একটা বোকা লোকের ডায়েরি
একটা বোকা লোকের ডায়েরি


(সময় ১৯৭০)
১
আগুনের ভেতরে আমি চলে যেতাম
ভালো লাগতো।
ভালো লাগতো বারুদের গন্ধ।
বিভিন্ন পাড়ায় আমাদের গোপন সভা হত
লাইনের ধারে হেলে পড়া একটা পরিত্যক্ত বাড়ির মধ্যে
অথবা একটা শ্রীহীন বস্তির আত্মীয় ঘরে;
যে ঘরে ভাঙাচোরা একটা মেঝে
বসার জন্যে একটা ছিন্ন চ্যাটাই
ঘরের একটা কোনে পেটে খিদে নিয়ে
দপদপ করত একটা হ্যারিকেন
হ্যারিকেনের ভাঙা কাচে
আটা দিয়ে লাগানো থাকতো কাগজের শুশ্রুষা ।
এক ভাঁড় চা আসতো
তার কড়া তেঁতো রক্তের বিশুদ্ধ ঘৃণায় মিশে যেতো
আমাদের কেউ কেউ ছাত্র পড়াতো
তাদের অনিচ্ছুক উদারতায় বিড়ি পেতাম।
সেই অন্ধকার আর আলোতে
ধোঁয়ায় অস্বচ্ছতায় প্রত্যেকদিন প্রসব করত সম্ভাবনা,
বুকের মধ্যে একসাথে বসবাস করত
ভালোবাসা আর ঘৃণা।
আস্তে কথা হত, খুব আস্তে কথা
কেননা আগুনের ভেতর দিয়ে আমরা হাঁটছিলাম
আমরা তা জানতাম,
একটা ছোট ছেলে হটাত যদি ঘরে ঢুকে বলত
‘পুলিশ’
সঙ্গে সঙ্গে বিচ্ছিন্ন হতে হত আমাদের।
নর্দমার পাশ দিয়ে, পাঁচিল ডিঙিয়ে, লাইন টপকিয়ে
যে ভাবেই হোক পালাও
ধরা পড়া মানে
মটমট করে আঙুলগুলো ভেঙে দেবে
লিঙ্গতে সিগারেটের ছ্যাঁকা
মলদ্বারে ঢুকে যাবে আইনের লাটি
আরো আরো মননশীল নারকীয়তা
আর্তনাদের উৎসব হবে থানায়
অতএব পালাও, ছোটো, ঢুকে পড়
গলির মধ্যে, কারো বাড়ির রান্নাঘরে
পানাপুকুরে ডুব দিয়ে বসে থাকো সারা রাত
মনে রেখো একটা রাত লাফিয়ে পেরিয়ে যায়
তারপর সূর্য উঠবেই ,
তারপর সুপ্রভাত।
তারমধ্যেও কেউ কেউ ধরা পড়ে যেত
কখনও বা কাউকে খুঁজেই পাওয়া যেত না
হয়ত বা সে মাড্রাসে অথবা বিহারের জেলে
অথবা খরচা বেশি মনে হলে
বাগজোলা খালের ধারে মুখ থুবরে পড়ে থাকতো
তরতাজা নষ্ট কিছু ছেলে ।
এইভাবে আমরা কমে যাচ্ছিলাম
আর সেইজন্যেই ক্রমশ রাত্রি বিদীর্ণ করে
প্রত্যেক ঘরে
আমরা আমাদের কন্ঠস্বর শুনতে পাচ্ছিলাম
কেঁপে উঠছিল বিভ্রান্ত স্বার্থপরতা
তখন সর্বত্য ত্রস্ত প্রতিষ্ঠিত শৃঙ্খলগুলো,
ঝনঝন করে উঠছিল প্রথমবার স্বাধীনতা।
২
আমাকে সবাই বলেছিল
আগুনের মধ্যে উত্তাপ আতঙ্ক ধ্বংস থাকে
যেও না, যেও না
কিন্তু বুকের ভেতর বিচূর্ণ করার বাসনা
