Unlock solutions to your love life challenges, from choosing the right partner to navigating deception and loneliness, with the book "Lust Love & Liberation ". Click here to get your copy!
Unlock solutions to your love life challenges, from choosing the right partner to navigating deception and loneliness, with the book "Lust Love & Liberation ". Click here to get your copy!

Sanghamitra Roychowdhury

Children Stories Classics Inspirational

4.9  

Sanghamitra Roychowdhury

Children Stories Classics Inspirational

গঙ্গারাম

গঙ্গারাম

10 mins
976


আমাদের বাড়ীর প্রায় সবাইকেই পশুপাখিপ্রেমীই বলা যায়। বিশেষতঃ আমার ঠাকুরদা... মানে দাদু যদিও পেশায় ডাক্তার ছিলেন, কিন্তু অবসরে দাদু একদম একজন আদ্যোপান্ত প্রকৃতিপ্রেমিক। অবশ্য ঠাকুমাও কম কিছু যেতেন না।

আমাদের বাড়ীর পেছনে এক মস্ত বাগান আছে। বাগানটা অনেক বড় বড় গাছে ঠাসাঠাসি ভরা। সবই যে দাদুর আমলের তেমন নয়, কিছু কিছু বড়ো বড়ো গাছপালা দাদুর বাবা, বা ঠাকুরদার আমলেরও আছে। তবে বেশীর ভাগই দাদুর নিজের হাতে লাগানো। আর কিছু আছে মালীকাকার হাতের। গরমের ছুটিতে বাড়ীতে এলে আমার প্রায় সারাদিনটাই বাগানের একোণে ওকোণে ঘুরে বেড়িয়েই কেটে যেতো।

আমার দাদু রোগীদের কাছেও তাদের খুব প্রিয় ডাক্তারবাবু, আর দাদুও রোগীদের সেবায় অর্থাৎ নিজের পেশায় একজন নিবেদিতপ্রাণ মানুষ। তবে ডাক্তারির বাইরে দাদুর কাছে গাছপালা বা পশুপাখি একেবারে নেশার মতো। এই গাছের নেশাতেই আমার দাদু মালীকাকাকে সঙ্গী করে দূর দূরান্তে দৌড়োতেন কোনো দুর্লভ জাতের গাছের সন্ধান পেলেই। দাদুর আরও একটা অভ্যেস ছিলো বাগানে আসা পাখিদের জন্য জল আর খাবার রাখা বারোমাস। বেশ ক'টা বড়ো বড়ো মাটির পাত্রে পরিষ্কার জল আর আধভাঙা চাল-গম রাখা থাকতো আমাদের বাগানটার বিভিন্ন কোণে কোণে। আর তাই রোজই অগুনতি পাখি আসতো আমাদের বাগানে। এমনকি অনেকে তো আমাদের বাগানের নানান গাছেই বাসা বেঁধে একেবারে গুছিয়ে সংসার করতো। তাদের কিচিরমিচির কলকলানিতেই আমাদের ঘুম ভাঙতো রোজ সকালে।

