিদিন একবার করে সমবেত সুরে মাষ্টারমশাইরা একশো পর্যন্ত গুনতে বলতেন।একটানা একবারও বলতে পারিনি।সেটা ওই বৃষ্টির ফোঁটা গুনতে গিয়ে প্রথম পেরে উঠি।


শ্রোতা ভদ্রলোকটি তার সামনে দাঁড়িয়ে থাকা আর এক ভদ্রলোককে ইশারায় বলে উঠলেন,

---সিটটায় বসবেন?

উত্তরে উনি অল্প হেসে বলে উঠলেন,

---আসলে উনার মনে ইতিমধ্যে মৌসুমীবায়ূ ঢুকে গেছে।আচ্ছা বসি আমিও কিছুক্ষণ।


(দুই)


পশ্চিমদিকে আজ একখন্ড মেঘ উঠেছে।ইতি ছাদের কাপড় ক'টা টানতে গিয়ে সেই মেঘের পানে চেয়ে খানিকক্ষণ অন্যমনস্ক হয়ে পড়ল।


সেদিনও আকাশটা এরকম কালো মেঘে ছেয়ে ছিল।আকাশে বিদ্যুৎ খেলছিল।বাস থেকে নেমে আকাশের অবস্থা দেখে পাশের বুথ থেকে ইতি বাড়িতে ফোনটা করেছিল।সে হোস্টেলে থেকে পড়াশুনো করত।তার বাবা ছিলেনএকজন ব্যাবসায়ী।বাড়িতে অর্ডার মত রেডিমেড টি-শার্ট বানাতেন।আট-দশজন ছেলে কাজ করত।


কিছুক্ষণ অপেক্ষা করার পর একটা বাইক নিয়ে তার শৈলেনদা এসেছিল।তার বাবার ব্যাবসার পুরো হিসেব পত্র ওই রাখত।তারসাথে মাস্টার্সটা করছিল।ইতির পিসিমা অনেক আগেই মারা যান।তখন শৈলেন সবে দশ বছরের।তারপর তার বাবা আর একটা নতুন বিয়ে করেন।সেই মায়ের সাথে শৈলেনের সম্পর্ক ভাল ছিল না। রোজ ঝগড়া হত।তাই মাধ্যমিকটা দিয়েই ইতির বাবার কাছে থেকে যায়।সেই বছরই ইতি বাড়ি ছেড়ে হোস্টেলে ভর্তি হয়েছিল।


মাঝ রাস্তায় আসতেই এক নাগাড়ে বৃষ্টি শুরু হয়ে যায়।বাইক দাঁড় করিয়ে একটা ইস্কুলের ভেতর মাথা বাঁচিয়ে দুজনেই ঢুকে পড়েছিল। এভাবে আধ ঘন্টা যায়। বৃষ্টি থামার নাম নেয়।এদিকে সন্ধ্যার আলো চুইয়ে আসছে।অগত্যা বৃষ্টি মাথায় নিয়ে আবার তারা বেরিয়ে পড়েছিল।কিছুদূর যেতেই বাইকের আগের চাকাটা একটা জলভর্তি খালে ঝপ করে পড়ে গেল।

আর তখনি ইতি আঁকড়ে ধরেছিল শৈলেনকে।যাক পড়ে যায়নি।চাকা উঠিয়ে আবার বাইকটা চলতে শুরু করল।জল,হাওয়া আর বিদ্যুৎ এই তিনটে মিলে দুটো বিপরীত লিঙ্গের শরীর পরস্পরের প্রতি মাতাল আকর্ষণে জড়িয়ে পড়ল একটু বাদেই।সেদিনেই ইতি প্রথম চুম্বনের স্বাদ পেয়েছিল।জীবনের প্রথম অপরাধের বিনিময়ে।


সেইথেকে ইতি যতবার আকাশে কালো মেঘ দেখে, ততবার একটা গোপন অপরাধের অলীক সুখে ভেসে যায়।কতদিন...কত বছর পার হয়ে গেছে!তবু সেই মিষ্টি যন্ত্রণা আজও বুকের ভেতর অবিকল লেগে আছে।তার স্বামীর অগনিত চুম্বনের ধারাতেও সেই প্রথম চুম্বনের দাগটা মন থেকে মুছে গেল না।


(তিন)


আট বছরের তন্ময় তার পাঁচ বছরের বোন রিংকুর উদ্দেশ্যে বলে উঠল,

----দিবি নাতো?আচ্ছা দিস না।আমি কিন্তু ছাদে গিয়ে ব্রহ্মদৈত্যকে ডেকে দেব।দেখবি তখন মজা!...খাবি একা একা জেলি দুটো।

রিংকু দুহাতে দুটো জেলি ধরে পালি করে করে চাটছে।দাদার কথায় হেসে বলে উঠল,

----মিত্তে কতা।বম্মদত্তিরা গাচে তাকে।চাদে না।

---তুই কচু জানিস।আয় তাহলে আমার সাথে।দেখিয়ে দিচ্ছি থাকে কিনা?


তাই শুনে রিংকু সাহস দেখিয়ে বলে উঠল,

----চল দেখি...কোতায় তোর বম্মদত্তি?