আমাকে যে ভাঙন ডাকে
আগুনের মধ্যে যে তার আকর্ষক আলোও থাকে
সে আলোর দিকে যখন হাঁটছি
তখন বুদ্ধিমান আত্মীয়রা বললেন
ফিরে এসো, ফিরে এসো
আমরা যা করি মেনে নাও তাকে
মেনে নেওয়াই সভ্যতা
মেনে নেওয়াই জীবনের কথা
মেনে নেওয়াই নিরাপত্তা
আমার শুভানুধ্যায়ী কৃতি মানুষেরা আমাকে বললেন
তুমি মূর্খ, আত্মঘাতী আলোর পোকা
তুমি ভীষন বোকা।
তখন আমি সত্যি কী ভীষণ বোকা ছিলাম
শহরের যে কোনো প্রান্তে মিছিল দেখলেই
কিছুক্ষণ তাদের সঙ্গে চলতে থাকতাম
সবাই অচেনা কিন্তু সবাই বন্ধু
যেন জীবন্ত জলরাশি, ঢেউএর মতন উঠছে হাত
সমুদ্রের গর্জন
যেন লাফিয়ে উঠে সূর্য পুড়িয়ে দিচ্ছে লুকোনো রাত
মানুষের দ্রোহ শব্দ আমার বুকে এমনই আগুন জ্বালাতো
স্নায়ু চঞ্চল হতো
আমি স্পষ্ট দেখতে পেতাম
শহরের রাজপথ দিয়ে মানুষ চলেছে
চলেছে মানুষের স্রোত
হতশ্রী, ক্ষুধার্ত,পীড়িত,ক্রীতদাস, রিক্ত, নির্বোধ
বিকীর্ণ আকাশ ঐকতানে
মানুষের গানে
দখল হয়ে যাচ্ছে শহরটা,
কারখানা, অফিস, স্কুল, আদালত,
মন্দির, মসজিদ, বেশ্যালয়,পানশালা থেকে
মুক্তি পাওয়া মানুষের প্রাণে
এক নতুন প্রত্যুষ
সব দখল করে ভাঙছে মানুষ
ভাঙছে অন্যায়ের স্থাপত্য
মানুষের হাতগুলোই তখন হাতুড়ি
অনেক মানুষ মানেই তো সশস্ত্র মানুষ
সবাই বলছে , ‘এসো, নতুন মানুষ গড়ি’।
৩
এইভাবে ভাবছিল শহরের দেয়ালও
টেনসিলে আলকাতরা দিয়ে আঁকা নিষিদ্ধ নেতার মুখ
লেনিন, স্ট্যালিন , মাও, রেডবুক
নিউজপ্রিন্টের গরম লিফলেট
পাড়া কাঁপানো শব্দ, হুঙ্কার
ভালবাসা অথবা ঘৃনার বুলেট ।
ভালবাসা ব্যাকারন খোঁজে না
ভালবাসা স্বপ্ন দেখে যায়
ভালোবাসা বড় নিরুপায়
কী করতে চায় বোঝে না
ভালোবাসা কী করে যে শেখে
এত ঘৃণা? এত?
পথের ওপরে লাশ,
তাজা রক্ত
শুধু ক্রোধ নিজেকে খনন করেছিল
প্রতিশোধ বুঝতে দেয়নি কিছু
পাহাড় যে এত উঁচু বোঝার আগেই
ভালবাসা শেষ হয়ে গেল ঘৃণাতেই।
৪
তারপর...
একদিন এই অন্যায় মননের দোষে
রাজরোষে, আতিথ্য পেলাম।
শীতল মাটিতে কুটকুটে কম্বল
দেয়ালের মাথায় একটা কৃপণ জানলা দিয়ে
সূর্য উঁকি মেরে শোনে , ‘হল্লা বোল’
বাতাসে গমগম করে
সবাই মিলে গাইছি আমরা
‘...ও মা তোর বুক থেকে রক্ত ঝরে...’
