অন্য রকম পূজো #শারদ সংখ্যা
অন্য রকম পূজো #শারদ সংখ্যা
-কী গো খেয়ে নাও। চা-টা তো ঠান্ডা জল হয়ে গেল। রুটিটাও শক্ত হয়ে গেল।
-ওহ...হুম খাচ্ছি। টুকি কী করছে ?
-ওকে জল মুড়ি দিলাম। ও খাচ্ছে।
-আর তোমার খাবার কই ? নিয়ে এস একসাথে খাই।
-তুমি খাও না। আমার এখন অনেক কাজ আছে। আমি পরে খাব।
অসীম বুঝতে পারে ঘরে আর কোনো খাবার নেই। তাই সে বলে- শোনো...বলছিলাম এখন আমার সেরকম খিদে নেই। এক কাজ করো আমি একটা রুটি খায় আর তুমি একটা খাও।
-বলছি আর কতদিন এইভাবে চলবে ? ঘরে যা আছে সব তো শেষ হতে চলল।
-সেটাই ভাবছি। প্রতিবছর এই সময় কাজের কোনো অভাব হয় না। মিত্তিরদের বাড়ির দূর্গাপূজোয় এই কটা দিন আমাদের ভালো করেই কাটে। মেয়েটাও এই কয়েকদিন ভালো ভালো খাবার খেতে পারে। কিন্তু এবছর এসব কিছুই হবে না মনে হয়। দেখছি কী করা যায়।
-আচ্ছা...শোনো, আমাকে মিত্তিরদের বাড়িতে ডেকেছে। আমি একবার দেখা করে আসছি। তুমি মেয়েটার একটু খেয়াল রেখো।
◆◆◆◆◆◆
-ও গিন্নিমা একবার নীচে আসো। তোমাকে কর্তাবাবু ডাকছে।
-হ্যাঁ বলো। ডাকছ কেন ?
-তুমি অসীমের বউকে খবর দিয়েছিলে ?
-হ্যাঁ, হারুকে পাঠিয়েছিলাম তো।
-প্রণাম নেবেন কর্তাবাবু, প্রণাম নেবেন গিন্নীমা। হারুদা বলল আপনারা ডেকেছেন।
-হ্যাঁ। শোন...এবছর তো সেরকম বড়ো করে পূজো হবে না জানিস। ছোট করেই পূজো হবে কিন্তু তার জন্যও তো ঘর-বাড়ি পরিস্কার করতেই হবে। তা তুই যদি নীচের তলার তিনটে ঘর, পূজোর বাসনকোসনগুলো, ওপরের তলায় একটা ঘর পরিস্কার করে দিস তাহলে খুব ভালো হতো। পয়সা-কড়ি চিন্তা করিস না।
-না গিন্নীমা, ওসব নিয়ে আমি চিন্তা করছি না। আসলে মেয়েটাকে অনেকক্ষণ রেখে আসতে হবে তো তাই। ও আমায় ছাড়া একটুও থাকতে চায় না।
-ঠিক আছে। তুই টুকিকে নিয়েই আসবি। ওতো ভারি শান্ত মেয়ে। এক জায়গায় চুপচাপ বসে থাকবে।
-আচ্ছা গিন্নীমা। আমি তাহলে কাল থেকে কাজে লেগে যাব। আজ আসি।
-হুমম সেই ভালো। কাল সকাল সকাল চলে আসিস।
-অসীমকে একবার দেখা করতে বলিস আমার সাথে।
-ঠিক আছে কর্তাবাবু।
যাক বাবা, ভগবান এতোদিনে মুখ তুলে চাইল। এখানে কাজ করে যে টাকাটা পাব সেটা দিয়ে মেয়েটাকে পূজোর কটাদিন ভালো কিছু খেতে দিতে পারব। যাই তাড়াতাড়ি বাড়ি যাই।
◆◆◆◆◆◆
-কি গো কি বলল ওরা ? কেন ডেকেছিল ?
-আরে বলছি বলছি। আগে একটু বিশ্রাম নিই। ওই বাড়িতে ঘর-দোড় পরিস্কার করার জন্য লোক লাগবে তাই আমাকে ডেকেছিল। টাকা-কড়ি ভালো দেবে বলেছে। পূজোর কটাদিন একটু হলেও ভালো যাবে কী বলো। আর শোনো..তোমাকে কর্তাবাবু দেখা করতে বলেছেন। পূজো এবারে হবে গো। শুধু ছোট করে হবে। অত জাঁক-জমক করা হবে না এই যা।
-তাহলে তো ঢাকটা পেড়ে পরিস্কার করে রাখতে হবে। পূজোর আর এক সপ্তাহ বাকী।
-আচ্ছা ঠিক আছে। কাল থেকেই আমাকে কাজে যেতে বলেছে। আর টুকিকেও সাথে নিয়ে যাব। তুমি তাহলে কালকেই দেখা করো।
-ঠিক আছে।
পরের দিন...
