কবিতার দেশের কন্যা
কবিতার দেশের কন্যা
" এসো তবে আমরা ভালবাসি,এসো ভালবাসি
ধাবমান প্রহর কে উপভোগ করি দ্রুত
মানুষের কোনো বন্দর নেই
সময়ের কোনো তটরেখা নেই
শুধু বয়ে চলে,আমরাও পার হয়ে যাই।'
-আলফঁস দ্য লামারতিন
মদ জিনিষটা সৌগত কে কোনোদিনই তেমন আকর্ষন করেনা।হংকং এর রিগাল হোটেলে তখন চলছে গালা পার্টির উত্তেজনা।থরে থরে সাজানো রয়েছে দামি স্কচ।
'চিয়ার্স'-বলে পার্টির উদ্বোধন করলেন ওদের কোম্পানির এম.ডি মিঃ প্যাটেল।তারপরেই শুরু হল উদ্দাম নাচ,গান আর আলোর রোশনাই।
ভদ্রতার খাতিরে নিয়ম রক্ষার্থে এক পেগ শেষ করে সৌগত বল রুম থেকে বেরিয়ে এলো।তার কিছুক্ষনের জন্য একা হয়ে যেতে ইচ্ছা করছে।মানুষ যতই বলুক যে একা থাকা যায়না সৌগত র মনে হয় একাকীত্বের ও একটা নিবিড় আনন্দ আছে।অনেকের মধ্যে থাকলে ভাবনা চিন্তার অপার স্বাধীনতায় কোথায় যেন রাশ পড়ে।
সৌগত এবার দশ তলা রিগাল হোটেলে উদ্দেশ্যহীন ভাবে ঘুরে বেড়াতে লাগল।কলকাতায় থাকলে চেন্নাই বা গাজিয়াবাদের মানুষদেরই মনে হয় দুরের অচেনা মানুষ অথচ হংকং এর মানুষদের সঙ্গে কমিউনিকেট করতে বাংলা মিডিয়মে পড়া সৌগতর কিছুমাত্র অসুবিধা হচ্ছেনা।পৃথিবীর সমস্ত মানুষই বোধহয় আসলে কোথাও না কোথাও একইরকম।পৃথিবীর সব দেশের মানুষেরই আবেগের বহিঃপ্রকাশ মোটামুটিভাবে একই ।
হোটেল সংলগ্ন একটি দোকান থেকে সৌগত বেশ কিছু চাবির রিং,পারফিউম,চকোলেট ইত্যাদি কিনে ঘরে গিয়ে দেখল চাবি কাজ করছেনা অর্থাৎ তার আর ঘরে ঢোকার উপায় নেই।সৌগত রিসেপসনে দৌড়াল।
সৌগত কে রিসেপসনে আসতে দেখে একটি মেয়ে দৌড়ে এল।কিছু কিছু নারীর সৌন্দর্য পুরুষকে অবশ করে দেয়।এই মেয়েটিও সেইরকম।এ যেন মাঁতিস এর আঁকা কোনো অনবদ্য পেইন্টিং।সৌগত স্থানুবৎ দাঁড়িয়ে রইল।
মেয়েটির গায়ের রঙ আক্ষরিক অর্থেই দুধে আলতা।চোখ দুটি ভূমধ্যসাগরের মত নীল।কাঁধ অবধি নেমে এসেছে সোনালী রঙের ঢেউ খেলানো অহঙ্কারি চুল।চাহনির মধ্যে অপার এক পবিত্রতা।মেয়েটি যেন স্বর্গের কোনো দেবী যাকে দেবরাজ ইন্দ্রের অভিশাপে মর্তে নেমে আসতে হয়েছে।মেয়েটি পরে রয়েছে কালো রঙের কোট এবং হাঁটু পর্যন্ত স্কার্ট।মেয়েটির সাদা ধবধবে পা দুটি যেন মোমের তৈরি অপরূপ এক ভাস্কর্য।
''গুড ইভনিং স্যর,আই অ্যাম ইনিকা।হাউ ক্যান আই হেল্প ইউ স্যর?''
''ইনিকা?..আই থিঙ্ক ইউ আর নট এ চাইনিজ্?''
-''নো, নো স্যার,আই অ্যাম ফ্রেঞ্চ।আই লিভ ইন অঁরিঁ,নিয়ারার টু প্যারি''..
-''আই অ্যাম সৌগত,আই অ্যাম ইন্ডিয়ান,বেঙ্গলি,আই লিভ ইন কোলকাতা।''
-ইনিকা অপার বিস্ময়ের সঙ্গে বলল'',-ওঃ কলকাতা? দ্যা প্লেস অফ দ্যা গ্রেট ফিল্ম মেকার স্যাট্যাজিট্ রে!আই অ্যাম দ্য গ্রেট ফ্যান অফ হিম।''
সৌগত চমকে উঠল!