ভারী দরজার ওপাশে পায়চারী করে ভারী বুট
পাড়ায় পাড়ায় রুট মার্চ করে দুঃস্বপ্ন ,ত্রাস
আর চিরুনী তল্লাশ
তারপর ঘুমের ভেতর ক্রমশ ঢুকে যায়
সন্দেহ, সন্ত্রাস, অবিশ্বাস ।
জায়গা নেই কাস্টডিতে, জেলখানায়
রাস্তাতেই শুয়ে আছে লাশ বন্দুকের বিবেচনায়
শহরের সড়ক বধ্যভূমি
পথগুলো বিপথে হারাতে থাকে
হারিয়ে যাই হাতে হাত ধরে থাকা আমি আর তুমি
তুমি বল এইটাই বাম
আমি বলি সংশোধনবাদী, মূদ্রার ওপিঠ ,
স্থাপত্যের অন্য নাম
তুমি বল সুবিধাবাদী বাম উগ্রতা
তখন মারি আর মরি, ঘুমিয়ে পড়ে আমাদের কথা।
৫
রাত শেষ হলে সূর্য উঠবে, কথা ছিলতো
কিন্তু এ রাত এত যে দীর্ঘ কে জানতো?
৬
পাল্টে যায়,
ঘরের ভেতর যুদ্ধ করতে করতে সময় চেনায়
কে বন্ধু, কে নয়,
প্রতিটি যুদ্ধের অবশিষ্ট মৃত্যু আর পরাজয় ।
আর তখন বাঁচার জন্যে তাড়াতাড়ি পোশাক পাল্টানো
ভুলে যাওয়া কী করতে চেয়েছিলাম আর কেন,
কুটকুটে কম্বল , মুতের গন্ধ, অল্প খাবার
আশাভঙ্গের বেদনা বুকে
তখন মনে হয় আর নয়,
ইচ্ছে করে যে কোনো শর্তে আকাশের নিচে দাঁড়াবার
মৃত্যু পরাজয়ের মধ্যে পরাজয়কেই মেনে নেবার ।
আমিও তাই
ঘুমোতে চাইলাম দুঃস্বপ্ন আড়াল করতে
চোখ বন্ধ করে নিজেকে বোঝালাম ‘ঘুমোতে চাই’।
৭
বন্ধ করে ফেললাম দুচোখ
যা হয় হোক,
বন্ধুদের জন্যে শোক
প্রতিবাদ, প্রতিরোধ,
সমাজের ভালোমন্দ, কান্না , ক্রোধ
সব এবার ঘুমোক ।
আমাকে পাঁচিলের বাইরে দিয়ে গেছে ওরা
স্বপ্ন দেখিনা আর
দৌড়তে ভুলে গেছি,
আমি যুদ্ধ থেকে ফিরে আসা বাতিল ঘোড়া
উপড়ে নিয়েছে আমার সাহস, আমার বিরুদ্ধাচার
জাহাজডুবির পর সমুদ্র নির্বিকার
সব যেন স্বাভাবিক ,সূর্য ওঠে নিয়মিত
একেবারে আগেকার মত
রোদ্দুরে দৌড়চ্ছে মানুষ
ঘুম পারাচ্ছে অন্ধকার ।
৮
এখানে কি ছিলাম আমি , এই ভূগোলেতে
সব উষ্ণতা নিভে গেছে ?
সবাই কী তৎপর আগুন নেভাতে ?
আমি ঘুরতে থাকি
ভালোছেলেরা রোজ নটায় দাঁড়ি কামিয়ে
কালো হাতব্যাগ নিয়ে অফিস যাচ্ছে
স্কুলের বাচ্ছারাও বলছে ইঁদুরছানা ভয়ে মরে
কারখানায় শ্রমিক শুধু কাজ করে
বিচারকদের ঘুম পেয়ে যায়, মাঝে মাঝে মন্ত্র পড়ে
মন্দিরে ঘণ্টাগুলো নিরাপদে বা্জে ,
ঈশ্বর আর পূজারীর কথা হয়
মসজিদে আশহাদু-আল লা-ইলাহ ইল্লাল্লাহ ...