সেবার গরমের ছুটি পড়ার কয়েকদিন আগেই বাবা আমাকে হস্টেল থেকে নিয়ে এসেছিলেন, কারণ আমার খুব জ্বর সর্দি কাশি হয়েছিলো। বাড়ীতে থাকলেই দাদুর তত্ত্বাবধানে চিকিৎসার সুবিধা হবে বলে বাড়ীতে চলে এসেছিলাম। তখন একটু সুস্থ হয়েছি। বৈশাখের প্রায় শেষ। একদিন সন্ধ্যের মুখে ভীষণ ঝড়। কালবৈশাখী, তাতেই সব একেবারে লণ্ডভণ্ড কাণ্ড। প্রবল ঝড়ে আমাদের বাগানের ঐসব পাখিদের বাসার ভয়ানক ক্ষতি হলো। দুমড়েমুচড়ে অনেক বাসা ভেঙে পড়েছিলো। ঝড় থামতেই দাদু টর্চ জ্বেলে সাথে মালীকাকাকে নিয়ে ভেঙে পড়া বাসাগুলো খুঁজে খুঁজে দেখলেন যে কোথাও কোনো ভাঙা বাসায় পাখিরা বাচ্চাসমেত আটকে রয়েছে কিনা। কিন্তু রাতে দাদুর বা মালীকাকার চোখে পড়েনি সেরকম কোনো বাসা। এদিকে পরদিন ভোরের আলো সবে ফুটেছে কি ফোটেনি, এমনি সময় বাগান থেকে অনেক পাখির সমবেত চেঁচামেচি আর তারস্বরে কিছু কাকের চিৎকারে দাদু ছুটলেন বাগানে। পেছন পেছন আমরা তুতো ভাইবোনেরা আর মালীকাকা। বাগানের শেষ প্রান্তে কোণের দিকে ধবধবে সাদা এক পেঁচার বাচ্চা ডানা ভেঙে পড়ে আছে, আর তার পাশে মা পেঁচাটা ঘাড়-গলা শরীর ফুলিয়ে ত্রাহি স্বরে চেঁচাচ্ছে। আর তাদের ঘিরে ধরে কিচিরমিচির করছে নানা জাতের পাখির দল। এই জমায়েতটির ঠিক মাথার ওপরে ডজনখানেক কাক কা-কা রবে বাগান মাত করে ফেলেছে।

দাদু গিয়ে ডানাভাঙা বাচ্চা পেঁচাটিকে মা-সমেত তুলে আনার সময়ে আমার চোখে পড়লো একটা সবুজ পাতার মতো পাখির বাচ্চা দু'পাশে ডানা ছড়িয়ে ছেঁচড়ে ছেঁচড়ে জলের পাত্রটার দিকে এগোনোর আপ্রাণ চেষ্টা করছে। কিন্তু পারছে না, একটু এগিয়েই কেঁপে থেমে যাচ্ছে। আমি চেঁচিয়ে দাদুকে ডেকে দেখালাম। ওর আশেপাশে আর কোনো বড়ো ঐরকম সবুজ পাখি নেই, বাচ্চাটা একলা। দাদু বললেন, ওটা টিয়ার জাতের বা চন্দনার জাতের। এতো ছোট যে ঠিক বোঝা যাচ্ছে না কি জাতের। আমি ততক্ষণে তুলে ফেলেছি ঐ পাখির বাচ্চাটাকে। বাড়ীতে নিয়ে আসা হলো তাদের সবাইকেই। মায়েপোয়ে পেঁচা আর ঐ বাচ্চা টিয়া বা চন্দনা যাইই হোক, এরা আমাদের বাড়ীর সদস্য হয়ে গেলো। এরপর বেশ অনেকদিন ধরে ওরা রইলো দাদুর ডাক্তারখানা ঘর লাগোয়া ওষুধের ঘরটার একপাশে, বড়ো বড়ো দু'খানা ঝুড়িতে করে। নতুন পোষ্যদের নিয়ে বাড়ীতে বেশ একটা ব্যস্তসমস্ত হৈহৈ রৈরৈ ব্যাপার স্যাপার চলতে থাকলো। কমলার রস, আঙুর, ছোট ছোট টুকরো করে কাটা আম আর আপেল, দুধের সর, ডালবাটা, এমনকি থিন অ্যারারুট বিস্কুট ইত্যাদি নিরামিষ ভোজন করেই দিব্যি ছিলো তারা। দাদু ফলের রসে মিশিয়ে ওষুধও খাওয়াতেন বাচ্চা দুটোকে রোজ। পেঁচার বাচ্চাটার ডানাটা ওড়ার উপযোগী হতেই এক আঁধার রাতে তারা মায়েপোয়ে আমাদের বাড়ী ছাড়লো। আর টিয়ার বাচ্চাটা দিব্যি রয়ে গেলো। তার খোঁজে তার অভিভাবকরা কেউ আসেনি। হয়তোবা তারা বাচ্চাকে বাগানে খুঁজে না পেয়ে অন্য কোথাও চলে গিয়ে থাকতে পারে। আবার এমনও হতে পারে তারা আমাদের বাগানেই হয়তো নতুন বাসাটাসা বানিয়ে আছে, আর বাচ্চার হারিয়ে যাওয়াটা তারা মেনেই নিয়েছে। তবে বাচ্চা পাখিটার অবয়বে ধীরেধীরে স্পষ্ট হচ্ছে যে সে অবশ্যই টিয়া। তার গলার দাগ আর ঠোঁটের রং অনেক গাঢ় হয়েছে। ঘরের একোণ থেকে ওকোণ ওড়াউড়ি করে বটে, কিন্তু ঘরের বাইরে কিছুতেই যায় না। দাদু আর ঠাকুমা অনেক আলোচনা করে টিয়ার নামকরণ করলেন, "গঙ্গারাম"। গঙ্গারাম এবার একটু একটু করে যেন রোজই বড়ো হচ্ছে, আর কী সুন্দর হয়ে উঠছে। গঙ্গারাম এখন সাহস করে মাঝেমাঝে ঘরের বাইরে বেরোয়। একদিন ঠাকুমা দেখলেন পাশের বাড়ীর বেড়ালটা আমাদের বাড়ীতে ঘুরঘুর করছে, তার হাবভাব মোটেই ভালো ঠেকেনি ঠাকুমার কাছে। তাই ঠাকুমা দাদুকে বলে মালীকাকাকে দিয়ে একখানা বেশ বড়সড় দাঁড় লাগানো খাঁচা আনালেন। রাখা হলো তার ভেতরে গঙ্গারামকে। তাতে তার বিশেষ কোনো হেলদোল নেই। গঙ্গারাম খাঁচায় ঢুকে বেশ বহাল তবিয়তেই রইলো।

