অন্য তিতলি
অন্য তিতলি
ড্রয়িং রুমে সোফার উপর বসে আছে তিতলি, সামনে টি টেবিলের উপর খবরের কাগজ টা এলোমেলোভাবে রাখা আছে কিন্তু তার চোখ পড়েনা সেদিকে। জানালা দিয়ে বাইরে চোখ চলে যায় ঠিকই কিন্তু সে আকাশ বাতাস গাছ বন পাখি প্রজাপতি সূর্যের আলো কিছুই ভালোভাবে দেখেনা মানে লক্ষ্য করে না।
হাই স্কুল লিভিং এক্সামের প্রথম দিনেই এক্সাম দিয়ে ফেরার পথে তিতলিদের স্কোরপিয়ন গাড়ি ভয়াবহ দুর্ঘটনার শিকার। দশ চাকার লরির সঙ্গে মুখোমুখি সংঘর্ষ! গাড়ি চালাচ্ছিল তিতলির বাবা, স্পট ডেড। তিতলি "আজমল সেঠস্ নার্সিংহোম" এ টানা দু'মাস। ভুল অস্ত্রপচার বসত স্নায়ু রোগে আক্রান্ত হয়ে তার ঐচ্ছিক পেশীগুলি ধীরে ধীরে তাদের কর্ম ক্ষমতা হারাতে শুরু করে। সে স্থবির হয়ে বসে থাকে, নিস্তব্ধতায় কাটে তার একেকটা দিন। তার চেতনার রঙে কোন কিছুই আর রঙিন হয়ে ওঠে না, প্রকৃতির কোন সৌন্দর্যই তাকে আর আকৃষ্ট করে না। এখন সে ভীষণভাবে নিঃসঙ্গ। বিকেল বেলার খেলার সাথিরাও এখন আর তার কাছে আসে না। নাচ গান যার প্রধান আকর্ষন ছিল, যে নাকি খুব চঞ্চল ছিল, ক্লাসে সব সময় যে প্রথম হতো, বাড়িতে অথবা খেলার মাঠে কিংবা স্কুলে যে সবার আগে ছুটতো হঠাৎ করে সে কেমন নিস্পৃহ থাকছে। বাড়িতে সকলের মন খারাপ। তার প্রিয় ঠাম্মি কিছুতেই তার এই কষ্ট সইতে পারে না, বুকের ভিতরটা হু হু করে ওঠে।
আজ হঠাৎ করেই খবরের কাগজটা তিতলির দৃষ্টি আকর্ষণ করল। ঠিক লোহাকে যেমনভাবে আকর্ষণ করে চুম্বক। সে দেখতে পেল তারই মত এক প্রতিকৃতি হুইল চেয়ারে বসা একটি পঙ্গু মেয়ে। শরীর বিকৃত কিন্তু তার অনুসন্ধানী দৃষ্টির আশ্চর্য ঝলক চশমার ফাঁক দিয়ে যেন বাইরে ঠিকরে পড়ছে। সেই দৃষ্টি সাধারণ দৃষ্টি নয় প্রাণশক্তিতে ভরপুর।
তিতলির অবসরপ্রাপ্ত ঠাম্মিই এখন তার দিন রাতের সঙ্গী, খবরের কাগজ খানা টি টেবিলের উপরে রেখে দিয়ে চোখ জুড়াতে গিয়েছিলেন কিছু সময়ের জন্য বাইরে প্রকৃতির ডাকে সাড়া দিয়ে। ফিরে এসে দেখলেন তার পরম আদরের নাতনি খবরের কাগজ খানি পরম যত্নে বুকে আঁকড়ে ধরে হুইল চেয়ারে বসে রয়েছে। তিতলিকে এই অবস্থায় দেখে ঠাম্মি কিছুটা অবাক হলেন। এক্সিডেন্টের পর এই প্রথম তিতলির কোন পরিবর্তন ঠাম্মি দেখতে পেলেন। অনুধাবন করছেন তার নাতনিকে কতটা কষ্ট করতে হয়েছে খবরের কাগজখানা তুলে আনতে টি টেবিলের উপর থেকে। এই দৃশ্য দেখে যতটা কষ্ট হচ্ছিল ততটাই আনন্দে চোখ দুটো ছল ছল করে উঠলো।
----দেখতে পেলেন আজ অনেকদিন পর তার হতাশাগ্রস্ত বাম অলিন্দের ব্ল্যাকহোলে যেন একটা কিরণচ্ছটা এসে প্রবেশ করেছে। সামনে যেন স্টিফেন হকিংস কে দেখতে পাচ্ছেন। তিনি আরেক যুদ্ধে নামলেন, সারাদিন যতটা সম্ভব তিনি ধৈর্য নিয়ে নাতনিকে হকিংসের জীবন যুদ্ধের কাহিনী, প্রতিবন্ধকতাকে পায়ে ঠেলে জীবন যুদ্ধে এগিয়ে যাওয়ার কাহিনী একতরফাই শুনিয়ে যেতে লাগলেন দিনের পর দিন।
ঠাম্মি দেখলেন তিতলি তার দিকে নিস্পলক দৃষ্টিতে চেয়ে আছে। মনে হচ্ছিল তিতলি যেন অতি আগ্রহের সঙ্গে হকিংসের কথা শুনেছে। তিতলির মনের কথা বুঝতে না পারলেও ঠাম্মির মনে আশার দ্বীপ জ্বেলে উঠলো।