আকাশ বিদীর্ণ করে ডাকছেন ইমাম
তবু চোখের জল, পিঠের চাবুক, গায়ের ঘাম
প্রতিটি পথ জুড়ে,
শীতল, শিহরিত মানুষ, চোখে ভয়, শুধু ভয় ।
দর্জিপাড়ায়, শোভাবাজারে দেয়াল ধরে
দাঁড়িয়ে থাকে আজও মেয়েরা
মুক্তির কথা শুনলে হাসে
কেননা সবাই মাংস ভালো বাসে
সেই আদিম পৃথিবী জঙ্গলের প্রতি পথে ,
আর জঙ্গল এগিয়ে এসেছে সভ্যতায়
শুধু খুঁজে পাইনা সেই আপোষহীন আগুনের বর্ণমালা
এইখানে ছিল এইখানে ,আমাদের স্বপ্ন দিয়ে তৈরি
আমাদের আবেগ ,আমাদের সূর্যস্নাত বেলা
হারালো কোথায় ?
৯
আমি প্রশ্ন করি
আমার মার দিকে চেয়ে দেখেছ কেউ ?
সবাই দৌড়চ্ছে, কেউ শুনতে পায় না
এখন উল্টোদিকে ঢেউ।
স্টেশনে ঝকঝক করে ঝাঁকাচ্ছিল কৌটো একটা লোক
হাতের কৌটোতে লেখা, ‘সংগ্রামী তহবিল’
বুকে লেখা ‘মোহিনী কটন মিল’
হাজার হাজার মানুষ পেরিয়ে যাচ্ছে একজনের কাতরতাকে
ভিড়ের ভেতর একজন মানুষের নির্জনতাকে
চেয়ে দেখেছ কেউ?
গাড়ি ছেড়ে দেবে , গাড়ি ছেড়ে দেবে
সবাই বড় ব্যস্ত,নিস্পৃহতার ঢেউ ।
১০
অনেকক্ষণ আমি একলা আছি কমরেড
আপনারা দেয়ালে চুন দিচ্ছিলেন
আমি অপেক্ষা করছিলাম
কী লেখেন , কী লেখেন
আপনারা লিখলেন, সমাবেশ এবং বিগ্রেড
আপনারা লিখলেন চোর,চোর দাও উত্তর
পরিশেষে সেই এক কথা , ‘ভোট দিন’ ।
তারপর রোদ্দুরে একটা বাধ্য নাগরিকের লাইন
আঙুলে একটা কালো দাগ
অসাম্যের বিরুদ্ধে একটা সভ্য ভব্য রাগ
ভোটাধিকার
বোঝা গেল ঈশ্বর ও শয়তান উভয়েই নিরাকার
উভয়কেই প্রার্থনা করার একটাই মন্ত্র
গণতন্ত্র ।
ভোট হয়ে গেলে দেয়ালে জুতো অথবা হাওয়াই
মিছিলের পাশে আমি একটা বোকা লোক হেঁটে যাই
সারা শহর জুড়ে যৌনরোগ বিশেষজ্ঞের বিজ্ঞাপন
নপুংসকের ঔষধি-বানিজ্যে রমরমা
একটাই ওষুধ,’সিংহাসন’ ।
অনেক অনেকদিন এইসব অন্যায়বোধে একা হয়ে আছি
তবু চুপ করে থাকি ,যদি একটু বেশি বাঁচি!
১১
আমি লিখতে থাকি
শুধু কি ভালবাসা নিয়ে যুদ্ধ জেতা যায়?
ভালবাসা অনুমান করতে পারেনি
যা দাহ্য তা সতত প্রদীপ্ত থাকেনা
আমরা পতঙ্গের মত আলোর সংকেত পেয়ে
ছুটে গেছি আগুনের ইন্ধনে,
পুড়ে গেছি, পড়ে আছে মনস্তাপ
তবুও ভস্মাধারে ধিকিধিকি যেন বেঁচে আছে
পাবকের প্রাণ
বেঁচে আছে উত্তাপের অভিশাপ
আপাত বিজিত যারা, যারা পারেনি
সময়ের অপেক্ষায় আছে তারা,
বুকে ক্ষত আজও যুদ্ধরত ,
হারেনি হারেনি তারা হারেনি।