-আয় আয় রিমি, হারুর হাতে হাতে বাসনগুলো চটপট নামিয়ে ফেল। আর হারু তোকে বলেছিলাম প্যান্ডেলের লোককে খবর দিতে। তুই দিয়েছিলিস ?
-হ্যাঁ গিন্নীমা। ওরা আজকেই আসবে।
-জেঠিমা, ফুলের লোকরা এসেছে। তুমি একবার কথা বলে নাও।
-ঠিক আছে। তুই যা আমি যাচ্ছি। তোরা এইদিকটা সামলে নিস।
-ঠিক আছে গিন্নীমা।
রিমি চটপট বাসনগুলো কলতলায় নিয়ে গিয়ে মাজতে শুরু করল।
◆◆◆◆◆◆
-কর্তাবাবু, আপনি ডেকেছিলেন ?
-ওহ অসীম, শোন...পূজো তো এসেই গেল। তুই তো সবই জানিস নতুন করে বলার কিছু নেই। অন্য বারের থেকে এবছর অত জাঁক-জমক করে হবে না কিন্তু পূজো মানেই ঢাক, ঢাক মানেই ঢাকী আর ঢাকী মানেই তুই। এই নে কিছু টাকা অগ্রিম দিলাম। বাকী টাকা পরে দেব।
-আচ্ছা ঠিক আছে বলে কর্তাবাবুকে প্রণাম করে অসীম চলে গেল।
◆◆◆◆◆◆
-এইকদিন কিন্তু খুব খাটা-খাটনি হল কি বলো গিন্নী ?
-তাই না তাই। পূজো ছোট হোক কি বড়ো কাজ অনেক করতে হয়। রুনুরা কাল আসবে আমাকে ফোন করেছিল। আর সোমুর সাথে তোমার কথা হয়েছে ?
-মেয়ে যখন আসার কথা জানিয়ে দিয়েছে তখন চিন্তা করো না তোমার ছেলেও ঠিক চলে আসবে। প্রতিবারই তো সব কাজ শ
েষ হবার পর আসে। মাঝে মাঝে আমি তো ভুলেই যাই ওরা এই বাড়ির ছেলে-মেয়ে না অতিথি।
-তুমি আর রাগ করো না। অসীম আর রিমি তোরা কিন্তু পূজোর কটাদিন এখানেই খাওয়া-দাওয়া করবি যেমন করিস। কালকে ষষ্ঠী,সকাল সকাল চলে আসিস।
◆◆◆◆◆◆
সকাল সকাল ওরা নতুন জামা-কাপড় পড়ে মিত্তিরবাড়ি চলে এসেছে। ষষ্ঠী পুজো শেষ হয়ে সকালের জলখাবারের তোড়জোড় হচ্ছে। এমন সময় বাইরে গাড়ির আওয়াজ শোনা গেল আর তার সাথে বাড়ির দুটো ছোট সদস্যদের গলার আওয়াজও।
-ওই তো ওরা এসে গেছে। ভালোই হলো সবাই মিলে একসাথে খাব।
-গিন্নীমা... সোমু দাদাবাবু আর রুনু দিদিমণিরা সবাই এসে গেছে।
-ঠিক আছে। তুই ওদের মালপত্রগুলো ওদের ঘরে রেখে দে।
-বাবা...তোমরা কেমন আছো ? মা...তোমার শরীর ঠিক আছে তো ?
-আমরা সবাই ঠিক আছি। তোমরা অনেকটা পথ এসেছ। এখন হাত-মুখ ধুয়ে এসো একসাথে সবাই জলখাবার খাই।
-তোমাদের পছন্দের ফুলকো ফুলকো লুচি,সাদা আলুর চচ্চরি,রসগোল্লা। খাওয়ার পর একসাথে সবাই মিলে গল্প করব।
-ঠিক আছে বাবা।
◆◆◆◆◆◆
সপ্তমীর দিন সকালবেলায় কলাবউ স্নানের পর ঠাকুরমশাই পূজোয় বসলেন। সারা বাড়ি ফুল দিয়ে সাজানো হয়েছে। রোহিত আর তিন্নি সারা বাড়ি জুড়ে হইহই করে বেড়াচ্ছে। ওদের সাথে সমান তালে পাল্লা দিচ্ছে টুকিও। একবার তো রোহিত অসীমের হাত থেকে ঢাকের কাঠি নিয়ে নিজেই ঢাক বাজাতে আরম্ভ করে দিয়েছিল।
-দাদুভাই দিদিভাইরা খুব আনন্দ করছে কী বলো গিন্নী।
-দিদিভাইরা মানে ?
