তুমি আমার বধূ শিখা সামাজিক উপন্যাস রচনা- লক্ষ্মণ ভাণ্ডারী
তুমি আমার বধূ শিখা সামাজিক উপন্যাস রচনা- লক্ষ্মণ ভাণ্ডারী
তুমি আমার বধূ শিখা সামাজিক উপন্যাস
রচনা- লক্ষ্মণ ভাণ্ডারী
প্রথম পরিচ্ছেদ
সূর্যোদয় আর স্বপ্নভঙ্গ
ভোরের আলো তখনও পুরোপুরি ফোটেনি। কৃষ্ণপক্ষের শেষ রাতের আকাশ তখনও বিষণ্ণ, কিন্তু পূর্ব দিগন্তে উঁকি দেওয়া ক্ষীণ আভা জানান দিচ্ছে, নতুন দিনের আগমন। গ্রামের এক প্রান্তে, গোয়ালঘরের পাশে থাকা ছোট্ট কুঁড়েঘর থেকে ভেসে আসছে খসখস শব্দ। হারান সর্দারের স্ত্রী, রাধারাণী, ধোঁয়া ওঠা ভাতের হাঁড়ি থেকে চাল নাগালের মধ্যে সরিয়ে নিচ্ছেন। তার বয়সের ভারে শরীরটা একটু নুয়ে পড়েছে, কিন্তু এখনো হাত-পা চলছে।
"ও হারান, ওঠো গো। সকাল হয়ে গেল," নরম গলায় ডাকলেন তিনি।
ভেতরে তখনো গুটিসুটি মেরে শুয়ে আছে তাদের একমাত্র মেয়ে, কুড়ি বছরের শিখা। আজ তার জীবনের এক নতুন অধ্যায় শুরু হওয়ার কথা। আজ তাদের গ্রামের মোড়ল, মহিম মণ্ডলের ছেলে, সুবলের সাথে তার বিয়ে। এই বিয়ে নিয়ে শিখা যতটা না খুশি, তার থেকে বেশি আছে এক অজানা ভয় আর উদ্বেগ।
বাইরে তখনো কাক ডাকতে শুরু করেনি, কিন্তু শিখার মনে তখন হাজারো পাখির কিচিরমিচির। তার লাল টুকটুকে বিয়ের শাড়িটা একপাশে ভাঁজ করা। তার ছোট বোন, মিনতি, রাত থেকেই দিদির পাশে বসে আছে। মিনতিরও চোখে ঘুম নেই। দিদির বিয়ে, এ এক বিরাট পরিবর্তন।
"দিদি, ওঠো। কিচ্ছু ভাবছো না তো?" মিনতি ফিসফিস করে জিজ্ঞেস করল।
শিখা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল, "কিচ্ছু না রে। শুধু একটু... কেমন যেন লাগছে।"
"কেন? সুপ্রিয়দা তো ভালো মানুষ। সবার সাথেই ভালো ব্যবহার করে। তুমি তো তাও ওকে দেখেছো," মিনতি সান্ত্বনা দেওয়ার চেষ্টা করল।
শিখা উঠে বসল। তার চোখে মুখে ভোরের আলোর মতোই এক মিশ্র অনুভূতি। একদিকে যেমন নতুন জীবনে প্রবেশ করার আনন্দ, তেমনই অন্যদিকে অচেনা এক পরিবেশে নতুন করে সবকিছু শুরু করার দুশ্চিন্তা। সুপ্রিয় ছেলেটা ভালো, গ্রামের সবাই বলে। কিন্তু শিখা তো তাকে ভালো করে চেনে না। দু-একবার দেখেছে বটে, কিন্তু সে তো আর পরিচিতি নয়। বিবাহিত জীবন কতটা সহজ বা কঠিন হবে, তা সে কল্পনাও করতে পারে না।
"মিনতি, তুই যা। আমি একটু পরে আসছি," বলে শিখা জানালার বাইরে তাকালো। দূরে, আবছা অন্ধকারে গ্রামের বটগাছটা যেন এক অচেনা প্রহরী। তার মনে হল, সেই গাছটার মতোই সেও আজ একা দাঁড়িয়ে আছে এক নতুন পথের মুখে।
হারান সর্দার, চওড়া কাঁধের মানুষ, কিন্তু এখন তারও মনটা একটু ভারাক্রান্ত। মেয়ের বিয়ে, কিন্তু সামর্থ্য মতো সবই করতে হবে। মহিম মণ্ডলের সাথে বাপ-দাদার আমলের এক ধরনের সাংসারিক যোগাযোগ। তাই এই বিয়েটার মানে সুযোগ থাকলে তার মেয়ে সুখে থাকবে, এই আশা মাত্র।
"কি গো, এখনো উঠলে না? বেলা গিয়ে আর বাকি কিছু নেই," রাধারাণী মাথায় ঘোমটা টেনে ঢুকলেন। "আজ থেকে তুমি পরের বাড়ি যাবে। ভালো করে থাকবে ওখানে।"
শিখা মা-এর মুখের দিকে তাকালো। তার মুখ থেকে যেন সব কথা বেরিয়ে আসছে। "মা, তোমার আগোছ থেকে অনেক দূরে চলে যাবো। আমার খুব কষ্ট হবে।"
