সম্মান
সম্মান
প্রথম স্কুলে ভর্তি হবার দিন থেকেই বান্ধবী দের কাছে বিভিন্ন ভাবে অপমানিত হয়েছি। আমার ছেঁড়া ব্যাগ আর নোংরা পোশাক দেখে কেউ আমার পাশে বসতে চাইত না।আসলে ঝাঁ চকচকে স্কুলে আমার যাবার ই কথা নয়, কিন্তু পড়াশুনা তে ভালো হবার জন্য বাবা মা এর স্বপ্ন তৈরি হচ্ছিল সুদিনের মুখ দেখার,আমাক ঘিরেই।আর অ্যাডমিশন টেস্ট এ চান্স পেয়ে যাওয়াতে ভর্তি হতেই হল। স্কুলের পুওর ফান্ড ছিল আমার মত ছাত্রছাত্রীদের ভরসা।এক বছরে এক ক্লাসে একজন সৌভাগ্যবতী। সে বছর সে সুযোগ আমি পাই। তাই বস্তি থেকে ব্যাগ গুছিয়ে সুন্দর গন্ধ ওয়ালা, চুলে শ্যাম্পু করা বড় লোকের মেয়েদের পাশাপাশি পড়তে চলে এলাম আমিও।
আমার বাবা রাজমিস্ত্রী,যে দিন জিজ্ঞাসা করে জেনেছিল, "এই তোর বাবা কি করে?", তারপর থেকে সহপাঠীরা আমাকে ঘেন্না করত আমি গরীব বলে ।আসলে আমাকে ওদের পাশে মোটেই মানাতো না।
একদিন প্রার্থনা শেষে এসে দেখি আমার ব্যাগ মাটিতে পড়ে আর টিফিনের মুড়ি ছড়িয়ে ধুলোয়। আসলে ওদের টিফিন ছিল স্যান্ডউইচ,চাউমিন,ম্যাগি,ডিমসেদ্ধ,ফল।তাই আমি লুকিয়ে লুকিয়ে কি খাই ওদের খুব জানার ইচ্ছে।স্বাভাবিক,আমার মত একজন কে এত কাছ থেকে তো ওরা আগে দেখেনি।সবাই খুব হাসছিল ,আমাকে ওরা বসতে নেয় না পাশে,বসলে হয় আমাকে চলে যেতে বলে না হয় নিজেরা চলে যায়। ওদের টিফিন লুকিয়ে খায় আর আড়চোখে আমাকে দেখে বলে, "এই একটু শুঁকে ফেলে দে, নজর লাগবে না",আমি তাও কাঁদিনি আমি তো পড়তে গেছি। এসব গায়ে মাখলে চলবে?
কিন্তু সেদিন আমার সারাদিনের খাবার পরে ধূলো গড়াগড়ি যেতে দেখে আমি আর নিজেকে সামলাতে পারলাম না, কেঁদে উঠলাম জোরে। হঠাৎ মাথায় একটা নরম স্পর্শ, মীনা দি, আমাদের ইংরেজি দিদিমনি।উনি ক্লাসে এসে সব শুনে সবাই কে খুব বকলেন, আর আমাকে আলাদা ডেকে বোঝালেন, আমাকে লড়াই করে বড় হতে হবে, যাতে সবাই সম্মান করতে বাধ্য হয়, কাঁদলে চলবে না। কাঁদা মানে তো হেরে যাওয়া। তারপর থেকে মীনা দি রোজ আমার জন্য টিফিন আনতেন যতদিন রিটায়ার্ড হননি,তারপর আনতেন রমা দি,আমার মাধ্যমিক পর্যন্ত।
মীনাদির সেদিনের কথার পর আর ফিরে তাকাই নি কোনদিন। প্রতি বছর প্রথম হতাম, কেউ স্কুলে থাকতে আমাকে আবৃত্তি,পড়াশুনো তে হারাতে পারেনি কোনদিন।ভালো রেজাল্ট করে আজ আমি একজন শিক্ষিকা। প্রতি পদে পদে আমি সাহায্য পেয়েছি আমার শিক্ষক শিক্ষিকাদের,না হলে আজ হয়তো কোনো বাড়িতে বাসন মাজতাম, নয় কোনো কারখানায় কাজ করতাম। এমনকি কলেজের খরচ যাতে চালাতে পারি তার জন্য আমার স্কুলের দিদিমনিরা চাঁদা তুলে দিয়েছেন।তাই যারা আমায় পথ দেখিয়েছেন তাদের পথ ই আমি অনুসরণ করছি।
আমি আমার ছাত্রছাত্রীদের শেখাই, নিজেকে এমন জায়গায় নিয়ে যাও যাতে সবাই তোমাকে সম্মান করতে বাধ্য হয়।