লেখালেখির অনুপ্রেরণা
লেখালেখির অনুপ্রেরণা


দ্বিতীয় শ্রেণীর কক্ষ, মুখচোরা এক ছাত্রী বেঞ্চের কোণায়,
আগের পিরিয়ডের বিভীষিকায় তখনও কোণঠাসা সে,
মনিটর হওয়ার সুবাদে ব্ল্যাকবোর্ডে লিখেছিল চারটে নাম,
চারজন বিশৃঙ্খল সহপাঠী, যারা ছিল প্রথম সারির ছাত্রী;
শিক্ষিকার হুঙ্কারে অভিযুক্তদের দোষারোপ মনিটরকে,
কিছু মিথ্যে অভিযোগ, সে নাকি গালি দিয়েছে ওদেরকে!
এদিকে শিশুটা তখনও বরাহ নন্দনের চলিতটাই জানে না!
বিনা দোষে শাস্তি বিধান, তার গালে সপাটে চড় শিক্ষিকার,
তার আত্মপক্ষ অবলম্বনটুকু বিশ্বাস করেনি সেদিন কেউ,
অপমান ও ভর্ৎসনার শেষে সে উন্মত্ত উপহাসের সম্মুখীন,
শিশুটা তখন খুঁজছে 'গালাগাল' শব্দটার আক্ষরিক অর্থ!
বুঝেছিল সে, প্রথম সারির ছাত্রীদের দোষ থাকতে নেই,
তারা শিক্ষিকার সুনজরে, তাদের নাম বোর্ডে উঠতে নেই,
পক্ষপাতিত্বটা বুঝে উঠতে তার খুব বেশি সময় লাগেনি;
মনস্থির করল, সে নিজের স্থান করে নেবে প্রথম তিনে,
পরবর্তী বাংলা ক্লাসে আনমনা, খাতা জুড়ে হিজিবিজি;
তার মনোবেদনা রূপ নিল ছয় লাইনের একটা ছড়ায়,
শিক্ষিকার হাতে খাতা, প্রথমে বিব্রত হয়েও মুগ্ধ তিনি,
দু'টো সেকশনের মাঝে দাঁড়িয়ে পড়ে শোনালেন ছড়াটা,
ছাত্রীটা ভয়ে গুটিশুটি, এরপর হয়তো আবারও লাঞ্ছনা!
হঠাৎ পালাবদল, আদর করে জড়িয়ে ধরলেন দিদিমণি!
সেই শুরু, তারপর স্মৃতি দি'র 'অমৃতম' পত্রিকায় লেখা,
অপ্রত্যাশিত অনুপ্রেরণার সূচনাটা এই বাংলা শিক্ষিকাই,
তারপর স্কুল ম্যাগাজিন ও 'ভাবনা' পত্রিকায় কলম ধরা,
দৃঢ়চেতা মেয়েটার অধ্যবসায় আনল তাকে প্রথম তিনে,
চলতে লাগল ডায়েরির পাতা জুড়ে শব্দদের আনাগোনা,
ক্রমে মাধ্যমিক আর উচ্চ মাধ্যমিকের গন্ডি পেরোনো;
তার কাব্যিরোগ
হঠাৎ মাথাচাড়া দিয়ে উঠত মাঝরাতে,
স্নেহশীলা মা বিরক্তি নিয়েও খুব আশকারা দিত তাকে,
আর বাবা ছিল যে কোনও লেখার প্রথম একনিষ্ঠ শ্রোতা,
মেয়ের লেখালেখিকে উৎসাহ দিয়ে প্রশ্রয় দিতেন তিনি,
মনে আশা ছিল, ছাপার অক্ষরে মেয়ের লেখা বই পড়ার;
বাবার অকাল প্রয়াণ, ছন্দহীন হয়ে ছন্নছাড়া মেয়েটা!
অনার্স গ্র্যাজুয়েট, বাস্তবের ভ্রূকুটির নির্মম পরিহাস!
এক এক করে বিদায় জানাতে হল ভালো লাগাগুলোকে,
তাকে ছেড়ে চলে গেল সবচেয়ে প্রিয় বিষয় প্রাণীবিদ্যা,
কবিতা আসত না আর, ভাবনারা মাঝপথেই খেই হারাতো!
রেলওয়েতে যোগদান, ভালো থাকার রসদ থেকে বিচ্যুত,
যদিও এই বিচ্ছেদ পিতৃবিয়োগের যন্ত্রণার কাছে তুচ্ছ!
নিরুদ্দেশের পানে উদ্দেশ্যেহীন পথ চলায় অভ্যস্ত হল সে,
ক্রমে হারিয়ে যাচ্ছিল সে, পরিস্থিতির শিকার আপন সত্তা!
সহসা বিচ্ছিন্ন জীবনে আলোড়ন, পথের বাঁক কাঁচরাপাড়া,
ট্রেনিং সেন্টারে এক আলোকবর্তিকার অদম্য হাতছানি,
বাঁচতে শেখালেন তিনিই, শেখালেন আবার ঘুরে দাঁড়াতে;
বেঁচে থাকার গল্পেরা অনুরণিত হল আবার বিক্ষিপ্ত প্রাণে,
আঁধার যাপনে অভ্যস্ত এই জীবনীতে প্রাঞ্জল অনুপ্রেরণা,
পিতৃস্নেহে কাছে টেনে গড়লেন রজ্জুহীন আত্মিক বন্ধন,
আজ চলার পথে প্রেরণা জীবনের এই সেরার সেরা প্রাপ্তি;
সেই মেয়েটা আজ প্রাঞ্জল, প্রথম কাব্যগ্রন্থ হয়েছে প্রকাশিত,
যদিও তার প্রথম পাঠক ও শ্রোতা বাবা চির না ফেরার দেশে!
আসা-যাওয়ার মাঝে অনুভূতিরা ভিড় করে শব্দের কোলাজে,
সেই মেয়েটা আমি, সূর্যসন্ধানী প্রত্যয়ে অন্তহীনে হেঁটে চলেছি,
'নগরজীবন ও বুলেটিন' পেরিয়ে চলেছি 'উজানের টানে',
ব্যস্ত দিনশেষে লেখালেখিতেই ভালো থাকার রসদ সন্ধানে।