গঙ্গারাম আমাদের বাড়ীতে পাকাপাকি সদস্য হয়ে যাওয়াতে, ঐ পেঁচা মা-বাচ্চার কথা একটু ফিকে হয়ে গিয়েছিলো। বিশেষতঃ তারা যখন স্বেচ্ছায় আমাদের বাড়ী ছেড়েছিলো। তবে তারা যে আমাদের মোটেই ভোলেনি তার প্রমাণ পাওয়া গেলো এক সন্ধ্যায় আমাদের রাঁধুনি অষ্টিপিসির চিৎকারে। একটা বড়ো আর একটা ছোট ধবধবে সাদা লক্ষ্মী পেঁচা দাদুর ডাক্তারখানা ঘরের লাগোয়া পাঁচিলে বসে আছে দেখা গেলো, উঠোনের দিকে মুখ করে। তারপর থেকে দেখা যেতে লাগলো তারা প্রায় রোজই সন্ধ্যেতে দু'জনে উড়ে এসে পাঁচিলে খানিকক্ষণ বসে থাকতো, বোধহয় কৃতজ্ঞতা জানাতে। ঠাকুমার পরিয়ে দেওয়া সিঁদুরের টিপ তাদের কপালে অন্ধকারে পরিষ্কার না দেখা গেলেও আমরা ঠিক চিনতাম যে তারা মায়েপোয়েই এসেছে। তার আরো বড়ো কারণ ছিলো গঙ্গারাম। ঠাকুমার ঘরের সামনের বারান্দায় একটা লোহার শিকে ঝোলানো গঙ্গারামের খাঁচা। সেখান থেকে সোজাসুজি দেখা যায় ডাক্তারখানা ঘরের লাগোয়া পাঁচিলটা। পেঁচারা মায়েপোয়ে এসে বসা মাত্রই গঙ্গারাম কত কিছু যে বলতো ওর নিজের ভাষায়, তার আর ইয়ত্তা নেই। আর পেঁচা দুটো নিয়মিত আসছে দেখে ঠাকুমাও অষ্টিপিসিকে দিয়ে পাঁচিলের ওপরে ফলের টুকরো বা বিস্কুট রাখিয়ে দিতেন। এমনকি ঠাকুমা আর অষ্টিপিসি দিব্যি তাদের লক্ষ্মী আর জগন্নাথ বলে আলোচনা করতেন। মা পেঁচার নাম লক্ষ্মী, তা নাহয় বোঝা গেলো, তবে বাচ্চার নামটি কেন জগন্নাথ সে রহস্য অজানাই ছিলো। কালের নিয়মে সবাই চলে যায় কোথাও না কোথাও ঠিক। তেমনই দাদু চলে গেলেন একদিন সেই না ফেরার দেশে। ডাক্তারখানা বন্ধ পড়ে থাকে দেখেই কিনা জানিনা, তবে লক্ষ্মী আর জগন্নাথের আসাও বন্ধ হলো একদিন। আমরাও যে যার জায়গায়। বাড়ীতে ঠাকুমা, অষ্টিপিসি, মালীকাকা শুধু, আর গঙ্গারাম। আমরা আসি ছুটিছাটায়। তাতে কি? গঙ্গারাম আমাদের খুব ভালোই চিনতো। আর দিনরাত কটর কটর করে কথা বলতো। ঠাকুমা অষ্টিপিসি মালীকাকার কথোপকথন শুনেই বোধহয় শিখতো। গঙ্গারামকে কে আর বসে বসে আলাদা করে কথা বলা শেখাবে নইলে? তবে যাইবা হোক বেড়ে কথা বলতে শিখেছে গঙ্গারাম, এবং বেশ বুঝেশুনে তার প্রয়োগ করতো।