তন্ময় ঘুরে ঘুরে সারা আকাশটার দিকে চেয়ে ঈশান কোণে এক টুকরো বর্ষার মেঘ দেখতে পেল।সেই দিকে আঙুল বাড়িয়ে রিংকুর উদ্দেশ্যে বলে উঠল,

---ওই দ্যাখ।ইয়া বড় কালো মুখ।চুলের জটা দেখেছিস কেমন ফুলছে!


কালো মেঘের মাঝে দুটো শাদা মেঘ উড়তে দেখে বলল,

----ওই দুটো ব্রহ্মদৈত্যর চোখ।লকলক করছে!..দ্যাখ...দ্যাখ তাকা ওদিকে। আমার হাতছানিতে কেমন আসছে দ্যাখ এদিকে।তোকে ওর কোলে চাপিয়ে দেব।

রিংকুর হাতটা ধরতেই সে কাঁদতে কাঁদতে বলে উঠল,

----আমাকে চাল বলছি।এ নে ধল।


তন্ময় জেলিটা হাতে নিয়ে বোনের হাতটা ছেড়ে খুব জোরে হেসে ফেলল।

রিংকু সুট করে ছাদের একটা কোণে ছায়ার নিচে লুকিয়ে পড়ল।তারপর ফিসফিস করে দাদাকে বলে উঠল,

--এই দাদা...আয় বলচি।এইখানটাই লুকিয়ে পল আমাল সাতে।দেকতে পাবে না ।তখন বম্মদত্তিটা অন্য বালি চলে যাবে।


(চার)


রামনাথের বয়স একষট্টি বছর।দশ বছর বয়সে বাপের সাথে হালের বটা ধরা শিখেছিলেন।আজও তা থেকে অবসর পেলেন না।

বলদ দুটোকে হ্যাট হ্যাট করে হালটা কাঁধে রেখে ধান বীজের থলিটা হাতে ঝুলিয়ে মাঠের উদ্দেশ্যে যাচ্ছেন।রাস্তায় মণিলালের সাথে দেখা। একগাল হেসে বলে উঠলেন,

----কী হল কাকা?এত রোদ্দুরে কোথায় চললে?বীজতলা করবে নাকি?

রামনাথ বলে উঠলেন,

----তাইতো ভাবছি।

----কী বলো কাকা! ঘরের লক্ষ্মীকে কেউ এভাবে অবহেলা করে?জেনেশুনে ধানগুলোকে কেন নষ্ট করো কাকা?এখনো আকাশে মেঘ উঠল না, রোদের জ্বালায় গা পুড়ে যাচ্ছে ।আর তুমি বীজতলা করতে যাচ্ছ!যত বয়স হচ্ছে,বুদ্ধি তোমার লোপ পাচ্ছে দেখছি।বাড়ি ফিরে চলো।


কথাটা শুনে রামনাথ অল্প হাসলেন।তারপর উত্তর দিলেন,

----এসেছি যখন,তখন বীজতলাটা না করে ফিরব না। তাতে যা হওয়ার হবে।


মণিলাল একটু অবজ্ঞার ভঙ্গি করে পাশ কেটে চলে গেলেন।


এত বছরের অভিজ্ঞতা কী তবে মিথ্যে?রামনাথ আর একবার ভাল করে শ্বাসবায়ুটা টানলেন।তারপর বুকের হাওয়াটা ছেড়ে বলে উঠলেন,

---অসম্ভব!

শুষ্কবায়ুতে জলীয়বাষ্প ঢুকতে শুরু করলে বাতাসের গন্ধটা একটু পাল্টে যায়।রামনাথ এত বছর প্রকৃতির সাথে মিশে অনেক কিছু আন্দাজ করতে শিখে গেছেন।চাঁদ-সূর্যের আলো আর বাতাস,শিশিরের ঘ্রাণ শুঁকে প্রকৃতির খামখেয়ালীপনাকে অনায়াসে বুঝে নিতে পারেন তিনি।সেই অভিজ্ঞতা থেকেই উপলব্ধি করলেন,আর এক,দু দিনের মধ্যেই বর্ষার মেঘ হানা দেবে।তাই তিনি আগেভাগেই বীজতলাটা কায়দা করে রেখে দিচ্ছেন।যাতে পরে সুবিধে হয়।তিনি নিজের বিশ্বাসের কাছে হারতে রাজি নন।তাতে লোকে যা বলার বলুক।


তার একদিন পরেই ঝমঝম করে বৃষ্টি শুরু হয়ে গেল।চালার জটলার মাঝে মণিলাল হঠাৎ করে রামনাথের উদ্দেশ্যে বলে উঠলেন,

---কাকা হে তুমিই জিতে গেলে।সেদিন যদি আমিও তোমার দেখাদেখি একটা তলা করে রাখতাম তাহলে হিড়ের জমির চারাটা এগিয়ে থাকত।

কথাটা শুনে রামনাথ মনে,মনে হাসলেন।মুখে কিছু বললেন না।কারণ তার সাথে প্রকৃতির যে সম্পর্ক একটা গড়ে উঠেছে,সেটা জোর দিয়ে অন্য কাউকে বিশ্বাস করাতে চান না।

   ------সমাপ্ত-----


Rate this content
Log in