শিপ্রা চক্রবর্তী

Children Stories Tragedy Classics

4  

শিপ্রা চক্রবর্তী

Children Stories Tragedy Classics

বাতাসা!!

বাতাসা!!

4 mins
266



"হরি দিনতো....গেল....

সন্ধ‍্যা হল.......

পার... করো... আমারে......."


খড়ের ছাউনি দেওয়া মাটির বাড়ি। বাড়ির দাওয়ায় সাদা থান পরে পা... ছড়িয়ে বসে আপন মনে কাঁপা কাঁপা গলায় গান গাইছে ক্ষ‍েন্তি পিসি। আর উঠোনের আম গাছের ছায়ার নিচে, চাটাই পেতে দুলে দুলে ছড়া পড়াচ্ছে চাঁপা ওর ভাই নয়নকে। রান্না ঘর থেকে শাড়ির আঁচলে হাত মুছতে মুছতে বেরিয়ে এসে, প্রতিমা বলে উঠল.........

-------এই চাঁপা তাড়াতাড়ি ছুটে গিয়ে মুদির দোকান থেকে দুটো বাতাসা নিয়ে আয় দেখি।

---------চাঁপা ঝটফট উঠে হাত বাড়িয়ে বলল, পয়সা দাও।

-------প্রতিমা আঁচলের খুট থেকে গিঁট খুলে পয়সা বার করে চাঁপার হাতে দিয়ে বলল, ছুটে যাবি আর আসবি দেরী করবিনা কিন্তু!!!! তোর মামা এক্ষুনি চলে আসবে। এসে একটু জিরিয়ে জল বাতাসা খাবে।

---------ক্ষেন্তি পিসি কাঁপা গলায় বলে উঠল, গুড়ের বাতাসা নিবি হ‍্যাঁ....., খেতে বড্ড ভালো লাগে, কত স্বাদ...!!

---------চাঁপা মাথা দুলিয়ে হ‍্যাঁ.... বলল।

---------আর প্রতিমা মুখ বেকিয়ে বলে উঠল, মরার বয়স হয়ে গেছে তবুও বুড়ির নোলা.... কমল না!!!

-----------ক্ষেন্তি পিসি মুখটা নীচু করে বসে আবার গাইতে শুরু করল......


"হরি দিনতো....গেল....

সন্ধ‍্যা হল.......

পার... করো... আমারে......."


****************************************

চাঁপা হাতে টাকাটা নিয়ে একবার মায়ের মুখের দিকে আর একবার বুড়ি পিসিঠাম্মার মুখের দিকে তাকিয়ে আছে। পিসিঠাম্মাকে দেখে খুব মায়া হয় চাঁপার, কিন্তু কেন হয়... সেটা চাঁপা জানেনা!!!

-------প্রতিমা ঝাঁঝালো কন্ঠে বলে উঠল, কিরে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে মুখ দেখবি, কাজটা করবি কখন যা.... তাড়াতাড়ি!!

-------চাঁপা আর কিছু না... বলে ছুট লাগাল, পিছন পিছন নয়ন বলে উঠল, এই দিদি দাঁড়া আমিও যাব।

চাঁপা দাঁড়িয়ে ভাইএর হাত ধরে চলল দোকানের পথে। দোকান থেকে গুড়ের বাতাসা কিনে দু... চারটে শাড়ির খুটে বেঁধে লুকিয়ে নিল চাঁপা।

--------নয়ন কৌতূহল নিয়ে বলে উঠল, এইগুলো দিয়ে কি.... হবে রে... দিদি???

---------চাঁপা ঠোঁটে আঙ্গুল দিয়ে বলল, মাকে বলিসনা..... যেন ভাই। পিসি ঠাম্মাকে দেব।

---------নয়ন একমুখ হেসে মাথা দুলিয়ে বলে উঠল বলবো না...।

চাঁপা আর নয়নের বাড়ি ফেরার আগেই ওদের মামা চলে এসেছে সাথে বাবাও এসে গেছে মন্দির থেকে নিত‍্যপূজো সেরে। মাটির দাওয়ায় বসে শরীরটাকে জিরিয়ে নিচ্ছে, আর ক্ষেন্তি পিসি তালের পাকা ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে হাওয়া করার চেষ্টা করছে, কিন্তু বয়সের জন‍্য পেরে উঠছেনা তবুও চেষ্টা করছে। চাঁপা মায়ের হাতে বাতাসাটা দিয়ে মামার কাছে ছুটে গেল, নয়নও দিদির পিছন পিছন গেল। প্রতিমা ভাই আর স্বামীর হাতে ঘটি করে জল আর বাতাসা তুলে দিল।

--------চাঁপার মাথায় হাত দিয়ে চাঁপার মামা বিশু বলে উঠল, চাঁপাতো দেখতে দেখতে অনেক বড় হয়ে গেল দিদি। এইবার তো.... বিয়ের ব‍্যবস্থা করতে হয়।

--------প্রতিমা বলে উঠল হ‍্যাঁ..... এইবার মেয়ের বিয়ের চিন্তা করতে তো....হবেই!!! তোর জামাইবাবু একটা ছেলের খোঁজ পেয়েছে, দেখা যাক কি.... হয়???