মেয়েটি নিমেষের মধ্যে চাবি দিয়ে দরজা খুলল।সৌগত র ভীষন ইচ্ছে করছে মেয়েটির সঙ্গে কিছুক্ষন গল্প করতে।
'সত্যজিৎ রায়'-এই নামটাই যেন ওদের দুজনের মধ্যে অদৃশ্য এক সেতু রচনা করেছে।
দরজা খুলে দিয়ে মেয়েটি ঘরে ঢুকে সবকটি আলো জ্বালিয়ে দিল,চালু করে দিল এসি।বাথরুমের টাওয়েল এবং টয়লেটরিস গুলো ঠিকঠাক আছে কিনা দেখে নিল, তারপর বিছানার চাদরটাকে আরো একটু টানটান করে সোফায় এসে বসল পায়ের উপর পা তুলে।মেয়েটির সাদা ধবধবে পায়ের মধ্যে পরিস্ফুট হয়ে রয়েছে নীল রঙের শিরা উপশিরা।
''তুমি ফরাসি হয়েও হংকং এ কাজ করছ ইনিকা?''
''আমি এখনও পাস-আউট হইনি।আমি এখন ট্রেনিং এ আছি,ইনস্টিটিউট থেকে আমাকে এখানে পাঠিয়েছে।দু বছর পরে আমি ফিরে যাব ফ্রান্সে,ওখানকার হোটেলে কাজ করব।''
''প্যারি তে তোমার বাড়িতে কে কে আছেন?''
''-আমার মা আর আমি।আমার মা সিঙ্গল পেরেন্ট,বাবা কে আমার এখন মনে পড়েনা৷
-তোমার?''
''-আমার মা, বাবা, বোন..''
''-তুমি ব্যাচেলর?''
''-হুম,তুমিও তো ব্যাচেলর..''
ইনিকার চোখদুটি এবার হেসে উঠল।
''-আমি এখানে পড়ে আছি,ওখানে মা একা একা৷মা কে খুব মিস করি জানো?
ইনিকার চোখে এক বিষাদ নেমে এল।
''তুমি সত্যজিৎ রায় কে কিভাবে চিনলে?''
''-ওমা! তুমি জানোনা?ফ্রান্সে সত্যজিৎ ভীষনই জনপ্রিয়,ওনার সবকটি বই ফরাসি ভাষায় অনুবাদ হয়েছে,ওনার ফিল্ম ফ্রান্সে অত্যন্ত জনপ্রিয়।আমি পড়েছি ওনার লেখা বই 'ফটিকচাঁদ',ওনার ফিল্ম ও দেখেছি 'দ্য স্ট্রেঞ্জার'।''
''হ্যাঁ ওটাই ওনার শেষ ছবি,বাংলায় ছবিটার নাম আগন্তুক''।
''-হ্যাঁ আমিও ওনার অন্ধ ভক্ত।ওনার সব লেখা, সব ফিল্ম আমার পড়া ও দেখা।হি ইজ আ জিনিয়াস।''
কথা বলতে বলতে ওরা উঠে এসেছে জানলার ধারে।রিগাল হোটেলটি একেবারে এয়ারপোর্টের গায়ে।অন্ধকার আকাশ ফুঁড়ে নেমে আসছে একের পর এক বিমান।আবার পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্তে উড়েও যাচ্ছে বিমানের দল।একটু দুরেই আলোকমালায় সেজে উঠেছে রাতের হংকং।পৃথিবীর দুই প্রান্তের দুজন যুবক যুবতী এক অচেনা দেশের জানলায় পাশাপাশি দাঁড়িয়ে সেই প্লেনগুলির নিরন্তর ওড়াউড়ি দেখতে লাগল নিশ্চুপ হয়ে।
ইনিকা হঠাৎ খুব উত্তেজিত হয়ে বলল,''-ঐ দেখ, ঐ দেখ,ঐ প্লেনটা প্যারি তে যাচ্ছে,আমার মায়ের কাছে৷''
সৌগত ইনিকার আঙুলগুলো নিজের আঙুলে স্পর্শ করে ফিসফিস করে বলল,''-তুমি চিন্তা করোনা,আমি ওদের বলে দিয়েছি তোমার মায়ের কাছে তোমার খবর পৌঁছে দিতে।''
ইনিকার মুখ এক স্বর্গীয় হাসিতে ভরে উঠল।এ হাসির সঙ্গে শুধু দেবশিশুদের হাসিরই তুলনা চলে।
লম্বা করিডর ধরে নিজের জায়গায় ফিরে যেতে যেতে লিফট্ এ ওঠবার আগে শেষবারের মত সৌগতর দিকে ফিরে হাত নাড়ল ইনিকা।দুজনের চোখেই বিষাদমাখা এক বিদায়ের সুর।
তবু সমস্ত বিষাদের স্মৃতির মধ্যেও বোধহয় কিছু সুখস্মৃতি লুকানো থাকে।
সৌগত র মনে পড়ল 'লেওপোল্ড সেঙ্খরের' একটি কবিতা-
"হে বন্ধু তোমাকে ফিরতে হবে
আমি তোমার প্রতীক্ষায় থাকব,কেইসড্রাট গাছের নিচে-
জলপোতের অধিপতির কাছে আমি এই গোপন কথা বলেছি-
অনেক প্রতিশ্রুতি নিয়ে তুমি ফিরে আসবে
সূর্য ডুবে গেলে ম্লান রাত্রি যখন ভর করে বাড়ির ছাদে-সেই কী তোমার ফিরে আসার চিহ্ন!"