-আরে অসীমের মেয়ের কথা বলেছি। ও কীরকম ওদের সাথে হুড়োহুড়ি করছে। একটুও ক্লান্তি নেই ওদের।
-ওরা কী তোমার আমার মতো বুড়ো হয়ে গেছে ?
-এই আমাকে বুড়ো বলবে না একদম বলে দিলাম। তাহলে কিন্তু খুব খারাপ হয়ে যাবে।
-আচ্ছা বাবা... তোমাকে কেউ বুড়ো বলবে না। এবার খেতে চলো।
-আজকে কী মেনু শুনি।
-এখন লুচি, ছোলার ডাল, আলুর দম আর ল্যাংচা।
-বাহ... দারুন।
-তুমি চারটের বেশী লুচি খাবে না। আর অর্ধেক ল্যাংচা।
-এর থেকে তো না খাওয়াই ভালো।
-আচ্ছা আর রাগ করে বাচ্চাদের মতো ঠোট ওলটাতে হবে না। চলো তাড়াতাড়ি। ওরা সবাই বসে আছে আমাদের জন্য।
-হারু কালকের পূজোর ফুলগুলো গুছিয়ে রেখে দিস। আর কালকে একটু বেশী করে জলখাবার তৈরী করিস আমার কিছু বন্ধু আসবে।
-ঠিক আছে বাবু।
-কী ব্যাপার দাদুভাই, এখানে চুপচাপ দাঁড়িয়ে আছো। কেউ বকেছে নাকি?
-না দাদুন, আমাকে কেউ বকেনি। আচ্ছা দাদুন, যাদের বাবা-মা নেই তারা কী করে পূজোর সময় আনন্দ করে ?
-হঠাৎ এরকম প্রশ্ন করলে কেন দাদুভাই?
-ওই যে সেদিন অনেক গুলো বাচ্চাকে দেখলাম সেই বাড়িটার সামনে।
সুশোভনবাবুর মনে পড়ে গেল সেদিন ওই অনাথ আশ্রমের বাচ্চাগুলোর কথা যারা ওনাদের কলাবউ স্নান করানো দেখার জন্য ভিড় করেছিল। সত্যি তো ওদের কথা তো আমরা কেউ ভাবিনা। এইবার যদি ওদের জন্য কিছু একটা করা যায় তাহলে ভালোই হবে। এইসব ভাবতে ভাবতে উনি চলে গেলেন।
দেখতে দেখতে বিজয়া দশমীর দিন চলে এল। পূজো আসছে আসছে এটাই যেন একটা আনন্দ। এসে গেলে কখন যে হুশ করে চলে যায় বোঝায় যায় না।
-দাদুভাই, আজকে তোমার জন্য একটা সারপ্রাইজ আছে।
-কী দাদুন, বলো।
-একটু পরেই জানতে পারবে।
কিছুক্ষণ পরেই একজন লোক অনেকগুলো বাচ্চাকে সাথে নিয়ে মিত্তিরবাড়িতে উপস্থিত হলো। সুশোভনবাবু সমস্ত বাচ্চাদের এক এক করে নতুন জামা আর মিষ্টির প্যাকেট তুলে দিলেন। বাচ্চাগুলোর মুখে খুশির ঝলকানি দেখে সুশোভনবাবুরও খুব ভালো লাগছে। ওনার নাতিও ভীষণ খুশি আজ।
কী দাদুভাই, দাদুনের দেওয়া সারপ্রাইজটা কেমন লাগল?
-ইউ আর গ্রেট, দাদুন। তুমি এইরকম সারপ্রাইজ সবসময় দিও। আমি খুব খুশি।
সুশোভনবাবু মনে মনে মা দূর্গার কাছে প্রার্থনা করলেন- মা, এবারের এই অন্যরকম পূজো যেন প্রতিবছর পালন করতে পারি। তুমি আর্শীবাদ করো। সকলকে ভালো রেখো। আসছে বছর আবার এসো।
সবাই একসাথে চিৎকার করে বলল জয় মা দূর্গা, আসছে বছর আবার হবে। বলো দূগ্গা মাইকি।
(সমাপ্ত)