শিপ্রা চক্রবর্তী

Others

4  

শিপ্রা চক্রবর্তী

Others

লালমণি

লালমণি

3 mins
244


চক্কোত্তি ঠাকুররা নিশিপুর গ্রামের একমাত্র বামুন পরিবার। এই নিশি পুর গ্রামে জেলেদের বাস। কোন এক কালে এই গ্রামের জমিদার বাড়ির গিন্নিমাকে নিশিতে ডেকে নিয়ে গেছিল, সেই থেকে এই গ্রামের নাম নিশিপুর। সবই লোকমুখে শোনা কথা। এই গ্রামে সেই রকম অবস্থাপন্ন লোক নেই বললেই চলে, সবার দিন আনা দিন খাওয়া অবস্থা, তবে টুকিটাকি বাড়ির পূজো, গ্রামের দূর্গা পূজো, সরস্বতী পূজো এইগুলো চক্কোত্তি ঠাকুর করেন, আর আছে জমিদারদের শীতলা মাতার মন্দির এই মন্দিরের নিত‍্য পূজারি চক্কোত্তি ঠাকুর। তবে রোজগার খুব কম। চক্কোত্তি ঠাকুরের দুই মেয়ে এক ছেলে। কোন রকমে অভাব অনটনের মধ‍্যে দিয়ে দিন চলে আরকি। চক্কোত্তি ঠাকুরকে গ্রামের লোকেরা খুব ভক্তি শ্রদ্ধা করে।

ফিবছর গ্রামের সজল হালদারের একমাত্র ছেলের খুব অসুখ হয়ে ছিল। জ্বর কিছুতেই সারে না!!! একেবারে যমে মানুষে টানাটানি, সবাই এক রকম হাল ছেড়েই দিয়ে ছিল,তখন চক্কোত্তি ঠাকুর বিপত্তারিনি পূজো করার পরামর্শ দেন সজল হালদারকে। ঠাকুরের কৃপায় সে.... যাত্রায় সজল হালদারের ছেলে বেঁচে ফেরে যমের দুয়ার থেকে। চক্কোত্তি ঠাকুর নিজে ওদের বাড়িতে বিপত্তারিনি পূজো করেছিলেন, এবং মন্ত্রপূত ধাগা সজল হালদারের ছেলের হাতে বেঁধে দিয়ে ছিলেন। এই বছরও তাই সজল হালদার এসে বলে গেছে পূজোর কথা।

সকাল সকাল উঠে স্নান সেরে শুদ্ধ বস্ত্র পরে গায়ে নামাবলি চাপিয়ে চক্কোত্তি ঠাকুর চললেন সজল হালদারের বাড়ি। নিয়ম বিধি মেনে মায়ের পূজো করে সজল হালদারের ছেলের হাতে মন্ত্রপূতো বিপত্তারিনির ধাগা বেঁধে দিলেন। পূজো শেষে এবার দক্ষিনা নেওয়ার পালা। কিন্তু সজল যেন কোথায় ছুটে চলে গেল। চক্কোত্তি ঠাকুর মনে মনে ভেবেছেন এই দক্ষিণার টাকায় গিন্নির জন‍্য একটা লাল পেড়ে সাদা শাড়ি নিয়ে যাবেন। অনেকদিন ধরে গিন্নি রং চটা শাড়ি পরে কাটিয়ে দিচ্ছে। অভাবের সংসার তাই মুখ ফুটে কিছু বলেনা।

----------কিছুক্ষনের মধ‍্যে সজল হালদার একটা গরু নিয়ে এসে চক্কোত্তি ঠাকুরের সামনে দাঁড়ালেন।

-----------চক্কোত্তি ঠাকুর বিস্ময় নিয়ে জিজ্ঞাসা করলেন, কিরে.... সজল এই গরু আনলি কেন??? কি... হবে গরু???

-----------সজল হলদার হাসি হাসি মুখে বলে উঠলেন আসলে ঠাউর মশাই আমার বউ ছেলের অসুখের সময় মানত করেছেল ব্রাহ্মন কে.... গরু দান করবে, তাতে নাকি প্রচুর পূন‍্যি লাভ হবে!!!তাই হাট থেকে এই গরুটা নিয়ে এইচি... আপনার জন্য।

------------চক্কোত্তি ঠাকুর মনে মনে বলে উঠলেন, একেই আমাদের এতগুলো লোকের পেট..... চালাতে গিয়ে আমার হিমশিম অবস্থা, তার ওপরে এই অবলা প্রানিকে কি.... খাওয়াব!!!

-----------চক্কোত্তি ঠাকুরকে ভাবতে দেখে সজল হালদার বলে উঠল, কি.... হল ঠাউর মশাই গরু নেবেন নে.....। বউ মানত করিছেল যে......

------------সজল হালদারের কথায় ভাবনার জগত থেকে বেড়িয়ে এসে চক্কোত্তি ঠাকুর বলে উঠলেন হ‍্যাঁ.... নেব, দিবি বলে যখন মানত করেছিস। তোরা সব ভালো থাক, সুস্থ থাক। এইবলে গরুর বাঁধনটা ধরে এগিয়ে চললেন নিজের বাড়ির দিকে। আর মনে মনে ভাবতে লাগলেন এর খাবার তো.... জোগাড় করতে হবে!!! কি.... থেকে যে.... কি করব... কে....জানে!!!

বাড়ি ঢোকার সাথে সাথে ছেলে মেয়েরা যেন আনন্দে হামলে পড়ল পোষ‍্যকে দেখে। কেউ গায়ে,কেউ মাথায়, কেউ গলায় হাত বোলাতে লাগল আর গরুটা আনন্দে শিং দুলিয়ে ডাক ছাড়তে লাগল। ওরা ওর নাম দিল লালমনি।

----------চক্কোত্তি ঠাকুর গিন্নিকে... সমস্ত ঘটনা বিস্তারিত ভাবে বললেন।

----------চক্কোত্তি গিন্নি দীর্ঘনিঃশ্বাস ফেলে বলে উঠলেন, অভাবের সংসারে আর একটা সদস‍্য বাড়ল এই যা.....!!! কি.... আর করা যাবে!!! অবলা প্রানি না.... খাইয়ে তো.... আর রাখা যাবেনা!!! আমাদের যেমন জুটছে ওরও... জুটে যাবে।

এইভাবে কেটে গেল পাঁচটা বছর। চক্কোত্তি ঠাকুরের সংসার এখন বেশ স্বচ্ছল। লালমনি যেন উন্নতির প্রতিক রূপে পা.... দিয়েছিল চক্কোত্তি ঠাকুরের ঘরে। চক্কোত্তি ঠাকুর নিজের গ্রামের পাশাপাশি, পাশের গ্রামেও বেশ কিছু বাড়ির এখন পূজো করেন। তারপর এখন দূর্গা পূজোর ডাকও আসে, আসে পাশের গ্রামগুলো থেকে। ললমনিও এখন দুগ্ধবতি গাভী। তার তিন সন্তান, একজন লালি, ফুলি আর একজন বেনু। লালমনি আর লালির দুধ বেচে বেশ পয়সা আসে সংসারে। এখন চক্কোত্তি ঠাকুরের বেশ বড় সুখের সংসার পোষ‍্যদের নিয়ে।


Rate this content
Log in