শিপ্রা চক্রবর্তী

Children Stories Others

3  

শিপ্রা চক্রবর্তী

Children Stories Others

ঘরে ফেরা...

ঘরে ফেরা...

4 mins
194



রঘু, বিলাই, মন্টু, এদের জীবন চলে ট্রেন আর ট্রেনলাইনকে নিত‍্য সঙ্গী করে। ট্রেন লাইনের ধারে গড়ে ওঠা হাজার ঝুপড়ির নতুন বস্তিতে ওদের বাস। সবার বয়স এই বারো থেকে পনেরোর কাছাকাছি। তবে ওদের এই বস্তিতে দুটো দল আছে একটা রঘু, বিলাই, মন্টু এদের, আর একটা লালটু, ভোলা আর ছোটনদের। তবে লালটু, ভোলা, ছোটন ওরা বয়সে রঘু, বিলাই, মন্টু এদের থেকে বছর দুই, তিনেকের বড়ই হবে। ভোর রাত থেকেই ওদের চলে লড়াই। সবাই যখন গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন হয়ে স্বপ্নের রাজ‍্যে পাড়ি জমাতে ব‍্যস্ত, তখন ওরা বাস্তবের কঠিন মাটিতে দাঁড়িয়ে লড়াই করতে ব‍্যস্ত। আর এই লড়াইটা শুধুমাত্র দুবেলা দুমুঠো ভাতের জন‍্য। যে.... ভাত অনেকেই অতি সহজে পেয়েও নষ্ট করে, ডাস্টবিনের মধ‍্যে হয় তার ঠিকানা । আর এরা সেই একমুঠো ভাতের জন‍্য নিজের জীবনের তোয়াক্কা করেনা।

ছোটনদের দলটা সুযোগ পেলেই রঘুদের ওপর চড়াও হয়। মাঝে মাঝে হাতাহাতিও লেগে যায়। একবার তো.... ট্রেন লাইনের ওপর মারামারি করতে গিয়ে পড়ে, পাথরে হাত পা... কেটে যাচ্ছেতাই অবস্থা। তবে ওদের কাজ একটাই, আর সেই কাজটা হল কয়লা চুরি। কয়লা বোঝাই মালগাড়ি যখন এই লাইনের ওপর দিয়ে ছুটে যায়, তখন চলন্ত ট্রেনে দলবেঁধে ওরা উঠে পড়ে, তারপর কয়লা বস্তায় ভরে ফেলতে থাকা। আর এই কাজ ওরা সবাই এক সাথেই করে। তারপর কয়লা বোঝাই বস্তা গুলো টেনে হিজড়ে নিয়ে আসে বস্তির সর্দার রফিক চাচার কাছে। আর রফিক চাচা ওদের সবার হাতে পারিশ্রমিক হিসেবে টাকা তুলে দেয়। রাতের শেষে নতুন সূর্যের আলো ফোটার সাথে সাথে এই টাকাটার যে খুব প্রয়োজন ওদের সংসারে।

ছোটনদের দলই প্রথম রঘুদের দলটাকে নিয়ে গিয়েছিল রফিক চাচার কাছে। তখন ওদের মধ‍্যে বেশ ভালোই বন্ধুত্ব ছিল, কাজের শেষে সবাই মিলে একসাথে ট্রেন লাইনের ধার দিয়ে দিয়ে এগিয়ে যেত শহরের মধ‍্যে। ওদের থাকার জায়গাটাতে..... তো কোন সৌন্দর্য নেই!!! চারিদিক জুড়ে শুধু নর্দমা পঁচা গন্ধ, আর ছেঁড়া ছেঁড়া ত্রিপলের ঝুপড়ি আর তার মাঝে কঞ্চির বেড়া। কিন্তু শহরের ভীতরে কত বড় বড় বিল্ডিং, রাস্তার মোড়ে মোড়ে কত আলো, কত বাহারি বাহারি দোকান, কত রকমের খাবার, দেখলেই যেন জিভে জল চলে আসে।

ছোটন,লালটু, ভোলা ওদের হাত ধরেই রঘু, বিলাই, মন্টু এই সবকিছু দেখেছিল। ওদের হাত ধরেই প্রথম বিড়িতে সুখটান দেওয়া, কায়দা করে ধোঁয়া ছাড়া, ওদের তালে তাল মিলিয়ে সুন্দর মেয়েদের দেখে মন্তব‍্য করা, সবকিছুর প্রথম অভিজ্ঞতা ওদের হাত ধরেই হয়েছে রঘুদের। আর তারপর যখনই ওদের একটু বেশি রোজগার হত, মানে ঘন ঘন কয়লার গাড়ি আসত তখন ওরা শহরের বুকে এসে ঘুগনি, ঝালমুড়ি, ফুচকা এইসব খেত। দুই একবার সিনেমাও দেখেছে হলে বসে একসাথে। সেইসব দিনের কথা এখনও রঘু মাঝে মাঝে ফাঁকা ট্রেনলাইনের দিকে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকতে থাকতে ভাবে। আর এও ভাবে তাদের সম্পর্ক কি আর আগের মত হবেনা!!!!