এভাবেই বছরের পর বছর পার হয়েছে। আমি সেবার স্কুলের শেষ পরীক্ষা দেবো। হস্টেলেই রয়ে গেলাম বড়দিনের ছুটিতে। স্কুল খুললেই টেস্ট পরীক্ষা। পড়াশোনার চাপ আছে। বাবা একবার এসে দেখা করে প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র কিনে দিয়ে গেছে আর বড়দির সাথে কথা বলে গেছে... টেস্ট পরীক্ষার শেষদিন এসে দু'দিনের জন্য বাড়ীতে নিয়ে যাবে। ঠাকুমা খুব করে আসতে বলেছে, তাই। পরীক্ষার শেষদিনে বাবার সাথে ট্যাক্সি চেপে শিয়ালদা, তারপর লোকাল ট্রেনে করে সোদপুরের বাড়ীতে। যাবার সময় বাবাকে বলে কমলালেবু কিনলাম গঙ্গারামের জন্য। গঙ্গারাম কমলালেবু খেতে ভারী ভালোবাসে। চোখ বুজে বুজে খায় তারিয়ে তারিয়ে। ঠাকুমার কমলালেবুর কোয়া ছাড়িয়ে দিতে একটু দেরী হলেই গঙ্গারাম আদুরে গলায় চেঁচামেচি করছে, "মা, মা, দাও, মা, মা, দাও!" ওর ঐ কথা বলা শোনার জন্যই আমি ঠাকুমার হাত ধরে দেরী করাচ্ছি। খানিকক্ষণ ধরে ঘাড় বেঁকিয়ে দেখে গঙ্গারাম দেরীর কারণটা বুঝে ফেললো। তারপর খানিকটা ক্যাঁও ক্যাঁও করেই মোক্ষম কথাটাই ছাড়লো, "দূর হ, হতভাগাটা, দূর হ, হতভাগাটা, দূর হ, হতভাগাটা..." পৌনঃপুনিক ভাবে বলেই চলেছে, থামার নাম নেই। আমরা সবাই হাসছি দেখে গঙ্গারাম আরো উৎসাহে উত্তেজিত হয়ে খাঁচার ভেতরের দাঁড়ে এমাথা ওমাথা পায়চারি করতে করতে আমাকে বকাবকি করে যাচ্ছে। বাবা জিজ্ঞেস করলেন, "গঙ্গারাম কথাটা শিখলো কি করে?" ঠাকুমা তোবড়াগালে ফোকলা দাঁতে অনাবিল হাসছিলেন। অষ্টিপিসি রহস্যটা ভাঙলো। ঠাকুমা বেশ কয়েকমাস আগে মালীকাকার সাথে কথা বলছিলেন, বাগানে একটা মৌচাক হয়েছে, সেটা ভাঙার বিষয়ে। ঠাকুমা বলেছিলেন কোনো পেশাদার লোক দিয়ে ভাঙাতে। আর মালীকাকা বলছিলো যে নিজেই ভাঙবে মৌচাক। তখন ঠাকুমা মালীকাকাকে বলেছিলেন, "দূর হ, হতভাগাটা!" ব্যাস্, খাঁচায় নিজের দাঁড়ে বসে বসেই গঙ্গারাম কথাটা অবিকল নিজের গলায় তুলে ফেললো, আর যখনই কোনো বিষয় নিজের অপছন্দ হয় অমনি আওড়াতে থাকে, "দূর হ, হতভাগাটা, দূর হ, হতভাগাটা...", রীতিমতো বুঝে শুনে, আলটপকা মোটেই বলে না। আমিও খুব মজাই পেলাম। বারবার নানান ভাবে চেষ্টা করতেই লাগলাম যাতে গঙ্গারাম বলে, "দূর হ, হতভাগাটা"!

