।।ডবল সারপ্রাইজ।।
।।ডবল সারপ্রাইজ।।
রনি, কলকাতার নামকরা সার্জন ড. কৌশিক সেনের একমাত্র ছেলে। ভালো নাম অবশ্য একটা আছে, সৌজন্য সেন। তবে রনি নামটাই বেশি পরিচিত। ওই নামেই বেশিরভাগ মানুষ ওকে চেনে।
আজ সকাল থেকেই রনির মনটা খারাপ। প্রতিবছর আজকের দিনটা ওর একটুও ভালো লাগে না। আজ ভাইফোঁটা। আশেপাশের সব বন্ধুদের সবার দিদি আছে, সবাই কত মজা করে। আর ও সারাদিন মন খারাপ করে বসে থাকে। বন্ধুদের কাছেও কত গল্প শোনে, সবাই কত উপহার পায় সেই সব সবাই ওকে দেখায়। কিন্তু ওর চুপ করে সেগুলো দেখা আর শোনা ছাড়া কিছুই করার থাকে না। ওর যে দিদি, বোন কেউই নেই। ওর সব সময় মনে হয়, কেন যে ভগবান ওকে একটা দিদি বা বোন দিলো না কে জানে। অন্য দিন তাও বন্ধুদের সাথে খেলে সময়টা কেটে যায়। কিন্তু আজ সারাদিন বাড়িতে বসেই কাটাতে হবে। বাবাও সারাদিন অফিসে থাকবে, আর মা তো কবেই ওদের ছেড়ে না ফেরার দেশে পাড়ি দিয়েছে। মায়ের মুখটাও ভালো করে মনে পড়ে না।
মালতী মাসি এলে ওর একটু ভালো লাগে। ওকে কতরকম মজাদার গল্প শোনায়,ওর সব পছন্দের খাবার রান্না করে দেয়। ওর খুব ভালো লাগে। এমনিতে বাড়িতে ওরা দুজন মানুষ। রনি নিজে, আর ওর বাবা। এছাড়া ওদের বাড়ির কাজের লোক রামুকাকা। অবশ্য ওরা কেউই রামুকাকাকে কাজের লোক ভাবে না। সবাই বাড়ির লোকই মনে করে। আর আছে মালতী মাসি। মালতী ওদের বাড়ি সকালে আসে তারপর সারাদিন থেকে রান্না, ঘরের কাজ সব করে রাতে বাড়ি চলে যায়। এছাড়া ড্রাইভারকাকু, দারোয়ানকাকু, মালিকাকু নিয়ে আরও তিনজন লোক। এইসব কথা মনে মনে ভাবতে ভাবতে ওর হঠাৎ মনে পড়ল- আজ এখনো মালতী মাসি আসে নি। অন্য দিন তো এতক্ষণে এসে যায়। শরীর খারাপ হলো নাকি। ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখল দশটা বেজে গেছে। একবার ভাবল- রামু কাকাকে বলবে মালতী মাসির বাড়ি নিয়ে যেতে। রামুকাকা চেনে মালতী মাসির বাড়ি। আর কিছুক্ষণ অপেক্ষা করে ও তাড়াতাড়ি তৈরি হয়ে নীচে নেমে এল।
-রামুকাকা, আমাকে একবার মালতী মাসির বাড়ি নিয়ে চলো তো।
-খোকাবাবু, তুমি এত চিন্তা করছ কেন? তুমি একটু অপেক্ষা কর মালতী ঠিক চলে আসবে।
-আচ্ছা, ঠিক আছে। আমি আধঘণ্টা অপেক্ষা করব। এর মধ্যে না এলে তুমি আমাকে মালতী মাসির বাড়ি নিয়ে যাবে।
-আচ্ছা, ঠিক আছে।
রনি চুপচাপ ওপরে চলে গেল।
(২)
একসপ্তাহ আগে...
-তুমি কে ? কাকে চাই?
-আমি রুমি, আমার মা এখানে কাজ করে।
-কে দারোয়ান কাকু?
-মালতী দিদির মেয়ে এসেছে।
-ও আচ্ছা। ভেতরে আসতে দাও।
-যাও।
-আজকে মালতী মাসি এলো না কেন?
-মায়ের খুব জ্বর। তাই কয়েকদিন আসতে পারবে না। আমি এটাই বলতে এসেছিলাম।
কথাটা বলেই রুমি ওখান থেকে চলে গেল।
রনি মনে মনে ভাবতে থাকে-ইসস, মালতী মাসির জ্বর হয়েছে কিন্তু ও কী করবে এখন? বাবাও বাড়িতে নেই।
-খোকাবাবু, তুমি খেয়ে নাও আমি মাখন পাউরুটি নিয়ে এসেছি।
-আচ্ছা, রামুকাকা, তুমি মালতী মাসির বাড়ি চেনো?
-হ্যাঁ, চিনি। কিন্তু...