যবে থেকে রঘু রফিক চাচার কাছে বলে দিয়েছে যে,ছোটন,লালটু, ভোলা এরা কয়লা চুরি করে আলাদা ভাবে বাজারে বেঁচে, তখন থেকেই ওদের সাথে সমস্ত বন্ধুত্ব কেটে গেছে ছোটনদের , আর তারপর থেকে রফিক চাচাও রঘুদের একটু বেশিই ভালো বাসে, ছোটনদের থেকে। আর ছোটনরা তবে থেকেই ওদের শত্রু হয়েগেছে।

কিন্তু গত সপ্তাহে কদিন ধরে টানা বৃষ্টি হয়ে চলেছে থামা থামির নাম নেই, বর্ষাকাল ওদের কাছে খুব কষ্টের। বর্ষাকালে বৃষ্টি পড়া, প্রকৃতির সৌন্দর্য উপভোগ করা, ভালো ভালো খাবার খাওয়ার মত বিলাসিতা করার সময় ওদের নেই, কারন বর্ষা মানে ওদের ঘরের চাল দিয়ে জল পড়া, বাইরে জল থইথই, ড্রেনের জল, বৃষ্টির জমা জল তখন মিলেমিশে একাকার। কাজের অভাব, সুতরাং খাবারে টান। তাই বর্ষা প্রকৃতির বুকে নতুন প্রানের সৃষ্টি করলেও ওদের তখন ওষ্ঠাগত প্রান হয়ে যায়। তারপর কয়লার গাড়িও আসেনি দুসপ্তাহ ধরে, কিন্তু রফিক চাচা ওদের বলেছে আজ কয়লার গাড়ি আসবেই, তাই ওরা বৃষ্টির মধ‍্যে মাথায় প্লাস্টিক মুড়িয়ে ট্রেনলাইনের ধারে অপেক্ষা করছে কয়লার গাড়ি আসার। আর ওদের থেকে একটু দুরে দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করছে ছোটনদের দল।

ওদের সবার অপেক্ষার অবসান ঘটিয়ে ঘষা ঘষা নিয়ন আলো ছড়িয়ে, হুইশেল দিতে দিতে এগিয়ে আসতে লাগল কয়লা বোঝাই গাড়ি। আর ওদের ঠোঁটের কোনে ফুটে উঠল আনন্দের হাসি। ওরা সবাই হুটোপুটি করে উঠতে শুরু করল, কিন্তু প্রচন্ড বৃষ্টি হওয়ায় সবকিছু তালগোল পাকিয়ে গেল, এতদিনের অভিজ্ঞতা থাকা সত্বেও ছোটন উঠতে গিয়েও উঠতে পারলনা পুরোপুরি, ঝুলতে লাগল। আর বৃষ্টির জন‍্য সবকিছু কেমন যেন স্লিপ হয়ে আছে, হাতটাও ঠিকমত ধরে রাখতে পাড়ছেনা, ছেড়ে গেলেই একবারে সোজা ট্রেন লাইনের তলায়, বাঁচার কোন আশা নেই!!! কিন্তু ছোটন প্রানপন চেষ্টা করছে ওপরে ওঠার। ছোটনের হাতের বাঁধন ছেড়ে যাচ্ছে একটু একটু করে, ছোটন বুঝতে পারছে সব শেষ!!! কিন্তু হঠাৎ করে ছোটন অনুভব করল, ওর হাতটা কে যেন শক্ত করে ধরল। ছোটন বৃষ্টির মধ‍্যেও ঝাপসা দৃষ্টিতে চেয়ে দেখল রঘু।

------------রঘু তখন চিৎকার করছে বিলাই, মন্টু তাড়াতাড়ি আয় ছেটনদাকে ওপরে তুলতে হবে!!!

সবাই বস্তা বোঝাই করা বন্ধ করে দিয়ে ছোটনকে ওপরে তুলতে লাগল। ছোটন মৃত্যুকে খুব কাছ থেকে উপলব্ধি করে, নতুন জীবন ফিরে পেল, সেই আনন্দে সবকিছু ভুলে রঘুকে বুকের মাঝে জড়িয়ে ধরল। আর বাকি সবাই একসাথে ওদের জড়িয়ে ধরল। ততঃখনে গাড়ি অনেকটা এগিয়ে গেছে এখন আর কয়লা বোঝাই বস্তা নিয়ে নামা যাবেনা!!! ধরা পড়ে যাবে তাহলে, কারন সামনেই স্টেশন আছে।

কিছুক্ষণের মধ‍্যে ট্রেন হুইশেল দিতে দিতে প্ল‍্যাটর্ফমে ঢুকে পড়ল, ওরাও ঝটফট নেমে পড়ল। বৃষ্টি তখন কিছুটা কমেছে। আর অল্প অল্প করে ভোরের আলো ফুঁটে উঠতে শুরু করেছে। সূর্যি মামা মেঘের আড়াল থেকে উঁকি দেওয়ার চেষ্টা করছে। বাকি পথটা ওদের এবার হেঁটেই ফিরতে হবে। সবার প্রথমে রঘু, তারপর বিলাই, মন্টু, লালটু, ভোলা আর সবার শেষে ছোটন একে অপরের কাঁধে হাত দিয়ে পু.... ঝিক... ঝিক... আওয়াজ করতে করতে ট্রেনের মত এগিয়ে চলল, ট্রেন লাইনের পাশ দিয়ে। এখন ওদের একসাথে ঘরে ফেরার পালা। আজ আর ওদের কোন টাকা পাওয়া হবেনা!!! তবে ওদের মাঝে হারিয়ে যাওয়া সেই বন্ধুত্বটা জোড়া লাগল, এবং আরও জোড়াল হল।





Rate this content
Log in