এমনিতে গঙ্গারাম, "হরেকৃষ্ণ, রাধে রাধে গোবিন্দ আর "মা", "অষ্টি", "মালী"... এসব বলতোই। নতুন সংযোজন "দূর হ, হতভাগাটা"। এবার বাবা-মাও আমাকে বাড়ীতে বেশিদিনের জন্য আনেননি শুধু পড়াশোনার চাপের জন্য, সামনেই উচ্চ মাধ্যমিক। দু'দিন হুস করে পার হয়ে গেলো। পরেরদিনই আমি হস্টেলে ফিরবো। আমাকে পৌঁছে দিয়েই বাবা-মাও উত্তরবঙ্গে ফিরবেন। বাবার তখন ওখানেই পোস্টিং। একটু মন খারাপ লাগছিলো। ঠাকুমা অষ্টিপিসিকে নিয়ে পাটিসাপটা ভাজছিলেন আমার জন্য। আর আমি গঙ্গারামের সাথে বসে বসে খেলছিলাম। অদ্ভুত খেলা, আমি একটা করে ভিজে ছোলা একটু দূরে ছুঁড়ে দিচ্ছিলাম আর গঙ্গারাম হেলেদুলে হেঁটে গিয়ে ছোলাটাকে ঠোঁট দিয়ে কামড়ে ধরে এনে আমার হাতে দিচ্ছিলো। ঠাকুমা এটা শিখিয়েছিলেন গঙ্গারামকে। সারাক্ষণ খাঁচার দাঁড়ে বসে থাকলে নাকি সেটা ওর শরীরের পক্ষে খারাপ, তাই একটু বেশি চলাফেরা করানোটাই উদ্দেশ্য। আর গঙ্গারাম মনেহয় উড়তে জানতোই না, নাকি উড়তে ভুলে গিয়েছিলো কে জানে! তবে মজার ব্যাপার খেলা হয়ে গেলে গঙ্গারাম আবার নিজেই হেঁটে হেঁটে গিয়ে খাঁচায় ঢুকে পড়তো। কখনো উড়ে পালানোর কোনো চেষ্টাই করেনি ও। সেদিনও যথারীতি খেলা শেষে গঙ্গারাম নিজেই গিয়ে খাঁচায় ঢুকে গেলো, অর্থাৎ অনেক খেলা হয়েছে, এবার আমি বিশ্রাম করবো, যাও তো এখন। গঙ্গারাম দাঁড়ে বসে "হরেকৃষ্ণ হরেকৃষ্ণ" বলে ডানায় মুখ গুঁজলো। আমি আর একলা বসে থেকে কী করবো? বাড়ির সবাই যে যার কাজে ব্যস্ত, আমি বড়ো দালানে পাতা কাঠের ইজিচেয়ারটায় গিয়ে বসলাম। ওটা আমার ঠাকুরদার চেয়ার। এই চেয়ারের হাতলে বসে দাদুর কাছে কত সব গল্প শুনেছি। মনটা ভারী হয়ে গেলো। দাদু আজ বেশ কয়েকবছর হলো চলে গেছেন। চোখ বুজে বসে ছিলাম। হঠাৎ ভীষণ জোরে চিৎকার করে উঠলো গঙ্গারাম। তারপর আবার। আমি ছুটলাম ঠাকুমার ঘরের সামনের বারান্দায়।