রাধারাণী মেয়েকে আলিঙ্গন করে বললেন, "আর কষ্ট কি? ওটাই তো সংসার। শ্বশুর বাড়িতে ভালো করে থাকবে দেখবে তোমাকেও ভালবাসবে। যেমন আমার বাবা তোমাকে ভালবাসতো।" কথাটা বলতে বলতে রাধারানীর চোখ ভেজা হয়ে এল। শিখা মা-কে সান্ত্বনা দিতে আরও জড়িয়ে ধরল। নতুন জীবনের শুরু ছিল এভাবে – এক রাশ স্বপ্ন, তার পাশে এক রাশ উদ্বেগ, আর এক রাশ পারিবারিক ভালবাসা।
দ্বিতীয় পরিচ্ছেদ
বিয়ের আসর এবং নতুন মুখ
বেলা বেড়ে ওঠার সাথে সাথে গ্রামের মেঠো পথ জনবহুল হয়ে উঠল। সকালের শান্ত পরিবেশ উৎসবের আনন্দে চঞ্চল হয়ে উঠল। শিখা তার ছোট কক্ষে হলুদ মাখতে বসেছে। তার পাশে সবাই এসে ভিড় করছে। বান্ধবীরা হাসাহাসি করছে, নতুন জীবনের গল্প বলছে। কিন্তু শিখার মন তখনো উদ্বিগ্ন।
"এই শিখা, মুখ টা এমন করে রেখেছিস কেন? আজ তোর বিয়ে!" তার প্রিয় বান্ধবী বীণা তার গালে আলতো চাপড় দিয়ে বলল।
শিখা ম্লান হাসল। "কই না তো। শুধু একটু অজানা লাগছে।"
"অজানা লাগবেই। কিন্তু দেখবি সব ঠিক হয়ে যাবে। সুপ্রিয় বেশ ভালো।" বীণা আবার বলল, "আচ্ছা, তোর যেমন যেমন সুপ্রিয়ের সাথে কথা হয়েছে বল তো শুনি।"
শিখা লাজুক ভাবে মাথা নাড়ল। "আর বলিস না। দু-একবার কথা তার সাথে হয়েছে বটে, কিন্তু তা আর নতুন করে কি বলব। শুধু শুনেছি সে ভালো।"
"শুধু শুনেছিস? নিজের চোখে দেখিসনি?" বীণা একটু হেসে কৌতুক করল।
খুব বেশি মাখামাখি ছিল না। গ্রামের মেয়ে আর ছেলেদের মধ্যে তেমন কিছু ছিল না। কিন্তু শিখা অনেক বার ঐ মেঠো পথ ধরে চলার সময় সুপ্রিয়কে অন্য অন্য ছেলেদের সাথে কথা বলতে দেখেছে। সুদর্শন চেহারা, বেশ লম্বা আর শান্ত ধরনের ছেলে। তার চেয়ে কম বয়সী হলেও সুপ্রিয়র চেহারা অনেক ভাল ছিল।
"হ্যাঁ, দেখেছি তো।" শিখা বলল, "কিন্তু কি করব বল? আমার তো আর কোন দিন ওকে অন্য ভাবে দেখার সুযোগ হয়নি।"
"আচ্ছা থাক। এখন নিজের সুখের কথা ভাব।" বীণা আবার শুরু করল, "শোন, আজ তো বিয়ে। পরে তোর নতুন সংসারের কথা বলিস।"
বাড়ির সামনে তখন ঢাক ঢোলের শব্দ। উঠোনে মানুষে ভরা। মহিম মণ্ডলের লোকজন এসে গেছে। সুপ্রিয় কে একবার দেখার জন্য শিখার মন চঞ্চল হয়ে উঠল। কিন্তু আজ তো আর সে বেরোতে পারবে না।
কিছুক্ষণ পর পালা পালা করে গান শুরু হলো। শিখা জানালার পাশে দাঁড়িয়ে বাইরের দিকে তাকিয়ে ছিল। তার মন ছিল অস্থির আর উদ্বিগ্ন। আজ তার জীবনে নতুন অধ্যায়, নতুন মানুষের সাথে। কতটা ভালো থাকবে সে, এর কোন কিছুই তার জানা নেই।
সন্ধ্যা নামার সাথে সাথে বিয়ে বাড়িতে আরও বেশি লোক জড়ো হলো। শিখাকে একটু পরে পালা পালা করে নতুন পোশাকে সাজানো হবে। তার মনে তখন এক অচেনা আকাঙ্ক্ষা আর উদ্বেগের মিশেল। আজ থেকে সে হবে সুপ্রিয় মণ্ডলের স্ত্রী। এই নতুন পরিচয়ে কেমন থাকবে তার জীবন, তা নিজেই জানেন না।
লক্ষ্মণ ভাণ্ডারী রচিত "শিখা! তুমি আমার প্রিয়তমা" একটি সামাজিক উপন্যাস, যা গ্রামীণ জীবনের সরলতা, শহুরে উচ্চাকাঙ্ক্ষা, পারিবারিক বন্ধন, সামাজিক প্রত্যাশা এবং প্রেমের চিরায়ত সংঘাতকে কেন্দ্র করে আবর্তিত হয়েছে। উপন্যাসের মূল চরিত্র শিখা এবং রাহুল, যাদের প্রেম বিভিন্ন প্রতিকূলতা পেরিয়ে এক নতুন দিগন্তে পৌঁছানোর স্বপ্ন দেখে।
