Sangita Duary

Children Stories Classics Inspirational

4  

Sangita Duary

Children Stories Classics Inspirational

চাঁদের উপহার

চাঁদের উপহার

5 mins
205



এই ছোট্ট ছোট্ট পায়ে চলতে চলতে ঠিক পৌঁছে যাবো, ওই চাঁদের পাহাড় দেখতে পাবো,..."


গান থামিয়ে হঠাৎ দূরে আঙুল তুলে দেখালো তোতন, "মা, ওই দেখো চাঁদের পাহাড়, মা....মা...."


কোথায় মা? এ তো চারিদিকে জঙ্গল! এত বড় জঙ্গলে তোতন এলো কোথা থেকে? আনমনে তোতনের গলা থেকে বেরিয়ে এলো, "রোডেশিয়া!"


দূরে চোখ পড়তেই, "ওই তো রিকটার্স ভেল্ট! মাউন্টেন অফ দ্য মুন! কিন্তু মা কোথায়?"


ওই তো ওই পাহাড়ের চূড়ায় বসে হাত বাড়িয়ে ডাকছে তোতনকে। তোতন আবার চিৎকার করলো, "মা......আমি আসছি তোমার কাছে...."

হঠাৎ পায়ের নিচের মাটিটা যেন ধ্বসে পড়লো আর তোতনও ঢুকে গেল অন্ধকার পাতালে..."মা.......!"



 হুড়মুড়িয়ে বিছানায় উঠে বসলো তোতন। হাঁফাচ্ছে। স্বপ্ন ছিল? কেন এমন স্বপ্ন দেখলো সে? তক্তপোষের পাশের বেঁটে টুলটায় স্টিলের গ্লাসে জল। তোতন ঢকঢক করে জল খেলো। গ্লাসটা ফেরত রাখতে গিয়েই চোখ পড়লো মায়ের ছবিটায়। মিষ্টি হাসছে মা। তোতন ছবিটা সাবধানে হাতে নিলো, "কেন এমন স্বপ্ন দেখলাম মা? কেন তোমাকে দেখলাম পাহাড় চূড়ায় বসে থাকতে? কোথায় চলে গেলে তুমি মা? আমিও তোমার সঙ্গে যাবো। মাগো...!"


ছবিটা বুকে জড়িয়ে হাপুস নয়নে কেঁদে উঠলো তোতন।


***************


পোস্ট অফিসের ক্লার্ক সব্যসাচী বসুর সংসারে আর্থিক বিলাসিতা না থাকলেও প্রতিমা তার দশ হাতে আগলে রেখেছিলেন সংসার। গোবেচারা স্বামী এবং চোদ্দ বছরের তোতনকে নিয়ে তাঁর সুখের অন্ত ছিলোনা।


ছেলেবেলা থেকেই তোতনটা বড্ড মা ন্যাওটা। মা যখন ভোরে বিছানা ছাড়তো, তোতন ঠিক বুঝতে পেরে মায়ের গলা জড়িয়ে উঠে পড়তো।


মা সারা বাড়ি পরিষ্কার করতো যখন, মা'র দেখা দেখি তোতনও ঝাড়ু বোলাতো মেঝেয়।


মা যখন রান্নাঘরে, তোতন লক্ষ্মী ছেলের মতো বই খাতা হাতে রান্না ঘরে পড়তে বসতো। মা রান্না করার ফাঁকে ফাঁকে পড়া ধরতো তোতনকে। গড়গড় করে মুখস্থ বলে যেত সে।


বিকেলে রোজ মায়ের সাথে বেড়াতে যেতো, নদীর ধারে, পার্কে, মা চুপটি করে পার্কের বেঞ্চে বসে থাকতো, তোতন খেলতো, ছুটতো, দোলনায় চড়তো, কোনো দুস্টুমি করতোনা। তোতন জানে দুস্টুমি করলে মা যে কষ্ট পাবে। মা বলতো, "তোতন আমার ঠাকুরের বরে পাওয়া ছেলে!"