গিয়ে দেখি ফোঁটা ফোঁটা রক্ত, সবুজ রঙের ছেঁড়া পালকের টুকরো। ঠিক গঙ্গারামের খাঁচার তলার মেঝেতে। একটু দূরেই থামের আড়ালে একটা বড়ো সাইজের হুলো বেড়াল বসে থাবা চাটছে, আর পাশে রক্তাক্ত খোবলানো গঙ্গারাম নেতিয়ে পড়ে আছে। তখনও প্রাণ ছিলো বোধহয়, একটু তিরতির করে কাঁপছিলো। তারপর থেমে গেলো। আমি হুলোটাকে তাড়া দিয়ে চিৎকার করে কাঁদতে শুরু করলাম। সবাই ছুটে এসেছে। ঠাকুমা, অষ্টিপিসি, মালীকাকা, বাবা, মা... সবাই। আমি কিছু বলতে পারছিলাম না। সবাই ততক্ষণে গঙ্গারামের খালি খাঁচা দেখে বিষয়টা বুঝে গেছে।

তারপর ঠাকুমা আমাকে খুব স্বান্তনা দিয়েছিলেন। বুঝিয়েছিলেন, মানুষ মাত্রেই ভুল হয়। তাই নিয়ে কষ্ট পেতে নেই। কিন্তু আমি কিছুতেই নিজেকে ক্ষমা করতে পারিনি। আমারই বিরাট ভুলের মাশুল দিতে হয়েছিলো গঙ্গারামকে। আমি খেলা শেষে গঙ্গারামের খাঁচার দরজা বন্ধ করে দিতে ভুলে গিয়েছিলাম। ওটাই দস্তুর ছিলো, গঙ্গারামের খেলা শেষ হয়ে গেলে যে সামনে থাকবে, তাকেই ওর খাঁচার দরজা বন্ধ করে হুকে খাঁচাটা ঝুলিয়ে দিতে হবে। আর সেদিন আমি অন্যমনস্কতাবশতঃ ঐ কাজটাই করিনি। তারপর বহু বছর পার হয়েছে, ঠাকুমা যতদিন বেঁচে ছিলেন আমি ঠাকুমার চোখের দিকে তাকিয়ে কথা বলতেই পারিনি। বাবাও অনেকবার বলেছেন ঠাকুমাকে আরেকটা টিয়াপাখি এনে দেবার কথা, কিন্তু ঠাকুমা কিছুতেই রাজি হননি। এটাই আমার সবথেকে কষ্টের কারণ ছিলো। একদিন ডানাভাঙা ছোট্ট গঙ্গারামকে তো বাগান থেকে আমিই তুলে এনেছিলাম। যদি ওকে খাঁচাবন্দি করে পোষা না হতো, তবে নিশ্চিতভাবেই গঙ্গারামের এমন করুণ মৃত্যু হয়তো হতো না।

