Aayan Das

Others

1.7  

Aayan Das

Others

আমি মহুয়া

আমি মহুয়া

3 mins
9.9K


কোনো এক দুর্বল মুহূর্তে সুমন আমাকে বলেছিল,''-দেখো মহুয়া,ভালবাসা একটা আবেগ,মানব মনের খুব কেন্দ্রস্থলে এর উৎস,মনের খুব গভীরে এর বিস্তার।সমাজ তার নিজের পরিসরে এর সবটুকুকে স্থান দিতে পারেনা।যেটুকু বাইরে রয়ে যায় সেটুকুকে নিয়েই আমাদের সমস্যা।''

আমি বলেছিলাম,''-সমাজ সংস্কৃতির বাইরে হলেই অপরাধ?''

সুমন বলেছিল,''-না,তা বোধহয় নয়,মানবিক প্রকৃতির বাইরে হলেই অপরাধ।''

সুমনের ঐ কথা আমাকে আজও ভাবায়।সত্যি যে ভালবাসাকে সমাজ অনুমোদন দেয়না সেই ভালবাসা কী অপরাধ?

আমার নাম মহুয়া।আমি নিতান্ত সাধারন পরিবার থেকে উঠে আসা একটি সাধারন মেয়ে, একটি স্কুলের শিক্ষিকা।সুমন আমার সহকর্মী।

সুমনের সঙ্গ আমার ভাল লাগে কেন? কেন যে ভাললাগে তা আমি নিজেও জানিনা।আপাতভবে ও একজন খামখেয়ালি অগোছালো উদাসীন মানুষ।নিজের চেহারা বা পোশাক পরিচ্ছদের দিকেও কোনো নজর নেই।আধপাগল লোকটাকে ছেড়ে স্ত্রী চলে গেছে বেশ কয়েকবছর।অথচ ঐ লোকটাই অন্যের অসুবিধা দেখলে মুখ ফিরিয়ে নেয়না,সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেয়।স্কুলের বার্ষিক অনুষ্ঠান বা রবীন্দ্রজয়ন্তীতে ছাত্রছাত্রীদের দিয়ে গান গাওয়ায়,নিজে উদাত্ত কন্ঠে আবৃত্তি করে।সেইসময় মলিন পোশাক ও সাতদিনের না কামানো কাঁচাপাকা দাড়িতেও সুমনকে অসাধারন সুপুরুষ লাগে আমার।সুমনকে দেখে কৌশিককে বড্ড শূন্য লাগে আর নিজেকেও একজন কিছু না পাওয়া মানুষ বলে মনে হয়।

অথচ কৌশিককেই তো ভালবাসার কথা আমার!আমি জানি আমাকে ছাড়া কৌশিক একেবারে অসহায়,নিঃস্ব! আমাকে ঘিরেই আবর্তিত হয় ওর পৃথিবী।ওকে কষ্ট দেবার কথা স্বপ্নেও ভাবতে পারিনা।

কৌশিক ছেলে হিসেবে একেবারে যাকে বলে দশে দশ।তার সিগারেট,মদ বা মেয়েদের নেশা নেই।প্রতিদিন সকালে উঠে শেভ্ করে।তারপর কিছুক্ষন ধ্যান করার পর পূজোয় বসে।আধ্যাত্মিক বই ছাড়া অন্য বই পড়েনা।আজেবাজে সিনেমা দেখে সময় নষ্ট করেনা।রোজ সকালে একটা করে মর্তমান কলা খায়।পেটের পক্ষে ভাল তাই সপ্তাহে একদিন করে পেঁপে খায়।রাত নটায় রাতের খাওয়া সেরে সাড়ে দশটার মধ্যে শুয়ে পড়ে।শোওয়ার আগে কিছুক্ষন ভজন শোনে।

সবচেয়ে বড় কথা, কৌশিকের মত কেয়ারিং স্বামী আমি দেখিনি।আমার অ্যালার্জির ধাত বলে ও প্রতিদিন আমার জন্য রসুনের কোয়া নিয়ে আসে,আমাকে ভিটামিন সি ট্যাবলেট খাওয়ায়।শীতের সময় নিয়মিত ফল এনে দেয়।অসুখ হলে নিজে হাতে আমাকে ওষুধ খাওয়ায়।বছরে একবার করে সপরিবার বেড়াতে যায়।আর..সংসারে আমার অমর্যাদা কৌশিক কোনোভাবেই বরদাস্ত করেনা।

 আমার মনের মধ্যে এক ভয়ঙ্কর অপরাধবোধ বিষধর কেউটে সাপের মত আমাকে ছোবল মারতে থাকে।আমি কৌশিকের মত করে আমার সবটুকু দিয়ে ওকে ভালবাসতে পারিনা।সুমনের সঙ্গে কথা বলে অথবা একসঙ্গে হাঁটলে আমার বুকের মধ্যে জলতরঙ্গ বাজে।আমার বুক ঢিপঢিপ করে আবার তা উপভোগও করি।মনে হয় আমরা নিঃশব্দে সবই বুঝি।আলাদা করে দুজন দুজনকে জানানোর কিছু দরকার পড়েনা।

সুমন একদিন বলেছিল,''-তোমার কী মনে হয়না মহুয়া,মানুষের কথা বলার চেয়ে না কথা বলার পরিমান অনেক বেশি?স্তব্ধতার গান শোনার যে নিবিড় আনন্দ সে আনন্দ কী আর অন্য কিছুতে আছে?''

সুমনের সঙ্গে কথা বললে আমার মনেহয় এই পৃথিবীতে আমার খুব নিজের কেউ আছে যে আমার দুঃখ,অসহায়তা,উচ্ছাস,দ্বন্দ্ব সবকিছু বুঝতে পারে।একটা ভাল লেখা পড়লেও তা সুমনকেই প্রথম শোনানোর কথা মনে হয় অথচ আমার মাথা যন্ত্রনা করলে কৌশিকই তো দৌড়ে ওষুধ নিয়ে আসে,আমাকে নার্সিং করে।

কৌশিকের সঙ্গে দিনের পর দিন এই লুকোচুরি খেলতে খেলতে আমি হাঁফিয়ে উঠি।আবার সুমনের খুব কাছেও আমি যেতে পারিনা।যদি ধরা পড়ে যাই?যদি ও অন্যায়ভাবে কিছু চেয়ে বসে?আমি কি ফেরাতে পারব ওকে?

দিন যায়, রাত যায়,ঘরে কৌশিকের ঘুমানোর শব্দ শোনা যায়।আমি ছাদে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে আকাশের তারা খসা দেখি।আমার মনে হয় মানুষের জীবনটা ঐ আকাশের চেয়েও বড়,গভীর ও রহস্যময়।এক এক সময় মনে হয় কৌশিক কী সুমনের মত হতে পারতনা?তাহলেই তো আমার সব অভাব দুর হয়ে যেত, আবার মনে হয় যা হয়েছে তা ভালই হয়েছে।আমরা আমাদের চাওয়ার শেষপ্রান্তকে কখনও অনুভব করতে পারিনা।যদি সত্যিই কৌশিক সুমনের মত হত তখন আর সুমনকে হয়ত ভাল লাগতনা।কৌশিক আছে বলেই আমি সুমনের অপেক্ষায় থাকি।

কোন একটা বইতে পড়েছিলাম-চাওয়ার শেষ নেই। আর পাওয়াটা তারই পথ ধরে চলে,যার কোথাও পৌঁছে যাওয়া নেই॥


Rate this content
Log in