তোতন মায়ের বুকে মুখ গুঁজে মায়ের গন্ধ নিত। ধীরে ধীরে বড় হতে লাগলো তোতন, তার দুনিয়ায় মা-ই তার বেস্ট ফ্রেন্ড।স্কুলের কথা, টিউশনের কথা, বন্ধুদের কথা মাকে না বললে তার পেট গুড়গুড় করতো।


প্রত্যেক জন্মদিনে মা একটা করে বই উপহার দিতো তোতনকে, বলতো, "বইয়ের চেয়ে বড় বন্ধু হয়না রে, বইকে কোনোদিন আঘাত করিসনা, দেখবি বইয়ের চেয়ে বেশি আনন্দ তোকে কেউ দেবেনা।"

তোতন গাল ফোলাতো, "তোমার চেয়েও বড় বন্ধু?"

-"আমার চেয়েও বড় বন্ধু। মা কি কারোর চিরকাল থাকে রে? বই থাকে, যতদিন না তুই নিজে ওকে তাড়িয়ে দিচ্ছিস!"

তোতন মাকে জড়িয়ে ধরতো, "আমার মা কোনোদিন আমাকে ছেড়ে যাবে না!"

প্রতিমা ছেলের চুল ঘেঁটে দিতেন, "পাগল ছেলে!" এইট পাশ করে যেন তোতন হঠাৎ করেই বেড়ে উঠল। অস্পষ্ট গোঁফের রেখা, গলার স্বর ভাঙা ভাঙা!

মা ভাতের দলা মুখে পুরতে পুরতে বলতো, "এবার তো নিজের হাতে খেতে শেখ, আর কতদিন বুড়ো ছেলেকে এমন খাইয়ে দিতে হবে?"


মা হঠাৎ হঠাৎ এরকম বলতো কেন? তবে কি মা বুঝেছিল, মা আর বেশিদিন...!


একদিন সকালে তোতন টিউশন যাবে বলে বেরোচ্ছে, মাকে বলতে ঘরে ঢুকেই দেখে তলপেটে হাত চেপে মা বিছানায় ছটপট করছে। তারপর....

দিনগুলো যেন এক চুটকিতেই কেটে গেল। অ্যাডভান্স স্টেজ ছিল প্রতিমার। লিভার ক্যান্সার। সব্যসাচী হাল ছাড়েননি। ভেলোর ছুটলেন স্ত্রীকে নিয়ে। চারটে কেমো শেষ করে যখন বাড়ি ফিরলো ওরা, তোতন মাকে চিনতেই পারতোনা। মাথা ন্যাড়া। শরীরে এতটুকু মাংস নেই, হাত দুটো যেন বাঁশের কঞ্চি।


মা'র কাছে যেতে ভয় করতো তোতনের, যদি মা'র ব্যথা লাগে! সারাদিন মা বিছানায় শুয়ে থাকতো। রাত জেগে তোতন পড়তো যখন, মা আগের মতোই তার পাশে এসে বসতে চাইতো, মা'র ক্ষতি হবে ভেবে তোতন মাকে ঘরে শুইয়ে আসতো।তোতন বুঝতে পারতো, মা কাঁদছে। কান্না পেতো তারও, কিন্তু সে কাঁদতো না, কান্নাটাকে বুকের ভেতর চেপে রাখতো প্রাণপন।


একদিন রাতে তোতন মা'র মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছিল। মা বললো, "মাধ্যমিক ভালো করে দিস বাবা, তুই ডাক্তার হবি, কতদিনের স্বপ্ন আমার।"


তোতন মাকে চুপ করিয়ে দিলো, "ঘুমোও এবার, আর কথা বলোনা মা, তোমার কষ্ট হবে।"


না, মা আর কথা বলেনি। পরদিন সকালে মা চিরঘুমের দেশে চলে গেল।


*****************


পড়ার টেবিলে মাথা রেখে বসে আছে তোতন, পড়তে ভালো লাগছেনা তার। মাধ্যমিকে জেলার ফার্স্ট হয়েছিল সে। মা'র স্বপ্ন পূরণের প্রথম ধাপ পার হয়েছে। এবার দ্বিতীয় ধাপের পালা। কিন্তু মনটাকে সমে রাখতে পারছেনা তোতন। মাকে দেখতে ইচ্ছে করছে খুব, জড়িয়ে ধরে মা'র গন্ধ নিতে ইচ্ছে করছে। কতদিন মা তার চুলে আঙুল বুলিয়ে দেয়নি, কতদিন ভাত মেখে খাইয়ে দেয়নি, কতদিন গান গায়নি মা.....