গঙ্গারাম মারা যাবার অনেকবছর পরে, তখন আমার বিয়ে হয়ে গেছে। একদিন আমার স্বামীর সাথে কিছু কেনাকাটা করে কলকাতা থেকে ফিরছিলাম। ট্রেন ধরবো শিয়ালদা থেকে। চার নম্বর বা পাঁচ নম্বর থেকে ডানকুনিগামী ট্রেন ছাড়বে। দুই প্ল্যাটফর্মের মাঝামাঝি জায়গায় অপেক্ষা করছিলাম। তখনও অফিস ফেরতা মানুষের ভিড় তেমন নেই। হঠাৎ দেখি এক পাখিওয়ালা, অনেকগুলো খাঁচায় করে নানানরকম পাখি নিয়ে বসে আছে। ট্রেনে করেই যাবে মনেহয়। তখনও বন্যপ্রাণী সংরক্ষণ আইনের তেমন কড়াকড়ি ছিলো না, এসব হামেশাই চলতো। আমি পায়ে পায়ে এগোলাম পাখিওয়ালার দিকে। আমার স্বামীর জানা ছিলো আমাদের গঙ্গারামের কাহিনী ও পরিণতি। তাই ভাবলো আমি হয়তো আবার পাখি পুষতে চাই। পাখিওয়ালার কাছে একটাই টিয়া ছিলো। আমার স্বামী দরদাম করে খাঁচাসমেত টিয়াটা পঁচাশি টাকায় কিনে নিলো। তারপর ট্রেন দিয়েছে পাঁচ নম্বর প্ল্যাটফর্মেই দেখে আমরা জোরে পা চালালাম। পিছনদিকে উঠলেই আমাদের একটু সুবিধা হয় তাই। তখনও প্ল্যাটফর্মে ট্রেন ঢোকেনি, আমি টিয়াপাখিটার খাঁচার দরজাটা খুলে দিলাম। আমার স্বামী কি বুঝেছিলো কে জানে, চুপচাপ দেখছিলো আমার কাণ্ড। কিন্তু খাঁচার দরজা খোলা পেয়েও কিছুতেই বেরোচ্ছে না টিয়াটা। খাঁচার গায়ে চেপে বসে ডানা ঝাপটাচ্ছে আর ক্যাঁ ক্যাঁ করছে। আমি খাঁচার দরজা দিয়ে হাত ঢুকিয়ে চেপে ধরলাম টিয়াটাকে। তারপর খাঁচা থেকে বের করে এনে দুহাতে ধরে ওকে উড়িয়ে দিলাম। হতভম্ব টিয়াটা উড়ে গিয়ে খানিকটা দূরের প্ল্যাটফর্মের টিনের শেডে বসলো প্রথমে। তারপর কয়েক সেকেন্ড পরেই দুই ডানা মেলে দিয়ে দূরের নীল আকাশের বুকে উড়তে শুরু করলো। তাকিয়ে রইলাম আমি আকাশের দিকে। ধীরে ধীরে টিয়াটা একটা বিন্দু হয়ে গেলো। তারপর একেবারে কোথায় মিলিয়ে গেলো। আহা, ও উড়তে ভোলেনি। আবার কোনোবাড়ির হুলোর শিকার হতে দিতে চাইনি ওকে। ততক্ষণে আমাদের ট্রেন ঢুকে গেছে প্ল্যাটফর্মে। ট্রেনে ওঠার আগে প্ল্যাটফর্মের ওপরে কয়েক ফোঁটা রক্ত, দেখে চোখটা ভিজে উঠলো আমার। এই রক্তের ফোঁটাটা আমার, খাঁচা থেকে জোর করে বের করার সময়ে গায়ের জোরে আমার ডানহাতের আঙুল কামড়ে দিয়েছে টিয়াটা, কেটে রক্তাক্ত হয়েছে। ট্রেনে বসে যখন আমার স্বামী আমার হাতে বোরোলিন লাগাচ্ছে আমার ব্যাগ থেকে বার করে, তারপর রুমাল জড়িয়ে ক্ষতস্থান মুড়ে ঢেকে দিচ্ছে, তখনও আমার বিন্দুমাত্রও ব্যাথার কোনো বোধ হয়নি। জানালা দিয়ে তাকিয়েছিলাম আকাশের দিকে।

তারপর যথাসময়ে ট্রেন ছাড়লো, ধীরেধীরে এগোচ্ছে ট্রেন বিধাননগরের দিকে। স্টেশনে ঢোকার আগেই একটা বড়ো গাছ, বট বা অশ্বত্থ হবে হয়তোবা। সেই গাছটার ডালে ডালে ঝাঁকে ঝাঁকে টিয়াপাখি। গাছের একটা অংশ গাঢ় সবুজ হয়ে উঠেছে। আমার ছেড়ে দেওয়াই টিয়াপাখিটা কি এই ঝাঁকে এসে মিশতে পেরেছে, নিজের জনেদের কাছে পৌঁছতে পেরেছে?

উত্তরটা জানা নেই। তবে মনে অপার শান্তি পেলাম। চোখ বুজে ঠাকুমা আর গঙ্গারামের কাছে ক্ষমা চেয়ে নিলাম... আমার ভুলের প্রায়শ্চিত্ত হলো কিনা জানি না, তবে খাঁচায় পাখি পোষার বিরোধী আমি আজও।


Rate this content
Log in