দাদু-নাতির গপ্পো
দাদু-নাতির গপ্পো
কালে কালে অনেকটা সময়ই পেরিয়ে গেল, আর তো বছর দুয়েক পরেই অবসর, বেশ আর কি...এসব ভাবতে ভাবতেই অজিত বাবু কখন যেনো দুপুরে একটু ঘুমিয়ে পড়েছেন ক্লান্ত মনে নিজেরই খেয়াল নেই।
হঠাৎ নাতির ডাক, দাদু - ও দাদু, ওঠো না।
কি হয়েছে দাদুভাই?
তুমি আমাকে একটা কবিতা মুখস্থ করিয়ে দাও না গো। মা বকছে, আমি ঠিক করে পারছি না। আমি জানি তুমি বলে দিলে আমি ঠিক পেরে যাব।
আচ্ছা বেশ বেশ, বসো পাশে। বলো এবার তুমি কি কবিতা পড়বে?
বীরপুরুষ, কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের লেখা।
বাহ্ এতো খুব ভালো কবিতা। তা তুমি কবিতাটা শিখে কি করবে গো?
আমি এবারে দাদু এই কবিতাটা দুর্গাপূজোয় পাড়ার অনুষ্ঠানে আবৃত্তি করে সবাইকে শোনাব। তুমি আমাকে ভালো করে শিখিয়ে দাও না গো।
এতো খুব ভালো কথা। আমার দাদুভাই বীরপুরুষ বলবে, আর আমি শিখিয়ে দেব না তা কখনো হয়? তোমাকে একটা গোপন কথা বলি দাদুভাই, যখন আমি তোমার মতন বয়সে ছিলাম তখন আমিও আমাদের গ্রামের পুজোয় অনুষ্ঠানে প্রথম এই কবিতাটাই বলেছিলাম।
তোমাদের গ্রামেও এতবড়ো পুজো হত দাদু?
পুজো তো হত দাদু, হয়তো এখনকার মতন এত আলু প্যান্ডেল থাকত না তবে দাদুভাই তখন ঐ চারদিন পুরো গ্রাম আনন্দে মেতে উঠত একসাথে। আর আমাদের গ্রামে তো ঐ একটাই মন্দির ছিল, তাই সেটা নিয়ে আমাদের প্রচুর গর্ব হত। পাশের গ্রাম থেকেও কত মানুষজন দেখতে আসত। মেলা বসত, গ্রামের ছেলে-মেয়েরা ছড়া বলত, গান করত, নাচ করত, আর শেষদিন হত পুতুল নাচ। পুতুলনাচ দেখার জন্য আমরা সবাই মুখিয়ে থাকতাম জানো।
এতো কিছু হত দাদু তখনও?
হ্যাঁ দাদুভাই, তখনও সব হত। আচ্ছা এবার তুমি কবিতায় মন দাও। আগে পাঁচবার মন দিয়ে পড়ো তুমি, নাহলে তো ভুলে যাবে সব।
ও দাদু, দাদু তোমার একটুও ভয় লাগেনি গো যখন তুমি প্রথম মঞ্চে উঠেছিলে?
ভয়! একদম লাগেনি বললে মিথ্যে বলা হবে দাদুভাই, তবে কি বলত তোমার বড়দাদু, বড়মা, আরও আমার দাদারা সবাই তো সামনে বসেছিল, গ্রামের সবাই হাততালি দিচ্ছিল, বেশ ওসব দেখেই আমার ভয় ছুমন্তর। আর তারপর যখন বীরপুরুষ কবিতা বলব, তখন তো বীরপুরুষের মতন সাহসী হতেই হবে। তোমাকেও কিন্তু বীরপুরুষ হতে হবে দাদুভাই।
আচ্ছা দাদু তোমার সেদিনের কিছু কথা বলো না গো, আমি শুনি একটু।
সেদিনের কথা! দেখো আমার সেই প্রথম মঞ্চে ওঠা। তার আগে ঘরের উঠোনে বলতাম মাঝেমধ্যে, কিন্তু অতো লোকের সামনে দাঁড়িয়ে বলব মাইকে ওটাই একটা আলাদা বিষয় ছিল আমার কাছে। তবে ঐ যে বললাম বাড়ির সবার উপস্থিতিতে আর গ্রামবসীদের উৎসাহে আমার ভয় ধীরেধীরে একদম কেটে গেছল। তারপর আবার কবিতা বলার পর আমাকে দুটো নারকেল নাড়ু দিয়েছিল হাতে, বেশ ওর চেয়ে বড়ো উপহার তখন আর কিছুই মনে হয় নি। তারপর অবশ্য সময় অনেক গড়িয়েছে, আরও অনেক ভালো ভালো জায়গায় কবিতা বলেছি, আরও বড়ো বড়ো মঞ্চে উঠেছি কিন্তু দাদুভাই সেই যে প্রথম মঞ্চে ওঠা তার সেই অনুভূতি আজও ভুলতে পারিনি। আর গ্রামে তো সবাই নিজের, ওখানে আপন-পর বলে তখন কিছুই ছিল না, তাই সব নিজের মানুষের সামনে দাঁড়িয়ে বীরপুরুষ কবিতাটা একবারও না আটকে সবটা বলতে পারাটাই আমার কাছে সবচেয়ে বড়ো প্রাপ্তি ছিল। তখন যদিও এত কিছু বুঝতে পারিনি, কিন্তু সময় যত গড়িয়েছে, চুল যত সাদা হয়েছে তত বুঝেছি তার চেয়ে বড়ো মঞ্চ এজীবনে আর কখনোই পাব না। সব গ্রামবাসীদের হাততালির চেয়ে বড়ো সম্মান আর কিই বা হতে পারে বলো।
এবার চলো ঝটপট আমরা কাজে লেগে পড়ি, তুমি পড়ো আর আমি তোমাকে শিখিয়ে দিই। তোমাকেও কিন্তু দাদুভাই ভালো করে বলতে হবে, তোমাকেও একদিন বীরপুরুষ হয়ে উঠতে হবে।