-কোনো কিন্তু নয়, তুমি তাড়াতাড়ি চলো।
রনি রামুকে নিয়ে মালতীর বাড়ি আসে। ওদেরকে দেখে রুমি অবাক হয়ে যায়। রনি রুমিকে বলে - তুমি কোনো ডাক্তার দেখিয়েছ ?
-হ্যাঁ, আমাদের পাড়ার ডাক্তার দেখিয়েছি। অনেকগুলো ওষুধ লিখে দিয়েছে। এখনো কিনে আনা হয়নি।
-আচ্ছা, তুমি প্রেসক্রিপশনটা রামুকাকাকে দিয়ে দাও। আর রামুকাকা ওষুধগুলো নিয়ে এসো সঙ্গে কিছু ফল নিয়ে আসবে।
-আমি এক্ষুনি যাচ্ছি।
-মাসি তুমি কিছুদিন বাড়িতে বিশ্রাম নাও। আমি রোজ এসে তোমাকে দেখে যাব।
রনি ওখান থেকে চলে গেলে রুমি বলে- ছেলেটা খুব ভালো তাই না মা? তোমাকে খুব ভালোবাসে। ওত বড়োলোকের ছেলে তাও...
-সবাই একরকম হয় না রে। তুই একজনকে দেখে বাকি সবাইকে বিচার করিস না। রনি খুব ভালো ছেলে। এরপর প্রতিদিনই রনি এসে ওর মালতী মাসিকে দেখে যায়। রুমির সাথেও বেশ ভাব হয়ে গেছে। এখানে ওদের সাথে খেয়ে তারপর ও বাড়ি যায়।
একসপ্তাহ আগের এইসব কথা ভাবতে ভাবতে ও শুনতে পায় কারা যেন নীচে কথা বলছে। ও নীচে গিয়ে দেখে মালতী আর ওর মেয়ে রুমি এসেছে। ও ওদেরকে দেখে খুব খুশি হয়। তবে একটু রাগ করে দেরিতে এসেছে বলে। কিন্তু যখন রুমি ওকে বলল- তোকে ভাইফোঁটা দেব বলে সব জোগাড় করতে করতে দেরী হয়ে গেল। রাগ করিস না ভাই।
এই কথাটা শোনার পর ও ভীষণ খুশি হল। সব সাজিয়ে গুছিয়ে ভাইফোঁটার অনুষ্ঠান শুরু হল। রনি আজ খুব খুশি। এতদিনের ইচ্ছটা আজ পূরণ হল।
-নে তাড়াতাড়ি জলখাবার খেয়ে নে।
-আজ কি করেছ মাসি?
-তোর পছন্দের সাদা আলুর তরকারি আর ফুলকো ফুলকো লুচি। তাড়াতাড়ি খেতে বস না হলে ঠাণ্ডা হয়ে যাবে।
-আজকে আমরা সবাই একসাথে খাব। তুমি, আমি, রুমিদিদি, রামুকাকা। শুধু বাপি থাকলে খুব মজা হত।
-মনখারাপ করিস না দেখবি তোর বাবা ঠিক চলে আসবে। তোরা খেয়ে নে। আমি ততক্ষণ দুপুরের খাওয়া-দাওয়ার জোগাড়টা করি।
-দুপুরে কি হবে?
-আমি রামুদাকে বলে সব তোর পছন্দের জিনিস আনিয়েছি।
-আর দিদির পছন্দের কিছু করবে না?
ওর কথা শুনে রুমি বলে- তোর পছন্দই আমার পছন্দ। আর আজ ভাইফোঁটা। আজ তো ভাইয়ের পছন্দমতো খাবার খেতে হবে।
দুপুরবেলা...
-মাসি, এত খাবার করেছ!
-হ্যাঁ। সব তোর পছন্দের খাবার। ভাত, ডাল, আলুভাজা, দইকাতলা, কষা মাংস, চাটনি, পাঁপড় সব করেছি।
-আজকে খুব মজা হবে।
এমন সময় রনি ওর বাবাকে দেখে। ওর বাবা বলে- কীরে কেমন দিলাম সারপ্রাইজটা?
-একদম ফাটাফাটি বাপি।
ওরা সবাই একসাথে খেতে বসে। রনি মনে মনে ভাবতে থাকে- এবছরের ভাইফোঁটার ডবল সারপ্রাইজটা ওর সারাজীবন মনে থাকবে। এইরকম ভাইফোঁটা যেন ওর জীবনে প্রতি বছর আসে। ওরা এইরকম আনন্দ মজা করেই যেন সবসময় থাকতে পারে।
খাবার টেবিলে শুরু হয় ওদের আড্ডা। রক্তের সম্পর্কে নয়, ভালোবাসার সুতোয় গাঁথা অটুট সম্পর্কগুলো এইভাবেই অকারণে জীবনভরের সুখ দিয়ে যায় বোধহয়।
(সমাপ্ত)