হঠাৎ কাঁধে কার স্পর্শ? বাবা!


ছেলের পাশে বসলেন সব্যসাচী। বাবাকে কাল রাতের স্বপ্নের কথা বলতেই এক ছেলেমানুষি প্রশ্ন করে ফেললো তোতন, "মা যদি চাঁদের পাহাড়ে বসে থাকে বাবা, আমিও কি ওখানে মা'র কাছে পৌঁছতে পারিনা?"


সব্যসাচীর মুখটা রক্তশূন্য হয়ে গেল ছেলের কথা শুনে। স্ত্রীর ছবিতে অনেকক্ষণ তাকিয়ে ছেলের মাথায় হাত রেখে বললেন, "তার আগে যে তোর মা'র স্বপ্ন পূরণ করতে হবে বাবা, তোর মা চাইতেন না, তুই ডাক্তার হ?


জানিস তোতন, চাঁদের পাহাড় তো একটা কাল্পনিক স্থান, বিভূতিবাবু কোনোদিন আফ্রিকায় না গিয়েও শুধুমাত্র কল্পনার রঙে শঙ্করকে প্রাণ দিয়েছিলেন। আসল রত্ন তো চাঁদের পাহাড়ে ছিলোনা, আসল রত্ন তো ছড়িয়ে ছিল শঙ্করের অ্যাডভেঞ্চারে, তার জীবন শিক্ষায়, অ্যালভারেসের স্নেহে। লক্ষ্যে পৌঁছতে গেলে লক্ষ্য স্থির করে চলতে হয়, কিন্তু যখন লক্ষ্যে পৌঁছবি, দেখবি, ফেলে আসা পথগুলোই নস্টালজিক হয়ে গেছে। হিরে মানিক মূল্যবান রত্ন হলেও জীবনের অভিজ্ঞতার কাছে এসব মূল্যহীন।আসল রত্ন ধনসম্পদে নেই, আসল রত্ন লুকিয়ে আছে মানুষের মনে, ব্যবহারে, রুচিতে, শিক্ষায়, অভিজ্ঞতায়"।


বাবার চোখদুটো জলে ভরে যেতে দেখলো তোতন, "আমার যে তুই ছাড়া কেউ নেই রে। কাল তোর দেখা স্বপ্নের ইঙ্গিতটা কী জানিস? তোর মায়ের চাঁদের পাহাড়ে বসে থাকাটা তোর লক্ষ্য হোক, তোর মায়ের স্বপ্ন পূরণের লক্ষ্য। মা তো কোথাও হারিয়ে যায়নি, চেয়ে দেখ, এই বিছানায়, ওই চাদরে, বালিশে, আলমারিতে, রান্নাঘরে, সর্বত্র, সর্বত্র তোর মায়ের চিহ্ন খুঁজে পাবি। মা তোর মনে আছে। আমি তোর সঙ্গে আছি, দেখিস তুই একদিন তোর লক্ষ্যে পৌঁছবিই। তোর মা এখন চাঁদ তারার দেশে। মায়ের স্বপ্ন তোর জন্য উপহার হোক, বোঝা নয়।"


অনেকদিন পর বাবাকে জড়িয়ে ধরেছে তোতন, ঠিক যেমন মাকে জড়িয়ে ধরতো। বাবার বুকেও আজ মা'র গন্ধ। বাবার স্পর্শেও যেন মা'র স্পর্শ।


টেবিলে ফটোফ্রেমে প্রতিমার সহাস্যে ছবি, জীবন্ত চোখে আর কোনো ক্লান্তি নেই যেন, কোনো কষ্ট নেই। হিরে মানিক চাঁদের পাহাড়ে নয়, ছড়িয়ে আছে, তাঁর তোতনের মনে, তাঁর ঠাকুরের বরে পাওয়া ছেলের মধ্যে। ছোট্ট ছোট্ট পায়ে চলতে চলতে সে ঠিক তার লক্ষ্যে পৌঁছে যাবে, যাবেই।






Rate this content
Log in