--------বিশু আবার বলে উঠল, বলিকি দিদি ওকে আমার সাথে কদিন নিয়ে যাই ঘুরে আসবে।চাঁপার মুখটা ধরে বলল কিরে যাবি আমার সাথে।

------প্রতিমা বলে উঠল, তা.... নিয়ে গেলে যা, কিন্তু দিয়ে যেতে হবে।

-------চাঁপা ঘাড় নেড়ে বলল হ‍্যাঁ.....। নয়ন সাথে সাথে বলল আমিও যাব।

---------প্রতিমা বলে উঠল না...!!! তুই গিয়ে থাকতে পারবিনা,কাঁদতে শুরু করবি তোকে যেতে হবেনা, চাঁপা ঘুরে আসুক কদিন।

************************************

দুপুর গড়িয়ে বিকেল হতে চলল, চাঁপা পুঁটলি বেঁধে তৈরী হল মামার সাথে যাওয়ার জন‍্য। তবে যাওয়ার আগে চাঁপা চুপিচুপি মায়ের নজর এড়িয়ে গুড়ের বাতাসা কটা পিসি ঠাম্মার হাতে দিয়ে বলল.... খেও কেমন।

--------ক্ষেন্তি পিসির চোখটা তখন খুশির জলে চিকচিক করে উঠেছিল, চাঁপার মাথায় হাত রেখে বলে উঠে ছিল, তুই আগের জন্মে নিশ্চয়ই আমার মা.... ছিলিস রে...!!! কোন ছোট বয়সে বিয়ে হয়েছিল। স্বামী কি... বোঝার আগেই মানুষটা মরে গেল!!!! তারপর থেকে এর সংসারে ওর সংসারে অবাঞ্ছিতের মত পড়ে থেকে জীবনটা কেটে গেল। মিষ্টি খেতে বড্ড ভালো লাগেরে, জানি এই বয়সে এত নোলা ঠিকনা!!! কিন্তু কি করব যখন বয়স ছিল তখনতো কেউ খেতেই দিলনা, উপোস করে আর বারদিবার করেই জীবন কেটে গেল।যা.... ঘুরে আয় মামার বাড়ি থেকে। শরীরটা ভালো যাচ্ছেনা কি...জানি... তোকে আর দেখতে পাব কিনা??? তাড়াতাড়ি আসিস ফিরে আর সাবধানে থাকিস।

-------চাঁপা মুখ দিয়ে একটা কথাও বার করতে পারেনি, পিসিঠাম্মার কথা শুনে দলা পাকিয়ে গেছিল গলার কাছে ওর কথাগুলো । কিন্তু চোখটা ঝাপসা হয়ে গেছিল সাথে সাথে । চাঁপা মাথা নেড়ে হ‍্যাঁ.... বলেছিল।

বাবা, মা, ভাই, পিসিঠাম্মা সবাইকে বিদায় জানিয়ে চাঁপা মামার হাত ধরে এগিয়ে চলল। গঙ্গার পার হওয়ার জন‍্য নৌকায় উঠে বসল। অথৈই জলের বুকের ওপর দিয়ে ওদের ছোট্ট নৌকাটা কি... সুন্দর ভেসে চলেছে। মাঝি দাঁড় টানতে টানতে কিসুন্দর গান গাইছে। অবাক চোখে চাঁপা জলের দিকেই তাকিয়ে রইল। প্রচন্ড একটা ধাক্কা দিয়ে নৌকাটা তীরে এসে বাঁধল। নৌকা থেকে নেমে লাল মাটির পথ এবং সবুজের পর সবুজ ধানের ক্ষেত পিছনে ফেলে এগিয়ে চলল চাঁপা মামার পিছু পিছু, সূর্য তখন লাল হয়ে পাটে বসছে।

মামার বাড়িতে ঢোকার সাথে সাথে মামি আদর করে কাছে টেনে নিল চাঁপাকে। দাদা বোনেরাও তাকে নিয়ে আনন্দে হই হুল্লোড়ে মেতে উঠল। কিন্তু ভোর রাতেই ওদের গ্রাম থেকে একজন লোক গিয়ে খবর দিল মামার কাছে, চাঁপাকে নিয়ে তাড়াতাড়ি বাড়ি ফিরতে। ক্ষেন্তি পিসির শরীর নাকি খুব খারাপ, যায় যায় অবস্থা। আর বিড়বিড় করে শুধু চাঁপা... চাঁপা... করছে। মামার হাত ধরে চাঁপা আবার ছুটল বাড়ির পথে। খবরটা শোনার পর থেকেই চাঁপার মনটা কেঁদে উঠল, আসার সময় যে.... পথটা এত ভালো লাগছিল চাঁপার, ফেরার সময় সেটাই যেন অনেক দীর্ঘ এবং বিরক্তিকর লাগছে।

বাড়ির উঠোনে পা দিয়েই চাঁপা দেখল লোক জনে গিজগিজ করছে। মা চিৎকার করে করে কাঁদছে, মায়ের কান্নার আওয়াজে বুঝি এত লোক জড়ো হয়েছে ওদের বাড়িতে।

---------নয়ন দিদিকে দেখে ছুটে এসে দিদির হাত ধরে নিয়ে যেতে যেতে বলে উঠল,তাড়াতাড়ি চল দিদি... দেখ পিসিঠাম্মা কেমন করছে।

চাঁপা এগিয়ে গিয়ে দেখল মাটির দাওয়ায় চাটাই এর ওপর পিসি ঠাম্মা শুয়ে আছে। পিসি ঠাম্মার মাথার কাছে বসে মাথাটা কোলে তুলে নিয়ে হাত বুলিয়ে দিতে লাগল চাঁপা, সাথে মুখে কিছুটা জলও দিল। পিসিঠাম্মা কিছু বলার চেষ্টা করছে বুঝতে পেরে চাঁপা নিজের কানটা পিসি ঠাম্মার মুখের কাছে নিয়ে গেল।

--------দম আটকানো খনা গলায় চাঁপার কানে আসলো একটাই কথা বাতাসাটা... বড্ড.... ভালো..... ছিল রে......মা.!





Rate this content
Log in